এডোবির ইতিহাস: গ্রাফিক দুনিয়াকে বদলে দেওয়ার গল্প

প্রযুক্তি কিংবা কম্পিউটিং ডিভাইসের সাথে সম্পর্কযুক্ত এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যে কিনা এডোবি’র নাম শোনেনি। মহল্লার ছোট কম্পিউটারের দোকান থেকে শুরু করে বিশাল যত স্টুডিও সবখানেই এডোবির সফটওয়্যার যেন অত্যাবশ্যক। ফটোশপ থেকে শুরু করে পিডিএফ, ইলাস্ট্রেটর, প্রিমিয়ার প্রো সহ এডোবির নানারকম সফটওয়্যার দিয়ে টেক ইন্ডাস্ট্রির একটি বিশাল অংশ পরিচালিত হচ্ছে। আজ এডোবির হেডকোয়ার্টারের পরিমাপ ৯,৮০,৯৫৩ বর্গফুট হলেও শুরুটা হয়েছিল একটি সাধারণ গ্যারেজ থেকে। 

এডোবির শুরু

১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে জন ওয়ারনক এবং চার্লস গেশকির হাত ধরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এডোবি ইনকর্প। পূর্বে তারা দুজনই কাজ করতেন Xerox Parc কোম্পানিতে। অনেকের কাছে Xerox Parc নামটি পরিচিত লাগতে পারে। কারণ হচ্ছে এরাই প্রথম গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস আবিষ্কার এবং আধুনিক মডার্ন কম্পিউটারের নকশা প্রণয়ন করে। জন এবং গেশকি একটি কি প্রিন্টিং (Key Printing) প্রযুক্তির উদ্ভব করেন এবং এ সম্পর্কে Xerox কে অবগত করেন। কিন্তু জেরক্স তাদের এই প্রযুক্তিকে পাত্তা না দিলে তারা কোম্পানি থেকে বের হয়ে যান এবং এডোবি প্রতিষ্ঠা করেন।

অনেকের প্রশ্ন জাগতে পারে কোম্পানিটির নাম এডোবি হলো কীভাবে? এর উত্তর অনেকটা সরলই বলা যায়। জনের বাসার পিছনে একটি নালা ছিল, যার নাম ছিলো এডোবি। সেখানে থেকেই এই নাম। এডোবির লোগো ডিজাইন করেছিলেন জনের স্ত্রী মারভা ওয়ারনক।

চার্লস এবং গেশকি; Image Source: Nationalmedals.org

ওয়ারনক এবং গেশকি তাদের প্রিন্টিং প্রযুক্তির নাম দিয়েছিলেন পোস্টস্ক্রিপ্ট (Postscript), যা এখন পর্যন্ত প্রিন্টারের প্রিন্টিং স্ট্যান্ডার্ড। তবে এটি ছিল একটি বিশাল সৃষ্টি। তখনকার দিনে প্রচলিত ছিল ডট ম্যাট্রিক্স (Dot-Matrix) প্রিন্টার। সাধারণত ক্যালকুলেটরের স্ক্রিনে যেমন লেখা দেখা যায় অনেকটা তেমনই প্রিন্ট হতো এই প্রিন্টারগুলো দিয়ে। ডট ম্যাট্রিক্সের বড় সীমাবদ্ধতার মাঝে ছিল টাইপোগ্রাফি। যেহেতু সবকিছুই প্রিন্ট হতো ছোট ডটের সমন্বয়ে এ কারণে প্রিন্ট করার পর ছবি অনেকটা আজকের যুগের লো-রেজুলেশন ছবির মতো পিক্সেলেটেড বা ফেটে গিয়েছে বলে মনে হতো।

ডট ম্যাট্রিক্স প্রিন্টিং এর উদাহরণ; Image Source: Typographica

এসব সমস্যা সমাধান করতে চলে আসে লেজার প্রিন্টার, যা চালিত করার জন্য সফটওয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় পোস্টস্ক্রিপ্ট প্রযুক্তি। এই প্রিন্টারগুলো প্রিন্টিং দুনিয়াকে বদলে দিলো, মানুষ প্রথমবারের মতো পরিষ্কার এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রিন্ট করতে সক্ষম হলো। তবে তখন হাতেগোনা কিছু মানুষ ছাড়া কেউই কম্পিউটারে গ্রাফিক্সের কাজ তেমন করতো না এবং এর ফলে ওয়ারনিক-গেশকিকে অসংখ্যবার শুনতে হয়েছে যে তার ভুল পথে হাঁটছেন। তবে তারা এসব কান ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন এবং এরই কিছু পর স্টিভ জবস এডোবিকে কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

১৯৮২ সালে ৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে স্টিভ জবস এডোবিকে কিনতে চাইলে জন এবং চার্লস তার অফার প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা তাদের দুজনকে স্টিভ জবসের সাথে একটি সুরাহা করার তাগিদ দেন এবং পরবর্তীতে স্টিভ জবস কোম্পানিটির ১৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নেন। জবস পোস্টস্ক্রিপ্টের ৫ বছরের লাইসেন্স প্রথমেই কিনে নিয়েছিলেন। এই ডিলের ফলে এডোবি প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরেই মুনাফার মুখ দেখে যা সিলিকন ভ্যালির ইতিহাসে কোনো কোম্পানির প্রথম। ১৯৮৫ সাল থেকে অ্যাপল তাদের লেজার প্রিন্টারগুলোতে পোস্টস্ক্রিপ্ট ব্যবহার শুরু করে।

পোস্টস্ক্রিপ্টের পূর্বে ডিজিটাল প্রকাশনীগুলো ফটোটাইপসেটার (PhotoTypeSetter) নামক এক প্রযুক্তিতে চলতো যা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। এই ফটোটাইপসেটারগুলো তৈরি করতো সেই জেরক্স কোম্পানি। ধারণা করা হয় এজন্যই তারা পোস্টস্ক্রিপ্টের ধারণাটি নিতে চাননি। স্টিভ জবস ম্যাকিনটশ এবং পোস্টস্ক্রিপ্ট দিয়ে পাবলিশিং ইন্ডাস্ট্রিকেই বদলে ফেলেন। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা ফটোটাইপসেটার প্রযুক্তি দুই বছরের মাঝেই পোস্টস্ক্রিপ্ট দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়।

চলছে টাইপসেটিং; Image Source: KWLS.org

সফটওয়্যার জগতে প্রবেশ

১৯৮৭ সালে অ্যাপলের ম্যাকিনটশের জন্য ইলাস্ট্রেটর সফটওয়্যার দিয়ে এডোবি সফটওয়্যার জগতে প্রবেশ করে। এটি পোস্টস্ক্রিপ্টের জনপ্রিয়তা আরও তরান্বিত করে। একই বছর জন এবং থমাস নোল এই দুই ভাই ফটোশপ তৈরির কাজ শুরু করেন। থমাস তখন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন পিএইচডিরত শিক্ষার্থী, সে সময় ম্যাকিনটশে গ্রেস্কেল (greyscale) ছবি প্রদর্শন করার জন্য তিনি একটি প্রোগ্রাম লিখছিলেন। ভাই জন এই প্রোগ্রাম দেখে বললেন তিনি যেন এটিকে একটি ফটো ইডিটিং সফটওয়্যারে রূপ দেন। ভাইয়ের কথা শুনে ১৯৮৮ সালে পড়াশুনা থেকে ৬ মাসের ছুটি নিয়ে ভাইয়ের সাথে সফটওয়্যার তৈরিতে লেগে পড়েন। সফটওয়্যারটির নাম তারা প্রথমে ইমেজ প্রো দেয়ার চিন্তা করলেও পরবর্তীতে ফটোশপ নাম দেন। এ সময়ের মাঝেই জন অ্যাপল ও এডোবিকে তাদের তৈরি সফটওয়্যারটি দেখান। তারা এটি অত্যন্ত পছন্দ করেন এবং এডোবি সফটওয়্যারটি বিক্রির জন্য জন এবং থমাসের থেকে তা লাইসেন্স করে নেয়।

জন ও থমাস। ফটোশপের স্রষ্টা Image Source: Graphiclearn.com

১৯৯০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র ম্যাকিনটশের জন্য এডোবি ফটোশপ উন্মুক্ত করা হয়। শীঘ্রই এটি প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং রঙ্গিন ছবি ইডিটিংয়ের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে দাড়ায়। এটি ছিল তৎকালীন সময়ে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। যখন ফটোশপ ১.০ রিলিজ করা হয় তখন সাধারণ একটি ছবি ইডিট করিয়ে নেয়ার মূল্য ছিল প্রায় ৩০০ ডলার প্রতি ঘণ্টা!

তবে ফটোশপের দামও নেহাত কম ছিল না। প্রতি কপি লাইসেন্সের মূল্য ছিলো ৮৯৫ ডলার। তবে সেটি ছিল আজীবনের জন্য, অর্থাৎ একবার কিনলে যত খুশি ইচ্ছা ব্যবহার করা যাবে। যার ফলে এটি ছিল ডিজিটাল ইমেজ ইন্ডাস্ট্রিতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

পিডিএফের শুরু এবং চার্লসের কিডন্যাপ হওয়া

১৯৯১ সালে জন ওয়ারনক একটি ডকুমেন্ট ব্যবস্থা চালু করেন যা পরবর্তীতে পিডিএফ বা Portable Document Format হিসেবে প্রচলিত হয়। এই ফরম্যাট তৈরির উদ্দেশ্য ছিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেন সহজেই ফাইল আদান-প্রদান, দেখা এবং প্রিন্ট করা যায়। ২ বছর পর পিডিএফ পড়া এবং ব্যবহারের জন্য Adobe Acrobat Reader চালু করা হয়। তবে বর্তমানে ফ্রি হলেও তখন এটির মূল্য ছিল ৫০ ডলার। ২০০৮ সালে এটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ফ্রি না হওয়ায় পিডিএফের জনপ্রিয়তার হার খানিকটা ধীরগতির ছিল। এভাবে এডোবির সফলতার হার যেমন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল তেমনি তৈরি হচ্ছিল শত্রুতাও।

১৯৯২ সালের ২৬শে মে, সকালবেলা ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউয়ে এডোবির পার্কিং গ্যারেজে গাড়ি থেকে নামতেই দুজন সন্ত্রাসী চার্লসের দিকে বন্দুক তাক করে তাকে কিডন্যাপ করে। তারা তাকে এবং তার পরিবারকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। দুপুর ১২টা ৩০-এর দিকে কিডন্যাপাররা তার স্ত্রী ন্যানকে ফোন করে জানায় যে তার স্বামীকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। মুক্তিপণ হিসেবে ৬৫০,০০০ ডলার দাবি করে। তিনি তা না দিতে চাইলে কিংবা পুলিশে খবর দিলে তার স্বামীকে হত্যা করে তার বাড়ির সামনে রেখে আসা হবে বলে হুমকি দেয় কিডন্যাপাররা।

এরপর চার্লসের স্ত্রী ন্যান একটি পাবলিক টেলিফোন থেকে জনকে ফোন করে কিডন্যাপ সম্পর্কে জানান এবং সতর্ক করেন। জন এই খবর শোনার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তার স্ত্রী মারভা’র সাথে কথা বলেন। মারভা এফ বি আইকে জানানোর মতামত দেন, কিন্তু জন তাতে দ্বিমত পোষণ করেন। জন এবং চার্লস দুজন অনেক ভালো বন্ধু ছিলেন তাই চার্লসের কোন ক্ষতি হবে এমন কোন সিদ্ধান্ত তিনি নিতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের এফবিআইয়ের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। 

টানা চার দিন এফবিআইয়ের সাথে আলাপ-আলোচনা করে তারা একটি পরিকল্পনায় স্থির হন। চার্লসের কন্যা ক্যাথির উপর কিডন্যাপারদের সাথে আলোচনা করার দায়িত্ব পড়ে। তিনি একটি বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে মুক্তিপণ নিয়ে কিডন্যাপারদের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং তার গাড়িতে লুকায়িত থাকে একজন এফবিআই এজেন্ট ও পেছনে কয়েকটি আন্ডার-কভার গাড়ি। অবশেষে এই অভিযানের মাধ্যমে ৪ দিন পর ৩১ মে চার্লসকে উদ্ধার করা হয়। ২৫ এবং ২৬ বছর বয়সী সেই দুই কিডন্যাপারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

ভয়ানক এই ঘটনার পরেও চার্লস এবং তার পরিবার আগের মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন, কোনো অতিরিক্ত সুরক্ষা কিংবা বডিগার্ড নেননি। এতে চার্লসের সাহসী মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

বাধাহীন অগ্রগতি

১৯৯৩ সালে উইন্ডোজ প্লাটফর্মের জন্যেও ফটোশপ চালু করে এডোবি। এর ফলে ডিজিটাল ইমেজ ইডিটিংয়ের পুরো বাজারই এডোবির কাছে চলে যায়। ফটোশপের পর এডোবির পরবর্তী নিশানা তৈরি হয় ভিডিওর উপর। ১৯৯১ সালে ভিডিও ইডিটিং সফটওয়্যার প্রিমিয়ার চালু করে যা ২০০৩ সালে নাম পরিবর্তন করে প্রিমিয়ার প্রো রাখা হয়। বর্তমানে সাধারণ কন্টেন্ট ভিডিও থেকে শুরু করে মিলিয়ন ডলারের সিনেমাও ইডিট করা হয় প্রিমিয়ার প্রো দিয়ে!

পরবর্তী সালগুলোতে এডোবি উল্লেখযোগ্য হারে বিভিন্ন সফটওয়্যার অধিগ্রহণ করতে থাকে। এর মাঝে রয়েছে After Effects, Cool Edit Pro (বর্তমানে Adobe Audition) এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী Macromedia। Flash নিয়ে পরবর্তীতে অ্যাপলের সাথে এডোবির  বিতর্কের সৃষ্টি হয়। স্টিভ জবস তার আইফোনে ফ্ল্যাশ ব্যবহারে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। ২০১০ এর এপ্রিলে একটি লেখায় তিনি Flash এর খারাপ দিক গুলো তুলে ধরেন এবং শেষ পর্যন্ত তারই জয় হয়। পরবর্তী সালে মোবাইল ডিভাইসগুলোতে Flash এর সাপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এডোবির সফটওয়ারের একাংশ; Image Source: liveatpc.com

২০১২ সালে এডোবি একটি হ্যাকের সম্মুখীন হয়। যার ফলে প্রায় ৩৮ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর তথ্য ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়। এ ঘটনা নিয়ে মামলার সম্মুখীনও তাদের হতে হয়েছে যা কোম্পানিটির সার্বিক চিত্রের উপর একটি খারাপ ছায়া ফেলে।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও এডোবির মুনাফা বৃদ্ধির হার ছিল চোখে পড়ার মতো। এডোবিকে নিয়ে মানুষের প্রচুর সমালোচনাও রয়েছে। বিশেষ করে তাদের পণ্যের দাম নিয়ে, যা বিভিন্ন দেশে কাঙ্ক্ষিত মূল্যের চেয়ে অধিক হারে বিক্রি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। 

এডোবির আয় বৃদ্ধি; Image Source: dazeinfo.com

২০০৯ সালে চার্লস National Medal of Technology পদক জেতেন এবং ২০১০ সালে চার্লস এবং জন উভয়ই মার্কনি প্রাইজ জেতেন যা তথ্য প্রযুক্তিতে অবদানের জন্য সবচেয়ে বড় সম্মান হিসেবে বিবেচিত। তাদের অবদান শুধু মানুষের জীবন সহজই করেনি, সৃষ্টি করেছে নতুন সম্ভাবনারও। নানা তর্ক-সমালোচনা থাকলেও এডোবি যে মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

Related Articles

Exit mobile version