বর্তমান যুগকে বলা হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। যতদিন যাচ্ছে প্রযুক্তির ততটাই উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে। প্রযুক্তির এই উন্নতির সাথে সাথে সব ধরনের মানুষও প্রযুক্তির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে বেশি। যদিও প্রযুক্তি নির্ভর করে থাকে তথ্যের উপর, বর্তমানে প্রযুক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের তথ্য পাওয়া যায়। যার মধ্যে কিছু তথ্য রয়েছে যেগুলো সঠিক, আবার কিছু তথ্য রয়েছে যেগুলো শুধু মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত, শোনা কথা, যার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। আজ এমনই কিছু প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
১. চার্জ একদম শেষ না হলে ফোন/ল্যাপটপে চার্জ দেয়া উচিত নয়
বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের সর্বত্র মোবাইল ফোন এবং ল্যাপটপের প্রসার হয়ে গেছে। প্রসারের সাথে সাথে যে ভ্রান্ত ধারণারও প্রচার ঘটেছে তা হলো, ফোনের বা ল্যাপটপের চার্জ একদম শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেগুলো চার্জ দেয়া উচিত নয়। ব্যাটারি পুরোটা শেষ হলেই চার্জ দেয়া উচিত, এতে করে ব্যাটারি ভাল থাকে এবং অনেকদিন টেকে!
কিন্তু এ ধারণা একদম ভুল। আপনার ফোনের যদি চার্জ ফুরিয়ে গিয়ে বন্ধ যায় এবং আপনি যদি পাওয়ার বাটন চেপে ধরেন তবে দেখবেন, ফোন আপনাকে অন্তত চার্জ দেয়ার জন্য হলেও একটা ম্যাসেজ দেখাবে। তাহলে এই ম্যাসেজ দেয়ার মতো চার্জ কোথা থেকে আসে? সত্যি বলতে ব্যাটারি পুরোটা শূন্য দেখালেও তাতে আরো প্রায় ১০% চার্জ মজুদ থাকে এসব কাজের জন্য। তাই আপনি কখনোই পুরো চার্জ নিঃশেষ করে ব্যাটারি রিচার্জ করতে পারবেন না।
সহজ করে বললে, ব্যাটারির কার্যক্রমটা আসলে ঠিক মানুষের মতো। ধরুন, একজন মানুষ সকালে শুধু ভরপেটে খেলো। তারপর সারাদিন কাজ করে আবার পরের দিন সকালে ভরপেটে খেলো। এভাবে মানুষটি কি অনেকদিন কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন? না! কয়েকদিন পরই তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বেন। তাই আমরা যেমন ক্ষুধা অনুভূত হলেই কিছু খাই বা দিনে তিনবেলা খেয়ে শরীর সতেজ এবং চালু রাখি, ঠিক তেমনি ব্যাটারিকেও চার্জ দিতে হবে। অর্থাৎ ব্যাটারি ৭০%, ৫০% বা ৩০% এ নেমে আসলে ফোন/ল্যাপটপ চার্জে দিবেন। এতে ব্যাটারি সতেজ থাকবে এবং তার দীর্ঘায়ু নিশ্চিত হবে।
২. ফোনে বেশি কথা বললে ক্যান্সার হয়
আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা বেশি প্রচলিত; বিশেষ করে আমাদের অভিভাবকদের মাঝে যে, ফোন বেশি ব্যবহার করলে বা ফোনে বেশি কথা বললে ব্রেইন ক্যান্সার হয়।
তাদের মাঝে এই ধারণাটা যেভাবেই আসুক না কেন, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমেরিকার জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা হলো, “বেতার তরঙ্গের যে শক্তি বা স্পন্দন, তা পুরোটাই আয়নিক বিকিরণের বিপরীত। যার কোনোভাবেই ডিএনএ নষ্ট করার মতো ক্ষমতা নেই। তবে এই বেতার তরঙ্গের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে খুব বেশি হলে যে প্রভাব মানুষের দেহে পড়তে পারে তা হলো, এটা দেহকোষের উষ্ণতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাণীদের উপর করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই বেতার তরঙ্গ কোনভাবেই ক্যান্সার তৈরি বা ক্যান্সারজনিত প্রভাবের বিস্তার ঘটাতে পারেনি।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও প্রায় দুই যুগ ধরে প্রচুর গবেষণা করেছে শুধু এটা বের করতে যে, আসলেই মোবাইল ফোনের তরঙ্গ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিনা! সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তারা বলেছেন, “এখন পর্যন্ত ফোন ব্যবহারের ফলে মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি হয়েছে এমন কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি।”
৩. যেকোন হার্ড ড্রাইভ, পেনড্রাইভ বা স্টোরেজ ডিভাইসের কাছে চুম্বক রাখলে সকল তথ্য মুছে যায়
এই ধারণার জন্ম হয়েছে হয়তো বিভিন্ন সিনেমা বা টেলিভিশন সিরিজ থেকে। যেমন জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ ‘ব্রেকিং ব্যাড’ এর পঞ্চম সিজনে দেখানো হয়েছিলো মাদকদ্রব্য প্রস্তুতকারী ওয়াল্টার হোয়াইট এবং তার সাথী পিংকম্যান একটি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক চুম্বক ব্যবহার করে একটি ল্যাপটপের হার্ড ড্রাইভে থাকা সকল তথ্য মুছে ফেলেছিলেন।
কিন্তু সত্যি বলতে দৈনন্দিন জীবনে এই কাজটি করা একপ্রকার অসম্ভবই বলা চলে। বর্তমানে প্রত্যেক হার্ডডিস্ক ড্রাইভে দুইটি শক্তিশালী নিয়োডিমিয়াম-আয়রন-বোরন চুম্বক থাকে। যেগুলো ডিস্কে রিড/রাইট হেডের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এই চুম্বক দুটির বেড়াজাল ভেদ করে ডিস্কের ভেতরে থাকা ডেটায় প্রভাব ফেলতে আপনার প্রচণ্ড শক্তিশালী চুম্বক লাগবে। এমনকি আপনি যদি নিয়োডিমিয়াম চুম্বকের প্রভাব ভেদ করেও ফেলেন তাহলে শুধু ডিস্কটাকেই ব্যবহারে অনুপযুক্ত করতে পারবেন, কিন্তু ডিস্কে থাকা তথ্যে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবেন না। অর্থাৎ সকল তথ্য যেমন ছিল তেমনই অক্ষত থেকে যাবে।
৪. ডেস্কটপ স্ক্রিন রিফ্রেশ করলে কম্পিউটারের গতি বাড়ে
অনেকে আছেন যারা কম্পিউটার চালু হওয়া মাত্র ডেস্কটপ পর্দায় মাউসের ডান বাটন চেপে ৫-১০ বার শুধু রিফ্রেশই করতে থাকেন। তাদের ধারণা এভাবে রিফ্রেশ করতে থাকলে কম্পিউটারের কাজের গতি বাড়ে।
কিন্তু এটিও একটি বহুল প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা। কম্পিউটারের কাজের গতির উপর রিফ্রেশ করার কোনোই সম্পর্ক নেই। একটুও প্রভাব ফেলে না এটি। তাহলে রিফ্রেশ করলে আসলে কী হয়? এর উত্তর হচ্ছে, রিফ্রেশ করলে ডেস্কটপ স্ক্রিনে থাকা আইকনগুলো পুনরায় নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিস্থাপিত হয়। আপনি যদি ডেস্কটপ স্ক্রিনে কোনো পরিবর্তন করে থাকেন এবং সেগুলো যদি তৎক্ষণাৎ সেখানে প্রদর্শিত না হয়, তাহলে রিফ্রেশ করলে সেগুলো সেখানে দেখা যায়।
৫. পোর্ট থেকে ইউএসবি নিরাপদে (USB Safely) না সরালে সকল তথ্য মুছে যাবে
কম্পিউটার থেকে কোন ইউএসবি ডিভাইস সরাতে গেলে যে উপদেশটি ম্যাসেজ আকারে কম্পিউটার নিজেই দিয়ে থাকে তা হলো “Safely Remove Hardware”। এতে করে অনেকে ধারণা করে থাকেন যে, এখানে ক্লিক করে ডিভাইস না সরালে ডিভাইসে থাকা সকল তথ্য মুছে যাবে বা ডেটা করাপ্ট হয়ে ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে যাবে।
একদিক দিয়ে এই প্রচলিত তথ্যটি সঠিক। তা হলো, কোনো ডেটা পিসি থেকে ইউএসবি ডিভাইসে গ্রহণ বা প্রেরণ করার সময় যদি আপনি ডিভাইসটি সরিয়ে ফেলেন এতে সেই ডেটা করাপ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে কম্পিউটার এবং ডিভাইসটির মধ্যে যদি কোনো কার্যপ্রণালী চালু না থাকে এমন অবস্থায়, অর্থাৎ সম্পূর্ণ ডেটা প্রেরণ করা হয়ে গেলে ডিভাইসটি আপনি এমনিতেই সরিয়ে ফেলতে পারেন। কম্পিউটারের উপদেশবাণী সম্বলিত ম্যাসেজে ক্লিক না করলেও আপনার ইউএসবি ডিভাইসে থাকা ডেটা মুছে যাবে না বা করাপ্ট হবে না।
৬. কোম্পানি থেকে সরবরাহকৃত চার্জার দিয়েই ফোন চার্জ দেয়া উচিত
যখন আপনি নতুন ফোন কেনেন তখন দেখবেন ফোনের বাক্সে থাকা নির্দেশনাবলীর কাগজে বলা থাকে শুধুমাত্র অফিসিয়াল চার্জার দিয়েই ফোন চার্জ দিতে। পাশাপাশি অনেকেই বলে থাকেন, ফোন কোম্পানি থেকে সরবারহকৃত চার্জার দিয়ে চার্জ দিলেই ফোন ভাল থাকে এবং অন্য থার্ড-পার্টি চার্জার ব্যবহার করলে ফোনের ব্যাটারি বেশিদিন টেকে না।
কিন্তু এটি একটি ভুল তথ্য। চার্জারের সাথে ফোনের ভাল-খারাপ থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি বাজারে প্রচলিত যেকোনো ভালো চার্জার দিয়ে ফোন চার্জ দিতে পারবেন। এতে ফোনের কোনো ক্ষতি হবে না। সেই চার্জারের অ্যাম্পিয়ার এবং ভোল্ট আপনার ফোনের ব্যাটারির লেভেলের তুলনায় বেশি হলেও এতে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কারণ বর্তমানে প্রচলিত প্রায় সকল স্মার্টফোনের ব্যাটারিই লিথিয়াম আয়নের। যার বৈশিষ্ট্য হলো এটি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় এবং মানে চার্জ গ্রহণ করতে সক্ষম। তাই আপনি বেশি মাত্রার চার্জার দিয়ে চার্জ দিলেও ফোনের ব্যাটারিতে নিজস্ব যে ধারণক্ষমতা বা মান বেঁধে দেয়া হয়েছে, তার উপরে সে চার্জ গ্রহণ করবে না।
৭. বেশি মেগাপিক্সেল মানেই ভালো ক্যামেরা
স্মার্টফোন কিনতে গেলে দেখা যায় প্রায় সকলেই আগে যাচাই করেন ফোনের ক্যামেরা কত মেগাপিক্সেল। অনেকেই ধারণা করে থাকেন, মেগাপিক্সেল যত বেশি হবে, ফোনের ক্যামেরাও তত ভাল হবে।
কিন্তু এই তথ্যটাও সম্পূর্ণ ভুল। আপনি নিজেই হয়তো খেয়াল করে দেখবেন কোন ফোনের ৫ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা অন্য ফোনের ১২ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা থেকে ভালো ছবি তুলতে পারছে। কারণ শুধু বেশি মেগাপিক্সেলই আপনাকে ভালো মানের ছবি প্রদানের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। ভাল ছবি আশা করার ক্ষেত্রে আপনাকে ক্যামেরার আনুষাঙ্গিক অন্য সকল দিকও বিবেচনা করতে হবে। যেমন মূল ক্যামেরা লেন্সের আকার এবং উপাদান, লাইট সেন্সর, ছবি প্রক্রিয়াকরণ হার্ডওয়্যার, উন্নত কোডিং সম্বলিত ক্যামেরা সফটওয়্যার ইত্যাদি।
যেমন গুগলের নতুন ফোন গুগল পিক্সেল ২, যার পেছনে ১২ মেগাপিক্সেলের একটিমাত্র ক্যামেরা রয়েছে। অন্যদিকে আরো কিছু নামিদামি ফোন আছে যেগুলোর পেছনে রয়েছে দুটি করে ক্যামেরা, যাদের মেগাপিক্সেলও বেশি। কিন্তু দেখা গেছে গুগলের ফোনটির এই একটি ক্যামেরাই অন্যান্য নামিদামি ফোনগুলোর ১৬, ২০ মেগাপিক্সেলের সম্মিলিত ক্যামেরা থেকেও বেশি ভালো ছবি তুলতে পারে। তাই মেগাপিক্সেল বেশি হলেই যে ক্যামেরা ভালো হবে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।
ফিচার ইমেজ: Steemit