বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির কিছু বিমান

দুরন্ত গতির প্রতি মানুষের আকর্ষণ সেই আদিযুগ থেকেই চলে আসছে। যুদ্ধে দ্রুতগতির বাহন বাড়তি সুবিধা দিত বিধায় এর কদর ছিল সবসময়। আধুনিক যুগের যুদ্ধে বিমানবাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আবিষ্কার হয়েছে অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতির যুদ্ধবিমান। আকাশযুদ্ধে এ ধরনের বিমান বিভিন্ন ক্ষেত্রে একজন দক্ষ পাইলটকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে থাকে। আজকের লেখায় আমরা বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির কয়েকটি এয়ারক্রাফটের সাথে সংক্ষিপ্তভাবে পরিচিত হবো।

প্রথমেই গতি নির্ণয়ের একক নিয়ে কিছু কথা বলতে হচ্ছে। আমরা সাধারণত কিলোমিটার/ঘন্টা অথবা মাইল/ঘন্টা দিয়ে দ্রুতগতির যেকোনো হিসাব করে থাকি। বিমানের ক্ষেত্রে পাইলটরা নট (Knot) স্কেল ব্যবহার করেন (১ নট = ১.৮৫ কিলোমিটার)। সমুদ্রে জাহাজের গতির একক হিসেবেও নট ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই লেখায় র‍্যাংকিংয়ের জন্য ম্যাক (Mach) স্কেল ব্যবহার করা হয়েছে। এটি শব্দের গতির সাথে তুলনা করে বিমানের গতি নির্ণয়ের একটি স্কেল যা অস্ট্রিয়ান গণিতবিদ আর্নেস্ট ম্যাক প্রবর্তন করেন। কোনো মিসাইল/এয়ারক্রাফটের গতি শব্দের গতির ১ গুণের বেশি হলে একে ম্যাক ১ বা সুপারসনিক বলা হয়, এবং শব্দের গতির ৫ গুণ হলে তাকে হাইপারসনিক বলা হয়। একে আমাদের বহুল প্রচলিত কি.মি./ঘণ্টা এককে রূপান্তর করা একটু জটিল।

ম্যাক সমীকরণ হলো M=u/c, যেখানে M = ম্যাক নাম্বার, u = বিমানের গতি, c = বিমান যে উচ্চতায় আছে সেখানকার বাতাসে শব্দের গতি। জানেন নিশ্চয়ই যে, শব্দের গতি নির্দিষ্ট মাধ্যমের তাপমাত্রা উপর নির্ভর করে। আবার বায়ুমন্ডলে উচ্চতার হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে তাপমাত্রার সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের বিমান বিভিন্ন উচ্চতায় ওড়ে বিধায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। স্কুলে থাকতে বিজ্ঞান বইয়ে নিশ্চয়ই পড়েছেন যে, শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বায়ুতে শব্দের গতি ৩৩২ মিটার/সেকেন্ড। আবার প্রতি ১ ডিগ্রি তাপমাত্রার জন্য শব্দের গতি ০.৬ মিটার/সেকেন্ড করে বৃদ্ধি পায়। সেই হিসেবে আপনার আশেপাশে এই মুহূর্তের তাপমাত্রা যদি ৩০ ডিগ্রি হয়, তবে আপনার আশেপাশে শব্দের গতি হবে 2022-01-27 13:56:27 অর্থাৎ ৩৫০ মিটার/সেকেন্ড। এখন আপনার আশেপাশ দিয়ে যদি কোনো যুদ্ধবিমান ম্যাক ১ বা সুপারসনিক গতিতে উড়তে চায়, তবে সেটা হবে ১২৬০ কি.মি./ঘন্টা এর সমতুল্য (কারণ 350 m/s = 1260 km/h)।

Image courtesy: Slideshare

কিন্তু বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা তো ভূপৃষ্ঠের মতো ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে না। উচ্চতা যত বাড়বে, তাপমাত্রা ততই কমবে। এজন্য ১৩.৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১,২২৫ কি.মি./ঘণ্টা গতিকে ‘স্ট্যান্ডার্ড ম্যাক ১’ গতি ধরা হয়। অন্যদিকে তাপমাত্রার পার্থক্য থাকায় ৩০ হাজার ফুট উচ্চতায় ১,০৯১ কি.মি./ঘণ্টা গতি ম্যাক ১ এর সমান। এতসব কথা বলার অর্থ হলো পাঠক যেন দুটো যুদ্ধবিমানের ম্যাক নাম্বারের সাথে কি.মি./ঘণ্টা এককে গতির পার্থক্য দেখে দ্বিধান্বিত না হন। তাহলে চলুন, ম্যাক স্কেলে জেনে নেয়া যাক বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির কয়েকটি বিমান সম্পর্কে। উল্লেখ্য, একই ম্যাক নাম্বারের বিমানগুলোর র‍্যাংকিং করার ক্ষেত্রে উচ্চতা (Service ceiling) ও কি.মি./ঘণ্টা এককে এগিয়ে থাকা বিমানকে উপরে স্থান দেয়া হয়েছে। এছাড়া ইঞ্জিন থ্রাস্ট এবং Thrust/weight অনুপাতের ন্যায় টেকনিক্যাল বিষয়গুলোকে আমলে নেয়া হলেও তা এই লেখায় উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকা হয়েছে।  

ইউরোফাইটার টাইফুন (২,৪৯৫ কি.মি./ঘণ্টা) এবং ড্যাসল্ট রাফাল (২,৪৫০ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ২.০

বর্তমান যুগে ম্যাক ২ গতির বেশ কয়েকটি আধুনিক যুদ্ধবিমান রয়েছে, যেগুলোর সব নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। এগুলোর মধ্য থেকে বর্তমানের অন্যতম সেরা মাল্টিরোল ফাইটার জেট ইউরোফাইটার টাইফুন ও ড্যাসল্ট রাফালকে আর্টিকেলের শুরুতে একত্রে বেছে নেয়া হলো। ১৯৮৩ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং স্পেন মিলে একটি যুদ্ধবিমান তৈরির যৌথ প্রজেক্ট শুরু করে। পরবর্তীতে নিজস্ব ড্যাসল্ট রাফাল যুদ্ধবিমান (ম্যাক ২) বানানোর জন্য ফ্রান্স প্রজেক্ট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে। পরে বাকি ইউরোপীয় দেশগুলো মিলে তৈরি করে ইউরোফাইটার টাইফুন।

প্রথমে একে এয়ার সুপিরিয়রিটি রোলে (আকাশযুদ্ধে পারদর্শী) বানানোর পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর হঠাৎ করেই স্নায়ুযুদ্ধের অপ্রত্যাশিত অবসান ঘটে। ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো চাচ্ছিল কম খরচ এবং একাধিক কাজের উপযোগী ফাইটার জেট। ফলে তৈরি হয় এযাবৎকালের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাল্টিরোল প্ল্যাটফর্ম ইউরোফাইটার টাইফুন। কর্মদক্ষতায় ফ্রান্সের রাফাল ও টাইফুনের চেয়ে কম যায় না। ফরাসিরা তাদের ‘মিরেজ’ সিরিজের কয়েকটি যুদ্ধবিমানের অভিজ্ঞতা থাকায় শুরু থেকেই তারা মাল্টিরোল বিমানের পরিকল্পনা করে এগিয়ে যায়। টাইফুন-রাফাল দুটো বিমানই বর্তমান যুগের সেরা যুদ্ধবিমানগুলোর মধ্যে রয়েছে। গতিতে টাইফুন সামান্য এগিয়ে থাকলেও উভয়েই ম্যাক ২ গতির যুদ্ধবিমান। এরা আকাশ, ভূমি এবং সমুদ্রের টার্গেটের বিরুদ্ধে সমানভাবে যুদ্ধে সক্ষম। 

ইউরোফাইটার টাইফুন (বামে) ও ড্যাসল্ট রাফাল (ডানে) খালি চোখে দেখতে প্রায় একই রকম মনে হয়; Image source: wonderfulengineering.com

লকহিড মার্টিন এফ-২২ র‍্যাপ্টর (২,৪১৪ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ২.২৫

হাইস্পিড এয়ারক্রাফটের এই লিস্টে মাত্র দুটো ৫ম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‍্যাপ্টর। ২০০৫ সালে সার্ভিসে আসা এই যুদ্ধবিমানের রাডার ফাঁকি দেয়ার সক্ষমতার (স্টেলথ) পাশাপাশি দুর্দান্ত গতি, ম্যানুভারিটি ও সর্বাধুনিক টেকনোলজির কারণে একে বর্তমান যুগের আকাশযুদ্ধের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ফাইটার জেট আখ্যায়িত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ কোনো মিত্রদেশের কাছেই এই বিমান বিক্রি করেনি। ৭৫০টি বিমান নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও অতিরিক্ত খরচের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও শেষপর্যন্ত ১৮৭টি র‍্যাপ্টর নির্মাণ করে। প্রতিটি যুদ্ধবিমানের পেছনে ৩৩৪ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে দেশটি। দুটো শক্তিশালী ইঞ্জিনের সাহায্যে এটি সর্বোচ্চ ম্যাক ২.২৫ গতিতে উড়তে সক্ষম। এর একটি বিশেষ সুবিধা হচ্ছে- আধুনিক ফাইটার জেটের অতিরিক্ত গতি তুলতে বহুল ব্যবহৃত ইঞ্জিন আফটারবার্নার টেকনোলজি ব্যবহার না করেই ম্যাক ১.৮২ গতিতে চলতে সক্ষম। একে ‘সুপারক্রুজ স্পিড’ বলা হয়, যা এখনকার যুগের যুদ্ধবিমানের মধ্যে সর্বোচ্চ। যার ফলে বিমানটি অল্প জ্বালানীতে অধিক দূরত্বে গিয়ে অপারেশন চালাতে সক্ষম। 

স্টেলথ যুদ্ধবিমান সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন : স্টেলথ যুদ্ধবিমান কীভাবে রাডার ফাঁকি দেয়?

এফ-২২ র‍্যাপ্টর বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফাইটার জেট; Image source : wonderfulengineering.com

মিকোয়ান মিগ-২৯ (২,৪০০ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ২.৩

কোনো পাঠক যদি আধুনিক যুদ্ধবিমান সম্পর্কে বেসিক ধারণা রেখে থাকেন, তাহলে মিগ-২৯ এর নাম তিনি অবশ্যই শুনেছেন। আশির দশকে সার্ভিসে আসা এই বিমানকে তার দুর্দান্ত গতি ও আকাশযুদ্ধে ম্যানুভার সক্ষমতার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো দেশগুলো সমীহ করে চলতো। এখন পর্যন্ত ১,৬০০ মিগ-২৯ তৈরি করা হয়েছে, এবং রাশিয়াসহ ২৫টি দেশ এই যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি কোম্পানির কেনা মিগ-২৯ বিমানগুলোকে মার্কিন এয়ারফোর্স তাদের পাইলটদের সত্যিকারের আকাশযুদ্ধের ট্রেনিং দিতে ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে রাশিয়ান বিমান বাহিনীতে ২৫৯টি মিগ-২৯ সার্ভিসে আছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীও এ ধরনের ৮টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। মিগ-২৯ সর্বোচ্চ ম্যাক ২.৩ গতিতে উড়তে সক্ষম। এর আপগ্রেড ভার্সন মিগ-৩৫ অস্ত্রশস্ত্র, রাডার, ইঞ্জিনের দিক দিয়ে আরো উন্নত।

এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল সজ্জিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান; Image source: baf.mil.bd

কনভেয়ার এফ-১০৬ ডেল্টা ডার্ট (২,৪৫৪ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ২.৩

সর্বোচ্চ গতির বিমানের এই লিস্টের একমাত্র সিঙ্গেল ইঞ্জিন ফাইটার হচ্ছে আশির দশকের শেষদিকে অবসরে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১০৬ ডেল্টা ডার্ট, যা মূলত ‘ইন্টারসেপ্টর’ শ্রেণীর যুদ্ধবিমান। এ শ্রেণীর সকল বিমান নিজেদের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করা শত্রু বিমান তাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শী বিধায় এরা অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতির অধিকারী। শত্রু যুদ্ধবিমানের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য বানানো এফ-১০৬ ডেল্টা ডার্ট তার এক ইঞ্জিনের সাহায্যেই ম্যাক ২.৩ গতি তুলতে পারতো! এটি ব্যতীত লিস্টের সব বিমানই দুই বা ততোধিক ইঞ্জিন ব্যবহার করে। ডেল্টা ডার্টের একটি উল্লেখযোগ্য ফিচার না বললেই নয়। সোভিয়েত বিমান বহরের সম্ভাব্য আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য এতে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডযুক্ত ম্যাক ৩.৩ গতির শর্টরেঞ্জ এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল সংযুক্ত করা হয়েছিল, যার ধ্বংস ক্ষমতা ছিল ১.৫ কিলোটন! অর্থাৎ প্রায় ১০ কি.মি. দূর থেকে একটি পারমাণবিক মিসাইল মেরে পুরো সোভিয়েত বিমানবহর ধ্বংস করে দেয়ার সক্ষমতা ছিল এই বিমানের। বর্তমান যুগে সর্বোচ্চ গতির সিঙ্গেল ইঞ্জিন ফাইটার জেটগুলো হচ্ছে সুইডেনের JAS-39 গ্রিপেন (ম্যাক ২), চীনের Chengdu J-10 ফায়ারবার্ড (ম্যাক ২), যুক্তরাষ্ট্রের F-16 ফাইটিং ফ্যালকন (ম্যাক ২.০৫), এবং ফ্রান্সের Mirage 2000 যুদ্ধবিমান (ম্যাক ২.২)। 

এফ-১০৬ ডেল্টা ডার্ট; Image source : theaviationgeekclub.com

গ্রুম্যান এফ-১৪ টমক্যাট (২,৪৮৫ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ২.৩৪

১৯৮৬ সালে তরুণ অভিনেতা টম ক্রুজ অভিনীত Top Gun মুভিটি মুক্তি পাওয়ার পর দেখা গেলো অদ্ভুত দৃশ্য। মার্কিন নৌবাহিনীর লোকেরা সিনেমা হলের বাইরে অস্থায়ী নিয়োগ বুথ খুলে বসতো। মুভির দুর্ধর্ষ নায়ক ম্যাভরিকের এফ-১৪ টমক্যাট যুদ্ধবিমান চালানো দেখে স্বপ্নবাজ তরুণদের মার্কিন নৌবাহিনীতে দলে দলে যোগ দেয়ার যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তী দশকেও বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এফ-১৪ এর কপাল এতটা ভালো ছিল না। এফ-১০৬ ডেল্টা ডার্ট ও এফ-৪ ফ্যান্টম (ম্যাক ২.২৩) অবসরে যাওয়ার আগেই ইউএস নেভি আকাশযুদ্ধে পারদর্শী এমন এক বিমান বানায় যা দুটো বিমানের চাহিদা একসাথে পূরণ করার পাশাপাশি তাদের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ থেকে ওঠা-নামা করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু কয়েক বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটায় মার্কিনীদের এয়ার সুপিরিয়রিটি রোলের চাহিদা হ্রাস পায়। ততদিনে সার্ভিসে চলে এসেছে মাল্টিরোল ফাইটার জেট এফ-১৮ হরনেট (ম্যাক ১.৮)। ফলে নির্ধারিত সময়ের আগেই টমক্যাটকে অবসরে পাঠানো হয়। ভেরিয়েবল সুইপ উইং (কিছুটা ভাঁজযোগ্য ডানা), লংরেঞ্জ মিসাইল ও ম্যাক ২.৩৪ গতি নিয়ে এফ-১৪ ছিল তৎকালীন বিশ্বের সেরা ফাইটার জেটগুলোর একটি। আকাশ যুদ্ধে ১৩৫টি বিজয়ের বিপরীতে মাত্র চারটি পরাজয় রয়েছে টমক্যাটের। ইরাক-ইরান যুদ্ধে একটি মিসাইল মেরে তিনটি শত্রু বিমান ধ্বংসের বিরল কৃতিত্ব রয়েছে একমাত্র এফ-১৪ এর! 

এফ-১৪ টমক্যাট তার ডানা ভাঁজ করতে পারতো; Image source : US Navy

সুখোই এসইউ-২৭ ফ্ল্যাঙ্কার (২,৫০০ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ২.৩৫

স্নায়ুযুদ্ধের যুগে মার্কিন বিমানের সাথে ডগফাইটে জিততে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি করে আকাশযুদ্ধের সর্বাধিক ম্যানুভারেবল যুদ্ধবিমান সুখোই এসইউ-২৭। ইউটিউবে সুখোই সিরিজের বিমানচালনা প্রথমবারের মতো দেখলে পাঠকমাত্রই অবাক হয়ে বলবেন, “এভাবেও কি যুদ্ধবিমান চালানো সম্ভব!” দুর্দান্ত গতি, চমৎকার ম্যানুভার সক্ষমতা, এবং অধিক সংখ্যক মিসাইলের সমন্বয়ে বানানো এসইউ-২৭ ছিল মার্কিন যুদ্ধবিমানের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। বর্তমানে এর আপগ্রেড ভার্সন SU-30 এবং SU-35 বিভিন্ন দেশের আকাশে রাজত্ব করছে। এসইউ-২৭ এবং এসইউ-৩৫ সর্বোচ্চ ম্যাক ২.৩৫ গতিতে উড়তে সক্ষম। ম্যানুভার সক্ষমতার আকাশযুদ্ধে এদের মতো ক্ষিপ্র যুদ্ধবিমান আর নেই। বিশেষ করে ক্লোজ রেঞ্জ এয়ার কমব্যাটে সুখোই ফ্যামিলির বিমানগুলো অতুলনীয়। 

সুখোই এসইউ-২৭, এসইউ-৩০ এবং এসইউ-৩৫ বাহ্যিক দৃষ্টিতে প্রায় একই রকম মনে হয়; Image source: militaryfactory.com

এফ-১১১ আর্ডভার্ক (২,৬৫৬ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ২.৫

লিস্টের একমাত্র ফাইটার-বোম্বার শ্রেণীর বিমান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১১১। ষাটের দশকে সার্ভিসে আসা এই বিমানটি ম্যাক ২.৫ গতির তুমুল ঝড় তুলে শত্রুর আকাশসীমায় ঢুকে যাওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। প্রচন্ড গতির সক্ষমতা থাকায় একে পরবর্তীতে ইন্টারসেপ্টর, রিকনসিস ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের কাজে ব্যবহার করায় একে আধুনিক মাল্টিরোল যুদ্ধবিমানের পূর্বসূরি বলা হয়। এটি কনভেশনাল ও নিউক্লিয়ার – দুধরনের হামলার জন্য উপযোগী ছিল। বিমানটিতে ভেরিয়েবল সুইপ উইং (কিছুটা ভাঁজযোগ্য ডানা), আফটারবার্নার টার্বোফ্যান ইঞ্জিন সহ বেশ কয়েকটি আধুনিক টেকনোলজির প্রথমবারের মতো ব্যবহার শুরু হয়েছিল। নব্বইয়ের দশকে এটি অবসরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মার্কিন ফাইটার-বোম্বার শ্রেণীর বিমানের যুগ শেষ হয়। এর জায়গা দখল করে এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের একটি ভার্শন স্ট্রাইক ঈগল। 

এফ-১১১ আর্ডভার্ক ফাইটার বোম্বার।  Image source : wall.alphacoders.com

ম্যাকডনেল ডগলাস এফ-১৫ ঈগল (২,৬৫৫ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ২.৫

আধুনিক যুগের ফাইটার বিমানের মধ্যে মার্কিন যুদ্ধবিমান এফ-১৫ ঈগলের এমন একটি রেকর্ড রয়েছে যেটি আজকের যুগের সমসাময়িক আর কোনো বিমানের নেই। এটি শতাধিক আকাশযুদ্ধে অংশ নিয়ে আজ অবধি অপরাজিত! বিভিন্ন যুদ্ধে এফ-১৫ এখন পর্যন্ত শত্রুপক্ষের ১০২টি এয়ারক্রাফট ধ্বংস করলেও তাকে কেউ ভূপাতিত করতে পারেনি! আকাশযুদ্ধে এটি যেন ঈগলের মতোই ভয়ংকর। শক্তিশালী দুটো ইঞ্জিনের সাহায্যে ম্যাক ২.৫ পর্যন্ত গতি তুলতে পারে এই মার্কিন দানব। সত্তরের দশকে সার্ভিসে আসলেও এই বিমানের কার্যকারিতা এখনও ফুরোয়নি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এফ-১৫এক্স নামে নতুন একটি ভার্সন বানানোর কাজ করছে যা আধুনিক যুদ্ধবিমানের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক (২২টি) এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল বহন করতে সক্ষম! আরেকটি কথা বলা হয়নি। এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের স্যাটেলাইট ধ্বংসের সক্ষমতাও রেকর্ড রয়েছে!

এফ-১৫ একশোর আকাশ যুদ্ধে অংশ নিয়ে আজ অবধি অপরাজিত; Image source : militarymachine.com

চেংদু জে-২০ (২,৪৭০ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ২.৫

তালিকায় ৫ম প্রজম্মের দ্বিতীয় যুদ্ধবিমান চীনের চেংদু জে-২০ ‘মাইটি ড্রাগন’ ফাইটার জেট। এটি যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ ও এফ-৩৫ এর পর বিশ্বের তৃতীয় অপারেশনাল স্টেলথ যুদ্ধবিমান। তবে বিশাল আকারের এই বিমানটির রাডার ক্রস সেকশন বেশি দাবি করে এটি আদৌ কতটা স্টেলথ তা নিয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা দ্বিধান্বিত। তবে চীনা এই যুদ্ধবিমানটি ১১ টন অস্ত্র বহন করে পেলোড সক্ষমতার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে। ডিজাইন অনেকটা মার্কিন এফ-২২ এর মতো বিধায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে ‘চাইনিজ র‍্যাপ্টর’ নামে কৌতুক করা হয়। জে-২০ যুদ্ধবিমান সম্পর্কে খুব বেশি কারিগরি তথ্য ইন্টারনেটে পাওয়া যায় না। চীন এর গতি ম্যাক ২.৫ গতি দাবি করলেও পশ্চিমা এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা একে ম্যাক ২ গতির যুদ্ধবিমান বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিমানটির দুটো ভ্যারিয়েন্ট দু’ধরনের ইঞ্জিন ব্যবহার করে এবং তৃতীয় আরেকটি ইঞ্জিন বানানোর কাজ চলমান বিধায় একে ম্যাক ২ বলে ধরে নেয়াই যৌক্তিক। 

চেংদু জে-২০ মাইটি ড্রাগন; Image source : theaviationgeekclub.com

মিকোয়ান-গুরেভিচ মিগ-২৫ ফক্সব্যাট (৩,০০০ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ২.৮৩

‘৭০-এর দশকের আকাশে গতির সোভিয়েত রাজার নাম ছিল মিগ-২৫ ফক্সব্যাট। হাইস্পিড এই বিমানটি শত্রুবিমান ইন্টারসেপ্ট করার পাশাপাশি হাই-অ্যালটিট্যুড ফটো রিকনসিস করতে পারতো। বিমানটি প্রায় ৮৯ হাজার ফুট উচ্চতা দিয়ে ওড়ার দুর্দান্ত এক ক্ষমতার অধিকারী ছিল। এছাড়া এর সর্বোচ্চ গতি ছিল ম্যাক ২.৮৩। ফলে অধিক উচ্চতায় প্রচন্ড গতিতে উড়ে যাওয়ার সময় এটি শত্রু এলাকার নিখুঁত ছবি তুলে নিতে পারতো। এটি গণ উৎপাদনে যাওয়া সবচেয়ে দ্রুতগতির যুদ্ধবিমানের একটি। মোট ১,১৮৪টি বিমান উৎপাদনের পর এটি বানানো বন্ধ করে দেয়া হয়। কারণ উচ্চগতির কারণে এর ফুয়েল খরচের হার অত্যন্ত বেশি ও রাডার রেঞ্জ কম থাকায় যখন এর আপগ্রেড ভার্সন বানানোর কাজ চলছিল। এরই মধ্যে ১৯৭৬ সালে ভিক্টর বেলেঙ্কো নামের এক বিশ্বাসঘাতক সোভিয়েত পাইলট তার মিগ-২৫ বিমান নিয়ে জাপানে পালিয়ে যায়। তাকে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার বিনিময়ে মার্কিনীরা জাপানেই ৬৭ দিন গবেষণা করে বিমানটির খুঁটিনাটি জেনে যায়। ফলে নতুন যুদ্ধবিমান বানানোর কাজ শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯১ সালে দেশটির পতন হলে বিমানটি অবসরে পাঠায় নবগঠিত রাশিয়া। সোভিয়েত মিত্র দেশগুলোর মধ্যে আলজেরিয়া, সিরিয়া এখনো বিমানটি ব্যবহার করে। রাশিয়ায় মিগ-২৯ এর পাশাপাশি মিগ-২৫ দিয়েও বেসামরিক লোকেরা অর্থের বিনিময়ে সুপারসনিক ফ্লাইটের অভিজ্ঞতা নিতে পারে।

মিগ-২৫ যুদ্ধবিমানে ৪০ মিনিটের সুপারসনিক ফ্লাইট উপভোগ করতে চাইলে প্রায় ১৬ লাখ টাকা খরচ পড়বে!
Image source : flyfighterjet.com

নর্থ আমেরিকান এক্সবি-৭০ ভ্যালক্যারি (৩,৩১০ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ৩.০৮ 

ষাটের দশকের দিকে তখন স্নায়ুযুদ্ধ ছিল তুঙ্গে। মার্কিন বোমারু বিমানের আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য সোভিয়েত তৈরি করেছে মিগ-২৫-সহ একাধিক ক্ষিপ্রগতির যুদ্ধবিমান। তাই সোভিয়েত রাডার, ইন্টারসেপ্টর ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ফাঁকি দিয়ে পারমাণবিক বোমা হামলা করতে সক্ষম এমন বোমারু বিমান বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে জন্ম নেয় এক্সবি-৭০ভ্যালক্যারি। এটি যেন কমিক্স থেকে উঠে আসা সেই হাইড্রা টেকনোলজি। ২৪৩ টনের দানবীয় বিমানটি ৬টি ইঞ্জিনের সাহায্যে ৭০ হাজার ফুট উচ্চতা দিয়ে ম্যাক ৩.০৮ গতিতে উড়তে সক্ষম ছিল। তখনকার সোভিয়েত রাডার একে ঠিকমতো শনাক্ত করার সক্ষমই ছিল না। তাদের হাইস্পিড ইন্টারসেপ্টরগুলো এজন্য অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে ইন্টারকন্টিনেটাল ব্যালাস্টিক মিসাইল সার্ভিসে আসায় এ ধরনের বোমারু বিমানের চাহিদা একেবারে হ্রাস পায়।

অন্যদিকে সোভিয়েত এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল সিস্টেমও শক্তিশালী হয়ে গেছে। ফলে ১৯৬১ সালে মাত্র দুটো প্রোটোটাইপ বিমান বানানোর পর ভ্যালক্যারি প্রোগ্রাম বাতিল করে মার্কিন বিমানবাহিনী। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল। ১৯৬৩-৬৯ সালে তারা বিমানবাহিনীর বাতিল হয়ে যাওয়া বেশ কিছু হাইস্পিড প্রজেক্ট নিজেদের চলমান সুপারসনিক গবেষণার কাজে লাগায়। এক্সবি-৭০ভ্যালক্যারি ম্যাক ৩+ গতিতে ওড়ার সময় এর তাপমাত্রা ২৩০-৫৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যেত! এসব পরিস্থিতির উপর গবেষণা করে পরবর্তী প্রজন্মের মহাকাশযানগুলোর ক্রুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নাসা। ১৯৬৬ সালে পাঁচটি বিমানের একটি ক্লোজ ফর্মেশনে উড়ে একটি ছবি তোলার পরপরই একটি এক্সবি-৭০ ভ্যালক্যারির সাথে অপর একটি এফ-১০৪ বিমানের সংঘর্ষ হয়ে উভয়েই ধ্বংস হয়ে যায়। ভ্যালক্যারির অপর প্রোটোটাইপটি বর্তমানে মার্কিন বিমান বাহিনীর জাদুঘরে সংরক্ষিত।

বর্তমানে অ্যাক্টিভ সার্ভিসে থাকা ভ্যালক্যারির ন্যায় লংরেঞ্জ সুপারসনিক বোমারু বিমান হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Rockwell B-1 Lancer ম্যাক ২.২২, রাশিয়ার Tupolev Tu-22M (ম্যাক ১.৮৮), এবং Tupolev Tu-160 (ম্যাক ২.৩)।

এক্সবি-৭০ভ্যালক্যারি; Image source: US Air Force

বেল এক্স-২ স্টারবাস্টার (৩,৩৭০ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ৩.১৯

নিত্যনতুন অ্যারোডাইনামিক ডিজাইন কনসেপ্ট নিয়ে চল্লিশ থেকে ষাটের দশকে উচ্চগতিতে বিমানচালনা ও পাইলটের উপর কেমন প্রভাব পড়ে সেই সম্পর্কে জানতে বেশ কিছু রিসার্চ বিমানের জন্ম হয়। মার্কিন এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিগুলোর তৈরি এই প্রোটোটাইপ বিমানগুলোকে X plane নামে আখ্যায়িত করা হয়। এরা টেস্ট প্ল্যাটফর্ম বিধায় জেট ও রকেট ইঞ্জিনের ব্যাপক ব্যবহার করা হয়েছিল। X-2 Starbuster তৈরি করে Bell Aircraft Corporation। এর পূর্বসূরি এক্স-১ বিমানটি ১৯৪৭ সালে ইতিহাসের প্রথমবারের মতো শব্দের বেগকে অতিক্রম করার সুপারসনিক ফ্লাইট (ম্যাক-১ গতি) সম্পন্ন করেছিল। এক্স-২ যেন সেই ধারাবাহিকতায় প্রথমবারের মতো ম্যাক-৩ এর রেকর্ড অর্জন করে। ১৯৫৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন মিলবার্ন গ্রান্ট মেল অ্যাপ্ট এই রেকর্ড গড়ার পরপরই নিজের ভুলে বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন। তার সহকর্মী ক্যাপ্টেন ইভান দুর্ঘটনার ২০ দিন আগে উক্ত বিমানটি দিয়েই ১,২৬,২৮৩ ফুট উচ্চতায় উড়ে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উড্ডয়ন রেকর্ড গড়েন। তবে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই রকেট ইঞ্জিনচালিত বিধায় এক্স সিরিজের বেশ কিছু এয়ারক্রাফটকে আসলে ঠিক বিমান বলতে রাজি নন। ফলে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উড্ডয়ন রেকর্ডের স্বীকৃতি গিনেজ বুক কর্তৃপক্ষ সোভিয়েত মিগ-২৫ যুদ্ধবিমানকে দিয়েছে (১,২৩,৫২০ ফুট)।

এক্স-২ বিমানটি প্রথমবারের মতো ম্যাক ৩ এর সীমা অতিক্রম করেছিল; Image source : nasa.gov

মিকোয়ান মিগ-৩১ ফক্সহাউন্ড (৩,০০০ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ৩.২

মিগ-২৫ এর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম যেখানে থমকে গিয়েছিল, ঠিক সেখান থেকেই মিগ-৩১ এর জন্ম। ইন্টারসেপ্টর শ্রেণীর যুদ্ধবিমান কাকে বলে তা একটু আগেই বলা হয়েছে। মিগ-৩১-কে বলা হয়‘ফাদার অব অল ইন্টারসেপ্টর’। ম্যাক ৩.২ গতি তুলতে সক্ষম এই বিমানটি সর্বোচ্চ গতির বিমানের তালিকার মধ্যে দ্বিতীয় এবং বর্তমান যুগে অ্যাক্টিভ সার্ভিসে থাকা বিমানগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে। মিগ-২৫ এর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা জয় করে মিগ-৩১ হয়ে উঠেছে সর্বকালের সেরা ইন্টারসেপ্টর যুদ্ধবিমান। ৪টি মিগ-৩১ যুদ্ধবিমানের একটি হান্টার কিলার গ্রুপ পরস্পরের মধ্যে ২০০ কি.মি. দূরত্ব বজায় রেখে আকাশে ৯০০ কিলোমিটার এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম। বর্তমানে বিমানটির সার্ভিস লাইফ প্রায় শেষ হয়ে এলেও রাশিয়ার এয়ারফোর্স একে আপগ্রেড করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সার্ভিসে রাখার পরিকল্পনার পাশাপাশি মিগ-৩১ এর এয়ার-টু-এয়ার মিসাইলের রেঞ্জ ৩০৪ কি.মি. থেকে বাড়িয়ে ৩৯৮ কি.মি.-তে উত্তীর্ণ করেছে! বিমানটি অবসরে গেলে এর স্থানে ম্যাক ৪+ গতির আরেক গতিদানব মিগ-৪১ কে সার্ভিসে আনার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে রাশিয়া।

সর্বকালের সেরা ইন্টারসেপ্টর মিগ-৩১; Image source : flyfighterjet.com

লকহিড ওয়াইএফ-১২ (৩,৬৬১ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ৩.৩৫ 

সোভিয়েতরা যদি হাইস্পিড ইন্টারসেপ্টর বানাতে সক্ষম হয়, তবে মার্কিনীরা পারবে না – স্নায়ুযুদ্ধের সময় এমনটি ধারণা করার সুযোগ নেই। যে প্রতিযোগিতা থেকে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা, তারই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র সবার আগে ১৯৬৩ সালে তৈরি করে ওয়াইএফ-১২ ইন্টারসেপ্টর। মূলত এফ-১০৬ ডেল্টা ডার্ট ৫৭ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় থাকা সোভিয়েত বিমান ধাওয়া করতে সক্ষম ছিল বিধায় ওয়াইএফ-১২ এর চাহিদা সৃষ্টি হয়।

ষাটের দশকের শুরুতে ইঞ্জিনিয়ার ক্ল্যারেন্স জনসন এক অদ্ভুত বিমানের কনসেপ্ট তৈরি করেন। তার টার্গেট ছিল এমন হাইস্পিড রিকনসিস বিমান তৈরি করা যা কিনা অতি উচ্চতা দিয়ে তীব্র গতিতে সোভিয়েত আকাশে ঢুকে পড়বে, কিন্তু রাডারে সহজে ধরা পড়বে না। এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র চাহিদানুযায়ী এ-১২ গোয়েন্দা বিমান মিসাইল তৈরি করা হয় যা অস্ত্রের বদলে ক্যামেরা বহন করতো। এদিকে মার্কিন বিমানবাহিনীও নতুন ইন্টারসেপ্টরের জন্য তাগাদা দিচ্ছিলো। ফলে এ-১২ এর ডিজাইন কিছুটা ঘষামাজা করে তিনটি ওয়াইএফ-১২ প্রোটোটাইপ তৈরি হয় যা তিনটি করে এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল বহনে সক্ষম ছিল। কিন্তু এর ফিল্ড পারফরম্যান্সে দেখা গেলো এটি ইন্টারসেপ্টরের চেয়ে রিকনসিস (গোয়েন্দা) হিসেবে এ-১২ এর চেয়েও ভালো কাজ করবে। ফলে ইন্টারসেপ্টর প্রজেক্টটি বাতিল করে নতুন গোয়েন্দা বিমান বানানোর প্রজেক্ট শুরু হয়। ওয়াইএফ-১২ বিমানটি ম্যাক ৩.২ পর্যন্ত গতি তুলতে সক্ষম ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় এক মিশনে এর জাতভাই এ-১২ এই ক্ষিপ্রগতির কারণে একসাথে ছয়টি ভিয়েতনামিজ সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল ফাঁকি দিয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।

YF-12 ইন্টারসেপ্টর প্রোটোটাইপ; Image source : US Air Force

লকহিড এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড (৩,৫৪০ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ৩.৪

একটু আগেই পড়েছেন যে, YF-12 ইন্টারসেপ্টর প্রজেক্টটি বাতিল করে নতুন গোয়েন্দা বিমান বানানোর প্রজেক্ট শুরু হয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির জেট ইঞ্জিন চালিত বিমান এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড। ব্ল্যাকবার্ডের ক্যামেরা এতই আধুনিক ছিল যে রাস্তায় ঘন্টায় ২০০ কি.মি. গতিতে থাকা গাড়ির নাম্বার প্লেটের ছবি ৮৫ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে নিখুঁতভাবে তোলা সম্ভব ছিল। মোট ৩২টি ব্ল্যাকবার্ড বানানো হয়েছিল যার ১২টি বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়েছিল। তবে একটিও শত্রুর হাতে ধ্বংস হয়নি। কারণ ৩২ বছরের সার্ভিস লাইফে বিমানটিকে লক্ষ্য করে চার হাজারের বেশি মিসাইল ফায়ার করা হয়েছিল। কিন্তু ব্ল্যাকবার্ডের গতি এত বেশি ছিল যে তাকে ছুঁতেই পারেনি! অফিসিয়ালি এটি ম্যাক ৩.৩২ গতির অধিকারী। তবে স্পিড টেস্টের সময় ম্যাক ৩.৪ পর্যন্ত গতি তুলেছিল শোনা যায়। এছাড়া মেজর ব্রায়ান শুল তার বইয়ে ১৯৮৬ সালে লিবিয়ার আকাশে মিসাইলের তাড়া খেয়ে পালানোর সময় ম্যাক ৩.৫ গতি তুলেছিলেন বলে দাবি করেছেন। বর্তমানে সর্বোচ্চ গতির বিমানের গিনেজ বুক রেকর্ডটি ব্ল্যাকবার্ডের দখলে। 

বিমানটি সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন Roar বাংলায় : এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড: বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বিমান

বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বিমান ব্ল্যাকবার্ড; Image source : militaryfactory.com

নর্থ আমেরিকান এক্স-১৫ (৭,২৭০ কি.মি./ঘণ্টা) – ম্যাক ৬.৭২

লিস্টের একমাত্র হাইপারসনিক (ম্যাক ৫+) গতির বিমান হচ্ছে X-15। স্পেস শাটল বাদ দিলে মানবচালিত সবচেয়ে দ্রুতগতির এয়ারক্রাফটের স্বীকৃতি এর দখলে রয়েছে। ১৯৬৭ সালে এটি ১,০২,১০০ ফুট উচ্চতায় ম্যাক ৬.৭২ গতিতে উড়ে পাইলট উইলিয়াম জে. নাইট যে রেকর্ড গড়েছিলেন তা আজও অক্ষত। তবে আগেই বলা হয়েছে যে, X সিরিজের বেশ কিছু এয়ারক্রাফটকে ঠিক বিমান বলা যায় না। X-15 জেট ইঞ্জিন নয়, রকেট ইঞ্জিন চালিত এয়ারক্রাফট। X-2 স্টারবাস্টারের ন্যায় এটিও মাদারশিপের সাহায্য ছাড়া সরাসরি আকাশে উড়তে পারতো না। বি-৫২ বোমারু বিমান এক্স-১৫-কে তার বোম্ব বে-র সাথে নিয়ে টেকঅফ করার পর একবারে ১৩.৭ কি.মি. উচ্চতায় উঠে যেত। অতঃপর ৮০৫ কি.মি./ঘন্টা গতিতে উড়তে থাকা বিমানটি এক্স-১৫ কে মুক্ত করে দিত। এরপর রকেট ইঞ্জিন চালু হয়ে এক্স-১৫ উড়তে শুরু করতো। ফ্লাইট শেষে এটি সাধারণ বিমানের মতোই রানওয়েতে নেমে আসতো। সর্বোচ্চ গতির রেকর্ডের স্বীকৃতি SR-71 ব্ল্যাকবার্ড পেলেও সর্বোচ্চ উচ্চতায় ওড়ার রেকর্ড কিন্তু X-15 এর। ১৯৬৩ সালে নাসার পাইলট জোসেফ ওয়াকার ১০৭.৯৬ কি.মি. উচ্চতায় (৩,৫৪,২০০ ফুট) রেকর্ড গড়েন। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের নভোচারীদের প্রশিক্ষণ দিতে এই বিমান ব্যবহার করেছে। X-15 এর রেকর্ড ভাঙার মতো আর কোনো বিমান তৈরি হয়নি। 

এক্স-১৫ যেন মানবচালিত মিসাইল। দ্বিতীয় ছবিতে মাদারশিপ থেকে লঞ্চ করার আগমুহূর্তে; Image source: nasa.gov

খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই যে, মহাকাশ গবেষণার গুটিকয়েক উদাহরণ ছাড়া গতি বিষয়ক বেশিরভাগ এক্সপেরিমেন্ট ও সফল প্রয়োগের বেশিরভাগই সামরিক ক্ষেত্রে। বেসামরিক বিমান চলাচলে এই গবেষণা যেন একেবারেই থমকে গেছে। সত্তরের দশকে ফরাসি-ব্রিটিশদের নির্মিত ‘কনকর্ড’ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘টুপোলেভ টিইউ-১৪৪’ নামের যাত্রীবাহী সুপারসনিক বিমান ছিল, যারা ম্যাক ২+ গতিতে নিয়মিত সিভিলিয়ান ফ্লাইট পরিচালনা করতো। বিকট শব্দ, উচ্চমাত্রার ফুয়েল ও মেইনটেন্স খরচের পাশাপাশি আকাশছোঁয়া টিকেটের দাম সত্ত্বেও ধনীদের কাছে এসব ফ্লাইট জনপ্রিয় হয়েছিল। এদের অকাল অবসরের পর সুপারসনিক বেসামরিক ফ্লাইটের উদ্যোগ একবারে থমকে যায়। তবে আশার কথা, ২০১৬ সালে কমার্শিয়াল এয়ারলাইনের জন্য কম শব্দ উৎপন্নকারী সুপারসনিক ইঞ্জিনের গবেষণা শুরু করেছে নাসা। ২০২৬ সালের মধ্যে সুপারসনিক যাত্রীবাহী বিমান সার্ভিসে আসবে বলে আশা করা যায়। গতির প্রতিযোগিতা বেসামরিক খাতে মানব সভ্যতার কল্যাণে ছড়িয়ে পড়ুক, এটাই প্রত্যাশা। 

 

Related Articles

Exit mobile version