সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নাশতা করতে গিয়েই দেখলেন টেবিলে খাবারের প্লেটে বিভিন্ন জাতের পোকামাকড় থরে থরে সাজানো। হ্যাঁ, এটাই আপনার সকালের খাবার। এহেন ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হচ্ছেন? কিন্তু নশ্বর এ পৃথিবীতে একদিন এ ধরনের বাস্তবতা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়ে পরিণত হবে বলেই ধারণা খাদ্য বিজ্ঞানীদের।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতিদিন ২ বিলিয়ন মানুষ পোকামাকড় খেয়ে জীবনযাপন করছে। ৭ বিলিয়নের অধিক মানুষের গ্রহ পৃথিবীতে ২ বিলিয়ন সংখ্যাটা আপাতত বেশি না হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের বড় একটি অংশ খাবার হিসেবে পোকা-মাকড় ভক্ষণে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন বলে মত দেন বিজ্ঞানীরা। কেননা বিভিন্ন পোকামাকড় পুষ্টিগুণে গবাদিপশুর চেয়ে উন্নত এবং স্বাদের দিক থেকে আপেল, পি নাট বাটার এবং মাছের কাছাকাছি অথবা তার চেয়েও মুখরোচক। এমনটাই বলেছেন খাদ্যবিজ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। মূলত অত্যধিক জনসংখ্যা ও সীমিত সম্পদজনিত সমস্যাগুলোকে সামনে রেখেই বিজ্ঞানী এবং ভবিষ্যতবাদীরা জোরলোভাবে বলেন, আমাদেরকে আবারো পুনর্বিবেচনা করতে হবে আমরা প্রতিদিন কী খাচ্ছি।
নিঃশ্বাসেই উৎপন্ন হবে খাদ্য
খাদ্য বিজ্ঞানীদের মতে, সাগরতলে শ্যাওলার মতো বিভিন্ন সামুদ্রিক উদ্ভিদে রয়েছে উচ্চমাত্রার ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। শারীরিকভাবে সুস্থ এবং স্বাভাবিক থাকার জন্য এ ফ্যাটি এসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটা জানা কথা। তবে অজানা বিষয়টি হলো, বিশেষ একধরনের মুখোশ পরে মানুষ চাইলে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এ ধরনের শৈবাল-শ্যাওলা কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে পারবে।
সম্প্রতি লন্ডনের ‘ভি এন্ড এ’ জাদুঘরে এক প্রদর্শনীতে মানুষ কীভাবে মুখোশ পরে এ ধরনের শৈবাল-শ্যাওলা তৈরি করতে পারে তার একটি প্রমাণ দেখান বিশেষজ্ঞ মাইকেল বার্টন এবং মিসিকো নিতা। এ ধরনের শ্যাওলা ভবিষ্যতে খাবার তালিকায় যুক্ত হয়ে নতুন করে তৈরি হওয়া খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
ল্যাবে তৈরি মাংস
তাছাড়া আজকের পৃথিবীতে অন্যতম একটি সমস্যা হলো পুষ্টিহীনতা। সঠিক সময়ে সঠিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ না করার কারণেই এ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার জন্যই মূলত মানুষের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত। মানুষের মাংসের চাহিদা পূরণে গবেষণাগারে একধরনের মাংস তৈরির পথে অনেকখানি এগিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রাণীদেহ থেকে বিশেষ সেল সংগ্রহ করে এরই মধ্যে ল্যাবে মাংস তৈরি করেছে ‘মেম্ফিস মিট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যদিও প্রাথমিকভাবে এ মাংসের জন্য খরচ অনেক পড়লেও সময়ের সাথে তা কমে আসবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কীভাবে কম খরচে ল্যাবে মাংস তৈরি করা যায় সেটা নিয়েও গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন তারা।
স্ব-পচনশীল প্যাকেট
সাধারণত দেখা যায়, প্যাকেটের খাবার নষ্ট হয়ে গেলেও প্যাকেট অক্ষত থেকে যায়। পক্ষান্তরে এ প্যাকেটগুলোই পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে। এজন্যই সুইডেনভিত্তিক ‘টুমরো মেশিন‘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এমন একধরনের প্যাকেটের কথা বলছে, যে প্যাকেট খাবার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে নিজে থেকে নষ্ট হয়ে যাবে। এতে করে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না।
খেতে পারবেন পানিশুদ্ধ বোতল!
শুনে অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ, অবাক হবারই কথা। ‘সীউইড টেক‘ নামে লন্ডনের একটি স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিকের বোতলের পরিবর্তে সমুদ্রতলের শ্যাওলা দিয়ে এমন একধরনের পানির বোতল তৈরির ধারণা দেন যা পরিবেশের ক্ষতি করবে না। প্রয়োজনে এ বোতল পুনরায় ব্যবহার করা যাবে। এ বোতলটি এমনভাবে তৈরি করা হবে যাতে পুরো বোতলটিই পানি হিসেবে খাওয়া যাবে। সামুদ্রিক জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি বিশেষ এ বোতল প্লাস্টিকের চেয়ে অনেক কম দামে পাওয়া যাবে বলে জানায় সীউইড টেক কর্তৃপক্ষ।
মিউজিকের তালে খাবার
পছন্দের গান শুনতে শুনতে খাবার খাওয়া অনেকে পছন্দ করেন। এজন্য এখনকার দিনে বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে মিউজিক শোনার বা টিভি দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একটি জরিপ চালান। এ জরিপে তারা দেখেন খাবারের স্বাদ তুলনামূলক ভালো না হলেও মিউজিকের দিকে মনোযোগের কারণে কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই অনেকে খাবার খেয়ে থাকেন।
ল্যাবে তৈরি মাছ
শুধু মাংসই নয়, এমন একটা সময় আসবে যখন ল্যাবে মাছও তৈরি করা যাবে। সেসময় খুব দূরে নয় বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমেরিকার নিউইয়র্কের টুরো কলেজের শিক্ষার্থীরা গোল্ড ফিশের টুকরো ফেলে ছোট মাছের টুকরো প্রস্তুতে ইতিবাচক সাফল্য পান। এছাড়া ‘নিউওয়েভ ফুডস’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান সমুদ্রের জলজ উদ্ভিদ দিয়ে বাগদা চিংড়ির মতো দেখতে অবিকল চিংড়ি তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটি ল্যাবে সামুদ্রিক উদ্ভিদ দিয়ে গলদা চিংড়ি এবং কাকড়া তৈরির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। খুব শীঘ্রই তারা তা করতে সমর্থ হবেন বলেও ধারণা করছেন।
অ্যাপেই মিলবে খাদ্য পুষ্টির গুণাগুণ
বেশিরভাগ সময় আমরা জানি না, যে খাবার গ্রহণ করছি তার পুষ্টিগুণ কেমন। সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের ফুড স্ক্যানার অ্যাপ এ সীমাবদ্ধতা দূর করেছে। যে খাবার গ্রহণ করছি সে খাবারগুলো অ্যাপ দিয়ে স্ক্যান করলেই খাবারের বিভিন্ন তথ্য স্মার্টফোনের পর্দায় ভেসে ওঠছে। ভবিষ্যতে এর ব্যবহার আরো বেশি সহজলভ্য হলে এবং বেশি মানুষের কাছে পৌছে গেলে মানুষ বুঝে-শুনে নিজের জন্য সঠিক খাবার নির্বাচন করতে সমর্থ হবে বলে মত দেন পুষ্টিবিজ্ঞানীরা।
খাবার হবে ডিএনএ ভিত্তিক
ডিএনএ সিকোয়েন্সের মাধ্যমে শরীরে জন্য প্রয়োজনীয় খাবার কী এবং কোন খাবার গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যের জন্য আরো উপকার হবে সেটা জানা যায়। যদিও ডিএনএ সিকোয়েন্স জানার বিষয়টি এখনো ততটা সহজলভ্য হয়নি। ডিএনএ সিকোয়েন্স অ্যাপ আকারে সহজলভ্য হলেই সুবিধাটা ষোল আনা পাওয়া যাবে। কারণ প্রত্যেক মানুষের জেনেটিক্সের দিকটা থেকে আলাদা। ফলশ্রুতিতে সবার জন্য একই ধরনের খাবার সুফল বয়ে আনতে না-ও পারে। সেক্ষেত্রে জনে জনে ডিএনএ সিকোয়েন্স জানা গেলে তা ওই সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের শারীরিক চাহিদা মোতাবেক খাবার যোগান দেওয়া সম্ভবপর হতো। তবে প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে চলছে, একদিন ডিএনএ সিকোয়েন্স জেনে খাবার গ্রহণ করাটা খুব সহজলভ্য হবে বলে ধারণা করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা।
কফি খাবেন চিবিয়ে!
এতদিন গরম গরম কফি খেয়ে আসছেন, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণালব্ধ এমন একধরনের কফি পাওয়া যাচ্ছে যা চিবিয়ে খেতে হয়। এতে করে কাপে করে কফি খাওয়ার পুরো সুফলটা পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে চিবিয়ে খাওয়ার যোগ্য এ কফি মনোযোগ বাড়াতে বিশেষভাবে সাহায্য করছে। তাছাড়া যে কেউ চাইলে এ কফি পকেটে পুরে প্রয়োজনের সময় খেতে পারছে।
সময়ের সাথে খাবার এবং খাদ্যাভ্যাস দুটোই পরিবর্তিত হচ্ছে। কারণ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ সর্বোচ্চ পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি মজাদার খাবার তৈরির দিকে বেশি ঝুঁকছে। এ কারণেই বিভিন্ন খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরির গবেষণা অব্যাহত রেখেছে। এ গবেষণার সূত্র ধরেই উপর্যুক্ত বিভিন্ন ধরনের খাবারের ধারণা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে বলে মত দিচ্ছেন খাদ্যবিজ্ঞানীরা। আপাতদৃষ্টিতে এ খাবারের এ ধারণাগুলো অদ্ভূত মনে হলেও পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির খাদ্য চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন প্রকারের খাবার তৈরির ওপর জোর দিচ্ছেন খাদ্যবিজ্ঞানীরা।এতে করে খাবারের উদ্ভূত চাহিদা মিটবে এবং একইসসঙ্গে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তাও মিটবে। আজকের যে বিষয়গুলো এখনো ধারণার পর্যায়ে রয়েছে তা বাস্তবতায় যেতে সময় নেবে না বলেও জানান বিজ্ঞানীরা। কারণ এ ধারণাগুলো নিয়ে তারা বেশ যত্নের সঙ্গে কাজ করছেন। ফলশ্রুতিতে অদূর ভবিষ্যতে উপর্যুক্ত খাবারের ধারণা মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে বলে মত দেন তারা। প্রাথমিক পর্যায়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই এ খাবারগুলো বাজারজাত করা হবে।
ফিচার ইমেজ: Burtonnitta & Depositphotos