২০২০ সাল একটি অনিশ্চিত সময়, বিশৃঙ্খলা ও শোকের বছর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক মহামারির প্রভাবে রেকর্ড পরিমাণ বেকারত্ব, জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরে কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলন, অস্থিতিশীল রাজনীতি ইত্যাদি সবমিলিয়ে সাধারণ জনগণ মানসিকভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। এসবের মাঝেই একটু হালকা মেজাজ, কম সময়ের মধ্যেই মনকে ফুরফুরে করে দেওয়ার জন্যে নতুন কিছুর দরকার ছিল। টিকটক সেরকম একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহজ ভাষায় বললে, টিকটক একটি সামাজিক মাধ্যম মডেলের অ্যাপ যেখানে প্রতিনিয়ত ছোট ছোট ভিডিওর মাধ্যমে প্রধানত নতুন ধরনের হাসি আনয়নকারী বিষয়বস্তু ব্যবহারকারীর স্ক্রিনে তুলে ধরছে।
এটা অনেকটা পার্টির মতো যেখানে সবাই নিজেদের মতো বিভিন্ন পারফর্মেন্স শেয়ার করে এবং তা অন্যদের মোবাইল স্ক্রিনে গিয়ে পৌঁছায়। নাচ-গান, সাজসজ্জা থেকে শুরু করে রান্নার টিউটোরিয়াল পর্যন্ত রয়েছে। প্রতিনিয়ত যোগ হওয়া নতুন ধরনের ভিডিও চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণ করা যায়, অপরিচিত কারোর ভিডিওতে অংশগ্রহণ করা যায়, ফেসবুকের মতো সেসব কনটেন্টগুলোতে আবার ইন্টার্যাক্টও করা যায়।
টিকটকে ভিডিও নির্মাতাদেরকে অনেকগুলো সহজ টুল দেওয়া হয়েছে। যেমন: স্ন্যাপচ্যাটের মতো ফিল্টার, ভিডিওতে ব্যবহারের জন্যে গান খোঁজার সুযোগ। অন্যদের ভিডিওতে বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করার জন্যে ব্যবহারকারীকে বেশ ভালোভাবেই উৎসাহিত করা হয়। ব্যবহারকারী আবার অন্যের ভিডিও অনুকরণ করে ভিডিও বানাতে পারে এবং সেরকম ভিডিওগুলোতে নিজেকে যোগ করতে পারে। এখানে হ্যাশট্যাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এটা টুইটারের মতো বাস্তব পৃথিবীর সাথে সংগতিপূর্ণ হ্যাশট্যাগ নয়। টিকটকে যে হ্যাশট্যাগগুলো চলে তা প্রধানত টিকটকের ভেতরকার ট্রেন্ড, বাইরের দুনিয়ার নয়। বেশিরভাগ সময়েই এই হ্যাশট্যাগগুলো প্রচলিত হয় কোনো ড্যান্স মুভ বা চ্যালেঞ্জের জন্যে।
টিকটক তার পূর্বসুরী অ্যাপগুলোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপাদানগুলো নিজের ফিচার হিসেবে যুক্ত করেছে। তবে, অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার তুলনায় টিকটক একটু ভিন্ন। প্রথম দেখায় মনে হবে, অন্যান্য সোশ্যল মিডিয়ার মতো এটাও ফিড ও ফলোয়ার নির্ভর প্ল্যাটফর্ম। অন্যান্য মাধ্যমের মতো এখানে অনেক বড় সেলিব্রিটিও রয়েছে। কিন্তু এর মূল পার্থক্য হচ্ছে ব্যবহারকারী ফিড। যেটা অ্যাপটিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
টুইটার জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে প্রধানত ফলোয়ারনির্ভর মডেলের মাধ্যমে এবং সেখান থেকেই এর বাকি ফিচারগুলো ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছে। এরপরে ব্যবহারকারীরা এই ধারণাটি দিয়ে কী করে সে ব্যাপারে তারা লক্ষ্য রেখেছে এবং সে অনুযায়ী পরিবর্তন এনেছিল। ‘রিটুইট’ এরকমই একটি ফিচার যেটা ব্যবহারকারীদের প্রভাবে টুইটার যুক্ত করেছিল। এরপরে পাবলিক শেয়ার কোম্পানি হওয়ার পরে তারা আরো ইতিবাচক হওয়া শুরু করলো। ব্যবহারকারীর পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন কনটেন্ট ফিডে প্রদর্শন করলো তারা। ইন্সটাগ্রামের যাত্রাও একইরকম। এখন অ্যালগরিদম নির্ভর সাজেশন ইন্সটাগ্রাম অভিজ্ঞতার একটি লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য। ইউটিউবেও একইরকম সাজেশন দেখা যায়। কিছু ব্যবহারকারী এরকম স্বয়ংক্রিয় ফিচারকে ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করেছে। এগুলোর প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষ যেন অ্যাপে বেশি সময় ব্যয় করে।
টিকটক ওপেন করার পরেই দেখা যায়, অ্যাপটির ফিড অন্য মিডিয়াগুলোর মতো ফলো নির্ভর নয়। এখানে একটা পেজ আছে ‘ফর ইউ’ নামে। ব্যবহারকারী যেসব ভিডিওতে ইন্টার্যাক্ট করেছে তার উপর নির্ভর করে তৈরি করা একটি ফিড। এটা কখনোই কনটেন্টের অভাব বোধ করে না। ব্যবহারকারী যে ভিডিওগুলো দেখেছে অ্যালগরিদম তা থেকে বুঝে নেয় ব্যবহারকারীর চাহিদা কী এবং সে অনুযায়ী ভিডিও প্রদর্শন করে। প্রতিনিয়ত অ্যাপটি ব্যবহারকারীর কাছ থেকে শেখে এবং তার পছন্দ অপছন্দের উপর নির্ভর করে শেষে একটি মডেল তৈরি করে ফেলে। এভাবে অ্যালগরিদমটি অনেক বেশি কার্যকর। অ্যাপটি প্রথমবারের মতো ওপেন করার পর থেকেই টিকটক অনুমান করা শুরু করে। ইন্সটাগ্রাম যদি সম্পূর্ণ তার ‘এক্সপ্লোর’ ট্যাবটির উপর নির্ভর করতো তাহলে অথবা ফেসবুকে কাউকে ফলো করার আগে থেকেই যদি ফিডে কনটেন্ট আসা শুরু করে তাহলে যেমন হতো টিকটকের মডেলটি অনেকটা সেরকম।
অডিয়েন্সের দিক থেকে টিকটকের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, এখানে প্রবেশের পথটা অনেক সহজ। বড় সংখ্যক অডিয়েন্সের কাছেই সহজেই পৌঁছানো যায় এবং ছোট নির্মাতাদের উপরে সহজেই নজর পড়ে। কারণ অ্যালগরিদমটি তৈরিই হয়েছে সব নির্মাতাদের কনটেন্ট যেন সমানভাবে ভিউ হয় সেরকম ভারসাম্যের লক্ষ্য নিয়ে। বেশিরভাগ সোশ্যাল মিডিয়াতেই অনেক মানুষের কাছে পৌঁছানোর প্রথম ধাপ হচ্ছে, বিশাল অডিয়েন্স অথবা বিশাল সংখ্যক ফ্রেন্ড গ্রুপ বানাতে হবে। টিকটক ব্যবহারকারীকে এক অডিয়েন্স থেকে অন্য অডিয়েন্সের কাছে, এক ট্রেন্ড থেকে অন্য ট্রেন্ডে যাওয়ার জন্যে উৎসাহিত করে । এভাবে ভাইরাল হওয়ার রাস্তাটি খুবই সহজ এখানে। অ্যাপটি ব্যবহারের উদ্দীপনা সবসময়েই উপস্থিত থাকে। ব্যবহারকারী অনুভব করেন, তিনি যে মিডিয়াটি ব্যবহার করছেন তা যেন চারপাশেই ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। দ্যা অ্যাটলান্টিকের টেইলর লরেন্টজ বলেছেন,
Watching too many in a row can feel like you’re about to have a brain freeze. They’re incredibly addictive.
তাছাড়া অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতে মানুষ নিজের সবচেয়ে ভদ্র ও সুন্দর রূপটি প্রকাশে আগ্রহী থাকে। কিন্তু মিম কালচার প্রভাবিত হওয়ায় টিকটকে উদ্ভট ও অপ্রচলিত অনেক কনটেন্ট পাওয়া যাচ্ছে।
টিকটক ইতোমধ্যে ২০২০ সালের সবচেয়ে ডাউনলোড করা অ্যাপে পরিণত হয়েছে। দুই বছর আগে বিশ্বব্যাপী মুক্তি পাওয়ার পর থেকে টিকটক ও তার চীনা ভার্সন ডুয়োইংয়ের মাসিক ব্যবহারকারী দাঁড়িয়েছে ৮০০ মিলিয়নে, সংখ্যাগত দিক থেকে যা রেডিট, স্ন্যাপচ্যাট ও টুইটারকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর স্বত্বাধিকারী কোম্পানি ‘বাইটড্যান্স’ এখন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান স্টার্টআপ কোম্পানি।
টিকটকের এই প্রচণ্ড উত্থানের পথটি এই পর্যায়ে এসে বিভিন্নরকম বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে, অ্যাপটির জন্ম চীনে যেখানে সবগুলো কোম্পানির সাথে তাদের সরকারের আইনগতভাবে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির সরকারকে তথ্যগত দিক থেকে কেউই বিশ্বাস করে না। বিভিন্ন কারণে টিকটকের বিরুদ্ধে সেন্সরশিপ ও গোপনীয়তা ভঙ্গের অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগের তোপের মুখে অনেকটা বাধ্য হয়েই টিকটকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে চীনের বাইরের একজনকে নিযুক্ত করা হয়েছে। গত মে মাসে ডিজনির স্ট্রিমিং বিভাগের সাবেক প্রধান কেভিন মেয়ার এই পদে নিযুক্ত হয়েছেন। তার প্রথমদিকের চ্যালেঞ্জগুলোর তালিকায় একেবারে উপরে থাকবে টিকটকের উপর আমেরিকানদের আস্থা অর্জন যা খুব সহজ হবে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, মহামারিকালীন এই অনিশ্চিত সময়েও টিকটকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
টিকটকের পূর্বসুরী ছিল ‘মিউজিক্যালি’ নামে একটি অ্যাপ। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই অ্যাপটি ব্যবহারকারীদেরকে পনেরো সেকেন্ডের ভিডিও শেয়ার করার একটি প্ল্যাটফর্ম দিয়েছিল। বেশিরভাগ কন্টেন্টই হয়ে উঠে বিভিন্ন গানে ঠোঁট মেলানো (লিপ সিংক) ও নাচের ভিডিও এবং এই কারণেই সম্ভবত কিশোর ও তরুণদের কাছে অ্যাপটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। মিউজিক্যালিতে যে গানগুলো ব্যবহার করা হতো তা এই অ্যাপে ব্যবহার করার জন্যে লাইসেন্সকৃত ছিল। পরবর্তীতে, মিউজিক্যালির প্রধান লক্ষ্যই হয়ে দাঁড়ায় এই ধরনের ভিডিও শেয়ারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। তারা বুঝতে পেরেছিল, গান শোনা ও তা শেয়ার করা মানুষের একটি সহজাত অভ্যাস এবং তা সামাজিক মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে প্রচলন করার এটি একটি উপায়। এক বছরের মধ্যেই এটি আইটিউনস অ্যাপ স্টোরের এক নম্বর অ্যাপ হয়ে দাঁড়ায় এবং এই বৃদ্ধি বজায় রাখে, যার ফলে ২০১৭ সালে বেইজিংয়ের স্টার্টআপ কোম্পানি বাইটড্যান্স এটি কিনে নেয়। বাইটড্যান্স আগে থেকেই টিকটকের স্বত্বাধিকারী ছিল। তারা মিউজিক্যালিকে টিকটকের সাথে মার্জ করে ফেলে।
টিকটকের সদর দপ্তর এখন ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে অবস্থিত। অ্যাপটির ব্যবহারকারী যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই নতুন নতুন সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটির জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। টিকটকে শেয়ার করা কনটেন্টগুলো প্রথম থেকেই ‘পাবলিক’ করা থাকে অর্থাৎ যে কেউ এই কনটেন্ট দেখতে পারে। এখানে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবহৃত অ্যালগরিদমটি ঠিক করে দেয়, ব্যবহারকারীর ফিডে কোন কনটেন্টগুলো যাবে।
টিকটকের কনটেন্ট অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার তুলনায় অনেকটাই আলাদা। ভিডিওগুলো অনেকটা ‘মিম কালচার’ থেকে প্রভাবিত। কনটেন্ট নির্মাতারা প্রধানত সে ভিডিওগুলোই বেশি তৈরি করেন যেগুলো মিম কালচার প্রভাবিত। জ্যাক কিং টিকটকের একজন সেলিব্রিটি। তিনি এডিটিংয়ের বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে যে ভিডিও নির্মাণ করেন সেগুলো দেখে ম্যাজিকের কারসাজি মনে হয়। এরকম সৃজনশীল দক্ষতা টিকটকে তার ৪৪ মিলিয়ন ফলোয়ার তৈরি করেছে; জুন ২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কিংয়ের বয়স ত্রিশ বছর হলেও বেশিরভাগ সেলিব্রিটিই কিশোর বয়সী। এই বয়সীদের কাছে লিপ সিংক ও বিভিন্নরকম নাচ তুমুলভাবে জনপ্রিয়। তবে বিভিন্ন মানুষ তাদের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় খুঁজে নিচ্ছেন এখানে। যার মধ্যে রয়েছে কৌতুক, রান্নার ভিডিও ও নানা ধরনের টিউটোরিয়াল।
কোয়ারেন্টাইনের সময়ে ঘরের ভেতরে একঘেয়ে সময়ে এই অ্যাপটি নতুন ধরনের একটি ট্রেন্ড এনে দিয়েছে। ঘরে বসেই খুব সহজে ছোট ছোট ভিডিও বানানোর কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে অ্যাপটি। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত এর ব্যবহারকারী বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে শুধু গত মার্চেই এর ব্যবহারকারী বেড়েছে ১২ মিলিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রে স্ন্যাপচ্যাট ও ইন্সটাগ্রাম ব্যবহারকারীর তুলনায় ব্যবহারকারীরা টিকটকে বেশি সময় ব্যয় করেন। টিকটকের জন্যে এটা একটা বড় ব্যাপার, কারণ স্ন্যাপচ্যাট ও ইন্সটাগ্রাম হচ্ছে এই অ্যাপের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। এইসবগুলো অ্যাপই কমবয়সী ছেলেমেয়ের কাছে প্রচুর জনপ্রিয়। সিএনবিসির হিসাব অনুযায়ী, এই বছরে টিকটকের ব্যবহারকারী ৪৫ মিলিয়ন বাড়বে। ইন্সটাগ্রাম ও স্ন্যাপচ্যাটের ব্যবহারকারী বাড়বে যথাক্রমে ১১০ মিলিয়ন ও ৮৫ মিলিয়ন। তাই যুক্তরাষ্ট্রে টিকটককে শীর্ষে উঠতে হলে এখনো কিছু পথ পাড়ি দিতে হবে।
চীনে টিকটকের ভার্সনটির নাম হচ্ছে ডুয়োয়িং। ২০২০ সালের প্রথম কোয়ার্টারে টিকটক এবং ডুয়োয়িং ৩১৫ মিলিয়ন বার ডাউনলোড হয়েছে যা আগের বছরের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এপ্রিল মাসের হিসাবে, কোম্পানিটির মোট ডাউনলোড হয়েছে ২ বিলিয়নের কাছাকাছি। ইন্ডিয়া এই অ্যাপটির সবচেয়ে বড় মার্কেট ছিল, সর্বমোট ৩০.৩ শতাংশ ব্যবহারকারীই ছিল ইন্ডিয়ার কিন্তু গত জুন মাসে সেখানে অ্যাপটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চীন এই অ্যাপের সবচেয়ে বেশি লাভজনক মার্কেট, শতকরা ৭২ ভাগ লভ্যাংশই এখান থেকে আসে। যুক্তরাষ্ট্র লভ্যাংশের দিক থেকে দ্বিতীয় ও ডাউনলোডের দিক থেকে তৃতীয় এবং এখানে এর প্রভাব ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। ভাইরাল হওয়া নাচ ও মিমে ব্যবহারের ফলে অনেকগুলো গান যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে ২০১৯ সালের ‘ওল্ড টাউন রোড’।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ উপার্জনের একটি ভালো সিস্টেম দাঁড় করাতে হলে টিকটককে সববয়সী মানুষদেরকে সমানভাবে আকর্ষণ করা জরুরী। কারণ বিজ্ঞাপনদাতারা বিস্তৃত ধরনের মানুষের পিছনে ছোটে, বিশেষভাবে যাদের কেনার জন্যে পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে। সেদিক থেকে কিশোর বা তরুণ বয়সীরা খুব ভালো টার্গেট অডিয়েন্স না। তবে টিকটকের এখনই সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ উপার্জনের কোনো তাড়া নেই। ধীরে ধীরে সোশ্যাল মিডিয়ার একটি স্থায়ী অবস্থানে পৌঁছানোটা এখন বেশি জরুরী। স্বত্বাধিকারী কোম্পানি বাইটড্যান্সের মূল্য এখন ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও উপরে এবং মাত্র গত বছরেই তারা তিন বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছে। টিকটক, ডুয়োয়িং ছাড়াও তাদের আরো কিছু লাভজনক চীনা অ্যাপ রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে টোটিয়াও।
উপার্জনের তুলনায় টিকটকের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে গোপনীয়তা ও ব্যবহারকারীর তথ্য বিষয়ে রাষ্ট্রগুলোর আস্থা অর্জন। এর আগে কোনো চীনা অ্যাপের কাছেই এতো আমেরিকানের তথ্য জমা হয়নি। আর চীনা কোম্পানি ও চীনা কম্যুনিস্ট সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ নিবিড়। টিকটক যদিও দাবি করে যে, আমেরিকান সকল ডেটা আমেরিকাতেই সংরক্ষিত, তাই চীনা আইন অনুযায়ী তা সরকারের কাছে দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়, অনেক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তারপরেও সন্দেহ পোষণ করেছেন। এরকম ঘটনা ভারতেও বিদ্যমান ছিল, যেখানে তথ্য নিরাপত্তা আইন আরো দূর্বল যার ফলে নাগরিকদের তথ্য নিয়ে সন্দেহ পোষণের অনেকরকম কারণ ছিল।
কয়েক বছর ধরে ঘটে চলা কিছু ব্যাপার এরকম সন্দেহ পোষণের পেছনে যথেষ্ট কারণ তৈরি করেছে। গত সেপ্টেম্বরে, দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে, টিকটক মডারেটরদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া ছিল, তারা টিয়ানামেন স্কয়ার ও চীনা সরকারের জন্যে এরকম সংবেদনশীল ভিডিওগুলো যেন সেন্সর করে। যদিও কোম্পানিটি দাবি করে যে, অনুসন্ধান সময়ের পরে এ ধরনের নির্দেশনাগুলো তারা সরিয়ে ফেলেছে, তবুও আমেরিকার ‘ফেডারেল কমিটি অন ফরেন ইনভেস্টমেন্ট’ বাইটড্যান্সের মিউজিক্যালি কিনে নেওয়ার ব্যাপারটি খতিয়ে দেখছে।
অতি সম্প্রতি অ্যাপটি একটি অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে যেটাকে তারা অনিচ্ছাকৃত ভুল হিসেবে দাবি করছে। অভিযোগটি হলো, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার ও জর্জ ফ্লয়েডের হ্যাশট্যাগ সম্বলিত পোস্টগুলোতে ভিউয়ারের সংখ্যা দেখানো হয়েছে শুন্য যেখানে তা দুই বিলিয়নকেও ছাড়িয়ে গেছে। অতীতে ইন্দোনেশিয়া অ্যাপটির উপরে সহিংসতা ও পর্নোগ্রাফির মতো কনটেন্টের কারণে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। অন্যদিকে, কিশোর বয়সীদের গোপনীয়তা সংক্রান্ত কিছু বিষয় নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। আপাতভাবে, ১৩ বছরের কম বয়সীরা অ্যাপটি ব্যবহার করা নিষেধ। কিন্তু টিকটক এই বয়সীদের আইডি খোলা থেকে বিরত রাখার জন্যে খুব বেশি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কোম্পানিটি অবৈধভাবে শিশুদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে এফটিসিকে (ফেডারেল ট্রেড কমিশন) ৫.৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। এই ঘটনার পরে যুক্তরাজ্য সরকারও একই ব্যাপারে নিজেদের মতো অনুসন্ধান চালানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। টিকটক আশ্বাস দিয়েছিল, তাদের গোপনীয়তা সংক্রান্ত নিয়মকানুনগুলো পরিবর্তন করবে। তবুও ২০২০ সালের মে মাসেই কনজ্যুমার গ্রুপগুলো জানিয়েছে, টিকটক তাদের কথা রাখেনি। নিঃসন্দেহে, বর্তমান নির্বাহী কেভিন মেয়ারের জন্যে এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, যদিও ডিজনিতে তার সাফল্য দেখে অনেক বিশেষজ্ঞই তাকে টিকটকের এই অভিযোগগুলো নিষ্পত্তির ব্যাপারে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে, সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মাঝে কোনো আমেরিকান কোম্পানি যদি টিকটককে কিনে না নেয়, সেক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকায় অ্যাপটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে। অ্যাপটি কিনে নেওয়ার ব্যাপারে মাইক্রোসফট অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে।
টিকটকের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, বিজ্ঞাপন থেকে উপার্জনের একটি স্থিতিশীল মডেল তৈরি। ইউটিউব এক্ষেত্রে একটি ভালো অনুপ্রেরণা হতে পারে। তাছাড়া টিকটককে বড় ভিডিও কনটেন্ট শেয়ার করার জন্যেও প্ল্যাটফর্ম উন্মুক্ত করতে হবে। কারণ চিরকাল ৬০ সেকেন্ডের ভিডিও দিয়ে জনপ্রিয় থাকার লক্ষ্যটা খুব বেশি বাস্তববাদী নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এরকম স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভিডিওর জনপ্রিয়তা খুব বেশি হলে দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী থাকতে পারে। তাছাড়া এর লাইভ স্ট্রিম ফিচারটি নিয়েও কাজ করতে হবে। চীনে এই ফিচারটি তুমুল জনপ্রিয় কিন্তু আমেরিকাতে তা এখনো সুবিধা করতে পারেনি। টিকটক লাভজনক হয়ে উঠবে যদি বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্যে তারা একটি সুন্দর কাঠামো তৈরি করতে পারে এবং একইসাথে, ভবিষ্যতেও অ্যাপটিতে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদেরকে নিয়মিত হওয়ার জন্যে পর্যাপ্ত উপাদান সরবরাহ করতে পারে।
একটি নতুন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহার ও জীবনযাত্রায় নতুন প্রভাব ফেলে। যেমন, অনেকেই স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহার করেনি কিন্তু স্ন্যাপচ্যাটের অত্যধিক জনপ্রিয়তার ফলে ফেসবুক নিজেদের ব্যবহারকারী ধরে রাখতে ইন্সটাগ্রামে অনেকগুলো ফিচার যুক্ত করেছে যা সরাসরি স্ন্যাপচ্যাট থেকে অনুকরণ করা হয়েছে। এভাবে, ইন্সটাগ্রাম ও ফেসবুক ইউজাররাও স্ন্যাপচ্যাট দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আবার, টুইটার ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় না হলেও বিখ্যাত মানুষদের টুইটগুলো প্রতিনিয়ত সংবাদ মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌছাচ্ছে। আর এখন তো অনেক রাষ্ট্রপ্রধানই চলমান ঘটনাগুলোর ব্যাপারে টুইটারে মতামত জানান। ফলে ব্যবহার না করলেও আমরা টুইটারের প্রভাবের বাইরে না। টিকটকও একইভাবে আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলবে। অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর নির্বাচিত মানুষ বা কম্যুনিটির মাধ্যমে তার চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলে, টিকটক সেখানে একেবারে অপরিচিত কাউকে মূল ট্রেন্ডের উৎস হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। একেবারে দূর্বল ও ক্ষমতাহীন কেউও এভাবে সীমাহীন ক্ষমতার উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে।