একজন মানুষ যত বেশি ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে, তার জীবনের নিরাপত্তাও আপনাআপনিই অধিক শঙ্কার মুখে পড়তে থাকে। একই কথা বলা যায় একটি রাষ্ট্রের বেলাতেও। তাই তো বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রয়েছে অত্যাধিক কড়াকড়ি। তাহলে একবার ভাবুন তো, আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে কতটা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সবসময় চলতে হয়?
ধরুন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোথাও প্লেনে করে যাচ্ছেন। আমেরিকার কোনো শত্রু ওবামাকে শেষ করে দিতে তাকে বহনকারী প্লেনের দিকে একটি বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করলো। ব্যস, সব শেষ! কিন্তু একটি দেশের রাষ্ট্রপতির জীবনের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা কি এতই সহজ? সেটা যদি আবার আমেরিকার মতো কোনো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশ হয় তাহলে তো কথাই নেই। আজ তাই আমরা গল্প করবো বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির প্রেসিডেন্টকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে উড়িয়ে নেয়া এরোপ্লেন সম্পর্কেই।
‘এয়ার ফোর্স ওয়ান’ হলো আমেরিকার প্রেসিডেন্টের চলাচলের জন্য ব্যবহৃত এয়ারক্রাফট। কোনো নির্দিষ্ট প্লেনকে এ নাম দেয়া হয় না। আমেরিকান এয়ার ফোর্সের যে প্লেনই সেই দেশের প্রেসিডেন্টকে বহন করবে, সেটিই তখন ‘এয়ার ফোর্স ওয়ান’ খেতাবধারী হবে। মূলত অন্যান্য প্লেন থেকে এ প্লেনটি যে আলাদা এটি বোঝাতেই এ কাজটি করা হয়।
বর্তমান সময়ে দুটি প্লেন রয়েছে যেগুলো এ ‘এয়ার ফোর্স ওয়ান’ খেতাবধারী। দুটোই বোয়িং 747-200B জেট। প্লেনদুটোর ডেজিগনেশন হলো VC-25A এবং তাদের টেইল নাম্বার SAM-28,000 ও SAM-29,000। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বিশেষ প্লেনের ভেতরে ঢোকার আগে চলুন তার প্লেনের গঠন সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক।
• প্রতিটি প্লেনই ৬৪ ফুট উঁচু।
• কেবিন স্পেস ৪০০০ স্কয়ার ফুট করে।
• প্রত্যেক প্লেনে জেনারেল ইলেকট্রিকের CF6-80C2B1 মডেলের জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়।
• প্রতিটি প্লেনের ওজন প্রায় ৮,৩৩,০০০ পাউন্ড।
• ঘন্টায় ৬৩০-৭০০ মাইল বেগে উড়ে যেতে পারে এরা।
• সর্বোচ্চ ৪৫,১০০ ফুট উঁচু দিয়ে সক্ষম প্লেনগুলো।
• ফুয়েল ট্যাঙ্ক ভর্তি থাকলে এরা অর্ধেক পৃথিবী একবারে ঘুরে আসতে সক্ষম।
কেবল এসব বৈশিষ্ট্য থাকলে অবশ্য এয়ার ফোর্স ওয়ানকে নিয়ে লিখতে বসতাম না। কারণ এর আসল বৈশিষ্ট্যের এখনো কিছুই বলিনি। এয়ার ফোর্স ওয়ানের মূল আকর্ষণ লুকিয়ে আছে এর ভেতরে প্রতিটি অংশজুড়ে।
এ কথা সত্য যে, এয়ার ফোর্স ওয়ান কোনোদিনই তার পুরো অবকাঠামোর তথ্য বিশ্বের জনগণের কাছে উন্মুক্ত করে দিবে না। নিজস্ব নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলে এটা কেউই করবে না। এমনকি সেখানে যেসব রাজনীতিবিদ আর সাংবাদিকরা বিভিন্ন কাজে যান তারাও পুরো প্লেন ঘুরে দেখার অনুমতি পান না! তাই এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য জানা গেছে তা বিভিন্ন সময়ে পাওয়া অফিসিয়াল-আনঅফিসিয়াল তথ্যের সম্মিলিত রুপ মাত্র।
অন্তর্জাল ঘেঁটে পাওয়া গুচ্ছ গুচ্ছ তথ্যগুলোকে একত্রিত করেই সাজানো হয়েছে এ লেখাটি। তাহলে আর দেরি কেন? চলুন একবার ঘুরে আসা যাক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আর জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো লোকদের ব্যবহার করা এরোপ্লেনের ভেতর থেকেই।
- সাধারণ জাম্বো জেটগুলোতে সাধারণত ৪০০ এর মতো যাত্রী থাকে, সেই সাথে থাকে অনেকজন ক্রু। কিন্তু এয়ার ফোর্স ওয়ানের একটি প্লেনে সর্বোচ্চ ৭০ জন যাত্রী থাকতে পারবে। আর সাথে থাকবে ২৬ জন ক্রু।
- জটিল কমিউনিকেশন ও ডিফেন্স সিস্টেমের জন্য এর ওয়্যারিংয়ের পরিমাণ সাধারণ জাম্বো জেটের তুলনায় দ্বিগুণ- প্রায় ২৩৮ মাইল! পারমাণবিক বোমের বিষ্ফোরণেও যাতে কোনো ক্ষতি না হয় এমনভাবেই সুরক্ষিত এর ওয়্যারিং সিস্টেম
- অবধারিতভাবেই প্লেনটির রয়েছে নিজস্ব চিকিৎসা সুবিধা। নিজস্ব বিশাল ফার্মেসি, ইমার্জেন্সি রুমের যন্ত্রপাতি আর ভাঁজ করা যায় এমন অপারেশন টেবিল নিয়েই পাখির মতো আকাশের বুকে উড়ে বেড়ায় প্লেনটি। প্রেসিডেন্ট যেখানেই যান, সেখানেই তার সাথে থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দল।
- পুরো এয়ারক্রাফটটি ৩টি লেভেলে ভাগ করা হয়েছে। একেবারে উপরের লেভেলে আছে জটিল জটিল সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি। কমিউনিকেশন সেন্টারও আছে এখানেই যেখানে আছে ৮৭টি টেলিফোন, ফ্যাক্স, ডজনখানেক রেডিও ও কম্পিউটার। সেই সাথে আছে ১৯টি টিভি। মাঝের লেভেলটি যাত্রীদের জন্য। সেখানে আছে গ্যালি, মেডিকেল সেন্টার ও প্রেসিডেন্টের নিজস্ব বাসস্থান। সেখানে রয়েছে বেডরুম, বাথরুম, ব্যায়ামাগার ও অফিস। আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের এমনও বলতে শোনা গেছে যে, তারা নাকি ভূপৃষ্ঠের চেয়ে এয়ার ফোর্স ওয়ানে চড়েই বেশি প্রাইভেসি খুঁজে পান! নিচের লেভেলটি রাখা কার্গো স্পেসের জন্য। সেখানে আছে অনেকগুলো ফ্রিজ, যেখানে ২০০০ বেলার অধিক (সকাল, দুপুর, বিকাল মানে তিন বেলা) খাবার সংরক্ষিত থাকে।
- প্লেনের ক্রুদের সবাই বিশেষভাবে পরীক্ষিত সামরিক বাহিনীর সদস্য যাদের সবার অতীতের রেকর্ড দৃষ্টান্তমূলক। যখন কোনো খাবার কেনার দরকার পড়ে, তখন তারা সাধারণ বেশে বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরে পছন্দমতো খাবার কিনেন যাতে নির্দিষ্ট কোনো খাবারে শত্রুপক্ষের কেউ বিষ মেশাতে না পারে।
- প্লেনদুটির সামনে এবং পেছনে নিজেদেরই গুটিয়ে নেয়ার মতো সিঁড়ি আছে যাতে স্থানীয় এয়ারপোর্টের জন্য অপেক্ষা করা না লাগে।
- ফুয়েল ট্যাংক আর ইঞ্জিনগুলো প্লেনটির সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর স্থান। এখানে চারটি ইঞ্জিন আছে। আর ফুয়েল ট্যাংকগুলো ২,০০,০০০ লিটার ফুয়েল ধারণে সক্ষম। এগুলোকে তাই ইনফ্রারেড ইউনিট দিয়ে সজ্জিত করা আছে যাতে তারা কোনো বুলেট অথবা মিসাইলকে দূর থেকেই শনাক্ত করতে পারে। সেই সাথে পাখার নিচে আছে ফ্লেয়ার যা শত্রুপক্ষের মিসাইলের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম।
- ছাদের ঠিক নিচেই আছে ইলেকট্রনিক কাউন্টারমিজার ডিফেন্স সিস্টেম যা শত্রুপক্ষের রাডারও জ্যাম করে দিতে সক্ষম
- পাখার নিচে থাকা মিরর-বল ডিফেন্স টেকনোলজি মিসাইলের ইনফ্রারেড গাইডেন্স সিস্টেমেও তালগোল পাকিয়ে দিতে সক্ষম।
- প্লেনটির অন্যতম বড় সুবিধা হলো আকাশে থাকা অবস্থায় যদি কোনো কারণে জ্বালানী ফুরিয়ে আসে তবে আকাশেই সেটি রিফুয়েলিং করিয়ে নিতে সক্ষম।
- প্রেসিডেন্টের জীবন বাঁচাতে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা সবসময় প্রেসিডেন্টের স্যুটের কাছাকাছিই লুকিয়ে থাকেন।
- প্লেনের ‘Situation Room’ এ প্লাজমা টিভির সাহায্যে পরিচালনা করা হয় বিভিন্ন টেলিকনফারেন্স।
- প্লেনের ৮৭টি টেলিফোন কিন্তু দু’ধরণের। বাদামী রঙের টেলিফোনগুলো সিকিউর লাইনের। অন্যদিকে সাদা রঙের টেলিফোনগুলো আনক্লাসিফাইড।
এতক্ষণ ধরে যে প্লেনের কথা বলে গেলাম, তাকে কিন্তু Flying White House-ও বলে। আর বলা হবেই না বা কেন? সে তো যেন আস্ত হোয়াইট হাউজকেই বুকে নিয়ে উড়ে বেড়ায় সগর্বে।