মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে তথ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনে মানুষ একে একে ব্যবহার করেছে বিভিন্ন পদ্ধতি, তৈরি করেছে নতুন নতুন পন্থা। আর আধুনিক এই প্রযুক্তিনির্ভর যুগে তথ্যের প্রয়োজন কত বেশি সেটা বোধকরি নতুন করে বলা লাগবে না। পাথর থেকে শুরু হয়ে কাগজ, পাঞ্চ কার্ড ম্যাগনেটিক টেপ এর যুগ অতিক্রম করে এখন চলছে হার্ডডিস্ক ড্রাইভ বা সিডি-ডিভিডি কিংবা ইউএসবি ড্রাইভের মতো অত্যাধুনিক সব ডেটা স্টোরেজ প্রযুক্তি।
কিন্তু একবার ভাবুন তো, যদি কখনো মানব ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ঘটনাটি ঘটে, আর সব কাগজ ধ্বংস হয়ে যায়, সব প্রযুক্তিগুলো নষ্ট হয়ে যায়, তখন কি আর কোনোভাবেই তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে না? তার উত্তর লুকিয়ে আছে আপনার দেহের ভিতরে ডিএনএ’র মধ্যে। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত যে হারে তথ্যের পরিমাণ বেড়ে চলেছে তাতে একসময় ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর ধারণক্ষমতার বাইরে চলে গেলেও এই সমস্যা থেকে রক্ষা করবে প্রকৃতির এই তথ্য বাহক বা বায়োডেটা স্টোরেজ।
বিজ্ঞানীদের মতে, ভবিষ্যতের ডেটা স্টোরেজ হতে চলেছে ডিএনএ, যা দিয়ে সংরক্ষণ করা যাবে বর্তমানে প্রচলিত ডিভাইসগুলোর তুলনায় আরও অনেক গুণ বেশি ডেটা। শুধু তা-ই নয়, পুরো পৃথিবীর সব ডেটা ধারণ করা যাবে মাত্র কয়েক গ্রাম ডিএনএ-তে। কিন্তু কীভাবে, আর কেনইবা ডিএনএ? আর এর দ্বারা কতটুকুই বা উপকার হবে? তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও আদতে কি তা সম্ভব? চলুন তবে বিচরণ করে আসা যাক ডিএনএ’র জগতে।
শুরুর আগে
ডিএনএ (Deoxyriboneucleic Acid) কীভাবে ডেটা স্টোর করবে তা জানার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক কী কী আছে ডিএনএ-তে আর এখনকার হার্ডডিস্ক বা অন্যান্য ডেটা স্টোরেজ ডিভাইসগুলোর মধ্যে কী ঘটে?
দ্বিসূত্রক ডিএনএ’র সাথে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত, যাকে আমরা চিনি বংশগতির ধারক-বাহক হিসেবে। আরেকটু গভীরে দেখলে পাওয়া যাবে এর গঠনগত একক নিউক্লিওটাইড আর লক্ষ লক্ষ নিউক্লিওটাইডের দীর্ঘ পলিমার হলো একটি ডিএনএ অণু। মানুষের সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে ডিএনএ। কেবল ধারণই নয়, বংশ পরম্পরায় তা বহণও করে। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো তথ্য, যা সংরক্ষিত থাকে ডিএনএ’র চার ধরনের নিউক্লিওটাইড নাইট্রোজেন বেইসের মধ্যে। এই চার নিউক্লিওটাইড বেইস হলো অ্যাডিনিন (Adenine), গুয়ানিন (Guanine), থাইমিন (Thymine) এবং সাইটোসিন (Cytosine)। সংক্ষেপে A, G, T ও C নামে আমরা চিনি তাদের। একটি মানব কোষে থাকে এমন ৩০০ কোটিরও বেশি নিউক্লিওটাইড।
এর আগের এক লেখায় আলোচনা করেছিলাম কিভাবে কম্পিউটার হার্ডডিস্কে তথ্য জমা থাকে। মোটামুটিভাবে সব ডিভাইসে একইভাবে তথ্য সংরক্ষিত হয়, কেবল এর কাজের ধরণটি আলাদা। প্রথমে তথ্যকে ০ আর ১ এ রুপান্তর করা হয়। এরপর হার্ডডিস্কে যেখানে সেগুলো জমা থাকে চৌম্বকত্বের সাহায্যে, অন্য কোনো ডিভাইস সেখানে ব্যবহার করে ইলেকট্রন বা আলোক ধর্মকে।
কিন্তু ডিএনএ তাহলে এই তথ্যকে কিভাবে ধারণ করবে?
ভবিষ্যতের হার্ডডিস্ক ডিএনএ
ডিএনএ’র মধ্যে প্রতি ধাপে নাইট্রোজেন বেইসগুলো জোড়ায় জোড়ায় বন্ধন গঠন করে বিভিন্ন বিন্যাস তৈরির মাধ্যমে। ডিএনএ’র একটি সূত্রের পর পর তিনটি নিউক্লিওটাইড বেইসের অনুক্রমকে বা বিশেষ বিন্যাসকে বলা হয় ‘কোডন’ (Codon), যেমন: AAA, AAG, ATG এরকম আরো অনেক বিন্যাস সম্ভব। নিউক্লিওটাইড হলো এক অণু নাইট্রোজেনঘটিত ক্ষারক, এক অণু পেন্টোজ শ্যুগার এবং এক অণু ফসফেটযুক্ত যৌগ। একেকটি কোডন অ্যামিনো অ্যাসিড বা প্রোটিনকে নির্দেশ দেয় বিশেষ বিশেষ কিছু কাজ করার জন্য। অন্যভাবে বলতে গেলে, একেকটি কোডন একেকটি সংকেত বহন করে আর সেই সংকেত দেখে প্রোটিনগুলো বুঝে নেয় তাদের কী করতে হবে।
ডিএনএ যখন সংকেত বহন করে তার মানে ডিএনএ’র এই বৈশিষ্ট্যকে আরেকটু অন্যভাবে কাজে লাগানো যায়। ডিজিটাল ডেটা মানেই ০ আর ১ এর খেলা। তাই কোনোভাবে যদি ডিএনএ’র এই নিউক্লিওটাইড সিকোয়েন্স বা অনুক্রমকে ০ আর ১ এর মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায় তাহলেই কিন্তু ডিজিটাল ডেটাকে ডিএনএ-তে সংরক্ষণ করা সম্ভব।
নিউইয়র্কের বিজ্ঞানীগণ ১৯৯৯ সালে ডিএনএ দিয়ে বর্ণ, সংখ্যা আর চিহ্ন তৈরি করেন। তারা চারটি নিউক্লিওটাইড এর মধ্য থেকে তিনটি করে নিউক্লিওটাইড নিয়ে সম্ভাব্য ৬৪টি কোডন তৈরি করেন। এদের প্রত্যেকটি একেকটি ইংরেজি অক্ষর, সংখ্যা আর চিহ্ন নির্দেশ করে। যেমন AAA দ্বারা ০, AAG দ্বারা ১ অনেকটা এরকম। এরপর তারা ২২টি অক্ষরের একটি মেসেজ তৈরি করেন একটি ডিএনএ স্ট্র্যান্ডে। এবং একটি প্রক্রিয়াতে স্ট্র্যান্ডে জেনেটিক মার্কারের সাহায্যে সেটির অবস্থান চিহ্নিত করে একটি বিশেষ চিহ্নের সাহায্যে ডিএনএ-টিকে একটি চিঠির মধ্যে রাখেন। অনেক দিন পর চিহ্ন অনুসরণ করে তারা ডিএনএ-টি খুঁজে মেসেজটি পুনরায় ডিকোড করেন সফলভাবে। আর এর ফলে সবার মাঝে ধারণা আরো শক্ত হয় যে ডিএনএ’র মাধ্যমে ডিজিটাল ডেটা ধারণ সম্ভব।
কিন্তু কীভাবে তাহলে করা যেতে পারে এই কাজটি? ধারণাটি খুবই সাধারণ। এবারে অক্ষর বা সংখ্যার পরিবর্তে ০ এবং ১ নিয়ে কাজ। আরেকটু পরিষ্কারভাবে বললে নিউক্লিওটাইড A কে ০০, G কে ০১, T কে ১০ এবং C কে ১১ দ্বারা প্রকাশ করা হয় এবং সেগুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী সিকোয়েন্স করে ফেলা হলেই তাতে দুর্বোধ্য সব বাইনারি কোডগুলো সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। অন্যভাবে বললে, এই প্রক্রিয়ায় নিউক্লিওটাইড এবং বাইনারি ০, ১ একে অপরের পরিপূরক। আর পুনরায় সেগুলো রিড করা বা ব্যবহার করার জন্য দরকার হবে একটি ডিএনএ সিকোয়েন্স ডিকোডার মেশিন যা চলবে চৌকষ অ্যালগোরিদম মেনে। আর সিন্থেটিক ডিএনএ-গুলো তৈরি করা হয় গবেষণাগারে।
এর আগে ১৯৭৯ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বায়োলজিস্ট জর্জ চার্চ সেসময় ৬,০০০ মার্কিন ডলার খরচ করে ১০টি নিউক্লিওটাইড কেনেন তাতে ডেটা স্টোর করার উদ্দেশ্যে। তাহলে কি মনে হয় এই প্রযুক্তি কি খুব সম্প্রতি আবিষ্কৃত?
সম্প্রতি আবিষ্কৃত না হলেও উন্নত পর্যায়ে পৌঁছাতে অপেক্ষা করতে হয়েছে কয়েক দশক। এবং এখনো তা উন্নয়নের পর্যায়েই রয়েছে। ২০০৯ সালে টরোন্টোর গবেষকগণ ২০০ বাইটের একটি ছোটদের ছড়ার ইমেজ, টেক্সট এবং মিউজিক ফাইল স্টোর করেন একটি ডিএনএ স্ট্র্যান্ডে।
২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা ১৭৯ কিলোবাইট ডেটা স্টোর করতে সক্ষম হন ডিএনএ-তে, আর তাতে সংরক্ষণ করেছিলেন শেক্সপিয়ারের ১৫৪টি সনেট আর মার্টিন লুথারের ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ বক্তৃতার কিছু উদ্ধৃতাংশের টেক্সট ফাইল।
কিন্তু এখন পর্যন্ত সব থেকে বড় রেকর্ড গড়েছে মাইক্রোসফট এবং ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের গবেষকগণ। ২০১৬ সালে তারা ২০০ মেগাবাইট ডেটা স্টোর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর তাতে ছিল ‘ইউনিভার্সাল ডেকোরেশন অব হিউম্যান রাইটস’ এবং হাই ডেফিনিশনের ‘ওকে গো’ এর মিউজিক ভিডিও। কিন্তু এত কম পরিমাণে ডেটা স্টোর করে কী হবে? আর সর্বোচ্চ কতটুকুই বা স্টোর করা যেতে পারে এই ডিএনএ-তে?
ধারণক্ষমতা আর দীর্ঘস্থায়ীতা
এখন পর্যন্ত ডেটা সংরক্ষণে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোতে আছে অনেক সীমাবদ্ধতা। তবে তাত্ত্বিকভাবে এক গ্রাম ডিএনএ ২১৫ পেটাবাইট ডেটা স্টোর করতে সক্ষম। আর এক পেটাবাইট = ১০,০০,০০০ গিগাবাইট। আর ১০০ মিলিয়ন এইচডি মুভি সংরক্ষণ করা যাবে একটি পেন্সিল ইরেজারে। বর্তমানে প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ তথ্য জমা হচ্ছে সারা পৃথিবীব্যাপী ২০৪০ সাল নাগাদ প্রচলিত সব ডেটা স্টোরেজ ডিভাইসের ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। ২০১৬ সালের এক তথ্যানুযায়ী সে সময় ইন্টারনেটে মোট পৃথিবীব্যাপী ডেটার পরিমাণ ১.১ জেটাবাইট। আর ২০২০ সাল নাগাদ তা ৪০ জেটা বাইট অতিক্রম করতে পারে। ১ জেটাবাইট = ১×১০^১২ গিগাবাইট। আর ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সাল নাগাদ এই পরিমাণ ১৬৩ জেটাবাইট অতিক্রম করবে। আর তখনই কাজে আসতে পারে ডিএনএ’র এই প্রযুক্তি। যদি ততদিনে এই প্রযুক্তি পরিপূর্ণতা পায়।
অন্যদিকে মাত্র কয়েক গ্রাম ডিএনএ পুরো পৃথিবীর মানুষের তথ্য ধারণে সক্ষম, যেখানে একটি হার্ডডিস্ক মাত্র কয়েক টেরাবাইট ডেটার স্টোর করার জন্য নেয় বেশ খানিকটা জায়গা।
ডিএনএ স্টোরেজ প্রযুক্তির সব থেকে বড় দুটি সাফল্য হলো তথ্যের নির্ভুলতা এবং দীর্ঘস্থায়ীতা। এখন পর্যন্ত যতগুলো ডেটা স্টোর করা হয়েছে তার সবগুলোই নির্ভুলভাবে ডিকোড বা উদ্ধার করা হয়েছে এবং ভুলের পরিমাণ ছিল শূন্য শতাংশ। আর যতদিন প্রাণের স্পন্দন আছে ততদিন পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকবে ডিএনএ। আলো-বাতাস ছাড়া অনেক ঠান্ডা আর শুষ্ক স্থানে হাজার হাজার বছরেরও বেশি সময় পর্যন্ত ঠিকঠাক থাকতে সক্ষম। যেখানে একটি হার্ডডিস্ক ড্রাইভ মাত্র কয়েক বছর কিংবা এক দশকের কিছুটা বেশি সময় পর্যন্ত কার্যকর থাকে। এছাড়া ডিজিটাল ডিভাইস হ্যাক হবার সম্ভাবনা, এমনকি প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার জন্য ডেটা হারানোর সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিন্তু ডিএনএ-তে মিউটেশন ছাড়া থাকবে না কোনো তথ্য বিকৃতির ভয়। তাই সব দিক থেকেই হয়তো আপনার ষোলো আনা পূর্ণ করতে যাচ্ছে ডিএনএ।
শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞানীরা একটি ব্যাক্টেরিয়ামের উপর পরীক্ষা চালিয়েছেন তার ডিএনএ সিকোয়েন্স করে আর সেটি শূন্যস্থানেও দিব্যি বেঁচেছিল আর মানুষকে মেরে ফেলতে যথেষ্ট রেডিয়েশনেও ছিল দিব্যি ভালো। আর ১,০০০ বার বংশবৃদ্ধি করেও কোনো ডেটা বিকৃত হয়নি কোনোটিতেই।
সীমাবদ্ধতা এবং সম্ভাবনা
আপাতদৃষ্টিতে কাজটি খুব সহজ মনে হলেও এখানে জড়িয়ে আছে অনেক জটিল সব পদ্ধতি আর হিসাবনিকাশ। এখন পর্যন্ত ডিএনএ সিকোয়েন্সিং অনেক ব্যয়বহুল আর সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ডিএনএ তৈরি, সিকোয়েন্সিং অ্যালগরিদম আর তা ডিকোড করা এখনো অনেকাংশে সকলের সাধ্যের বাইরে। সহজেই সকলে ব্যবহার করতে পারে এমন প্রযুক্তিও এখন পর্যন্ত আসেনি। কেবলমাত্র গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা কেবল কয়েক বাইট দিয়ে সূচনা করলেও এখন তা মেগাবাইটে পৌঁছেছে।
আরো একটি সমস্যা হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট ডেটা খুঁজতে হলে তার জন্যে পুরো ডিএনএ-কে ডিকোড করা লাগবে।
তবে এই প্রযুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। ডিএনএ সিকোয়েন্সিং জন্ম দিয়েছে নতুন সম্ভাবনার এবং নেক্সট জেনারেশন ডিএনএ সিকোয়েন্সিং এর মতো অনেক উন্নত শাখার। একটা সময় সকলের কাছে পৌঁছাবে এই প্রযুক্তি আর আপনার হাতের মুঠোই আদতেই থাকবে পুরো পৃথিবীর সব তথ্য। হয়তো তখন সেসব তথ্য থাকবে আপনারই বাসার পেছনের বাগানের গাছগুলোর মধ্যে আর সেসবের বীজ বয়ে বেড়াবে আপনার পরিবারের, দেশের অথবা জীবনের সব দিক, ছবিসহ আরো অনেক মজাদার মুহূর্ত বা জমা থাকবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য কিংবা ইতিহাস। কিংবা হয়তো একটা সময় ভিনগ্রহের প্রাণীরা এসে গবেষণা করবে সেসব ডিএনএ নিয়ে, আবিষ্কার করবে অতীতের মানব সভ্যতা।