সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে কতই না বিচিত্র প্রাণীর আবাসভূমি। তার সবটুকু এখনো বিজ্ঞানীদের জ্ঞানসীমার আয়ত্ত্বে আসেনি। এছাড়া সমুদ্রের তলদেশে ভূত্বকের গঠন বিন্যাস সম্পূর্ণরূপে আজও আবিষ্কৃত হয়নি। সে প্রচেষ্টায় গবেষকদল সমুদ্র তলদেশকে ঘিরে নানা পরীক্ষামূলক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন নানা সময়ে। এই অভিযানের গতিবেগ আরো ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে একদল জার্মান গবেষক নির্মাণ করেছেন এক অদ্ভুত ডুবোজাহজ। গবেষণার কাজে পৃথিবীর বুকে বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা নির্মিত একমাত্র সাবমেরিন তৈরির ইতিহাস, তার কর্মক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার তথ্যই আজ আপনাদের জানানো হবে।
ভূপৃষ্ঠের একটা বড় অংশই রয়েছে পানির নিচে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সমুদ্রগর্ভ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত। সাগরের জলে যেসব জীব থাকে, তার প্রায় ৯৫ ভাগই বিজ্ঞানীদের অজানা। সমুদ্রের তলদেশের গবেষণাকে এক ধাপ এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে একদল জার্মান গবেষক একটি প্রকল্প হাতে নেন, যা কিনা সমুদ্রের এই অজানা রহস্যের সমাধান দেবে। সেই গবেষকদের তত্ত্বাবধানে বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা নির্মিত প্রথম এবং একমাত্র ডুবো জাহাজ`জাগো’। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে এটি নির্মাণ করা হয়। সমুদ্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা এই ডুবোজাহাজটি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। এর সাহায্যে পানির নিচের ৪০০ মিটার গভীরে বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের উদ্ভিদকূল, প্রাণিকূল এবং মাটির নিচের ভূত্বক ও জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পর্কিত গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে তাদের বিশ্বাস। পূর্বে সমুদ্রবিজ্ঞানীরা অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাহায্যে সাগরের আলোকিত এলাকাগুলোতে পর্যবেক্ষণ করার উপায় বের করেছেন। তখন সমুদ্রের আরো গভীরে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। কিন্তু ‘জাগো’র সাহায্যে সমুদ্রের নিচে ৪০০ থেকে ৫০০ মিটার গভীরে যাওয়া যায় এবং সেসব অঞ্চলের আশ্চর্য সব জিনিস দেখতে পান সমুদ্র গবেষকরা ৷
এই সাবমেরিনে মানুষের বসার জায়গা আছে৷ এর সাহায্যে গবেষকদল সমুদ্রের নিচের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং এজন্য গবেষকদের কোনো ধরনের অক্সিজেন কিংবা এ জাতীয় কোনো সাপোর্ট স্টাফ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। মূলত ‘জাগো’ এমন এক ধরনের জলযান যাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যবেক্ষকের অবস্থানের সুযোগ রয়েছে এবং জলযানটিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন মজুদ এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের ব্যবস্থা থাকায় শ্বাসকষ্টজনিত কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। জলযানটিতে হ্যালোজেন লাইট, ফ্লাশ লাইট, লেজার স্কেলিং, ১০৮০ এইচডিটিভি রেজ্যুলেশান সম্পন্ন ডিজিটাল ছবি ও ভিডিও ডকুমেন্টেশনের ব্যবস্থা রয়েছে। যানটি কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে যাত্রীদের নিরাপদে রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এতে রয়েছে।
পাইলট এবং পর্যবেক্ষকের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জলযানটিতে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। তাছাড়া জলযানটি স্বচ্ছ অ্যাক্রিলিক কাচের তৈরি, যার ফলে দুটো জানালা দিয়ে চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করার সাথে সাথে অনেক দূর পর্যন্ত জীবজগতের অস্তিত্বও অবলোকন করা যায়। জলযানের ভেতরে থেকেই পাইলট এবং পর্যবেক্ষকরা তার চারপাশে পানির নিচের উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পান। ডুবো জাহাজটির প্রযুক্তিগত ব্যবহার সম্পর্কে জাহাজটির পাইলট শাউয়ারের অভিমত এই যে, “জাগো-তে ব্যবহৃত প্রযুক্তিবিদ্যা খুব একটা কঠিন প্রযুক্তি নয়। ডুব দেওয়া কিংবা ভেসে ওঠা, সেটা করা হয় বাতাসের মাধ্যমে- জলের চৌবাচ্চাতে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে, যা নিজেরাই করে দেখা যেতে পারে। একটি সহজ ও নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি এটি৷”
ডুবোজাহাজটি ছোট ও হালকা। ৩ মিটার দৈর্ঘ্য, ২ মিটার প্রস্থ এবং ২.৫ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন সাবমেরিনটির ওজন প্রায় ৩ টন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমুদ্র উপকূলে কার্যক্রম চালাতে সক্ষম এই সাবমেরিনটি সহজে পরিবহনযোগ্য। তাছাড়া উত্তর বাল্টিক সমুদ্র অঞ্চলের জন্য পুনরুদ্ধার যান হিসেবেও অনেক সময় জলযানটি ব্যবহার করা হয়।
গভীর সমুদ্রের জলজ প্রাণীদের অনুসন্ধান, পরিবেশগত প্রভাব- সবকিছুই সাবমেরিন থেকে পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া জলজ নমুনা সংগ্রহ এবং তা সংরক্ষণ করার যাবতীয় ব্যবস্থা জলযানটিতে বিদ্যমান। জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ পর্যবেক্ষণ, জলজ স্তরে বিদ্যমান শিলাস্তরের বিন্যাস, পানিতে বিদ্যমান গ্যাস এবং তরল পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষণ যন্ত্রপাতিও সাবমেরিনটিতে রাখা হয়েছে।
২০০৬ সাল থেকে হেলমোল্টজ সেন্টার ফর ওপেন রিসার্চ (জিওএমএআর) সেন্টারে সাবমেরিনটি সংরক্ষিত রয়েছে। সাবমেরিনটি তৈরির কার্যক্রম শুরু হয় আজ থেকে প্রায় বেশ কয়েক বছর আগে। সমুদ্রের নিচের অজানা প্রাণীজগতের সন্ধানে ১৯৮৮ সালে জার্মানির কিল শহরের ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিটিউটের এক গবেষণাগারে সমুদ্রবিদ হান্স ফ্রিক, সাবমেরিন পাইলট এবং টেকনিশিয়ান জোগ্রেন শাউয়ার, জীববিজ্ঞানী কারেন হিসম্যান এবং লুৎজ কাসানগের যৌথ সমন্বয়ে বিজ্ঞানীরা ‘জাগো’ নামের এই সাবমার্সিবল যান নির্মানের কাজ শুরু করেন।
১৯৮৯ সালের ১৭ আগস্ট স্টার্নবার্গের এক জলাশয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সাবমেরিনের যাত্রা শুরু হয়। ২ নভেম্বর ১৯৮৯-এ সাবমেরিন ‘জাগো’ প্রথমবারের মতো ‘গ্রান্ডি কোমরো’ দ্বীপে অভিযান চালিয়ে দ্বীপের নিচের ভূত্বকের গঠন পর্যবেক্ষণ করে। এছাড়া ডিনোফিসের আবাসস্থল এবং ১৯৫ মিটার গভীরে থাকা ‘কোয়েলাকান্থ’ নামক সামুদ্রিক প্রাণীর সন্ধানে সফল হয় জলযানটি। সাবমেরিনের সাহায্যে গবেষকদল এসব প্রাণীর জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হন।
গ্রান্ডি কোমরোর সফল যাত্রার পর ‘জাগো’ তার অভিজ্ঞতাকে আরো বাড়ানোর কাজে মনোযোগী হয়ে ওঠে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, আইসল্যান্ডে, কৃষ্ণ ও লোহিত সাগরে, বাভারিয়া হ্রদে প্রভৃতি জায়গায় ‘জাগো’ অভিযান চালায়। ১৯৯৭ সালে সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো সাবমেরিন ‘জাগো’র সাহায্যে নরওয়েজিয়ান উপকূলের শীতল পানির প্রবাল আবিষ্কার করেন। এই প্রবাল দ্বীপে ‘জাগো’ বেশ কিছুদিন তাদের অনুসন্ধান বজায় রাখে।
সমুদ্রের নিচে অজানা প্রাণী জগতের খোঁজে জার্মানির এই আশ্চর্য ডুবোজাহাজ প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সাফল্যে সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণাকে বেগবান করছে। সিনিয়র পাইলট ইয়ুর্গেন শাউয়ারের অভিজ্ঞ পরিচালনায় গবেষকরা সমুদ্রের নিচের বিভিন্ন দুর্গম স্থানে যেতে সফল হয়েছেন। সমুদ্রগর্ভে প্রাণী ও উদ্ভিদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে জানা যাচ্ছে নতুন নতুন তথ্য।
‘জাগো’ সমুদ্রের নানা স্যাম্পল সংগ্রহ করে জিওএমএআর-এর গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠায়। আর তা থেকে জানা যায়, সাগর থাকার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি অত তাড়াতাড়ি ঘটছে না, এর কারণ হিসেবে গবেষণায় উঠে এসেছে সাগরের পানি পরিবেশ থেকে প্রায় ৩০ শতাংশের মতো কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিচ্ছে। আর তাই সাগরের কারণে বিশ্বজুড়ে যে আবহাওয়ার পরিবর্তন তা ধীরে ধীরে ঘটছে বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত। তবুও সমুদ্রগর্ভে প্রাণী ও উদ্ভিদের উপর তাপমাত্রার কিছু না কিছু হলেও প্রভাব পড়ছে।
ইয়ানিনা ব্যুশার ‘জাগো’র একজন পর্যবেক্ষক। তার গবেষণার বিষয় ছিল কার্বন নিঃসরণের কারণে সামুদ্রিক প্রবালের ওপর কী ধরণের প্রভাব পড়ছে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। তিনি ‘জাগো’তে চড়ে সাগরের গভীরে নামার ও স্যাম্পল সংগ্রহ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ‘জাগো’র অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। ডুবোজাহাজটি নিজের মর্জিমতো ঘোরাফেরা করতে পারে, জলযানটির শব্দ সত্ত্বেও সমুদ্র তলদেশে সব কিছু ঠান্ডা আর নিরিবিলি। বিশেষ কিছু চলাফেরা করে না। মাঝে মাঝে হয়তো দু’একটা মাছ জানলার বাইরে দিয়ে সাঁতরে বেড়াতে চোখে পড়ে, নয়তো খুবই শান্ত পরিবেশ ৷”
জিওএমএআরে অবস্থিত কিল-এর সামুদ্রিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপের সমুদ্র গবেষণায় এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। সারা বিশ্বে মাত্র স্বল্প কয়েকটি সাবমার্সিবল আছে। ‘জাগো’ ইতোমধ্যেই বিশ্বের প্রায় সব সাগরে ডুব দিয়ে এসেছে। ‘জাগো’র পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকা বা লোহিত সাগরের অগভীর অংশ, যেখানে প্রচুর পরিমাণ আলো এবং সমুদের উষ্ণ তাপমাত্রা বিদ্যমান, সেখানেই বিভিন্ন প্রবালের সন্ধান পাওয়া গেছে। ঠিক তেমনি উত্তর আটলান্টিকে শীতল, অন্ধকার জলের অনেক নিচে বিশেষ করে হাজার মিটার গভীরে প্রবালের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। শীতল পানির প্রবালের ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম চালাতে অক্ষম। এসব প্রবাল মূলত পানি এবং পানির তরঙ্গ থেকে একধরনের বৈদ্যুতিক প্রবাহ ব্যবহার করে তাদের খাদ্য তৈরি করে নেয়। অন্যদিকে গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকায় অগভীর সমুদ্রের প্রবালগুলো ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপন্ন করতে সক্ষম। আটলান্টিকের আলোহীন ঘুটঘুটে অন্ধকারে আড়াইশো, তিনশো এমনকি হাজার মিটার গভীরে নানা ধরনের প্রবাল ও রীফের সন্ধান পাওয়া গেছে যা দেখে ‘জাগো’র পর্যবেক্ষকেরাও মুগ্ধ না হয়ে পারেননি।
আর এভাবেই ‘জাগো’ বিভিন্ন সাগরে তার অভিযান চালিয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণাকে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের সামনে সামুদ্রিক নানা প্রাণীজগতের সন্ধান দিচ্ছে, যা এককথায় অসাধারণ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।