ধরুন, আপনি সুন্দরবন কিংবা অ্যামাজনের মতো গহীন কোনো অরণ্যে ঘুরতে গিয়েছেন। অনেকক্ষণ বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে বেশ খানিকটা ক্লান্ত হয়ে কোথাও একটু বসে পড়লেন বিশ্রাম নেবার জন্য। তারপর আপনার পিঠে ঝোলানো ব্যাগটা থেকে রাউটার সাইজের একটা ডিভাইস বের করে সুইচ অন করলেন, এরপর স্মার্টফোন থেকে নেটফ্লিক্স ওপেন করে আপনার পছন্দের ওয়েব সিরিজের একটা এপিসোড দেখা শুরু করলেন, তা-ও আবার একদম 4K রেজল্যুশনে, কোনো বাফারিং ছাড়াই!
অথবা ধরুন, ৫-৬ বছর আগে আপনি নিউজপেপারে পড়েছিলেন, ইন্টারনেট স্পিডের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের অবস্থান র্যাংকিংয়ের তলানির দিকে। মনে মনে কত আফসোস করতেন, ‘ইশ! যদি আমেরিকা কিংবা কোরিয়া-চীনের মতো আমার বাসার ইন্টারনেট কানেকশনটাও অত ফাস্ট হতো!’ অথচ, আজ আপনি অজ পাড়া-গ্রামে কিংবা গহীন জঙ্গলের ভিতরে থেকেও নিউ ইয়র্ক-সাংহাইয়ে থাকা একজন মানুষের সমান ইন্টারনেট স্পিড পেয়ে যাচ্ছেন!
কী? অবাক লাগছে? মনে হচ্ছে কোনো সায়েন্স-ফিকশন মুভির গল্প বলছি? উহু, গল্প নয়, একেবারে সত্যি!
আজ থেকে ৪-৫ বছর পর এই গল্পগুলোই আমাদের নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়ে যাবে। আর সেটা সম্ভব হবে স্টারলিংকের মতো লো-অরবিট স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটির কারণে।
লো-অরবিট স্যাটেলাইট এবং স্টারলিংক
স্যাটেলাইট বলতে আমরা সাধারণত জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইটকে বুঝে থাকি। এ ধরনের স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫,৮০০ কিলোমিটার উপরে স্থির থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
বর্তমানে এসব জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট ব্যবহার করেই অনেক কোম্পানি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা প্রদান করছে। তবে এগুলোর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অপরদিকে, লো-অরবিট স্যাটেলাইট হলো এমন একধরনের স্যাটেলাইট, যেগুলো জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইটের মতো অত উপরে না থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠের অনেকটা কাছাকাছি থাকে, এবং এই স্যাটেলাইটগুলো একটা জায়গায় স্থির না থেকে অনবরত দ্রুতগতিতে স্থান পরিবর্তন করে। স্টারলিংক বা এর মতো প্রজেক্টগুলোর জন্য এই লো-অরবিট স্যাটেলাইটই ব্যবহার করা হবে। লো-অরবিট স্যাটেলাইট ব্যবহারের কারণে জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইটের সমস্ত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে একে ভবিষ্যতের ব্রডব্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর হবে।
বর্তমানে লো-আরবিট স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটির লক্ষ্যে অনেকগুলো প্রজেক্ট এর কাজ চলছে- যেগুলোর তত্ত্বাবধানে আছে বিশ্বের বাঘা বাঘা সব টেক-কোম্পানি। যেমন:
আজকে আমরা কথা বলবো বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা টেক-আইকন এলন মাস্কের ‘প্রজেক্ট স্টারলিংক’ নিয়ে।
ইতোমধ্যেই আপনারা জেনে গিয়েছেন, ‘স্টারলিংক’ আসলে কী। এটিও অন্য প্রজেক্টগুলোর মতোই একটা লো-অরবিট স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড প্রজেক্ট। স্টারলিংকের উদ্দেশ্য হলো, বিশ্বব্যাপী লো-কস্ট হাই-স্পিড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদান নিশ্চিত করা।
এখন আপনি বলতেই পারেন, ইতোমধ্যে আমাদের বিশ্বব্যাপী ফাইবার-অপটিক ক্যাবল নেটওয়ার্ক আছে। এছাড়াও কিছুদিন পর ফাইভ-জির মতো অ্যাডভান্সড হাই স্পিড মোবাইল নেটওয়ার্ক চলে আসবে, যার মাধ্যমে আনলিমিটেড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট দেয়াও সম্ভব হবে! তাহলে এই স্টারলিংক এর দরকারটা কী?
স্টারলিংকের উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয়তা
আপনি যদি ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ কনসেপ্টের সাথে পরিচিত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি এই প্রজেক্টের আসল উদ্দেশ্য এবং গুরুত্ব বুঝতে পারবেন।
একদম সহজভাবে যদি বলা হয়, গ্রামে বাস করা একজন মানুষ শহরে বাস করা একজন মানুষের মতো ডিজিটাল সুবিধাগুলো পায় না। ঢাকা শহরে বাস করা একজন মানুষ যত সহজে ডিজিটাল ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক কাজ করে ফেলতে পারে, অনেক সুবিধা গ্রহণ করতে পারে, রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকায় থাকা মানুষগুলো কিন্তু তার কিছুই পায় না। ফলে তারা এই দ্রুত বিকশিত ডিজিটাল দুনিয়া থেকে অনেক দূরে থাকে, পিছিয়ে পড়ে।
কিংবা ধরুন, ঢাকা শহরে ইন্টারনেট যতটা সহজলভ্য এবং সস্তা, পঞ্চগড় শহরে মোটেই ততটা সহজলভ্য এবং সস্তা নয়। আবার একই এলাকার একজন মানুষের কাছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট হয়তো ডাল-ভাত, কিন্তু অন্য একজনের কাছে সেটা একরকম বিলাসিতা!
আবার, ব্যাপকভাবে চিন্তা করে দেখুন, আমেরিকা-চীনে ইন্টারনেট ইনফ্রাস্ট্রাকচার যেরকম, বাংলাদেশে কিন্তু সেরকম উন্নত, অ্যাডভান্সড এবং সহজলভ্য নয়।
এসব কারণেই ইন্টারনেট সর্বজনীন এবং বর্তমান দুনিয়ার অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া সত্ত্বেও স্থানভেদে মানুষ এর সুবিধাগুলো সমানভাবে নিতে ও এর দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় ‘ডিজিটাল ডিভাইড’।
এখনো পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অপটিক্যাল ফাইবার কিংবা মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে সহজলভ্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা অত্যন্ত কঠিন, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল একটি কাজ। আর তাই স্টারলিংকের মতো প্রজেক্টগুলো বাস্তুবায়ন করা হচ্ছে গোটা পৃথিবীব্যাপী সর্বজনীন ইন্টারনেট সেবা প্রদান করার লক্ষ্যে। যার মাধ্যমে নিউ ইয়র্কে বসবাস করা একজন মানুষ এবং রাঙামাটির পাহাড়ী এলাকার একজন মানুষ উভয়ই সমান ইন্টারনেট সুবিধা ভোগ করতে সক্ষম হবে।
আরো কিছু আছে কি?
অবশ্যই স্টারলিংকের উদ্দেশ্য কেবল গ্লোবাল কানেক্টিভিটি নয়। একইসাথে হাই-স্পিড, লো-ল্যাটেন্সি, নেক্সট-লেভেল ইন্টারনেট কানেকটিভিটি নিশ্চিত করাও এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। যার ফলে স্টারলিঙ্ক সরাসরি কম্পিট করবে বর্তমানের অপটিক্যাল ফাইবার কানেক্টিভিটির সাথে, এবং একসময় হয়তো একে বিলুপ্ত করেও ফেলতে পারে!
SpaceX-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও এলন মাস্ক আশা করেন, স্কাইনেট-এর মাধ্যমে গিগাবিট স্পিডে ডেটা ট্রান্সফার করা সম্ভব হবে, এবং এর ল্যাটেন্সি হবে অনেক কম। শুরুর দিকে স্কাইনেটের ল্যাটেন্সি হবে ২৫ মিলিসেকেন্ডের আশেপাশে, এবং পরবর্তীতে সেটা ১০ মিলিসেকেন্ড কিংবা তারও নিচে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বর্তমানের ইন্টারনেট ব্যবস্থায় ল্যাটেন্সি (latency/Ping) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে, এবং ভবিষ্যতে লো-ল্যাটেন্সি হাই-স্পিড ইন্টারনেট একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা হিসেবে দেখা দেবে।
সবই নাহয় বোঝা গেল, কিন্তু এই ল্যাটেন্সি ব্যাপারটা আসলে কী?
ল্যাটেন্সি হচ্ছে মূলত একটি কম্পিউটার আরেকটি কম্পিউটারের সাথে কত দ্রুত সংযুক্ত হতে পারছে, কিংবা কত দ্রুত একে অপরকে রেসপন্স করতে পারছে, তার একটা পরিমাপ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ল্যাটেন্সি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ধরুন, আপনি অনলাইনে মাল্টি-প্লেয়ারে আপনার বন্ধুর সাথে গোলাগুলির কোনো গেম খেলছেন। আপনার ইন্টারনেট স্পিড যথেষ্ট ভালো, কিন্তু লেটেন্সি অনেক বেশি। তো এক্ষেত্রে যেটা হবে, হয়তো আপনি আপনার শত্রুকে দেখামাত্রই গুলি করলেন, কিন্তু আপনার ইন্টারনেট কানেকশনের যেহেতু ল্যাটেন্সি বেশি, তাই আপনার গুলি করার নির্দেশটা সার্ভারে গিয়ে পৌঁছাতে কিছু সময় লাগবে। আর এই সময়টুকুর মাঝেই হয়তো আপনার শত্রু সরে গিয়ে আপনাকেই গুলি করে বসে আছে! জেতার কথা ছিল আপনার,অথচ আপনিই হেরে বসে আছেন!
বোঝা গেল কি বিষয়টা? এরকম শুধু গেমের ক্ষেত্রেই না, আরো অনেক অনেক ক্ষেত্রেই ল্যাটেন্সি অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়।
অনলাইন গেমিং (যেটার ভবিষ্যতে মারাত্মক রকমের চাহিদা এবং বাজার সৃষ্টি হবে), স্টক এক্সচেঞ্জ, লাইভ স্ট্রিমিং ইত্যাদি বিষয়গুলোতে ল্যাটেন্সি অনেক মেজর এবং ক্রিটিক্যাল একটা ইস্যু। এছাড়াও, ভবিষ্যতে আইওটির মতো রেভল্যুশনারি টেকনোলজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও নিরবচ্ছিন্ন লো-ল্যাটেন্সি হাই-স্পিড ইন্টারনেট অবশ্যই প্রয়োজন হবে।
তাই স্টারলিংকের মাধ্যমে হাই-স্পিডের পাশাপাশি লো-ল্যাটেন্সি ইন্টারনেটও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আর এত কিছুর পরও স্টারলিংক হবে সস্তা, সহজলভ্য এবং ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি। তথা, ইন্টারনেট হবে সর্বজনীন!
কীভাবে কাজ করবে স্টারলিংক?
আগেই বলা হয়েছে, নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্টারলিংক লো-অরবিট স্যাটেলাইট ব্যবহার করবে। কিন্তু কেন এই লো-অরবিট স্যাটেলাইট ব্যবহার? জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইটে সমস্যাই বা কী?
জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। এ কারণে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কোনো তথ্য আদান-প্রদান করতে হলে অনেক দূর পথ অতিক্রম করতে হয়। এর ফলে স্পিড তো কম হয়ই, সাথে ল্যাটেন্সিও হয় অনেক বেশি। যার ফলে এই স্যাটেলাইট ইন্টারনেটগুলো জনপ্রিয় কিংবা সুবিধাজনক হতে পারেনি কখনোই, ফিউচার হওয়া তো দূরের কথা!
অন্যদিকে, লো-অরবিট স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫০০-১,০০০ কিলোমিটার উপরে থাকে, যেখানে জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট থাকে ৩৪,০০০ কিলোমিটার উপরে! পৃথিবীপৃষ্ঠের অত্যন্ত কাছাকাছি অবস্থান করার কারণে এই স্যাটেলাইটগুলো দিয়ে অত্যন্ত দ্রতগতিতে ডেটা আদান-প্রদান করা সম্ভব হয়। এবং কাছাকাছি অবস্থানের কারনে ল্যাটেন্সিও হয় অনেক কম।
আমরা বর্তমানে যে ফাইবার অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করি, তাতে আলোক-সংকেত ব্যবহার করে ডেটা আদান-প্রদান করা হয়। কিন্তু অপটিক্যাল ফাইবারে আলোকে গ্লাস মিডিয়ামের ভেতর দিয়ে যেতে হয় বলে আলোর গতি প্রায় ৪০% পর্যন্ত কমে যায়। লো-অরবিট স্যাটেলাইটগুলো একে অপরের সাথে যোগাযোগ এবং ডেটা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে লেজার-লাইট ব্যবহার করবে। যেহেতু এক্ষেত্রে আলোকে গ্লাসের বদলে বাতাসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তাই আলোর গতি কমে যায় না। আলো তার পূর্ণ গতিতে চলতে পারার কারণে ডেটা আদান-প্রদানের স্পিডও বেশি হয়।
তবে লো-অরবিট স্যাটেলাইটগুলো অনবরত দ্রুতগতিতে চলার কারণে এদেরকে নির্দিষ্ট একটা হিসাব-নিকাশ করে সাজানো হয়, যেন এরা একে অপরের সাথে সংঘর্ষ ঘটাতে না পারে। স্টারলিংক প্রজেক্টে প্রায় ১২,০০০ এর মতো স্যাটেলাইট ব্যবহার করার কথা। তাহলে বুঝুন, কাজটা ঠিক কতটা জটিল!
তবে এটাই একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। প্রশ্ন উঠেছিল, এত সংখ্যক স্যাটেলাইটের কারণে বিজ্ঞানীদের মহাকাশ পর্যবেক্ষণে এবং অন্যান্য স্যাটেলাইট ও রেডিও সংকেত আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা হবে। তবে স্পেসএক্স জানিয়েছে, স্টারলিংকের কারণে এ ধরণের কোনো সমস্যা হবে না, এবং তারা সম্ভাব্য সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কাজ করছে।
স্পেসএক্স কি পারবে চ্যালেঞ্জগুলো পার করতে? সব সমস্যার সমাধান করে স্টারলিংক কি সফল হবে? পৃথিবী কি সত্যিই তার ভবিষ্যতের ব্রডব্যান্ড পাবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুটা সময়। আশা করি, স্টারলিংক সফল হবে। পৃথিবী পাবে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত সত্যিকারের ‘ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব’।