‘যানজট’ একটি আধুনিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার নাম। দিন দিন যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে এ সমস্যাটিও প্রকট আকার ধারণ করছে। যোগাযোগব্যবস্থা যে হারে বিস্তৃত হচ্ছে, যে হারে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে এবং সেই সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন শহরে যেভাবে যানজট দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে, মানুষের আপ্রাণ প্রচেষ্টাও সে গতির সাথে তাল মেলাতে পারছে না। ফলে যানজটের সমস্যাটি দিন দিন বেড়েই চলেছে। আবার মানুষের প্রচেষ্টাও থেমে নেই; যানজট থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় অনুসন্ধান চলছেই।
তবে সভ্যতার এ পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে, যেহেতু সমস্যাটি প্রযুক্তিগত, তাই মানুষ নিজে কখনোই এ সমস্যাটির পুরোপুরি সমাধান করতে পারবে না। শেষপর্যন্ত মানুষকে যুগান্তকারী কোনো প্রযুক্তির সাহায্যই নিতে হবে। গবেষকেরা ইতোমধ্যে জেনে গেছেন, আমাদের হাতে থাকা এরকম একমাত্র প্রযুক্তিটির নাম ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা‘ বা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)’।
যানজটে ক্ষয়ক্ষতি
যানজটের ফলে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাক, যা হিসাব করাটাও দুঃসাধ্য। মানুষের প্রচুর কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা গাড়ি থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ বেড়ে যায়, হর্ণের ব্যবহারও বেড়ে যায়, এমনকি হাসপাতালে যেতে দেরি হওয়ায় অনেক রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে।
প্রথম আলোর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রতিবছর শুধুমাত্র ঢাকা শহরের যানজটের কারণে মানুষের প্রায় ৫০ লক্ষ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে এবং মোট প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। ২০১৭ সালে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জার্মানিতে ট্রাফিক জ্যামের কারণে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণই ৩০৫ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাব থেকে যানজটের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে খানিকটা আন্দাজ করা যায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রকৃতপক্ষে কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি শাখা। একে অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। সহজ ভাষায় বাখ্যা করতে গেলে, যদি এক বা একাধিক শক্তিশালী কম্পিউটার ব্যবস্থার সাথে সমন্বিত কিছু জটিল ও দক্ষ প্রোগ্রাম সম্মিলিতভাবে ঐ ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত কিছু ইনপুট বা সেন্সরের সাহায্যে বাইরের পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এবং সে তথ্যগুলোকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করে কোনোকিছু নিজে নিজেই শিখে নিতে পারে, তথ্যগুলো থেকে প্রাপ্ত ঘটনাসমূহের উপর যুক্তি প্রয়োগ করে কোনো অর্থপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে এবং কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ও নির্দেশনা অনুসারে ভুল সিদ্ধান্তগুলোকে সংশোধন করে নিতে সক্ষম হয়, তবে সে ব্যবস্থাটিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) বলা যায়।। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে পুরো ব্যবস্থাটি সামগ্রিকভাবে একটি বুদ্ধিমান প্রাণীর মতোই আচরণ করে বলে মনে হয়। একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থার সাথে যত শক্তিশালী কম্পিউটিং ব্যবস্থা যুক্ত থাকবে এবং এর সমস্যা সমাধানের অ্যালগোরিদম যত উন্নত মানের হবে, তার আচরণ তত বেশি বুদ্ধিমান প্রাণীর মত মনে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে
এখনো পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই পুরনো পদ্ধতিতে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। এতে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর ট্রাফিক সিগন্যালের লাইটগুলো পরিবর্তিত হয়। এ পদ্ধতিটি যুগোপযোগী নয়। কারণ, যান চলাচলের একদম সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে নির্ধারিত কোনো রুটিন নেই। যানজট থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রধানতম শর্ত হচ্ছে, অত্যন্ত দ্রুত সমগ্র ট্রাফিকের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে এবং এর ভিত্তিতে ট্রাফিক সিগন্যালগুলো পরিবর্তন করে কোনো একটি এলাকা বা রাস্তার যানবাহনসমূহকে তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। এ কাজটি মানুষের চেয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুব সূক্ষ্ম ও নির্ভুলভাবে করতে সক্ষম।
যানজট নিরসনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানোর জন্য ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অংশের দায়িত্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর ছেড়ে দিতে হবে। তবে এর জন্য বিদ্যমান ট্রাফিক ব্যবস্থার কয়েকটা দিককে খানিকটা ঢেলে সাজাতেও হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত কয়েকটি ধাপে যানজট কমানোর চেষ্টা করবে:
(১) যানবাহন শনাক্তকরণ ও তথ্য সংগ্রহ: বর্তমানকালে বিভিন্ন দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য এবং ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যে জনবহুল রাস্তাগুলোর বিভিন্ন অংশে ক্যামেরা বসানো থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থায় এরকম ক্যামেরার সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে এবং প্রতিটি ক্যামেরার সাথে যুক্ত থাকবে নির্দিষ্ট কর্মক্ষমতার একটি করে কম্পিউটার। এই কম্পিউটারে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত ক্যামেরাটিতে ধারণকৃত দৃশ্যে ছোট-বড় নানা ধরনের যানবাহনকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারবে। এমনকি পথচারী বা সাইকেল আরোহীকেও শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এছাড়া রাস্তার বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে থাকবে সহায়ক আরও কিছু সেন্সর, যেগুলোর সাহায্যে ক্যামেরায় গৃহীত তথ্যগুলোকে আরও নিশ্চিতভাবে যাচাই করা সম্ভব হবে। প্রয়োজনে এমনকি স্যাটেলাইটেরও সহায়তা নেওয়া হবে। এই তথ্যগুলো ধারণ করার পর খুব দ্রুত তা একটি কেন্দ্রীয় কম্পিউটার ব্যবস্থায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বলাই বাহুল্য, এই কেন্দ্রীয় কম্পিউটার ব্যবস্থাটিই হবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণকারী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রাণকেন্দ্র। বিভিন্ন অঞ্চলের ক্যামেরা থেকে প্রেরণকৃত এসব তথ্যগুলো থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একদম নিখুঁতভাবে জানতে পারবে ঠিক সেই মুহূর্তে কোথায় কতটি গাড়ি বা মানুষ আছে এবং তারা ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে।
(২) দ্রুত তথ্য বিশ্লেষণ ও পূর্বানুমান: যে তথ্যগুলো কেন্দ্রীয় কম্পিউটার ব্যবস্থাটির কাছে রয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুবই জটিল উপায়ে সে তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করবে। এ জায়গাটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে মানুষের মস্তিষ্কের পার্থক্য রয়েছে; মানুষের পক্ষে খুব দ্রুত এত জটিলভাবে চিন্তা করা সম্ভব নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুবই সামান্য সময়ের মধ্যে প্রত্যেকটি যানবাহন কোন কোন দিকে যেতে পারে, এবং এর ফলে ট্রাফিকের উপর কী প্রভাব পড়তে পারে, কয়েক সেকেন্ড পর কোন কোন অঞ্চলে যানবাহনের ঘনত্ব বেড়ে যেতে পারে- এসবের একটা সম্ভাব্য হিসাব করে রাখবে। আবার, একটি গাড়ি একটি নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে গেলে সেই গাড়িটি সম্ভাব্য কোন কোন গন্তব্যে যেতে পারে, তা-ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বুঝতে পারবে। কেননা, একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের গাড়ি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করেই যায়। ফলে সে ঠিক কয়টায় কোন রাস্তায় থাকবে তা অনুমান করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে কঠিন কিছু নয়।
আমরা আমাদের মানব মস্তিষ্ক ব্যবহার করে খুব সহজ একটি পরিস্থিতির কথা চিন্তা করতে পারি। ধরি, একটি সোজা রাস্তা ধরে একটি ট্রাক আর একটি বাস সামনের দিকে যাচ্ছে। সামনে একটি চৌরাস্তা। আমরা যখন বাস ও ট্রাক- কোনটি কোনদিকে যেতে পারে, তা নিয়ে চিন্তা করবো, তখন কয়েকটা সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারবো-
- বাসটি ডানে যাবে, ট্রাকটি বামে যাবে।
- বাসটি বামে যাবে, ট্রাকটি ডানে যাবে।
- বাসটি সোজা যাবে, ট্রাকটি ডানে যাবে।
- বাসটি সোজা যাবে, ট্রাকটি বামে যাবে।
- ট্রাকটি সোজা যাবে, বাসটি বামে যাবে।
- ট্রাকটি সোজা যাবে, বাসটি ডানে যাবে।
- বাস-ট্রাক উভয়েই বামে যাবে।
- বাস-ট্রাক উভয়েই সোজা যাবে।
- বাস-ট্রাক উভয়েই ডানে যাবে।
দেখলেন, মাত্র দুটো যানবাহনের সম্ভাব্য গতিবিধি নিয়ে ভাবতে গিয়েই আমাদের কী অবস্থা! এবার তিনটি যানবাহন নিয়ে ভেবে দেখুন, তাহলেই আমাদের মানব মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতা টের পাবেন। কিন্তু কম্পিউটার মানুষের চেয়ে লক্ষ গুণ বা তারচেয়েও অনেক দ্রুত হিসাব করতে পারে। ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুব কম সময়ের মধ্যেই অনায়াসে শত শত যানবাহনের সম্ভাব্য গতিবিধি নিয়ে একটি নিখুঁত হিসাব করে ফেলতে পারবে। অর্থাৎ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বুঝে নেবে, একটু পর কী ঘটতে যাচ্ছে। অন্যান্য সাধারণ কম্পিউটার ব্যবস্থার সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য হলো, সে পারিপার্শ্বিক অনেকগুলো ফ্যাক্টর বা নিয়ামক বিবেচনা করে এই সম্ভাবনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত সম্ভাবনাটি বের করে ফেলতে পারবে। অর্থাৎ, সে প্রায় নির্ভুলভাবে অনুমান করে নিতে পারবে যে, সামনের কিছু সময়ের মাঝে ঠিক কোন কোন রাস্তার মোড়ে বা সিগন্যাল পয়েন্টে বড় ধরনের যানজট শুরু হতে যাচ্ছে। এমনকি তার অনুমান যদি খানিকটা ভুলও হয়, তবুও সে অত্যন্ত দ্রুত সে ভুল শোধরে নিতে পারবে, কেননা, যানবাহনগুলোর গতিবিধি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক তার নজরদারির মধ্যে রয়েছে।
(৩) সমন্বয় সাধন ও পরিকল্পনা গ্রহণ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পাশাপাশি বেশ কিছু ট্রাফিক সিগন্যাল পয়েন্ট বা রাস্তা থেকে একইভাবে আরও তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোকেও বিশ্লেষণ করবে। এরপর সবগুলো তথ্যকে সমন্বয় করে কয়েক সেকেন্ড পর গোটা অঞ্চলের ট্রাফিকের অবস্থা কী হবে সেটা প্রায় নির্ভুলভাবে অনুমান করবে। সেই অনুসারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিটি সিগন্যালে প্রতিটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি, এমনকি সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্যও একটি পরিকল্পনা তৈরি করে রাখবে। আবার প্রয়োজন অনুসারে খুব দ্রুত সেই পরিকল্পনা বদলে ফেলতে পারবে।
(৪) সিগন্যাল লাইট নিয়ন্ত্রণ: কার্যকরভাবে ট্রাফিক জ্যাম থেকে মুক্তি পেতে হলে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে তুলে দিতে হবে। অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ট্রাফিক সিগন্যালের লাইট নিয়ন্ত্রণ করবে। বিভিন্ন যানবাহনের গতিবিধি বিশ্লেষণ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আগে থেকেই বুঝতে পারবে কোন কোন পয়েন্টে গাড়ির ঘনত্ব বেড়ে যাবে। আবার সে এটাও হিসাব করে দেখবে যে, একটি নির্দিষ্ট সিগন্যাল থেকে একটা নির্দিষ্ট দিকে কিছু সংখ্যক গাড়িকে বের হয়ে যেতে দিলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী হতে পারে, অর্থাৎ, সে গাড়িগুলো অন্য কোনো সিগন্যালে গিয়ে যানজটকে প্রভাবিত করবে কি না। সে অনুসারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন পয়েন্টের সিগন্যাল লাইট নিয়ন্ত্রণ করে গোটা অঞ্চলটাকে যথাসম্ভব যানজটমুক্ত রাখবে।
(৫) বিকল্প গতিপথ নির্ধারণ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি মনে করে কোনো ট্রাফিক এরিয়াতে একটা নির্দিষ্ট রুটের গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে, তাহলে যানজট রোধ করার জন্য প্রয়োজনে সে কিছু যানবাহনকে রাস্তা পরিবর্তন করে অন্য পথে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেবে। কিংবা কোনো একটি নির্দিষ্ট রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে সে রাস্তাটি বন্ধ করে দেবে এবং সে পথের গাড়িগুলোকে পথ পরিবর্তন করে বিকল্প পথে যেতে বলা হবে। এ কাজটি দুভাবে করা যাবে- এক, রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ডিসপ্লে লাগানো থাকবে এবং এতে লেখা ফুটে উঠবে কোন ধরনের যানবাহনের কোন রাস্তা ধরে যাওয়া উচিত। দুই, গাড়িগুলো নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে সংযুক্ত থাকবে। ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সরাসরি চালককে পরামর্শ পাঠাবে রাস্তা পরিবর্তন করার জন্য। ইতোমধ্যে অনেক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের নেটওয়ার্কিংয়ে সক্ষম গাড়ি তৈরি করা শুরু করেছে এবং এ ব্যবস্থাকে ভবিষ্যতে আরও উন্নত করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
যেসব গবেষকরা যানজট নিরসনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন, তারা মনে করছেন, কোনো একটি অঞ্চলের কিছু সংখ্যক যানবাহনের চালককে যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত এই ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করা যায়, তাহলে এই ব্যবস্থাটি আরও অনেক বেশি নির্ভুলভাবে কাজ করবে। সেসব যানবাহনের আরোহীরা আগেই সিস্টেমকে জানিয়ে রাখবেন যে, তারা কোথায় যেতে চাচ্ছেন এবং গতিপথে সিস্টেমকে অনবরত তাদের গতিবিধি সম্পর্কে আপডেট পাঠাতে থাকবেন। এর ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে সমগ্র এলাকার যানবাহনের গতিবিধি সম্পর্কে পূর্বানুমান করা যেমন অনেকটা সহজ হয়ে যাবে, তেমনই সেসব আরোহীরাও সহজে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারবেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে সফলতা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যানজট নিরসনের প্রচেষ্টা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। পৃথিবীর কয়েকটি অঞ্চলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অভাবনীয় সাফল্যও পাওয়া গেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত পিটসবার্গ শহরের একটি অংশে ২০১২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হয়। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের উপর। গবেষকরা সফলভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহার করে দেখিয়েছেন। তারা নিজেদের উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তিটির নাম দেন ‘সারট্র্যাক’ (Surtrac)। সারট্র্যাক ব্যবহারে পিটসবার্গে যানজট সংক্রান্ত ভোগান্তি অনেক কমেছে। সম্প্রতি এই গবেষকেরা গঠন করেন ‘র্যাপিড ফ্লো টেকনোলজিস’ (Rapid Flow Technologies) নামক একটি প্রতিষ্ঠান, যার লক্ষ্য ‘সারট্র্যাক’ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে সেটিকে বাণিজ্যিকীকরণ করা। তাদের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক জোনে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে গন্তব্যে পৌঁছাতে ২৫% কম সময় লাগছে, ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহনের আটকে থাকার হার ৪০% কমে এসেছে, যানগুলোকে আগের মতো ঘন ঘন সিগন্যালে পড়তে হচ্ছে না এবং সেই সাথে যানবাহন থেকে নির্গত ক্ষতিকর ধোয়ার পরিমাণ ২০% কমেছে।
এদিকে, ইংল্যান্ডের মিল্টন কিনেস শহরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ভিভাসিটি ল্যাবস (Vivacity Labs) নামক একটি বেসরকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান যানজট রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার চালু করেছে। শহরজুড়ে ৪১১টি ক্যামেরার সাহায্যে ট্রাফিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রায় ১৫ মিনিট আগেই যানজটের ব্যাপারে প্রায় ৮৯ শতাংশ নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। ফলে সহজে যানজট রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।
এছাড়াও জার্মানির হ্যাগেন শহরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যানজট কমানোর দায়িত্ব হাতে নিয়েছে ‘সিমেন্স মোবিলিটি’ (Siemens Mobility) নামক প্রতিষ্ঠান। তারাও এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। যাত্রীদেরকে সিগন্যাল পয়েন্টগুলোতে আগের তুলনায় ৪৭% কম অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই বিপুল সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিটির ব্যবহার নিয়ে আরও বিস্তর গবেষণা চলছে।
এসব সাফল্যের খবর এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে ক্রমবর্ধমান গবেষণা এটিই নির্দেশ করে যে, অদূর ভবিষ্যতে যানজট নিরসনে নিশ্চিতভাবেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের দিকে ঝুঁকবে বিশ্বের বহু অঞ্চলের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যত
কেমন হবে ভবিষ্যতের ট্রাফিক ব্যবস্থা? সেটা অনুমান করতে গেলে আগে ভেবে দেখতে হবে ভবিষ্যতের যানবাহনগুলো কেমন হতে পারে। এ বিষয়ে সম্ভবত কেউই দ্বিমত করবে না যে, দূর ভবিষ্যতের যানবাহনগুলো হবে চালকবিহীন।
মানুষ অনেক সময় ট্রাফিক আইন মানতে না চাইলেও যন্ত্র কখনো নিয়মের বাত্যয় করবে না, যন্ত্র মানুষের মতো ভুলও করবে না, আবার যেকোনো আকস্মিক পরিস্থিতিতে যন্ত্র মানুষের চেয়ে দশগুণ দ্রুত রেসপন্স করে দুর্ঘটনা রোধ করতে পারবে। সেজন্য দিন দিন চালকবিহীন গাড়ির সংখ্যাও বাড়তে থাকবে এবং একসময় গাড়ির জন্য কোনো চালকই প্রয়োজন হবে না।
যদি একসময় সকল গাড়িই চালকবিহীন হয়ে পড়ে, তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থা তার কার্যক্ষমতা পুরোপুরি প্রয়োগ করতে পারবে। কারণ, মানুষ চালিত যানবাহনগুলোর গতিবিধি ও গন্তব্য অনিশ্চিত। কিন্তু চালকবিহীন গাড়িগুলো নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম অনুসারে চলবে, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গাড়িগুলোর সাথে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করে শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে সেগুলোর গতিবিধি ও গন্তব্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারবে এবং প্রতিমুহূর্তে তাদের অবস্থান সম্পর্কে আপডেট জানতে পারবে। আবার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজনে খুব কম সময়ের মধ্যে সেসব চালকবিহীন গাড়িগুলোকে তাদের যাত্রাপথ বা গতি পরিবর্তন করার নির্দেশ দিয়ে যানজট রোধে ভূমিকা রাখতে পারবে। অর্থাৎ বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই একপ্রকার গাড়িগুলোকে নিয়ন্ত্রণই করবে। এমন একটি ব্যবস্থাতে সম্ভবত যানজট বলে কিছু থাকবেই না!
তবে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে, সামনের অন্তত দুই দশকের মধ্যেই সকল যানবাহন চালকবিহীন হয়ে যাবে না। তবে সামনের বছরগুলোতে রাস্তায় নতুন নতুন চালকবিহীন গাড়ি নামতে থাকবে এবং রাস্তায় একইসাথে মনুষ্যচালিত যানবাহন ও চালকবিহীন গাড়ির সমাহার দেখা যাবে। এতে করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে সেটার সমাধানও মিলবে।
আরেকটি বিষয় সহজেই অনুমান করা যায় যে, ভবিষ্যতের বাহনগুলো, এমনকি মনুষ্যচালিত গাড়িগুলোতেও উন্নত নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা থাকবে, যেন গাড়িগুলো ট্রাফিক ব্যবস্থার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে পারে।
কিছু আশংকা ও সতর্কতা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বহু প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে আশংকা প্রকাশ করেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভবিষ্যতে মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে- এমন ভয় সাধারণ মানুষের মনের মধ্যেও আছে। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে খুব বেশি ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। ফলে এক্ষেত্রে ভয়ের অবকাশ থাকছে না।
আরেকটি ভাবনার বিষয় হচ্ছে, যন্ত্রের উপর ঠিক কতটা আস্থা রাখা যায়? এটি একটি তাত্ত্বিক ধারণা যে, যন্ত্র কখনো ভুল করবে না। হ্যাঁ, সত্যিই, যন্ত্র কখনো ‘ভুল’ করে না; তাকে যা ‘সঠিক’ বলে শেখানো হয়, সে তা-ই করে, এবং ‘নির্ভুল’ভাবেই করে। কিন্তু যন্ত্রকে একটি বিষয় বোঝাতে গিয়ে যদি কোনো একটি দিক থেকে ঘাটতি রয়ে যায়, তাহলে যন্ত্র হয়তো এমন কোনো ‘ভুল’ করবে, যে ভুলের ক্ষতি হবে অপূরণীয়। তবে এখানে দৃষ্টিভঙ্গির একটা ব্যাপার আছে। মানুষের ভুলের কারণে অনেকগুলো বড় ক্ষতি হয়ে গেলে সমাজে যতটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে, যন্ত্রের ছোটখাট একটা ‘ভুল’ই তারচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলবে। যদিও ‘ভুল’ যন্ত্রের হয় না, কারণ মানুষই যন্ত্রকে বানায় এবং শেখায়।
এছাড়াও যে ব্যাপারে সমস্যা হতে পারে, তা হলো মানুষের গোপনীয়তা। বর্তমান যুগের মানুষ নিজেদের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে সোচ্চার। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক পরিসরে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা শুরু হবে এবং মানুষ যখন জানবে, রাস্তায় তাদের গতিবিধিকে সর্বদা মনিটরিং করা হচ্ছে, তা-ও আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা, তখন মানুষ সেটাকে কীভাবে নেবে, তা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
কিন্তু যে আশংকাটি সবচেয়ে গুরুতর, তা হচ্ছে, গোটা অঞ্চলের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব এককভাবে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর অর্পণ করা হবে, কোনোভাবে যদি সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কেন্দ্রীয় কম্পিউটার ব্যবস্থাটি দুর্বৃত্ত হ্যাকারদের দ্বারা হ্যাকিংয়ের শিকার হয়, তাহলে এর ফলাফল হতে পারে সুদূরপ্রসারী ও কল্পনাতীত ভয়াবহ। কারণ, শুধুমাত্র ট্রাফিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ হাতে পেলে এর মাধ্যমে কোনো অপরাধী চক্র ভয়ানক ও ব্যাপক মাত্রার অপরাধ সংঘটিত করতে পারবে।
আশার কথা হচ্ছে, এসব সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে আমরা যতটা উদ্বিগ্ন, তারচেয়েও বেশি চিন্তিত প্রযুক্তিবিদেরা, যারা এ প্রযুক্তিকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করার দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন। তারা নিশ্চয়ই এসব আশংকার একটা বিহিত করে প্রযুক্তিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন।
আমরা সবসময়ই দেখে এসেছি, কোনো প্রযুক্তিগত আইডিয়ার কথা একবার হলেও উচ্চারিত হয়েছে, তা আজ হোক বা কাল, বাস্তবায়িত হবেই। তাই আমরা আশায় থাকতেই পারি, হয়তো আমাদের জীবদ্দশাতেই আমরা যানজটমুক্ত অথচ কর্মব্যস্ত নগরী দেখে যেতে পারবো।
এই সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
২) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: প্রযুক্তি বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত