পৃথিবী ধীরে ধীরে মুঠোফোনের হাতে বন্দী হয়ে যাচ্ছে। আগে যেসব কাজ করতে বড় কম্পিউটার (অন্তত একটি ল্যাপটপ) লাগত, সেগুলো এখন খুব সহজেই ট্যাবলেট কম্পিউটার এমনকি মোবাইলেই করে ফেলা যায়। মোবাইলেই শক্তিশালী প্রসেসর ও মেমরি থাকছে। কিন্তু সবকিছুর পরও মোবাইল ফোনের একটা বড় সীমাবদ্ধতা এর আকার। এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার একটা বড় উপায় হলো ভালো হার্ডওয়্যারের সাথে চিন্তাশীল ডিজাইনের সফটওয়্যার দেওয়া। মোবাইলের অপারেটিং সিস্টেম যতটা সুন্দর করে ডিজাইন করা হবে, তার কার্যক্ষমতা তত ভালো হবে, সেই সাথে ব্যবহারের আরামও বাড়বে। অ্যাপলের আইফোন মোবাইল বাজারে খুবই জনপ্রিয়। তাদের যন্ত্রাংশ ও সফটওয়্যার একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্য—একটি ছাড়া আরেকটি কাজ করবে না।
এজন্য অ্যাপলের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম আইওএস পেতে চাইলে অ্যাপলের পণ্য কেনার কোনো বিকল্প নেই। মোবাইলের আরেক জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেমের নাম অ্যান্ড্রয়েড।
বাস্তবিক অ্যান্ড্রয়েড পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী সংখ্যক যন্ত্রে ইনস্টল হওয়া অপারেটিং সিস্টেম। গুগলের পণ্য অ্যান্ড্রয়েডের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। নিজস্ব কিছু পণ্য বাদে গুগল প্রায় পুরো অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমটি মুক্ত সফটওয়্যার হিসেবে ডেভেলপ করে থাকে। যেকোনো বড় রিলিজের সাথে সাথেই সোর্স কোড প্রকাশ করা হয়। এতে করে বিভিন্ন ডিভাইস নির্মাতা সেই সোর্স নিয়ে নিজেদের যন্ত্রাংশের জন্য প্রয়োজনমাফিক পরিবর্তন এনে বাজারে ছাড়তে পারেন। এভাবেই অ্যান্ড্রয়েড পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম হয়ে উঠেছে।
শুরুতে যে ব্যবহারের আরামের কথা বলা হয়েছে, সেটা নিয়ে ডেভেলপারদের আপ্রাণ প্রচেষ্টার ছাপ এই পর্যায়ে চোখে পড়ে। প্রত্যেক ডিভাইস নির্মাতা তাদের পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে প্রচুর পরিবর্তন আনে। একটি স্যামসাং মোবাইল আর একটি হুয়াওয়ে মোবাইলের ‘ইন্টারফেস’ এতটাই আলাদা যে আদতে তাদের ভেতরের অপারেটিং সিস্টেমটা যে এক, সেটা বিশ্বাস করা শক্ত। গুগল যেভাবে অ্যান্ড্রয়েড বানায় ঠিক সেরকমটা পাওয়া যায় গুগলের নিজেদের মোবাইল এবং ট্যাবলেটে (নেক্সাস ও পিক্সেল ডিভাইসে)। কিন্তু এগুলো সবই ডিভাইস নির্মাতাদের দিয়ে দেওয়া অপারেটিং সিস্টেম। যদি ভালো লাগে, তো ভালো। না লাগলে কী করা? এই প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে যাকে গণমানুষ পর্যায়ে বলা হয় ‘কাস্টম রম’।
বিকল্প কিছু
যেহেতু অ্যান্ড্রয়েডের সোর্স কোড মুক্ত, তাই যে কেউ চাইলে সেটা ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে ‘কম্পাইল’ করতে পারে, মানে সেটাকে সরাসরি ফোনে ব্যবহার করার একটা আকারে নিয়ে আসতে পারে। যে ফোনে যেমন দরকার, সেরকম উপযুক্ত ডিভাইস ড্রাইভার জুড়ে দিয়ে পুরোপুরি ব্যবহারযোগ্য একটা অপারেটিং সিস্টেমই গড়ে তুলতে পারে। এগুলোকে বলা হয় ‘ফার্মওয়্যার রিপ্লেসমেন্ট’। অ্যান্ড্রয়েড ছাড়াও আইপড সহ বিভিন্ন বহনযোগ্য গান শোনার যন্ত্রে অফিশিয়াল অপারেটিং সিস্টেম বা ফার্মওয়্যার সরিয়ে নিজস্ব সফটওয়্যার দেবার চমৎকার একটি প্রজেক্টের নাম রকবক্স। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের যন্ত্রে প্রচুর অ্যাপ্লিকেশন বা ‘অ্যাপ দিয়ে দেওয়া হয় যেগুলো আপনার কোনোদিন কাজে লাগবে না। স্বাভাবিক উপায়ে এগুলো ফোন বা ট্যাবলেট থেকে সরানোও সম্ভব নয়।
এর চাইতেও খারাপ ব্যাপার হলো কিছু কিছু ডিভাইস নির্মাতা তাদের অপারেটিং সিস্টেমে বিজ্ঞাপন, ক্ষতিকর অ্যাপ, এমনকি নজরদারির কলকব্জা ঢুকিয়ে দিয়ে রাখে। উন্মুক্ত সোর্স কোডের ফার্মওয়্যার রিপ্লেসমেন্ট বা কাস্টম রমে এগুলো থাকে না। স্বাধীনভাবে যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কাস্টম রম নিয়ে শুরুর দিকে ডিভাইস নির্মাতারা আশঙ্কা প্রকাশ করলেও এগুলোর জনপ্রিয়তার কারণে শিথিল অবস্থানে আসে তারা। মুক্তভাবে গড়ে ওঠা বেশ ক’টি জনপ্রিয় কাস্টম রম রয়েছে, যার ভেতর সায়ানোজেনমড (বন্ধ হয়ে যাবার পর লিনিয়েজওএস নামে আলাদাভাবে চালু করা হয়েছে) সবচেয়ে জনপ্রিয়। ২০১৫ সালে পাঁচ কোটির কাছাকাছি মানুষের ফোনে সায়ানোজেনমড ইনস্টল করা হয়েছে। এছাড়া প্যারানয়েড অ্যান্ড্রয়েড, এওকেপি, ডার্টি ইউনিকর্ন, রেসারেকশন রিমিক্স ইত্যাদি কয়েকটি জনপ্রিয় কাস্টম রমের নাম। কাস্টম রম কিছু বাড়তি সুবিধা দেয় যেগুলো ডিভাইস নির্মাতাদের দেওয়া অপারেটিং সিস্টেমে থাকে না।
হাতে-কলমে
ব্যক্তিগত কথা বলি। গান শোনার ব্যাপারে আমি একটু খুঁতখুঁতে। এমপিথ্রি ফরম্যাট যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলি (এমপিথ্রিতে গানের অনেক কিছু হারিয়ে যায়)। সম্প্রতি একটি এইচটিসি মোবাইল আমার হাতে আসে। সেটা ভর্তি এইচটিসির প্রোপ্রাইটারি অ্যাপ। সবচেয়ে বড় সমস্যা কোনো এক কারণে অপারেটিং সিস্টেম আপডেট হচ্ছিল না। সাহস করে লিনিয়েজওএস সেটায় ইনস্টল দিয়ে দিলাম। তারপর থেকে মোবাইলটা ব্যবহারের অভিজ্ঞতাই আমূল বদলে গেছে।
এইচটিসি ঐ ফোনটিতে অ্যান্ড্রয়েডের ষষ্ঠ ভার্শনের বেশি আপডেট দেয় না। লিনিয়েজওএস দেওয়াতে আমি অ্যান্ড্রয়েড ৭.১ পেয়ে গেলাম। আরেকটি সুবিধা হলো লিনিয়েজ প্রায় কোনো পরিবর্তন ছাড়া একদম অকৃত্রিম মুক্ত সোর্স অ্যান্ড্রয়েড দিয়ে থাকে। সাধারণ লিনাক্স কার্নেল ব্যবহার না করে এতে SELinux (Security Enhanced Linux) দেওয়া, ফলে নিরাপত্তা নিয়েও আর ভাবনা নেই। গুগল সব ভাষার জন্য নোটো ফন্ট নামের একটি প্রজেক্ট চালায়, কিন্তু সাধারণত একটি ফোনে সবগুলো নোটো ফন্ট দেওয়া থাকে না, ফলে অনেক স্বল্প পরিচিতি ভাষা ফোনের পর্দায় আসে না। লিনিয়েজে অনেকগুলি নোটো ফন্ট দেওয়া (অবশ্যই বাংলা সহ)।
তবে আমার সবচেয়ে বড় লাভ হলো এখন আমি মোবাইলে Opus ফরম্যাটের গান শুনতে পাচ্ছি। এমপিথ্রি, এএসি, এমনকি ওজিজি ফর্ম্যাটের চাইতেও ওপাসের মান ভালো হয়ে থাকে। সরাসরি গুগল থেকে আসা অ্যান্ড্রয়েডে এই সুবিধাগুলি নেই।
কী করে পাবো?
যে কাস্টম রম দিতে চান, দেখে নিন আপনার মোবাইল ফোনটি সেই কাস্টম রম পুরোপুরি সমর্থন করে কি না। তারপর তাদের ওয়েবসাইট থেকে রম ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস ডাউনলোড করে সেখানে যা যা করতে বলা হয়েছে সেগুলো খুবই সাবধানে করুন। মনে রাখতে হবে, এগুলো স্বেচ্ছাসেবক পরিচালিত প্রজেক্ট, আপনার ফোনের কোনো ক্ষতির দায়ভার তারা নেবে না। সাধারণত সবকিছু নিয়ম মেনে করা হলে কোনো সমস্যা হয় না। তারপরও কী করছেন সেটা ভালোভাবে বুঝে নেবেন, প্রয়োজনে অভিজ্ঞ কারও পরামর্শ নেবেন। সবার আগে মোবাইলে যতকিছুর সম্ভব ব্যাকআপ রেখে দেবেন। মূল প্রক্রিয়াটা হল একটা রিকভারি বুটলোডার ইনস্টল দিতে হয়, তার জন্য সাধারণত মোবাইলে রুট অ্যাক্সেস যোগ করতে হয়। বাকি কাজটা সহজ এবং সংক্ষিপ্ত।
বড় কম্পিউটারের সাথে মোবাইল বা ট্যাবলেটের আরেকটি পার্থক্য স্বাধীনতা। কম্পিউটারে চাইলেই যেকোনো অপারেটিং সিস্টেম ইনস্টল করে ফেলা যায়। অ্যাপলের পণ্যে সেটা সম্ভব নয়। অ্যান্ড্রয়েডের ক্ষেত্রে সেই সীমাবদ্ধতাটি অন্তত কিছুটা হলেও কাটিয়ে তোলা সম্ভব।
ফিচার ইমেজ: soiposervices.com