ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনের বাজারে স্যামসাং ইলেকট্রনিক্সের দাপুটে রাজত্বের বিষয়টি ইতিহাস হিসেবে বেশ পুরনো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটি বেশ বড় ধরনের চমক দেখিয়েছে বাজেট স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে। চলতি বছরের মার্চ মাসে স্যামসাং ভারতের বাজারে এনেছে ‘এ সিরিজ’-এর তিনটি অনবদ্য স্মার্টফোন- গ্যালাক্সি এ১০, এ৩০ এবং এ৫০। আর মার্চের ১ তারিখ থেকে পরবর্তী ৪০ দিনে এই ‘এ সিরিজ’-এর স্মার্টফোনগুলো ভারতের বাজারে বিক্রি হয়েছে অন্তত বিশ লক্ষ ইউনিট! চমকে দেওয়া এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় স্যামসাং সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে এবছরই ভারতের বাজারে এ সিরিজের চতুর্থ স্মার্টফোন ‘গ্যালাক্সি এ২০’ নিয়ে আসার।
২০১৪ সালে গ্যালাক্সি এ৩ এবং গ্যালাক্সি এ৫ নামের দুটি স্মার্টফোন বাজারে আনার মধ্য দিয়ে ‘এ সিরিজ’ (A Series) নামের একটি নতুন স্মার্টফোন সিরিজ চালু করে স্যামসাং। স্বাধীনচেতা এবং প্রযুক্তিপ্রেমী তরুণদের কথা মাথায় রেখেই এসেছিল এই স্মার্টফোন সিরিজ এবং ফোন দুটি সমাদৃতও হয় ব্যাপকভাবে। স্যামসাং এর ‘অ্যাকশন সিরিজ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই সিরিজে পরবর্তী বছরগুলোতে আসে গ্যালাক্সি এ৭, এ৮, এ৮+, এ৯, এ৯প্রো মডেলের বিভিন্ন সংস্করণ। এই সিরিজের স্মার্টফোনগুলোর দারুণ সাফল্যের প্রধানতম কারণ হলো, বাজেট স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে এই সিরিজের ফোনগুলোতে এমন কিছু সুবিধা বা ফিচার থাকে, যা প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফ্ল্যাগশিপ ‘এস’ সিরিজেই শুধুমাত্র দেখা যায়। বিশেষত এই সিরিজের ফোনগুলোর আল্ট্রা-ওয়াইড ক্যামেরা স্যামসাং তো বটেই, গোটা স্মার্টফোনের বাজারেই এসেছে এই প্রথমবারের মতো।
২০১৯ সালে স্যামসাং চেষ্টা করেছে গ্যালাক্সি এ সিরিজটিকে আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে। যার ফলে এ সিরিজের স্মার্টফোনগুলো এখন হয়ে দাঁড়াচ্ছে একের মধ্যে সবকিছুর সমন্বয়। দ্রুতগতির প্রসেসর, বাজেটের মধ্যে সবচেয়ে দারুণ ক্যামেরা সেটআপ, দারুণ নকশা- সবক্ষেত্রেই এই সিরিজের স্মার্টফোনগুলোতে সমন্বয় ঘটেছে সময়োচিত আধুনিকতার। আর সেকারণেই এখন মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এই সিরিজটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে দারুণভাবে। ভারতের বাজারে মাত্র ৪০ দিনে তিনটি মডেলের প্রায় ২০ লাখ ফোন বিক্রি সত্যিকার অর্থেই এই অঞ্চলের স্মার্টফোন ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটি রেকর্ড। এই অল্প সময়েই প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের ফোন কিনেছেন ক্রেতারা।
কেমন ছিল দারুণ জনপ্রিয় এই স্মার্টফোনগুলো? চলুন দেখে আসি এ সিরিজের সর্বশেষ চার মডেলের ফোনগুলোর খুঁটিনাটি।
গ্যালাক্সি এ১০
গ্যালাক্সি এ সিরিজের এই বাজেট স্মার্টফোনটিতে ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির অক্টাকোরের এক্সিনোস ৭৮৮৪ প্রসেসর এবং মালি-জি৭১ এমপি২ সিরিজের জিপিইউ। ৬.২ ইঞ্চির আইপিএস পর্দাবিশিষ্ট স্মার্টফোনটিতে ৩৪০০ মিলিআম্পিয়ারের বড় ব্যাটারির পাশাপাশি মাল্টি-টাস্কিং সামলে নেবার জন্য আছে ২ গিগাবাইট র্যাম।
ফোর-জি সমর্থিত স্মার্টফোনটিতে ১.৯ অ্যাপাচারের ১৩ মেগাপিক্সেলের রিয়ার ক্যামেরার পাশাপাশি, সেলফি তোলার জন্য থাকছে ৫ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা। স্মার্টফোনটিতে ব্যবহৃত হয়েছে আন্ড্রয়েডের সর্বশেষ সংস্করণ। বাংলাদেশের বাজারে এর আনুষ্ঠানিক মূল্য ঠিক করা হয়েছে ১২ হাজার টাকা।
গ্যালাক্সি এ৩০
দ্রুতগতির প্রসেসর, উন্নত ক্যামেরা সেটআপ এবং বাহ্যিক ডিজাইনের বিচারে এই স্মার্টফোনটি বেশ এগিয়ে আছে। ফোনটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৪ মিলিমিটারের অক্টাকোর এক্সিনোস ৭৯০৪ সিরিজের প্রসেসর এবং মালি-জি৭১ এমপি২ সিরিজের জিপিইউ। ৬.৪ ইঞ্চির সুপার অ্যামোলেড পর্দার জন্য দেওয়া হয়েছে ৪০০০ মিলিঅ্যাম্পিয়ারের বড় ব্যাটারি।
স্মার্টফোনটিতে ১৬ মেগাপিক্সেল এবং ১.৭ অ্যাপাচারের অসাধারণ লো-লাইট রিয়ার ক্যামেরার সাথে ৫ মেগাপিক্সেলের আল্ট্রা ওয়াইড ক্যামেরা এবং ১৬ মেগা পিক্সেলের সেলফি ক্যামেরার সমন্বয় রয়েছে। এছাড়া দ্রুতগতির মাল্টি-টাস্কিং এবং গেমিং পারফর্মেন্সের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ৪ গিগাবাইট র্যাম। আন্ড্রয়েডের সর্বশেষ সংস্করণ এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট সুবিধাসহ আকর্ষণীয় এই স্মার্টফোনটি বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ২৩ হাজার টাকায়।
গ্যালাক্সি এ৫০
নতুন গ্যালাক্সি এ৫০ স্মার্টফোনটিতে থাকছে ৬.৪ ইঞ্চি সুপার অ্যামোলেড পর্দা এবং ৪০০০ মিলিঅ্যাম্পিয়ারের ব্যাটারি। বর্তমান ট্রেন্ডের সাথে সমন্বয় রেখে ফোনটিতে দেওয়া হয়েছে তিনটি ক্যামেরা। রিয়ার ক্যামেরায় ১.৭ অ্যাপাচারের ২৫ মেগাপিক্সেলের সাথে থাকছে ৮ মেগা পিক্সেলের আল্ট্রা ওয়াইড সেন্সর এবং ৫ মেগাপিক্সেলের একটি ডেপথ সেন্সর। সেলফি ধারণের জন্য দেওয়া হয়েছে ২ অ্যাপাচারের ২৫ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা। দ্রুতগতির মাল্টি টাস্কিং এবং গেমিং পারফর্মেন্স দিতে থাকছে ১০ মিলিমিটারের অক্টাকোর এক্সিনস ৯৬১০ সিরিজের প্রসেসর এবং মালি-জি৭২ এমপি৩ সিরিজের জিপিইউ।
স্মার্টফোনটি পাওয়া যাচ্ছে ৪ এবং ৬ গিগাবাইট র্যামের ভিন্ন সংস্করণে। ফোনটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর এইচডিআর সমর্থিত পর্দা এবং ইন-ডিসপ্লে ফিঙ্গারপ্রিন্ট। বাংলাদেশের বাজারে ৪ গিগাবাইট র্যামের সংস্করণটির মূল্য ২৭ হাজার টাকার কাছাকাছি।
গ্যালাক্সি এ৯
গত বছরের নভেম্বর মাসে এ সিরিজের এই ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনটি বাজারে নিয়ে আসে স্যামসাং। স্মার্টফোনটিতে ৬.৩ ইঞ্চি সুপার অ্যামোলেড পর্দার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ৪০০০ মিলিঅ্যাম্পিয়ারের ব্যাটারি। ফোনটিতে বর্তমান ট্রেন্ডের সাথে সমন্বয় রেখে থাকছে ফ্লাগশিপ পর্যায়ের চারটি রিয়ার ক্যামেরা। ১.৭ অ্যাপাচারের ২৪ মেগাপিক্সেল ক্যামেরার পাশাপাশি ৮ মেগাপিক্সেলের আল্ট্রা-ওয়াইড সেন্সর, ১০ মেগাপিক্সেলের টেলিফটো সেন্সর এবং ৫ মেগাপিক্সেলের ডেপথ সেন্সর ক্যামেরা দেওয়া হয়েছে এটিতে। সেলফি ক্যামেরা হিসেবে থাকছে ২ অ্যাপাচারের ২৪ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা। মাল্টি টাস্কিং এবং গেমিং পারফর্মেন্সের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ১৪ মিলিমিটারের কোয়ালকমের অক্টাকোর সিরিজের ৬৬০ প্রসেসর এবং আড্রিনো ৫১২ সিরিজের জিপিইউ।
৪ এবং ৬ গিগাবাইট র্যামের ভিন্ন সংস্করণে বাজারে আসা এই স্মার্টফোনে দেওয়া হয়েছে ডলবি সাউন্ড, দ্রুত চার্জ করার সুবিধা, এইচডিআর এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট ফিচার। স্মার্টফোনটি দিয়ে ধারণ করা যাবে ফোর-কে মানের ভিডিও। বাংলাদেশের বাজারে ৬ গিগাবাইট র্যামের সংস্করণটির মূল্য দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার টাকার কাছাকাছি।
দারুণ এই স্মার্টফোনগুলোর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি সামনের দিনগুলোতে এই সিরিজের অধীনে আনতে যাচ্ছে এ২, এ৮০, এ৭০, এ৬০, এ৪০ মডেলের বেশ কয়েকটি নতুন স্মার্টফোন। দেশভেদে মডেলগুলোর প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে তারতম্য হলেও, বাংলাদেশ এবং ভারতের স্মার্টফোন বাজারে অচিরেই আরও নতুন নতুন ‘গ্যালাক্সি এ’ স্মার্টফোন উন্মুক্ত হবে বলেই আশা স্মার্টফোনপ্রেমীদের। এই সিরিজের নতুন স্মার্টফোনগুলোতে ব্যবহৃত ‘ইনফিনিটি পর্দা’ এবং ‘আল্ট্রা ওয়াইড ক্যামেরা’ অ্যাডভঞ্চারপ্রিয় তরুণদের মাঝে সাড়া ফেলেছে দারুণভাবে। স্যামসাং এ সিরিজের এই পুনঃরুত্থান এবং সাম্প্রতিক সাফল্য সামনের দিনগুলোতে মধ্য বাজেটের স্মার্টফোন বাজারে স্যামসাংকে দারুণ এগিয়ে রাখবে, একথা কিন্তু হলফ করেই বলা যায়।