বর্তমান পৃথিবী এতটাই অগ্রগামী যে, আজকের গ্যাজেট আগামীকালই পুরনো বলে মনে হয়। আমরা যদি সভ্যতার একদম শুরুর দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে কী দেখতে পাবো? সত্য বলতে আমরা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যে, প্রাগৈতিহাসিক সেই অবস্থা আমাদের কল্পনায়ও পরিষ্কার ধরা দেয় না। চাকাবিহীন পৃথিবীর কথা একবার চিন্তা করে দেখুন। আমাদের অত্যাধুনিক সভ্যতা সম্পূর্ণ যন্ত্রনির্ভর। যান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে অতি সাধারণ কিছু যন্ত্র মানব সভ্যতার প্রায় সবকিছু সহজ করে তুলেছে। একবিংশ শতাব্দীর জটিল সব যন্ত্র বলতে গেলে সাধারণ কিছু যন্ত্রের জটিল এবং উন্নত সংমিশ্রণ। এরকম কিছু সাধারণ যন্ত্রের নাম বলতে গেলে শুরুতেই উল্লেখ করতে হয় চাকা ও অক্ষ (Wheel & Axle), লিভার (Lever), তির্যক তল (Inclined plane), স্ক্রু (Screw), পুলি (Pulley) ইত্যাদি। শেষ ২টি অবশ্য প্রথম ৩টির পরিবর্ধিত বা সংযোজিত সংস্করণ। এই যন্ত্রগুলো নিয়ে আলোচনা শুরুর পূর্বে, সংক্ষেপে কিছু কথা বলে নেওয়া ভালো।
যেকোনো যন্ত্রই কাজ করে এবং মানুষের কাজকে সহজ করে তোলে। সাধারণত কাজকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, কোনো বস্তুর উপর বল (Force) প্রয়োগে বলের দিকে প্রাপ্ত গতির ফলে সরণ বা স্থানান্তর। জেফারসন ল্যাব অনুযায়ী, যেকোনো যন্ত্রই মানুষের কাজকে সহজ করে তুলতে নিচের যেকোনো একটি বা একাধিক কার্যক্রম একত্রে সমাধা করে।
- এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বল স্থানান্তর
- বলের দিক পরিবর্তন
- বলের মাত্রা বৃদ্ধি ও
- বলের দূরত্ব বা গতি বৃদ্ধি
নির্দিষ্ট দূরত্বে বল প্রয়োগ করা হলেই কাজ সম্পাদিত হয়। গাণিতিকভাবে, W=F × D। তাহলে কোনো বস্তু উপরে তুলতে আমাদের যে কাজ করতে হবে তা মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপক্ষে এবং বস্তুটিকে নির্দিষ্ট দূরত্বের উপরে ওঠাতে হবে। একই দূরত্বে দ্বিগুণ ভারী বস্তু তুলতে দ্বিগুণ বেশি কাজ করতে হবে। আবার একই বস্তু দ্বিগুণ উপরে তুলতে আরও বেশি কাজ সম্পাদন করতে হবে অর্থাৎ দ্বিগুণ বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে। যন্ত্রের মাধ্যমে কাজ করার সুবিধা হলো, একই পরিমাণ কাজ করতে অধিক দূরত্বের বিপরীতে অল্প বল প্রয়োগ করলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়। ঘর্ষণ বল উপেক্ষা করে এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে, কারণ প্রয়োগকৃত বল ও প্রাপ্ত ফলাফলের তুলনায় ঘর্ষণ বল সামান্য।
গোটা যান্ত্রিক পৃথিবীকে একটি সুনির্দিষ্ট পরিধিতে নিয়ে আসা সাধারণ যন্ত্রগুলোর কথা সংক্ষেপে তুলে ধরতেই এই আয়োজন।
চাকা ও অক্ষ
প্রথম চাকা আবিষ্কৃত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালে মেসোপটেমিয়া সভ্যতায়। চাকার ব্যবহার যে যুগে শুরু হয়েছে, সেটি ছিল ব্রোঞ্জ যুগ। সেই অর্থে বলা যায়, মানব সভ্যতার বিকাশে চাকা আবিষ্কার বেশ খানিকটা দেরিতেই হয়েছে। কেননা ততদিনে মানুষ পশু পালন, ফসল ফলানো এবং সামাজিকভাবে বেশ সংঘবদ্ধ হওয়া শুরু করেছিল।
ধারণা করা হয়, প্রথম আবিষ্কৃত চাকা আসলে কুমারদের মাটির দ্রব্যাদি তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো। পরিবহনের কাজে চাকা ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয় আরও ৩০০ বছর পরে। একবার ভেবে দেখুন, চাকা আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ স্থল পথে ভারী বস্তু ঠিক কতদূর পর্যন্ত বহন করতে পারতো কিংবা কতখানি সীমাবদ্ধ ছিলো তাদের জীবন?
সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো চাকা। পৃষ্ঠতলের উপর দিয়ে কোনো অসমান বা আয়তকার বস্তু স্থানান্তরিত করতে প্রচুর শক্তির প্রয়োজন, কারণ পৃষ্ঠতল ও বস্তুর মধ্যকার ঘর্ষণ বলের বিপক্ষে আরও বেশি বল প্রয়োগ করতে হয়। এত বিশাল পরিমাণ বল প্রয়োগ করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজ করা গেলেও, তা তেমন কার্যকর নয়। কিন্তু চাকা গোলাকার হওয়ায় এই পৃষ্ঠতলের সাথে ঘর্ষণ বল অনেক কমিয়ে আনে। বলতে গেলে, চাকার গতি বৃদ্ধির সাথে আনুপাতিক হারে সভ্যতার গতি বেড়েছে। তবে এককভাবে চাকা কতটা গুরুত্ববহন করে?
চাকার আবিষ্কার ভিন্ন মাত্রা পায় যখন একটি অক্ষের সাথে এটি যুক্ত হয়। অক্ষের সাথে চাকা যুক্ত হওয়া মাত্রই সভ্যতার গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে যেতে থাকে। এরপরই ইতিহাসে যুক্ত থাকে মালবাহী গাড়ি, ঠেলাগাড়ি, যাত্রীবাহী গাড়ি, পশু চালিত টানা গাড়ি ইত্যাদি। প্রামাণিক তথ্যানুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালে প্রথম চাকার সাথে অক্ষ যুক্ত করে সুমেরিয়ানরা।
লিভার
কুয়া থেকে পানি তোলা, বড় পাথর অপসারণ, বন্দরের ভারী মালামাল স্থানান্তর কিংবা ভারী বস্তু উত্তোলনের জন্য যে মূলনীতি ব্যবহার করা হয়, তা হলো লিভারের মূলনীতি। তাছাড়া কাঁচি, চাপ কল, এমনকি বন্দুকের ট্রিগারেও লিভারের নীতি ব্যবহার করা হয়। খুব সাধারণ একটি যন্ত্র লিভার। মাত্র একটি লম্বা দণ্ড ও একটি ফালক্রাম বা পিভট নিয়ে পূর্ণ একটি লিভার গঠিত হয়। এই সাধারণ একটি যন্ত্র নিয়ে দম্ভ করে গ্রিক দার্শনিক, গণিতবিদ ও উদ্ভাবক আর্কিমিডিস বলেছিলেন, “আমাকে একটি লিভার এবং দাঁড়ানোর জায়গা দাও। আমি পৃথিবী স্থানান্তর করে দেখাবো।” আর্কিমিডিসের বক্তব্য খুব বেশি বাড়াবাড়ি মনে হলেও, এই উক্তিটির মাধ্যমে বোঝা যায়, শক্তি ও কর্মদক্ষতার বিচারে লিভার কতটা কার্যকরী। লিভার মূলত কাজ করে বল এবং দূরত্বের সাহায্যে। সাধারণত লিভারের মূল নীতির উপর নির্ভর করে পিভট থেকে দণ্ডের আনুপাতিক দূরত্বের উপর।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা যদি একটি ১০০ পাউন্ড ওজনের বস্তু ২ ফুট উপরে উত্তোলন করতে চাই তাহলে মোট কাজ করতে হবে ২০০ পাউন্ড-ফুট। বস্তুটির নিচে একটি ৩০ ফুট লম্বা দণ্ডের অগ্রভাগ স্থাপন করে, সেখান থেকে ১০ ফুট দূরত্বে ১ ফুট পিভটের উপর দণ্ডটি রাখার পর বস্তুটি পৃষ্ঠতল থেকে উত্তোলন করতে অপর প্রান্তে মাত্র ৫০ পাউন্ড সমমানের বল প্রয়োগ করতে হবে। আবার যদি বস্তুটিকে ২ ফুট উপরে তুলতে চাই, তাহলে দণ্ডটির অপর প্রান্ত ৪ ফুট পর্যন্ত নিচে নামাতে হবে।
তির্যক তল/আনত তল
তির্যক তল ব্যবহারের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ ভবনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা। উঁচু ভবনে যদি সিঁড়ি না থাকতো তাহলে খাড়া ভাবে উপরে উঠতে (লিফট ব্যতীত) কতটা পরিশ্রম করতে হত তা সহজেই অনুমেয়। তির্যক তল আসলে একটি সমতল যা নির্দিষ্ট কোণে ধীরে ধীরে উপরের দিকে অগ্রগামী। এই কোণই আসলে নির্ধারণ করে দেয় কোনো বস্তু উপরে তুলতে আমাদের কতটা কাজ করতে হবে। তল যত খাড়া হবে, তত বেশি কাজ করতে হবে। যেমন, আমরা যদি ১০০ পাউন্ড ওজনের কোনো বস্তু ২ ফুট উচ্চতায় উত্তোলন করতে ৪ ফুট লম্বা আনত তল ব্যবহার করি তাহলে মাত্র অর্ধেক পরিমাণ বল প্রয়োগ করলেই কাজটি করা সহজ হবে। দেখা যাচ্ছে যে, আনত তল ব্যবহার করে দূরত্ব দ্বিগুণ করলে বল অর্ধেক প্রয়োগ করলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়। এখন যদি আমরা তলের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ৮ ফুট করে দেই, তাহলে একই কাজ করতে প্রয়োগকৃত বলের পরিমাণ কমে ২৫ পাউন্ডে নেমে আসবে।
পুলি
পুলির কার্যপদ্ধতি সম্পূর্ণ লিভারের মূলনীতির উপর নির্ভরশীল এবং বলতে গেলে লিভারের পরিবর্ধিত ও সংযোজিত রূপই হচ্ছে পুলি, শুধুমাত্র লিভার ও পুলির কাঠামো ভিন্ন রকমের। লিভারের দণ্ডের পরিবর্তে সাধারণ পুলিতে একটি দড়ি যুক্ত থাকে এবং পুলিটি সংযুক্ত থাকে একটি নির্দিষ্ট ভিত্তির সাথে। দড়ির এক প্রান্ত যুক্ত থাকে কোনো বস্ত্র সাথে এবং অপর প্রান্ত থাকে একজন চালকের কাছে। ঠিক যেভাবে কুয়া থেকে পানি তোলা হয়। এরকম একটি পুলির মাধ্যমে ১০০ পাউন্ড ওজনের বস্তু নিচ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে উপরে তুলতে ১০০ পাউন্ড বলই প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু যদি দুটি পুলি ব্যবহার করা হয়, তাহলে একই কাজ করতে বলের দরকার হবে পূর্বের কাঠামোর চেয়ে অর্ধেক।
স্ক্রু
যন্ত্রকৌশলের জগতে বহুল ব্যবহৃত আরেকটি যন্ত্র হচ্ছে স্ক্রু। স্ক্রু হলো আনত তলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা যন্ত্র, যা সামান্য বল প্রয়োগে অধিক কাজ করতে সক্ষম। আনত তলের সাথে বিশেষভাবে শ্যাফট যুক্ত করলেই তা স্ক্রুতে রূপান্তরিত হয়। স্ক্রুর সাথে হাতল যোগ করে ঘুরিয়ে কাজ করা যায়, এভাবে যে পরিমাণ কাজ সম্পাদিত করা যায়, সেই তুলনায় খুবই সামান্য বলের প্রয়োজন হয়। আর্কিমিডিস স্ক্রু ব্যবহার করে পানি উত্তোলনের জন্যে একধরনের পাম্প আবিষ্কার করেছিলেন, যা আর্কিমিডিস স্ক্রু পাম্প নামে পরিচিত। বর্তমানে একই কার্যপদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তৈরিকৃত স্ক্রু পাম্পগুলো পানি পরিশোধনাগারে বহুল ব্যবহৃত হয়।
ফিচার ইমেজ: math.nyu.edu