বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর যুগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ সেমিকন্ডাক্টরের হাতে। আমাদের নিত্য ব্যবহৃত প্রতিটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মূল চালিকাশক্তিই শুধু নয়, এসব ডিভাইস যে ফ্যাক্টরিগুলোতে তৈরি হয়, সেগুলোকে চলার শক্তিও দেয় এই সেমিকন্ডাক্টর। আমাদের ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, গাড়ি, ওয়াশিং মেশিন এমনকি রেফ্রিজারেটরেও সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার রয়েছে। নিত্য ব্যবহার্য এ রকম অসংখ্য ডিভাইসের পাশাপাশি পাওয়ার গ্রিড আর সামরিক খাতেও রয়েছে এর বিশাল ব্যবহার। মোটরগাড়ি ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে যোগাযোগ, প্রকৌশল, চিকিৎসা, সামরিক ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর প্রচণ্ড নির্ভরতার ফলে অনেকে একে ডিজিটাল যুগের তেল হিসেবে নামকরণ করেছেন।
কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম থেকেই সেমিকন্ডাক্টরের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে দূরত্ব দেখা যাচ্ছিল। সেমিকন্ডাক্টর স্বল্পতার কারণে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে এর প্রভাব দেখা দেয়। বিশ্বজুড়ে এই সংকটটি এখন প্রবল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেমিকন্ডাক্টর চিপের এই স্বল্পতার কারণ আলোচনা করার আগে, সেমিকন্ডাক্টর কী জিনিস, তা জানা প্রয়োজন। সেমিকন্ডাক্টর বলতে অর্ধ-পরিবাহী পদার্থ বুঝানো হয়, যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে সিলিকন। এ রকম অর্ধ-পরিবাহী দিয়ে ট্রানজিস্টর নির্মাণ করা হয়। সহজ ভাষায়, সিলিকনের মধ্যে ট্রানজিস্টরসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র উপাদান স্থাপন (embed) করে যে সার্কিট তৈরি হয়, সেটাকে বলা হয় ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা চিপ। কম্পিউটার, সেলুলার ফোন এবং অন্য সকল আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের মূল গাঠনিক উপাদান হিসেবে ট্রানজিস্টর ব্যবহার করা হয়। আজকাল অবশ্য যেসব পণ্যে বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়োজন, সেসব পণ্যেই এরকম সার্কিট ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, সব ইলেকট্রনিক পণ্যেই এই চিপের ব্যবহার রয়েছে।
সেমিকন্ডাক্টরে যে ট্রানজিস্টর ব্যবহার করা হয়, তা প্রথমবারের মতো ১৯৪৭ সালে উদ্ভাবন করা হয়েছিল। এর উদ্ভাবনকারীরা উইলিয়াম শকলি, ওয়াল্টার ব্রেটেইন ও জন বারডিন পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। এই আবিষ্কারটি আধুনিক ডিজিটাল দুনিয়ার জন্য একটি ভিত হয়ে দাঁড়ায়। ট্রানজিস্টরের পরে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আইসি) উদ্ভাবিত হয়, এরপরে হয় মাইক্রোপ্রসেসর। এর ফলে তৎকালীন বিশালাকারের কম্পিউটারগুলো ছোট হতে হতে, আজকে আমাদের ঘরের কোণে টেবিলের উপরে জায়গা নিয়েছে।
আজকের যুগের সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিটি বিশাল। এর মধ্যে প্রধানত দুইটি ভাগ রয়েছে। কিছু কোম্পানি রয়েছে, যারা চিপ ডিজাইন করে। তাদেরকে বলা হয় ‘ফ্যাবলেস’ কোম্পানি। অন্য ভাগে রয়েছে, যারা এগুলো নির্মাণ করে। এই কোম্পানিগুলোকে বলা হয়, ‘ফাউন্ড্রি’। ফাউন্ড্রি মডেলের সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলো হচ্ছে, ইন্টেল, স্যামসাং ও টিএসএমসি। এদের কাজ করার ধরন ভিন্ন। স্যামসাং এবং ইন্টেল ডিজাইন থেকে শুরু করে উৎপাদন ও বিক্রি সবই করে থাকে। অন্যদিকে টিএসএমসি শুধুই ফাউন্ড্রি। তবে, টিএসএমসির পরিধি বিশাল। অ্যাপল, এএমডি, এনভিডিয়ার মতো কোম্পানিগুলোর ডিজাইনকৃত চিপ তারা নির্মাণ করে দেয়।
এদিক থেকে চিন্তা করলে বেশিরভাগ বড় কোম্পানিই ফ্যাবলেস মডেলটি অনুসরণ করছে। আর তাদের ডিজাইনকৃত পণ্যের অর্ডার তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর বা স্যামসাংয়ের মতো ফাউন্ড্রির কাছে পাঠাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিপ ইন্ডাস্ট্রি বিক্রির দিক থেকে বিশ্ববাজারের ৪৭ শতাংশ দখল করে রেখেছে। সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদনের দিক থেকে এই সংখ্যাটি মাত্র ১২ শতাংশ।
সেমিকন্ডাক্টর চিপ সময়ের সাথে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে, একইসাথে পাল্লা দিয়ে তাদের ক্ষমতাও বাড়ছে। আমেরিকান জায়ান্ট ইন্টেলের সহপ্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুর ১৯৬৫ সালে একটি নীতি বর্ণনা করেছেন, চিপের মধ্যে ব্যবহৃত ট্রানজিস্টরের সংখ্যা প্রতি দুই বছরে দ্বিগুণ পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। তার মানে, কম্পিউটারগুলোর সক্ষমতা এই সময়ে দ্বিগুণ হবে। সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আকার কমানোর ব্যাপারে এটা একটা নির্দেশক।
আমরা অনেকেই হয়তো এই ব্যাপারটা উপলদ্ধি করতে পেরেছি। কত দ্রুত প্রযুক্তির এক জেনারেশন থেকে আরেকটি জেনারেশনে পা দিচ্ছি আমরা। প্রচণ্ড গতির ফাইভজি সংযোগ দ্রুতই সাধারণের নাগালে এসে পড়ছে। ইন্টারনেট অব থিংসের ব্যবহার বাড়ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমর্থিত প্রযুক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া চিপের এই ক্ষমতা ব্যবহার করছে। চিপগুলোর ক্ষমতা যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের প্রস্তুতকারীরা সাপ্লাই চেইনের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে তত দক্ষ হচ্ছে। এই ব্যাপারটিও কিছুটা চিপ সংকটের জন্যে দায়ী। চিপের চাহিদা অনুযায়ী মূল উৎপাদনকারীর সংখ্যা অনেক কম।
চিপের প্রতি জেনারেশনের সাথে তার দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাঁচ ন্যানোমিটারের চিপ উৎপাদনের জন্যে কমপক্ষে ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের ফ্যাসিলিটি দরকার হয়। এ রকম একটি চিপের উদাহরণ হলো, অ্যাপলের এ১৪ বায়োনিক। অ্যাপল দাবি করে, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রত স্মার্টফোন প্রসেসর। এই চিপগুলো টিএসএমসিতে তৈরি। অথচ এই নামটি অনেকেই শুনেনি, যেরকমভাবে সবাই অ্যাপলের নাম শুনেছে। কিন্তু টিএসএমসির সাহায্য ছাড়া অ্যাপল এটা করতে পারতো না। একই কথা হুয়াওয়ের ক্ষেত্রেও বলা যায়।
গত বছরের শুরু থেকেই কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির কারণে মানুষ ঘরে বসে অফিস, মিটিং, ক্লাস করতে বাধ্য হয়। একেবারে সাধারণ যোগাযোগটিও করতে হয়েছে ঘরে বসেই। তাই অনেক মানুষকে নতুন ডিভাইস কিনতে হয়েছে। অনেকে কম্পিউটার কিনেছে, স্মার্ট স্পিকার কিনেছে। কোয়ারেন্টিনে ঘরে বসে বিনোদনের জন্যে প্রচুর ভিডিও গেম অডিয়েন্স বেড়েছে। অনেক কোম্পানিকে ‘রিমোট ওয়ার্ক সিস্টেম’ তৈরি করতে হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এ রকম কার্যক্রমের চাপে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের অবকাঠামো বেড়েছে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই দরকার হয়েছে অসংখ্য সেমিকন্ডাক্টর চিপ। করোনার প্রাথমিক ধাক্কায় সাপ্লাই চেইনে এ করকম ভাঙন দেখা গিয়েছিল। কিন্তু যখন তা আবার কাজ করা শুরু করলো, তাতেও এই চাহিদার কোনো কমতি দেখা গেল না।
২০১৯ সালে পুরো বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর বিক্রি হয়েছিল ৪১২.৩ বিলিয়ন ডলার। সেখানে, ২০২০ সালে তা ৬.৫ শতাংশ বেড়ে হলো ৪৩৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে বিক্রি হয়েছিল ৩৯.২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ৮.৩ শতাংশ বৃদ্ধি।
সেমিকন্ডাক্টর স্বল্পতার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, অটো ইন্ডাস্ট্রি। গাড়িগুলো দিন দিন অত্যাধুনিক হয়ে উঠছে। গাড়ির ভেতর স্মার্ট সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এবং এ সমস্ত কাজের জন্যেই তাদের সেমিকন্ডাক্টরের অনেক দরকার পড়ছে। গাড়ির ভেতরে ক্রমবর্ধমান জটিল কম্পিউটার সিস্টেমের জন্যে অত্যাধুনিক চিপের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে, পাওয়ার কিংবা স্টিয়ারিং সিস্টেমের জন্যে প্রয়োজন হয় কিছু কম উন্নত সেমিকন্ডাক্টর।
এএমডির লিসা সু অনুমান করেছেন, এই স্বল্পতা আরও ছয়মাস দীর্ঘ হতে পারে। বাজার বিশ্লেষকরা এ সময়ের ব্যপ্তি কীভাবে কমানো যায় তা নিয়েও ভাবছেন। তবে, এখনো খুব একটা উন্নতি দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন এ রকম সংকট যেন ভবিষ্যতে আবারো দেখা না দেয়, তা নিয়ে পরিকল্পনা করছেন। সে দেশের সেমিকন্ডাক্টর সাপ্লাই চেইনে ফাঁকফোকর খুঁজে বের করতে অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদেরকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।
We need to stop playing catch-up after the supply chain crisis hit. We need to prevent the supply chain crisis from hitting in the first place and in some cases building resilience will mean increasing our production of certain types of elements here at home. And others will mean working more closely with our trusted friends and partners, nations that share our values so that our supply chains can’t be used against us as leverage.
ভূ-রাজনৈতিকভাবে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বোঝাপড়ার ব্যাপার রয়েছে। তারা দেখবে কোনটা জাতীয় নিরাপত্তা এবং কোনটি আর্থিক নিরাপত্তা এবং এই দুইটির মধ্যে একটি ক্লোজ লিংক রয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সাপ্লাই চেইন এবং বাইডেন প্রশাসন সেটা নিয়েই কাজ করছে। নিজেদের মিত্র রাষ্ট্রের সাথে এই ব্যাপারে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রকে কীভাবে এই ইন্ডাস্ট্রিতে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা যায়, সেটি এই প্রশাসনের একটি লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। এই লক্ষ্যে চীন একটি বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবস্থানে রয়েছে।
সেমিকন্ডাক্টর চিপের ব্যাপারে চীন আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্যে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। বর্তমানে, চীন নিজেদের জন্যে ব্যবহৃত বেশিরভাগ চিপই আমদানি করে। চীনের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার উচ্চাশা সবসময়েই ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা বিভিন্ন রকমের নিষেধাজ্ঞা, বিশেষত টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করার ফলে, তা তাদের জন্যে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে। পরবর্তী পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় চিপ তাদের একটি অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করার একটি পরিকল্পনাও করা হয়েছে যেন ২০২৫ সালের মাঝে তাদের ব্যবহৃত ৭০ শতাংশ চিপ চীনেই প্রস্তুত হয়। এটা কোনো গোপন খবর নয় যে, ইলেকট্রনিক ডিভাইস নির্মাণের প্রধান স্থান হিসেবে চীন জায়গা করে নিয়েছে।
স্যামসাংয়ের কো-সিইও কোহ-ডং জিন তাদের একটি শেয়ারহোল্ডার মিটিংয়ে জানিয়েছেন, এই বছরে গ্যালাক্সি নোট ২১ বাজারে আসছে না। গ্যালাক্সি নোট সিরিজ কোম্পানিটির ফোন লাইনআপের মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি ফোন মুক্তি না দেওয়ার পেছনে কারণ হচ্ছে, সেমিকন্ডাক্টর সংকট। যেটুকু সেমিকন্ডাক্টর তাদের হাতে রয়েছে, তা দিয়ে তারা গ্যালাক্সি জি ফোল্ড এবং এস২১ এফই বাজারে মুক্তির চেষ্টা করবে।
একটি অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, স্যামসাং নিজেই সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন করে, আর তারাই কিনা স্বল্পতায় ভুগছে। এর পেছনে কারণ হচ্ছে, স্যামসাং একটি বিশালাকারের কোম্পানি এবং এর প্রতিটি বিভাগ আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে। তাদের মোবাইল বিভাগটি চিপসেট বিভাগ থেকে সেমিকন্ডাক্টর কিনে থাকে। অর্থাৎ, একই প্যারেন্ট কোম্পানির ছাতার নিচে দুইটি স্বতন্ত্র কোম্পানি। মোবাইল বিভাগটি এ বছরে কতটুকু সেমিকন্ডাক্টর লাগতে পারে, সে ব্যাপারে ঠিকমতো অনুমান করতে পারেনি। চিপসেট বিভাগে যেটুকু সেমিকন্ডাক্টরের অর্ডার দিয়েছে, তারা ঠিক ততোটুকুই পেয়েছে।
২০১৯ সালে ফেরত যাওয়া যাক, যখন সেমিকন্ডাক্টর বাজার স্বাভাবিক ছিল। বাজার বিশ্লেষকরা সাধারণ কনজ্যুমার বা ভোক্তা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বাইরেও যে চিপের নতুন চাহিদা তৈরি হবে, সে ব্যাপারে আভাস দিয়েছিলেন। এই নতুন চাহিদার একটি বড় অংশ তৈরি করেছে অটোমোবাইল বা গাড়ি ইন্ডাস্ট্রি। অটোমোবাইল নির্মাণকারীদেরকেও বাকি সবার মতোই একটি নির্দিষ্ট বছরে ঠিক কতটুকু সেমিকন্ডাক্টর প্রয়োজন হবে, তা বিশ্লেষণ করে অর্ডার পাঠাতে হয়। স্মার্ট সিস্টেম সংযুক্ত করার কারণে, আজকাল অটোমোবাইলে অনেক বেশি সেমিকন্ডাক্টর প্রয়োজন হয়। আধুনিক গাড়িগুলোর ৪০ শতাংশ উৎপাদন খরচই যায় সেমিকন্ডাক্টরের পেছনে। ২০০০ সালে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।
এরপরে ২০২০ সালে, কোভিড-১৯ মহামারি দেখা গেল। হঠাৎ করেই সবকিছু বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো সবাই। অটোমোবাইল প্রস্তুতকারীরা অনুমান করল, লকডাউনের কারণে গাড়ির চাহিদা অনেক কমে যাবে। তাই, সেমিকন্ডাক্টরের অর্ডার তারা প্রায় অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছিল। তাদের এই ভাবনায় ভুল ছিল। পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতি বাজার বিশ্লেষকদের ধারণার চেয়ে দ্রুতই ফিরে এসেছিল এবং সেখানে প্রচুর গাড়ির চাহিদা তৈরি হয়েছে। অন্য দেশগুলোতেও একইরকম চিত্র দেখা গেল। মহামারির প্রথমদিকে গাড়ির চাহিদা কমে গেলেও, লকডাউন যখন ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছিল, চাহিদা হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে গেল। কারণ, মানুষ গণপরিবহণের তুলনায় নিজের ব্যক্তিগত পরিবহণে যাতায়াতের ব্যাপারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল বেশি। অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো অর্ধেক অর্ডার কমিয়ে দেওয়ার ফলে, এই বৃদ্ধি পাওয়া চাহিদার সাথে তারা তাল মেলাতে পারলো না।
দৃশ্যতই, মহামারির কারণে চাহিদা ও যোগানের মধ্যেকার সম্পর্কের আকার পরিবর্তন হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, চিপ ইন্ডাস্ট্রি দ্রুত তাদের প্রোডাকশন সক্ষমতা বাড়াতে পারে না। ফলে, চাহিদা হঠাৎ বৃদ্ধি পেলেও, দ্রুতই তার সাথে তাল মিলিয়ে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে, সেমিকন্ডাক্টরের উপরে নির্ভরশীল অন্যান্য শিল্পে এর কোনো বিকল্প নেই। সেমিকন্ডাক্টর ছাড়া সেসব ইন্ডাস্ট্রি অচল।
অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি এবারে নিত্য ব্যবহার্য কনজ্যুমার ইলেকট্রনিকসের কথা ভাবা যাক। তারাও মহামারির কারণে বৃদ্ধি পাওয়া চাহিদার ব্যাপারটি অনুমান করতে পারেনি। হোম কোয়ারেন্টিনে, মানুষ অনেক বেশি ফোন, ল্যাপটপ ও গেমিং কনসোল কিনেছে। এভাবে, প্রস্তুতকারকদের বাজে অনুমান, বৈশ্বিক মহামারি ও তার ফলে তৈরি হওয়া ইলেকট্রনিকসের প্রচণ্ড চাহিদা একত্রে এরকম একটি সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কোম্পানিগুলো এখন সেমিকন্ডাক্টরের সামান্য মজুদ নিয়েই যতোটুকু বিক্রয় সম্ভব, তা করছে।
অটো ইন্ডাস্ট্রি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম বড় গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি ভোক্সওয়াগন প্রায় এক লক্ষ গাড়ি প্রোডাকশন হারিয়েছে এই সংকটের কারণে। জেনারেল মোটরস জানিয়েছে, চিপ স্বল্পতার কারণে তাদের কিছু ফ্যাক্টরি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে, দুই বিলিয়ন ডলার মুনাফা তারা হারাতে পারে। এ ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিতে পারলে পরিস্থিতি আরও অনেক বেশি খারাপ হবে। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে যদি এ রকম অসামঞ্জস্যতা থাকে, তাহলে সাধারণত দুই ধরনের ব্যাপার ঘটে। হয় পণ্যের দাম অত্যাধিক বেড়ে যায় অথবা তাদের মজুত শেষ হয়ে যায়। একই কারণে, এএমডি বা এনভিডিয়ার জিপিউ কেনা যাচ্ছে না। বাজারে যে কয়টি জিপিইউ অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের দাম আকাশচুম্বী ধারণ করেছে।
অনেক কোম্পানিই হয়তো স্যামসাংয়ের মতো সিদ্ধান্ত নেবে। তাদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক পণ্য এ বছর মুক্তি দেবে না। অথবা, মুক্তি দিলেও, মজুত স্বল্পতার কারণে খুব কম মানুষই তা কিনতে পারবে। সম্প্রতি টিএসএমসি নতুন একটি ফ্যাব্রিকেশন ইউনিট তৈরি করার জন্য অ্যারিজোনায় কিছু ভূমি কেনার ঘোষণা দিয়েছে।
যোগাযোগের ও পরিবহনের খরচ কমে যাওয়ার ফলে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে সেমিকন্ডাক্টরের বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাছাড়া, এই ছড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি অর্থনৈতিকভাবেও ভালো। এভাবে, উৎপাদনের খরচ কমানো সম্ভব। কিন্তু বিগত কিছু বছর থেকে প্রযুক্তি ক্রমেই একটি বড় হাতিয়ার হয়ে উঠছে, উন্নত সবগুলো রাষ্ট্রই চায় প্রযুক্তিগত সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে। এ রকম একটি জটিলতা এখন এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করেছে। অর্থনৈতিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি হিসেবে পরনির্ভর কাঠামো থেকে বের হয়ে আসতে চায়।
ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকিটি ব্যাখ্যা করা যাক। বর্তমানে পৃথিবীর সবগুলো দেশেরই সেমিকন্ডাক্টর চিপ প্রয়োজন। এই চিপগুলো উৎপাদন করা বেশ জটিল। পৃথিবীর অর্থনীতি এখন অনেকটাই চিপের উপরে নির্ভরশীল। তাই, কে এটির উৎপাদনকারী এবং কার কেনার সক্ষমতা কেমন তা অনেক গভীরে গিয়ে নির্ধারণ করবে এখানে কে প্রগতিশীল আর কে স্থবির। প্রযুক্তি যত দ্রুত সব জায়গা দখল করে নিচ্ছে, চিপ ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
টিএসএমসি তাইওয়ানের একটি কোম্পানি এবং দেশটি এখন বড় ধরনের রাজনৈতিক জটিলতায় ভুগছে। চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি মূল ভূখণ্ডের সাথে দেশটির পুনর্মিলন চায়। তারা এখনো সহিংসতার রাস্তা পরিহার করেনি। তাইওয়ান তাই এই মূহুর্তে একটি সংকটের মধ্যে রয়েছে। চীন তাদের পরিকল্পনায় সফল বা ব্যর্থ যাই হোক না কেন, সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনটি এই জটিলতার কারণে ব্যাহত হতে পারে। অন্যদিকে, চীন যদি তাদের মিশনে সফল হয়, তাহলে টিএসএমসির বোর্ড অব ডিরেক্টরসে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যদের প্রবেশ ঘটতে পারে। অথবা অন্য যেকোনোভাবে তারা কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করবে।
প্রযুক্তি দুনিয়ায় চীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হতে চায়, এই ব্যাপারটি এখন ভালোমতোই প্রতিষ্ঠিত। সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি নিয়ন্ত্রণ সেই পরিকল্পনার একটি মূল অংশ। আবার, চীনের উপরে আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্নরকম নিষেধাজ্ঞা সেই পরিকল্পনার জন্যে একটি হুমকি। কিন্তু চীন তাদের নিজস্ব কৌশলে এগোচ্ছে। সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠার জন্যে তারা প্রচুর টাকা খরচ করছে। কিন্তু বিগত কিছু বছরে তাদের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাটি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার পরে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের দূর্বলতা প্রকাশ হয়ে গেছে। হুয়াওয়ের মতো জায়ান্ট কোম্পানি চীনা স্টার্ট আপ এবং অন্য সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিগুলোর পেছনে প্রচুর টাকা ঢালছে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভ্যালু চেইনের মাধ্যমে।
চীন এখানে সফল হবে কিনা তা দেখতে হলে আরও অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, একেবারে গোড়া থেকে একটি ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে হলে, অনেকগুলো ক্ষেত্রে কাজ করতে হয়। তাছাড়া, তারা এমন একটি দশায় প্রবেশ করেছে, যেখানে তাদের প্রতি অন্য দেশগুলোর আস্থা নেই। চিপ উৎপাদন বৈশ্বিক চেইনের অনেকগুলো সংযুক্তি ও উপাদানের উপরে নির্ভর করে, যেখানে অনেক ইঞ্জিনিয়ার ও কোম্পানি একত্রে কাজ করে। আর চীন এখন ঠিক সেরকমই একটি বিশ্বাসযোগ্য চেইনের বাইরে অবস্থান করছে। তাই, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই তারা সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে ফেলতে পারবে, সেরকমটি সহজে বলা যাচ্ছে না। চীনে অনেকগুলো উন্নত প্রযুক্তির ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে, যার মধ্যে বাণিজ্যিক এয়ারলাইন্সও অন্তর্ভুক্ত। এসব জায়গায় তারা গত ত্রিশ বছর ধরেই কাজ করে যাচ্ছে, তারপরেও খুব বড় সাফল্য পায়নি এখনো। তাদের মতো বড় অর্থনৈতিক শক্তি হয়তো অনেক কিছুই দাবি করে। কিন্তু এ রকম অবস্থানে পৌঁছাতে শক্তিশালী অর্থনীতির পাশাপাশি অনেক কিছুই প্রয়োজন। সে জায়গাগুলোতে চীন এখনো পিছিয়ে রয়েছে।
এ রকম বিভক্তির মাধ্যমে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সংকট নিরসন বেশ কঠিন হবে। এক্ষেত্রে একটি ভালো সমাধান হতে পারে, একইরকম আদর্শ অনুসরণকারী দেশগুলো নিজেদের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা গ্রহণ করা। একসাথে কাজ করলে, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার কাজটি সহজ হয়ে দাঁড়ায়। মহামারিতে পৃথিবী ধুঁকছে, চিপ সংকট সেটিকে কতোটুকু খারাপ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে, তা সময়ই বলে দেবে। সেমিকন্ডাক্টর রাজনৈতিক একটি সংবেদনশীলতার উৎস। একইসাথে এটি পরস্পর নির্ভরশীল ও সংযুক্ত একটি বৈশ্বিক অর্থনীতিরও প্রতীক। তাই, চিপ উৎপাদন যখন সংকটে রয়েছে, তা নিরসনের জন্যে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা তৈরি করার এটা একটা ভালো সময়।