বিশ্বের সর্বত্র যখন প্রযুক্তির জয় জয়কার তখন আমাদের দেশের তরুণ তরুণীদের একটা বৃহৎ অংশ ছুটছে প্রযুক্তির বিশাল মার্কেটে নিজের অবস্থান স্থায়ী করে নিতে। এমনবস্থায় প্রতিদিন প্রচুর তরুণ তরুণী প্রযুক্তিকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে আগ্রহী হচ্ছে। প্রযুক্তির বিশাল রাজ্যের রাজপুত্র বলা যায় কম্পিউটার প্রোগ্রামিংকে। যারা কম্পিউটার পোগ্রামার হওয়ার কথা ভাবছেন তাদের জন্য প্রাথমিক গাইডলাইন হিসেবে এই আর্টিকেলটি লেখা হলো।
কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর অসংখ্য ভাষা রয়েছে। প্রতিটি ভাষাই অনন্য। তবে এই সকল ভাষায় একজন ব্যাক্তির পক্ষে সমান দক্ষ হয়ে ওঠা অসম্ভব প্রায়। কাজেই আপনি যদি একজন পোগ্রামার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করতে চান তাহলে প্রথমেই আপনাকে একটি নির্দিষ্ট প্রোগ্রামিং ভাষা পছন্দ করতে হবে এবং সেই ভাষায় নিজেকে দক্ষ করে তুলতে হবে। এই আর্টিকেলে আমি বর্তমান সময়ের উপযোগী কিছু প্রোগ্রামিং ভাষার সুযোগ সুবিধা ও এই সব ভাষার মার্কেট প্লেস নিয়ে আলোচনা করবো। এতে করে তরুণ পোগ্রামারদের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।
১. জাভাস্ক্রিপ্ট (JavaScript)
ওয়েব পেইজ প্রোগ্রামিং করার জন্য জাভাস্ক্রিপ্ট (সংক্ষেপে JS) একটি স্ক্রিপ্টিং প্রোগ্রামিং ভাষা। বর্তমান পৃথিবীতে সব থেকে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে এই ভাষাটি। এটি এতোটাই প্রভাবশালী একটি ভাষা যে, বর্তমানে জাভাস্ক্রিপ্ট ছাড়া কোন ওয়েব সাইট কল্পনা করাও কষ্টকর।
সুবিধা
>> অত্যধিক সহজ প্রোগ্রামিং ভাষা।
>> প্রোগ্রামিং সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান ছাড়াই এই ভাষাটি শেখা যায়।
>> শক্ত-সমর্থ ভাষা এবং সরাসরি এইচটিএমএল (HTML) পেজে রান হয়।
>> জাভাস্ক্রিপ্টের প্রচুর ফ্রের্মওয়ার্ক রয়েছে।
>> সকল প্লাটফর্মের জন্য হাইব্রিড অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা যায়।
>> ওয়েব পেজ ডিজাইনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রোগ্রামিং ভাষা।
>> জাভাস্ক্রিপ্টের বিভিন্ন অপারেটরের ব্যবহার জাভা (java) ভাষার অনুরূপ।
অসুবিধা
>> জাভাস্ক্রিপ্ট হাই লেভেলের প্রোগ্রামিং ভাষা নয়।
>> ডাটাবেজ সমর্থন করে না।
>> ফাইল তৈরি করতে ও পড়তে পারে না।
মার্কেটপ্লেস : একজন দক্ষ জাভাস্ক্রিপ্ট ডেভলপারের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ১১০,৭৫৬ ডলার। যা অন্য যেকোনো প্রোগ্রামিং ভাষার থেকে বেশি! তবে উপমহাদেশে ক্যারিয়ার হিসাবে জাভাস্ক্রিপ্ট কখনোই প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেওয়া উচিত হবে না। কারণ তুলনামূলক স্বল্পমূল্যে এখানে প্রচুর ডেভলপার পাওয়া যায়।
২. জাভা (Java)
হাই লেভেল প্রোগ্রামিং ভাষা হিসেবে সর্বাধিক মার্কেট সফল ভাষা হলো জাভা। যা বর্তমান প্রযুক্তি দুনিয়ার প্রায় পুরোটাই দখল করে আছে। জাভা ৩ বিলিয়ন ইলেকট্রিক ডিভাইসে রান করছে। ফলাফলস্বরূপ আমাদের প্রতিদিন জীবনের আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, এমন প্রায় প্রতিটি স্থানেই জাভা রান হচ্ছে। চন্দ্র বিজয়েও আছে জাভার অবদান!
সুবিধা
>> অত্যন্ত শক্তিশালী ও নিরাপদ ভাষা।
>> প্লাটফর্ম স্বাধীন। অর্থাৎ সকল প্লাটফর্মেই রান হয়।
>> লোকাল সফটওয়্যার ও সার্ভার সফটওয়্যার দুই ক্ষেত্রেই ব্যবহারযোগ্য।
>> সাইনট্যাক্স সহজ ও পড়ার উপযোগী।
>> অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের অফিশিয়ালি ভাষা।
>> উন্নত ফাইল সিস্টেম।
>> থ্রিডি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমর্থিত প্রোগ্রামিং ভাষা।
অসুবিধা
>> প্রোগ্রামিং ভাষা সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া সরাসরি জাভা শেখা খুবই কষ্টকর। তাই জাভা শেখার পূর্বে জাভাস্ক্রিপ্ট (JavaScript), সি (C) অথবা সি++ (C++) ভাষা শিখে তারপর জাভা শুরু করতে হয়।
মার্কেটপ্লেস: একজন দক্ষ জাভা ডেভলপারের বার্ষিক গড় আয় ৭৩,২৬৮ ডলার! কাজের ক্ষেত্র, জাভার দক্ষতা এবং উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে জাভা পছন্দের প্রোগ্রামিং ভাষা হওয়ার ক্ষেত্রে ‘নাম্বার ওয়ান’ হওয়ার দাবি রাখে।
৩. পাইথন (Python)
পাইথনকে বলা হয় আধুনিক প্রোগ্রামিং ভাষা। হাই লেভেলের এই ভাষাটি বিশ্বের তরুণ সমাজে খুব জনপ্রিয়। উচ্চ কর্মদক্ষতা, সহজ সাইনটেক্স, পড়ার উপযোগিতা ও স্বাধীন প্লাটফর্মের সুবিধা নিয়ে পাইথন বর্তমানে জাভার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। তরুণ সমাজে পাইথনের জনপ্রিয়তার অন্যতম বড় কারণ হলো, প্রোগ্রামিং ভাষা সম্পর্কে পূর্বের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই পাইথন সরাসরি শেখা যায়।
সুবিধা
>> সাইনটেক্স খুবই সহজ ও পড়ার উপযোগী।
>> প্লাটফর্ম স্বাধীন। অর্থাৎ সকল প্লাটফর্মে রান হয়।
>> লোকাল সফটওয়্যার ও সার্ভার সফটওয়্যার দুই ক্ষেত্রেই ব্যবহারযোগ্য।
>> সার্ভারের জন্য ডিজেনগো (Django) নামে ফ্রেমওয়ার্ক রয়েছে।
>> উন্নত ফাইল সিস্টেম ও ডাটাবেজ সমর্থক প্রোগ্রামিং ভাষা।
অসুবিধা
>> আধুনিক স্মার্ট ফোনের অ্যাপ তৈরির জন্য পাইথন সুবিধাজনক ভাষা নয়।
মার্কেটপ্লেস: আউটসোর্সিংয়ে পাইথনের বর্তমান চাহিদা প্রচুর। একজন পাইথন ডেভলপারের বার্ষিক গড় আয় ১১৪,২৯১ ডলার। যা হাই লেভেল প্রোগ্রামিং ভাষার জন্য সর্বোচ্চ। তবে পাইথনের জনপ্রিয়তার মূল কেন্দ্র হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোতে। উপমহাদেশ কিংবা মিডেল ইস্টের দেশগুলোতে পাইথনের চাহিদা তুলনামূলক কম। তবে ভবিষ্যতের সময়টা পাইথনের জন্য সুখকর হতে যাচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই। কাজেই ক্যারিয়ার হিসেবে পাইথনকে পছন্দ করা হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
৪. পিএইপি (PHP)
পিএইচপি হলো সার্ভার সাইট স্ক্রিপ্টিং ভাষা। সার্ভার অ্যাপ্লিকেশন তৈরির জন্য পিএইচপি তুমুল জনপ্রিয় ভাষা। ওয়ার্ডপ্রেস (WordPress), জুমলা (Joomla), ধ্রুপাল (Drupal) এর মতো শীর্ষস্থানীয় সিএমএসগুলো (CMS) নির্মিত হয়েছে পিএইচপি দিয়ে। ফেইসবুক (Facebook), উইকিপিডিয়া (Wikipedia), ই-বে (eBay) সহ প্রায় সবগুলো অনলাইন মার্কেটিং সাইটও তৈরি হয়েছে এই পিএইচপি দিয়ে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আপডেট ও বিশাল ডেভলপার টিম নিয়ে পিএইচপি এখন মার্কেটের শীর্ষে।
সুবিধা
>> সহজ সাইনটেক্স ও অত্যন্ত কর্মদক্ষ ভাষা।
>> উন্নত ফাইল সিস্টেম।
>> নিরাপদ ও শক্তিশালী ভাষা।
>> হাই লেভেল প্রোগ্রামিং ভাষার মতো ক্লাস সমর্থিত।
>> এইচটিএমএল (HTML) এর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সকল প্লাটফর্মে রানেবল যোগ্য।
>> বৃহৎ ডেলপার টিম, ফ্রেমওয়ার্ক ও সমৃদ্ধ ততোধিক সিএমএস রয়েছে।
অসুবিধা :
>> সার্ভার সাইট স্ক্রিপ্টিং ভাষা হিসেবে পিএইচপির উল্লেখযোগ্য কোন অসুবিধা নেই।
মার্কেটপ্লেস : জন্মের পর থেকেই পিএইচপি মার্কেটে তার শীর্ষ অবস্থান অক্ষুন্ন রেখেছে। একজন পিএইচপি ডেভলপারের বার্ষিক গড় আয় ৬১,৪০৫ ডলার। বিশ্বের সর্বত্র পিএইচপি ডেভলপারদের ব্যপক চাহিদা রয়েছে। কাজেই ওয়েব পোগ্রামার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য পিএইচপি একটি চমৎকার ভাষা।
৫. সি++ (C++)
হাই লেভেল প্রোগ্রামিং ভাষার মধ্যে সি++ অন্যতম মার্কেট সফল প্রোগ্রামিং ভাষা। আধুনিক প্রতিটি কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেমের মূল ভিত্তি সি++। উন্নতমানের সফটওয়্যার ডেভলাপের ক্ষেত্রে সি++ এর বিকল্প নেই। বিশেষ করে হাই গ্রাফিক্যাল কম্পিউটারের গেম তৈরির জন্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী পোগ্রামিং ভাষা।
সুবিধা
>> অত্যন্ত পাওয়ারফুল প্রোগ্রামিং ভাষা।
>> কর্মদক্ষতার স্কেলে নাম্বার ওয়ান প্রোগ্রামিং ভাষা।
>> রয়েছে অসংখ্য শক্তিশালী পোগ্রামিং টুল।
>> উন্নত ফাইল সিস্টেম।
>> রয়েছে আধুনিক প্রোগ্রামিং ভাষার সকল সুবিধা এবং দ্রুত এক্সিকিউট হবার ক্ষমতা।
অসুবিধা
>> নিরাপত্তার দিকে সামান্য দুর্বলতা রয়েছে।
>> প্লাটফর্ম স্বাধীন নয়। অর্থাৎ আলাদা প্লাটফর্মের জন্য একই অ্যাপ্লিকেশন আলাদাভাবে লেখতে হয়।
মার্কেটপ্লেস: পিসি গেম তৈরিতে সি++ এখনো তার অবস্থান শীর্ষে ধরে রেখেছে। প্রতি বছর বিভিন্ন গেমিং কোম্পানি থেকে যত পিসি গেম রিলিজ হয় তার বৃহৎ অংশই সি++ দিয়ে তৈরী। তাছাড়া এডোব, মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানিগুলোর তৈরি প্রায় সকল সফটওয়্যারই সি++ দিয়ে তৈরী। সি++ এর একজন দক্ষ ডেভলপারের বার্ষিক গড় আয় ৭০,৬৪১ ডলার। আপনি যদি পিসি গেম তৈরি করতে চান, অথবা বড় কোনো গেমিং প্লাটফর্মে কাজ করতে চান, তাহলে সি++ এর বিকল্প নেই।
৬. সুইফট (Swift)
সুইফট হচ্ছে iOS (আইফোন অপারেটিং সিস্টেম) এ কাজ করার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত একটি ভাষা। যা আইফোনের হার্ডওয়্যারের সাথে সব থেকে ভালো সার্ভিস দিতে পারে। আপনি যদি আইফোন ও আইপ্যাডের জন্য অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করতে চান তাহলে সুইফ্ট হচ্ছে একমাত্র পোগ্রামিং ভাষা।
সুবিধা
>> হাই লেভেল পোগ্রামিং ভাষা।
>> উন্নত ফাইল সিস্টেম।
>> শক্তিশালী ও নিরাপদ ভাষা।
>> iOS এর অফিশিয়ালি প্রোগ্রামিং ভাষা।
অসুবিধা
>> macOS, iOS, watchOS এবং tvOS ছাড়া অন্য কোনো প্লাটফর্মে সুইফ্ট ভাষা তেমন সুবিধাজনক নয়।
মার্কেটপ্লেস: সময়ের সাথে সুইফ্ট তার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। যেহেতু সুইফ্ট শুধুমাত্র macOS, iOS, watchOS এবং tvOS এ আবদ্ধ তাই নতুন প্রোগ্রামাররা সুইফ্ট এর প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। এজন্য সুইফ্টে প্রতিযোগিতা তুলনামূলক কম। এটাও হতে পারে আপনার ক্যারিয়ারের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ। একজন সুইফ্ট ডেভলপারের জন্য বার্ষিক গড় আয় প্রায় ১১২,২৬৫ ডলার। যদিও সুইফ্ট মার্কেটে খুব শক্ত অবস্থানে নেই, তথাপি বলা যায়, যতদিন অ্যাপল তাদের মার্কেট ধরে রাখতে পারবে, ততদিন সুইফ্টও মার্কেটে থাকবে। সেই অর্থে তুলনামূলক স্বল্প প্রতিযোগিতায় ক্যারিয়ার গড়ার জন্য সুইফ্ট হতে পারে একটি চমৎকার মাধ্যম।
উপরোল্লিখিত প্রোগ্রামিং ভাষা ছাড়াও রয়েছে আরও বহু জনপ্রিয় মার্কেট সফল প্রোগ্রামিং ভাষা। যেমন- জাভা ও পাইথন এর বিকল্প হিসাবে আছে কটলিন (Kotlin), রুবি (Ruby), ডট নেট (.Net), পার্ল (Perl) ইত্যাদি। সার্ভার সাইটের জন্য পিএইচপির বিকল্প হিসেবে আছে এএসপি ডট নেট (ASP.NET), ডিজেনগো (Django), নোড ডট জেএস (Node.js) ইত্যাদি। এছাড়াও উইনডোজ ফোনের জন্য রয়েছে সি সার্প (C#)। রয়েছে জাভা স্ক্রিপ্টের ফ্রেমওয়ার্ক জেকিউরি (jQuery), এনগুলার জেএস (Angular JS) ইত্যাদি।
একজন সফল প্রোগ্রামার হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা বাধ্যতামূলক নয়। অনলাইনে প্রোগ্রামিং শেখার রয়েছে প্রচুর স্কুল, ব্লগ, কমিউনিটি, ইউটিউব ভিডিও চ্যানেল। যেখান থেকে একজন আগ্রহী তরুণ-তরুণী বিনামূল্যে প্রোগ্রামিং শিখে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে পারে। এ লেখার পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে, কীভাবে কোথায় প্রোগ্রামিং শেখা যাবে, কীভাবে প্রোগ্রামিং শেখা শুরু করব এবং কীভাবে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলা যায়, এ নিয়ে।
ফিচার ইমেজ: pixabay.com