জাঁ ফন্টেইন নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
আজকাল বিশ্বকাপে গোল করার যে হার, তাতে এই আসরেও তার ১৩ গোলের রেকর্ড কেউ ভেঙে দেবে, এটা মনে হয় না। ফলে তার রেকর্ডটা রাশিয়াতেও নিরাপদে থাকছে, এটা বলা যায়।
কিন্তু সকলের ভাগ্য ফন্টেইনের মতো নয়। এবার বিশ্বকাপে অনেকেরই একটু দুশ্চিন্তা নিয়ে খেলা দেখতে হবে। অনেক রেকর্ড এবার বিশ্বকাপে ভেঙে যেতে পারে। এই দুশ্চিন্তায় থাকা গ্রেটদের তালিকায় পেলে, ম্যারাডোনা যেমন আছেন, তেমনই ক্লোসার মতো ফুটবলারও আছেন। ভেঙে যেতে পারে তাদের কয়েকটি রেকর্ড।
চোখে বুলিয়ে নেওয়া যাক এমন কয়েকটি রেকর্ডে, যেগুলো আছে হুমকির মুখে।
বৃদ্ধ কোচদের রেকর্ড
উরুগুয়ে ও পর্তুগালের যদি শেষ ষোলোতে এবার দেখা হয়, তাহলে সেই ম্যাচে দুই কোচের সম্মিলিত বয়স হবে ১৩৫ বছর তিন মাস! অস্কার তাবারেজ ও ফার্নান্দো সান্তোসই এবার আসরের সবচেয়ে প্রবীন দুই কোচ। এই দুজনের দেখা হলে সেই ম্যাচ বয়সের দিক থেকে নতুন রেকর্ড করবে। গত বিশ্বকাপে উরুগুয়ে ও ইংল্যান্ডের যখন দেখা হলো, তখন দুই কোচ তাবারেজ ও রয় হডসনের সম্মিলিত বয়স ছিলো ১৩৪ বছর দুই মাস। এর আগে ২০১০ বিশ্বকাপে গ্রিসের অটো রেহেগাল ও নাইজেরিয়ার লার্স ল্যাজারবার্গের দেখা হয়েছিলো এক ম্যাচে। সেই ম্যাচে দুজনের সম্মিলিত বয়স ছিলো ১৩৩ বছর ৯ মাস।
বুঝতেই পারছেন, প্রবীনদের একটা আলাদা দাপট আছে!
মেসির হুমকিতে ম্যারাডোনা
বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশী গোল করার রেকর্ড ডিয়েগো ম্যারাডোনার। তিনি করেছিলেন ৬ গোল। লিওনেল মেসি চোখ রাঙাচ্ছেন এই রেকর্ডকে। গত ব্রাজিল বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে চার গোল করেছেন মেসি। এবার আর দুটি গোল করলেই তিনি স্পর্শ করে ফেলবেন ম্যারাডোনাকে। আর ৩ গোল করলে ছাপিয়ে যাবেন নিজের দেশেরই এই কিংবদন্তীকে। মেসি আর ম্যারাডোনার মাঝে অবশ্য আরও কয়েকটি নাম আছে। অধিনায়ক হিসেবে ৫টি করে গোল করার রেকর্ড আছে গিওর্গি সারোসি, কার্ল-হেইঞ্জ রুমেনিগে, উই সিলার ও লোথার ম্যাথুসের।
ম্যারাডোনার আরেকটি রেকর্ড আছে হুমকিতে। বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশী ম্যাচ খেলার রেকর্ডও আর্জেন্টাইন এই গ্রেটের। তিনি ১৬ ম্যাচ খেলেছেন অধিনায়ক হিসেবে। মেক্সিকোর অধিনায়ক রাফা মার্কুয়েজ এই বিশ্বকাপের আগেই খেলেছেন ১৪ ম্যাচ। কোনো ইনজুরিজনিত ঝামেলা না হলে এই রেকর্ড ম্যারাডোনার থাকছে না।
টানা জয়ের রেকর্ড
বিশ্বকাপে টানা সবচেয়ে বেশী জয়ের রেকর্ড ব্রাজিলের। ২০০২-০৬ বিশ্বকাপে তারা টানা ১১টি ম্যাচ জিতেছিলো। এ ছাড়া ৭টি জয়ের রেকর্ড আছে ইতালির। ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ বিশ্বকাপে তারা টানা ৭টি ম্যাচ জিতেছিলো। ব্রাজিলকে ধরাটা কঠিন হলেও তৃতীয় দল হিসেবে ৭ জয় স্পর্শ করাটা সম্ভব জোয়াকিম লোর জার্মানির পক্ষে। জার্মানি গত বিশ্বকাপে টানা ৫টি ম্যাচ জিতেছে। এই জয়ের মধ্যে অতিরিক্ত সময়ের জয় ও পেনাল্টি শুট আউটে আসা জয়ও বিবেচনা করা হচ্ছে। এবার প্রথম রাউন্ডে তিন ম্যাচ জিতলেই জার্মানি ছাড়িয়ে যাবে ইতালিকে। এরপর বিশ্বকাপটা জিততে পারলে ব্রাজিলকেও ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব তাদের পক্ষে।
তিন বার পাঁচ গোল
একাধিক বিশ্বকাপে ৫টি করে গোল করার রেকর্ড পেলে, রোনালদো, গার্ড মুলারদেরও নেই। এটা এমন এক রেকর্ড যা আছে মাত্র তিনজন খেলোয়াড়ের। পেরেুর তেওফিলো কুবিলাস ১৯৭০ মেক্সিকো বিশ্বকাপে এবং ১৯৭৮ আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে করেছিলেন ৫টি করে গোল। এরপর ১৯৮২ সালে স্পেনে আর কোনো গোল করতে পারেননি তিনি।
মিরোস্লাভ ক্লোসা ২০০২ সালে কোরিয়া জাপানে প্রথম পাঁচ গোল করেন এবং ২০০৬ সালে জার্মান আসরে আবার ৫ গোল করেন। এরপর আছেন ক্লোসার উত্তরসুরী থমাস মুলার। মুলার দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০১০ সালে করেছেন ৫ গোল এবং ২০১৪ সালে ব্রাজিলেও করেছেন ৫ গোল। মুলারের সামনে এবার সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়ার সুযোগ। তিনি টানা তৃতীয় বিশ্বকাপে ৫ বা ততোধিক গোল করার সুযোগে পাচ্ছেন। সেটা করলে তিনি হবেন তিন বিশ্বকাপে ৫ বা তার বেশী গোল করা বিশ্বের প্রথম ফুটবলার। এ ছাড়া মুলারের সামনে ক্লোসার সবচেয়ে বেশী গোলের রেকর্ডও ছাপিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে।
কনকাকাফের নতুন রেকর্ড
বিশ্বকাপে কনকাকাফ অঞ্চলের কোনো দলের টানা অপরাজিত থাকার রেকর্ড মেক্সিকোর। ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তারা টানা ৬ ম্যাচ অপরাজিত ছিলো। এই রেকর্ডটা এবার নিজেদের করে নিতে পারে কোস্টারিকা। গত বিশ্বকাপে তারা টানা ৫ ম্যাচ অপরাজিত ছিলো। গ্রুপপর্বে উরুগুয়ে, ইতালি ও ইংল্যান্ড হারাতে পারেনি তাদের। এরপর গ্রিসের সাথে দ্বিতীয় রাউন্ডে জয়। আর কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডের কাছে পেনাল্টি শুট আউটে বিদায় নিলেও পরিসংখ্যানে ওটা ড্র বলেই লেখা থাকবে। ফলে এবার তারা সার্বিয়ার বিপক্ষে ড্র করতে পারলেই কনকাকাফ জোনের রেকর্ড স্পর্শ করে ফেলবে। আর ব্রাজিলের বিপক্ষে অপরাজিত থাকলে রেকর্ডটা নতুন করে লেখা হবে।
টানা চার বিশ্বকাপে গোল
এটা অসাধারণ একটা কীর্তি। টানা চার বিশ্বকাপে গোল করার রেকর্ড আছে কেবল তিন জন ফুটবলারের- পেলে, উই সিলার ও মিরোস্লাভ ক্লোসা এই কীর্তি করেছেন। তবে এবার তিনজন ফুটবলারের সামনে এই রেকর্ড স্পর্শ করার সুযোগ আছে। অস্ট্রেলিয়ার টিম কাহিল, মেক্সিকোর রাফা মার্কুয়েজ ও পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো একটি করে গোল করতে পারলেই এই এলিট ক্লাবে নাম লিখিয়ে ফেলতে পারবেন। পেলেদের ক্লাবে নতুন সদস্য তাহলে আসছে?
প্রবীনতম ফুটবলার
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশী বয়সে মাঠে নামার রেকর্ডটা একসময় ছিলো ক্যামেরুনের রজার মিলার। গত বিশ্বকাপে ব্রাজিলে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন কলম্বিয়ার ফারিদ মনড্রাগন। ৪৩ বছর তিন দিন বয়সে তিনি মাঠে নেমেছিলেন। এবার মনড্রাগনের রেকর্ডটাও হুমকির মুখে আছে।
মিসরের এসাম আল-হাদারি মাঠে নামতে পারলেই রেকর্ডটা নিজের করে নেবেন। উরুগুয়ের বিপক্ষে মিসরের যেদিন ম্যাচ, সেদিন আল-হাদারির বয়স হবে ৪৫ বছর ৫ মাস। তিনি মাঠে নামলে অনেক পেছনে পড়ে যাবেন মনড্রাগন। শুধু খেলোয়াড়রা নয়, এবার বিশ্বকাপে আল হাদারির চেয়ে বয়সে ছোট তিনজন কোচও আছেন। সেনেগালের কোচ আলিওেই সিসের বয়স ৪২ বছর, সার্বিয়ার কোচ ম্লাডেন কির্স্টাজিসের বয়স ৪৪ বছর এবং বেলজিয়ামের কোচ রবার্তো মার্টিনেজের বয়স ৪৪ বছর!
জোয়াকিম লোর হাতছানি
বিশ্বকাপে কোচ হিসেবে সবচেয়ে বেশী ম্যাচ জয়ের রেকর্ড এখনও হেলমুট শোনের। তিনি ১৯৬৬, ১৯৭০, ১৯৭৪ ও ১৯৭৮ বিশ্বকাপ মিলিয়ে তিনি ১৬টি ম্যাচে জয় পেয়েছিলেন। পশ্চিম জার্মানির এই কোচের রেকর্ডটা এবার ভেঙে ফেলার সুযোগ আছে তারই উত্তরসুরী জোয়াকিম লোর সামনে। লো এ অবধি ১১ ম্যাচ জিতেছেন বিশ্বকাপে। ২০১০ সালে জিতেছিলেন ৫টি এবং ৬টি জিতেছিলেন ২০১৪ সালে। এবার বিশ্বকাপটা জিততে হলে শোনের রেকর্ড তাকে ভাঙতেই হবে।
রদ্রিগেজের দুর্লভ সুযোগ
বিশ্বকাপ ইতিহাসে ৭টি বা তার বেশী ম্যাচ খেলেছেন এবং গড়ে ম্যাচপ্রতি একটার বেশী গোল করেছেন; এমন খেলোয়াড় একজনই- গার্ড মুলার। তিনি পশ্চিম জার্মানির হয়ে ১৯৭০ ও ১৯৭৪ বিশ্বকাপে ১৩ ম্যাচে ১৪ গোল করেছিলেন। জেমস রদ্রিগেজ ৫ ম্যাচে করেছেন ৬ গোল। তিনি রাশিয়ায় একটার বেশী ম্যাচ খেললে এবং গোল গড় ধরে রাখতে পারলে মুলারের এই গড়ের রেকর্ড স্পর্শ করবেন।