১.
আপনি আর ক্রিকেট দেখবেন না!
এমন সংকল্প এবারই আপনি প্রথমবার নেননি। প্রথম যেবার নিয়েছিলেন, সেবার আপনি দশম শ্রেণির ছাত্র। পরদিন আপনার গণিত পরীক্ষা, ক্যারিবিয়ানে মুখোমুখি বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া। ম্যাচ শেষ করে বিছানায় যেতে আপনার বেজেছিল সাড়ে তিনটা, ঘোরলাগা সেই জয়ের রাতে চোখ লেগে আসতে সময় লেগেছিল আরও অনেকক্ষণ৷ পরদিন সকাল দশটায় আপনার আর পরীক্ষা দিতে যাওয়া হয়নি!
সে সকালে(কিংবা দুপুরে) ঘুম ভেঙে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ‘এ জীবনে আর ক্রিকেট দেখব না!’ প্রতিজ্ঞা ভেঙেছিলেন দিনসাতেক পরই। বাংলাদেশের খেলা বারমুডার সাথে, ম্যাচ না দেখে থাকতেন কী করে!
আপনার জীবনে এমন পণ নেওয়া আর ভাঙার খেলা তো এরপরে নিয়মিতই। জীবন থেকে কিছু না কিছু হারিয়ে যেই না ক্রিকেটকে ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন প্রতিবার, অমনি যেন ক্রিকেটটা আরও বেশি রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছিল, গলির মোড়ের করিম ভাইয়ের চায়ের দোকানটাও যেন আরও বেশি সরব হয়ে গিয়েছিল তখনই। মনের সাথে একপ্রস্থ লড়াইশেষে আপনি হয়েছিলেন পরাজিত, আপনি ফেরত এসেছিলেন ক্রিকেটের কাছে, বারেবারে।
আরও একবার জীবনের মাঠে মার খেয়ে আপনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, ‘হেডিংলির এই টেস্ট ম্যাচই আমার দেখা শেষ ক্রিকেট ম্যাচ’। হ্যাঁ, আপনি হেডিংলিতে ছিলেন।
২.
আপনার ক্রিকেটদর্শন ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোতে ছিল ক্যাঙারুদের একচ্ছত্র আধিপত্য। বাংলাদেশ তখনও ক্রিকেটে হাঁটি-হাঁটি-পা-পা, ‘সবসময়ই জিততে চাওয়া’ আপনি তাই সমর্থন শুরু করেছিলেন অজিদের। অজিরা আপনাকে নিরাশ করেনি, সমর্থক হিসেবে আপনি ঝুলিতে পুরেছেন তিন-তিনটি বিশ্বকাপ। বন্ধুমহলে এ নিয়ে আপনার গর্বের শেষ নেই।
টেস্টের পরিসংখ্যান তো আপনাকে আরও বনেদি বানায়। আপনি ২০১৯ অ্যাশেজ দেখতে বসেছিলেন বিগতবারের ৪-০ ব্যবধানে জয়ের স্মৃতিকে জাবর কেটে।
মাঝের সময়টা অবশ্য বিভীষিকাময়ই ছিল। বল টেম্পারিং-কাণ্ডে অস্ট্রেলিয়া হয়েছিল টালমাটাল, আপনি ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন আরও একবার। সম্পর্ক জোড়া লাগতেও সময় লাগেনি তেমন। আপনিও তাই মিস করেননি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার আরও একবার ঘুরে দাঁড়ানোর দৃশ্য।
এতদিন অব্দি প্রত্যাবর্তনের পুরোটাই ছিল একদিবসী ক্রিকেটে, টেস্ট ক্রিকেটেও ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন এই অ্যাশেজ দিয়েই। স্টিভেন স্মিথ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন এই অ্যাশেজ দিয়েই, রীতিমতো রাজকীয় প্রত্যাবর্তন যাকে বলে। আপনার মনঃকামনাও পূর্ণতা পেয়েছিল বার্মিংহামের জয়ে। মাঝে লর্ডস টেস্টে আপনি পরাজয় থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন বৃষ্টির কল্যাণে, হেডিংলিতে আপনার সমর্থনপুষ্ট দল তাই এসেছিল টেস্ট জিতে অ্যাশেজকে তাসমান সাগরপাড়েই রেখে দিতে।
আর আপনি এসেছিলেন, ক্রিকেটকে বিদায় বলতে!
৩.
বিদায়ী টেস্ট ম্যাচ বলেই কি না আপনি মিস করতে চাননি ম্যাচের একটি কানাকড়িও। বল মাঠে গড়ানোর আগেই তাই স্বাদ লাভ করেছিলেন পরাজয়ের; টস জিতেছিলেন জো রুট, ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে।
সিদ্ধান্তটা পক্ষে এলো নাকি বিপক্ষে, তা নিয়ে আপনি জল্পনা-কল্পনা করেছেন বেশ কিছুক্ষণ। লর্ডসে ঘাড়ে বল লাগার কারণে স্টিভেন স্মিথ পড়েছিলেন কনকাশনে, খেলতে পারবেন না লীডসে, এ আপনি আগেই জানতেন৷ বৃষ্টির কারণে লীডসে খেলাও শুরু হচ্ছিল না যথাসময়ে, বৃষ্টি আর মেঘলা আকাশের নিচে ইংলিশ পেসারদের দাপটের ইতিহাসটাও আপনার জানাই ছিল। ইতিহাস অবশ্য আপনি অনেকটুকুই জানতেন। যেমন জানতেন, হেডিংলির এই মাঠে সর্বশেষ পাঁচ ম্যাচেই টস জয়ী দল হেরে গিয়েছে। জল্পনা-কল্পনার সব রহস্য এই রেকর্ডেই লুকিয়ে।
৪.
বৃষ্টির বিরতিতে খেলা শুরু হতেই আপনাকে কাঁপন ধরিয়ে গেলেন ব্রড আর আর্চার। আবারও বৃষ্টি নামার আগে খেলা হলো চার ওভার। তাতেই আপনার মুখ থেকে ‘আহা-উহু’ ধ্বনি নিঃসৃত হলো ছয়বার। আপনি সমর্থনটা যাকেই দিন না কেন, ফাস্ট বোলারের বলে ব্যাটসম্যান পরাস্ত হচ্ছেন, ক্রিকেটে এর চাইতে অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য এসেছিল কি না, তা আপনার জানা নেই।
ক্যামেরন ব্যানক্রফট নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরে সুবিধা করতে পারেননি সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে। তৃতীয় টেস্টের দলে তাই এসেছিলেন মার্কাস হ্যারিস। বৃষ্টির কারণে চার ওভার পরে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন সবাই, তবে মার্কাস হ্যারিস ফিরেছিলেন আউট হয়ে। অস্ট্রেলিয়া প্রথম উইকেট হারিয়েছিল তাই দলীয় চার রানেই।
বৃষ্টি বাধায় এরপর খেলা বন্ধ ছিল ঘণ্টাদেড়েক। স্টিভেন স্মিথবিহীন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপের ওপর আপনার ভরসা ছিল না কোনোকালেই, এমন প্রতিকূল কন্ডিশনে তো আরও না। বৃষ্টি থামলে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরাও যেন দায়িত্ব নিয়েছিলেন আপনার বিশ্বাসকে আরও বদ্ধমূল করার, নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে গুটিয়ে গিয়েছিল ১৭৯ রানে। সমস্যা হচ্ছে, এই ব্যাটিং ভরাডুবির পরও আপনি স্টিভেন স্মিথের না থাকাকে দায়ী করতে পারছিলেন না। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ইনিংস-সর্বোচ্চ ৭৪ রান করেছিলেন লাবুশেন, দলে যার জায়গা হয়েছে স্টিভেন স্মিথ না খেলার কারণেই।
লর্ডসের পর থেকে আপনি এই দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ক্রিকেটারে কেবল মুগ্ধই হচ্ছিলেন। আপনি মুগ্ধ হচ্ছিলেন তার প্রতিটি ফ্লিকে, মুগ্ধ হচ্ছিলেন প্রতিটি ড্রাইভে, এমনকি মুগ্ধ বনে যাচ্ছিলেন উনি যে কায়দায় বল ছাড়ছিলেন, তাতেও! লর্ডস থেকে তো আপনি মুগ্ধ হতে শুরু করেছেন আরও একজনে, জফরা আর্চারে!
এমন নয় যে আর্চারকে আপনি এর আগে কখনো দেখেননি। এই তো মাসদুয়েক আগে, আর্চার বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাবার পরে সাসেক্স-রাজস্থান রয়্যালস-বারবাডোজ ট্রাইডেন্টসের মাঝে আর্চারকে নিয়ে টুইটার-যুদ্ধ দেখেও তো আপনি মুচকি হেসেছিলেন। আর্চারকে তো আপনি দেখে ফেলেছিলেন এর বহু আগেই, খুলনা টাইটানসের জার্সিতে! পুরো বিশ্বের এমন কাড়াকাড়িতেও আপনি একেবারে গদগদ হয়ে যাননি আর্চারের প্রশংসায়, আর্চার যে তখনও টেস্ট খেলেননি।
অভিষেক টেস্টেই আর্চার আপনাকে মুগ্ধ করেছেন গতির ঝড়ে, এমন বিধ্বংসী ফাস্ট বোলিং আপনি দেখেন না অনেকদিন। পরের টেস্টে আপনি মুগ্ধ হয়েছেন আর্চারের পরিণতিবোধে। মেঘলা আকাশের নিচে বল সুইং করানো যাবে ইচ্ছেমতো, এটা বুঝতে পেরেই কি না বলের গতি কিছুটা কমিয়ে বল করেছিলেন কিছুটা ওপরে। গ্রেট বোলাররা তো এমনই, যেকোনো কন্ডিশনেই সুবিধা আদায় করে নেবেন পরিপূর্ণরূপে! আর্চারের ৬ উইকেট তুলে নেয়া দেখতে দেখতে আপনি নিশ্চিত হয়েছেন, ‘ক্রিকেটে আরও একজন গ্রেট আসছে!’
নিশ্চিত হয়েছেন আরও এক বিষয়ে, এই টেস্ট যাচ্ছে ইংল্যান্ডের ঘরে।
৫.
যে কারণে পরের বিকেলে নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানিয়েছেন একবার। এই ‘ম্যাগি নুডুলস’ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দর্শকদের অধৈর্য করে ফেলেছে বলে রায়ও দিয়ে ফেলেছেন ততক্ষণে। নইলে ১৫ সেশনের ম্যাচকে আপনি কী করে বিচার করে ফেললেন মাত্র ৫৪ ওভার দেখে?
টেস্টের দ্বিতীয় দিনে আপনি ধাক্কা খান জশ হ্যাজলউড, জেমস প্যাটিনসন আর প্যাট কামিন্সে। আপনি ভুলে যান গতকালের বোলিংকে। ক্রিকেটে এমন প্রতি বলেই ‘কিছু না কিছু হবেই’ অনুভূতিটা আপনার কাছে ধরা দেয়নি অনেকদিন। প্রথম পরিচয়ের ‘নতুন ম্যাকগ্রা’ ছাপিয়ে জশ হ্যাজলউড আপনার মনে স্বীয় পরিচয়েই জায়গা করে নিয়েছেন অনেকদিন। এই টেস্টের আগে আপনি তাজ্জব হয়ে লক্ষ্য করেছেন, টেস্ট ক্যারিয়ারে প্যাট কামিন্সের চেয়ে বেশি রেটিং পয়েন্ট অর্জন করেছিলেন মাত্র চারজন। কে বলে, এই যুগে বোলারের আকাল পড়েছে!
তাদের বোলিং দেখতে দেখতে আপনি ফেরত যান ২০১৫ সালের ট্রেন্টব্রিজে, সেবার স্টুয়ার্ট ব্রডের বোলিং-তোপে মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া উড়ে গিয়েছিল ১৮.৩ ওভারে। অস্ট্রেলিয়ার পেসত্রয়ী মিলে ইংল্যান্ডকে ফেরত দেন সেই লজ্জা, ইংল্যান্ড গুটিয়ে যায় ৬৭ রানে।
ক্রিকেট পরিসংখ্যানে সবসময়ই এক চোখ রাখা আপনি জানেন, বিগত দুই বছরে এই নিয়ে ইংল্যান্ড চতুর্থবারের মতো গুটিয়ে গেল একশ’র নিচে। এমনকি এই বছরের সর্বনিম্ন পাঁচ টেস্ট স্কোরের চারটিই আছে ইংল্যান্ডের দখলে।
৬.
ওই দিনে আপনার মনে আরও একবার মুগ্ধতা ছড়ান মারনাস লাবুশেন। ইতিহাসের পাতায় তার ঠাঁইপ্রাপ্তি তো নিশ্চিতই, কনকাশনজনিত কারণে ইতিহাসের প্রথম বদলি ক্রিকেটারটি তো তিনিই। আপনার মনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নেয়ার যে সামান্য ব্যাপারটি বাকি ছিল, সেটাও তিনি নিশ্চিত করে নেন টানা তিন ইনিংসে ফিফটি করে। যে কন্ডিশনে দলের প্রতি ব্যাটসম্যান নাভিশ্বাস তুলছেন অবিরাম, সেখানে এমন লাবণ্যময় টেস্ট ব্যাটিং আপনাকে তো মুগ্ধ করবেই।
অস্ট্রেলিয়া সেদিন শেষ করে ১৭১ রানে। আর আপনি দেখেন, অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে ২৮৩ রানে।
৭.
টেস্টের তৃতীয় দিনে প্রথম সকালে অস্ট্রেলিয়া যোগ করে আরও ৭৫ রান। মারনাস লাবুশেন আউট হন আশি রানে, সেই সাথে ঢুকে যান ছোট্ট এক তালিকাতে! টেস্ট ক্রিকেটের ১৪২ বছরের ইতিহাসে দুই ইনিংসেই প্রতিপক্ষের এক ইনিংসের চেয়ে ইংল্যান্ডের সামনে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৩৫৯ রানের। টেস্ট ইতিহাসে এর চাইতে বেশি রান করে জেতার ঘটনাই ছিল মোটে নয়টা।
আপনি যদি তখনই ফেসবুকে ‘রিটেইনিং অ্যাশেজ’ জাতীয় স্ট্যাটাস দিয়ে বসেন, আপনার ক্রিকেট প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ ছিল সামান্যই। একে তো ইতিহাস বিপক্ষে, তার ওপর ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের যাচ্ছেতাই ফর্ম, ইংল্যান্ড এই রান তাড়া করবে, সে তো ছিল অলীক কল্পনা!
৮.
জেসন রয় আউট হয়েছিলেন তার রানখরার ধারাকে অব্যাহত রেখে। আপনি অবশ্য তেমনটাই আশা করেছিলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মিডল-অর্ডারে ব্যাট করা ৩৭ গড়ের ব্যাটসম্যানকে যখন টেস্ট ক্রিকেটের মঞ্চে ইনিংস উদ্বোধন করতে নামিয়ে দেয়া হয়, আপনি যদি ঘোরতর ইংলিশ সমর্থকও হতেন, তবুও তার থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করতে পারতেন না। ইংল্যান্ডের এই ব্যাটিং লাইনআপে এক জো রুট ছাড়া কারও গড়ই অবশ্য আপনাকে টেস্ট আঙিনায় ভয় জাগায় না।
জেসন রয়ের আগে রোরি বার্নসও ফিরেছিলেন প্যাভিলিয়নে। জো রুট জুটি বেঁধেছিলেন জো ডেনলিকে নিয়ে। জো ডেনলি উইকেটে সেট হচ্ছিলেন প্রতি ইনিংসেই, কিন্তু ওই সেট হওয়া পর্যন্তই। এই টেস্টে তিনি শুরু পেলেন, টিকে গেলেন, জো রুটের সঙ্গে গড়লেন শতরানের জুটি, পঞ্চাশের দেখাও পেলেন টেস্ট ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো।
কিন্তু আপনাকে ভয় পাইয়ে দেবার আগেই তিনি বিদায় নিলেন। জয় পেতে অস্ট্রেলিয়ার আর সাত উইকেট লাগে!
৯.
বেন স্টোকসকে নিয়ে আপনার ভয় আগে থেকেই ছিল। কারণ, আপনি জানেন, বেন স্টোকস আর অতলে তলিয়ে যাবার ভয় করেন না। ভয় পাবেন কী করে, বিশ্বকাপ ফাইনালের মঞ্চে শেষ ওভারের রোমাঞ্চে চার ছক্কা খেয়ে দলকে ম্যাচ হারানোর চাইতে তো আর গহীনে যাওয়া সম্ভব না!
ইডেন গার্ডেনের সেই ম্যাচের পরে আপনি দেখেছেন এক বদলে যাওয়া স্টোকসকে। আপনি দেখেছেন শ্রীলংকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হেরে যাওয়া ম্যাচে একজন স্টোকসকে দাঁড়িয়ে যেতে। স্টোকস আপনাকে শিখিয়েছেন, বিশ্বকাপ ফাইনালকে কী করে নিজের করে নিতে হয়! স্টোকস আপনাকে লড়াই করতে শিখিয়েছেন।
শুরুটা করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়ে। প্রথম রান নিয়েছিলেন নবম বলে, পরের ৫৮ বলে রান করেছিলেন একটি। এর মাঝেই শেষ হয়েছিল তৃতীয় দিন, ইংল্যান্ড আর জয়ের মাঝে ব্যবধান তখনও ২০২ রানের।
আপনি তখন কিছুটা সংশয়ে, সংশয় ছাপিয়ে জয়ের সুবাস লাগছে আপনার নাকে। সান্ত্বনা দিচ্ছেন নিজেই নিজেকে,‘জো রুট আর বেন স্টোকসই তো!’
১০.
এতদিন ধরে ক্রিকেট দেখার সুবাদে আপনি জানেন, যেকোনো দিনেরই প্রথম ঘণ্টাটা গুরুত্বপূর্ণ। সকালের আর্দ্রতা কাজে লাগিয়ে আপনার পেসাররা আপনাকে উইকেট এনে দেবেন, এই আশা আপনি রাতভরই করেছেন। আপনি দিন শুরুর পাঁচ ওভারের মাঝেই উইকেট পেলেন, তা অবশ্য স্পিনার নাথান লায়নের বলে, ডেভিড ওয়ার্নারের দারুণ ক্যাচে। অস্ট্রেলিয়ার চাই ছয় উইকেট, আপনার চাই বেন স্টোকস!
জনি বেয়ারেস্টো টেস্ট ক্রিকেটে রানে নেই বেশ কিছু সময় ধরেই। উইকেটেই তো টিকতে পারছিলেন না তেমন। শেষ শতকের দেখা পেয়েছিলেন ১৪ ইনিংস আগে, মাঝে এক অংকের ঘরে আউট হয়েছিলেন ছয়বার। জনি বেয়ারেস্টো এবারে টিকেছিলেন ৬৭ বল, তার আগে রান করে গিয়েছিলেন ৩৬।
ইংল্যান্ড তখন ১১৪ রান দূরত্বে, ক্রিজে একজন পুরোদস্তুর সেট ব্যাটসম্যান, আর বাটলারের মতো ফিনিশারকে নামতে দেখে অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক আপনি ঘাবড়েই গিয়েছিলেন। উইন প্রেডিক্টরও তো তখন ইংল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনা ৬১ শতাংশ বলে রায় দিয়ে দিয়েছে। ম্যাচে ফিরতে অস্ট্রেলিয়াকে অতিমানবীয় কিছু করতেই হতো। ট্রাভিস হেড আপনার চোখে সেই সুপারম্যান হলেন। স্টোকস-বাটলারের ভুল বোঝাবুঝিতে বাটলার রানআউটে কাটা পড়লেন, তার আগে ট্রাভিস হেড ডাইভিং থ্রো করেছিলেন!
শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ইংল্যান্ড আবার চাপে পড়েছে। ক্রিস ওকসকে খানিক বাদেই ফিরিয়ে হ্যাজলউড আপনাকে নিশ্চিন্ত করলেন, অমন এলোপাতাড়ি ব্যাট চালিয়ে জোফরা আর্চার খুব বেশি দূর যেতে পারবেন না, সে আপনি বহু আগেই জানতেন।
১১.
ব্রড ফিরলেন দলীয় ২৮৬ রানে, প্যাটিনসনের ফিল্ড-সেটআপে বোকা বনে গিয়ে। স্টোকসকে ক্রিজে রেখে গিয়েছিলেন ৬১ রানে, শেষ ব্যাটসম্যান জ্যাক লিচের জন্যে রেখে গিয়েছিলেন চার বল। মধ্যাহ্নবিরতির পর ৪৮ রানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া আপনাকে জয়ীর বেশে বিদায় জানাবে, এ ভেবেই আপনি শিহরিত বোধ করছেন!
জ্যাক লিচ ওই চার বল টিকে গিয়েছিলেন, বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথেই। আপনার তাতে থোড়াই পরোয়া, অস্ট্রেলিয়ার তো একটি বলই লাগে।
আপনার এক বলের অপেক্ষা শুরু হয়। চার বল পর স্টোকস হাত খোলেন, লায়নকে লং-অফে উড়িয়ে মারেন। আপনি ‘ক্যাচ’ বলে গুঙিয়ে ওঠার আগেই বুঝে যান, ওটা ছয় হচ্ছে। আপনি তাতে ভয় পান না, টিম পেইনও তো পাননি। নাথান লায়নকে দিয়েই আক্রমণ চালিয়ে যান, স্টোকস আবারও বলকে সীমানাছাড়া করেন, ইংল্যান্ডের লক্ষ্যে পৌঁছাতে তখন পঞ্চাশেরও কম রান লাগে।
আপনি ঘাবড়ে যান। লায়নও আক্রমণ থেকে সরে যান। প্যাটিনসন-কামিন্স জুটি আক্রমণে আসেন, খানিক পরে আসেন হ্যাজলউড, তারও পরে আবার লায়ন। এমন ঘনঘন বোলিং পরিবর্তনের কারণ একটিই, বেন স্টোকস আউট হচ্ছিলেন না। জ্যাক লিচকে আউট করবার জন্য বেন স্টোকস অস্ট্রেলিয়ানদের যথেষ্ট সুযোগ দিচ্ছিলেন না।
১২.
নাথান লায়ন অফ স্ট্যাম্পের বাইরের ক্ষতে বল ফেলেন, বেন স্টোকস ডানহাতি বনে যান, রিভার্স সুইপ আর স্লগ সুইপের মিশেলে কোনো এক শট খেলেন, আপনি বলকে ওয়েস্টার্ন টেরেসে উড়ে যেতে দেখেন। প্যাট কামিন্সের গুড লেংথের বলকে স্কুপ মতো কিছু একটা করেন স্টোকস, এদিন সে শটেও আপনি ছয় হতে দেখেন। হ্যাজলউডের বলে কেবল টাইমিংটাই হয় বেন স্টোকসের, সেখানেও আপনি স্কয়ার লেগের ফিল্ডারকে নীরব দর্শক হিসেবেই আবিষ্কার করেন। কোনো শটে আবার টাইমিংটাও হয় না, এদিন সেসব শটেও বেন স্টোকসের নামের পাশে ছয় লেখা হয়!
টার্গেট ৪৮ থেকে ৩৭ রানে নামে, ৩৭ থেকে ১৮, ১৮ থেকে এক অঙ্কে, বেন স্টোকস অপরাজিতই থাকেন। এর মাঝেই টানা দ্বিতীয় টেস্টে শতক তুলে নেন স্টোকস। পুরো পৃথিবী যেই শতকের কথা জানলেও জানেন না কেবল একজনই, বেন স্টোকস। ৩৫৯ সংখ্যাটিকে তো পাখির চোখ করেছেন ইনিংসের শুরুতেই। জ্যাক লিচকে হ্যাজলউডরা স্ট্রাইকপ্রান্তে আনতে পারেন না, স্ট্রাইকে জ্যাক লিচ এলেও প্যাটো-প্যাটি তাকে আউট করতে পারেন না। জ্যাক লিচ ব্লকের পর ব্লক করে ১৭টি বল খেলে ফেলেন, সম্ভবত ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৭ বল! আপনি অবাক হয়ে অবলোকন করেন, মার্কাস হ্যারিসের হাত ফসকে ক্যাচ বেরিয়ে যায়, ডেভিড ওয়ার্নারও স্টোকসের ক্যাচ ফেলেছেন কি না, সেটা আপনি টিভি-পর্দায় বুঝতে পারেন না।
১৩.
ততক্ষণে আপনি অজি সমর্থক পরিচয় ছেঁটে ফেলেছেন। আপনি বেন স্টোকসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছেন। ইংল্যান্ডের জয়ের জন্যে প্রয়োজনীয় দুই রান আপনিও চাইছেন!
বিধাতা আপনার চাওয়া নিয়ে আবারও নাটক করেন। বেন স্টোকস ফিল্ডারকে খুঁজে নেন, বেন স্টোকসের রিভার্স সুইপ প্যাট কামিন্সকে খুঁজে নেয়। জ্যাক লিচ দৌড়ে স্টোকসের কাছে চলে আসেন, নন-স্ট্রাইকিং প্রান্ত ফাঁকাই পড়ে থাকে, লায়নের কাছে কামিন্সের থ্রো আসে। লায়ন সেই থ্রো মিস করেন, টিভিতে আপনি ইংরেজ-ড্রেসিংরুমকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে দেখেন।
পরের বলেই নাথান লায়ন স্টোকসকে পরাস্ত করেন। আপনি পুরো মাঠকে ‘হাউ’স দ্যাট’ বলে চিৎকার করে উঠতে শোনেন। জোয়েল উইলসন লায়নকে ‘না’ বলে দেন, লায়ন মাটিতে গড়াগড়ি খান। আপনি টিম পেইনের ওপর রাগ ঝাড়েন। এর আগের ওভারেই কীভাবে এক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক অহেতুক ওই রিভিউ নিয়েছিলেন, তা ভেবেই আপনি দিশেহারা হন।
খানিক বাদে টেলিভিশন রিপ্লে আপনাকে নিশ্চিত করে, বেন স্টোকস আউট ছিলেন! পুরো ম্যাচের মতো শেষ দৃশ্যেও আপনি ‘বাজে আম্পায়ারিং’ প্রত্যক্ষ করেছেন। কখন যেন আপনি আবার অস্ট্রেলিয়ার সমর্থনে কোরাস গাইতে শুরু করেছেন।
১৪.
জ্যাক লিচ অবশেষে রানের খাতা খোলেন, বেন স্টোকস স্ট্রাইকে আসেন, কাভার দিয়ে কামিন্সকে সীমানাছাড়া করে স্টোকস ম্যাচের ইতি টানেন।
আপনি ততক্ষণে ঘোরে চলে গিয়েছেন, আপনি কখনো লর্ডসে ঘুরপাক খাচ্ছেন, তো পরক্ষণেই চলে যাচ্ছেন ডারবানে। তারপর আপনার মন চলে যাচ্ছে এজবাস্টনে, এজবাস্টন থেকে জোহানেসবার্গে। শেষমেশ অবশ্য ফেরত আসতে হয় হেডিংলিতেই, হেডিংলিতে এর আগেও যে এক মিরাকল ঘটেছিল।
গুগল নামের ভেলায় চড়ে আপনি ফিরে যান ১৩১ বছর আগে, প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের চেয়ে কম রান করেও ম্যাচ জয়ের ঘটনা সর্বশেষ ঘটেছিল তো সেই ১৮৮৮ সালে।
বেন স্টোকস আর জ্যাক লিচের ৭৬ রানের জুটিতেও আপনি রেকর্ড খুঁজে পান, জয়ী ম্যাচে দশম উইকেট জুটিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের কীর্তি আপনি দেখেছেন এই ম্যাচেই। যার ৭৪ রানই এসেছিল বেন স্টোকসের ব্যাটে।
বেন স্টোকসের অমর ১৩৫ রানে ডুবতে গিয়ে আপনার মনে পড়ে যায়, ক্রিকেটে আজকেই আপনার শেষ দিন ছিল। বেশ কিছুক্ষণ ছটফট করে, মন আর মস্তিষ্কের মাঝে বেশ একটা লড়াই শেষে আপনার নেয়া সিদ্ধান্তের সারমর্মটা বোধকরি এমনই, ‘এই ক্রিকেটকে ছেড়ে থাকা মুখের কথা নয়!’