ইস্টিশনের রেল গাড়িটা
মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা
প্লাটফর্মে বইসা ভাবি
কখন বাজে বারোটা!
কখন বাজে বারোটা!
রুনা লায়লার এই গানটা যেমন তুমুল জনপ্রিয়, তেমনি যাতায়াতের জনপ্রিয় এক মাধ্যম হচ্ছে ট্রেন। নিরাপদ, আরামদায়ক এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা তো কেবল ট্রেনেই রয়েছে। আমাদের দেশে ট্রেনের জনপ্রিয়তা অনুধাবন করতে হলে কেবল ঈদের সময় প্লাটফর্মগুলোতে টিকিটের লাইন দেখলেই চলবে। তবে জনপ্রিয় এই পরিবহন নিয়ে ভোগান্তি আর অভিযোগের শেষ নেই। সবচেয়ে জোরালো যে অভিযোগ, তা হচ্ছে কালক্ষেপণের। এই কালবিলম্ব নিয়ে আপনি হতাশ হতেই পারেন। কারণ, বিশ্ব এখন আর সেই গদাই লস্করি চালে চলা ট্রেনে ভ্রমণ করে না। এখন এমন সব ট্রেন চালু হয়েছে, যা বিমানের গতিতে ছুটে যায়, চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায়। কালক্ষেপণের তো প্রশ্নই আসে না। ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, চীন, জাপান, রাশিয়া সবাই যেন একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেদের ট্রেনের গতি বাড়িয়ে চলেছে। আর তাতেই পৃথিবীতে আধুনিককালে তৈরি হয়েছে ‘হাইস্পিড রেলওয়ে’র ধারণা। চলুন দেখে আসি পৃথিবীর দ্রুততম দশটি ট্রেন, যেগুলোকে ভূপৃষ্ঠের বিমান বললেও ভুল হবে না!
১০. টিএইচএসআর ৭০০-টি, তাইওয়ান
২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হওয়া টিএইচএসআর ৭০০-টি ট্রেন সার্ভিস বিশ্বের অন্যতম দ্রুতগামী ট্রেন। প্রাথমিকভাবে এই ট্রেনটি তাইপে থেকে কাওসিউং রুটে চলাচল করতো। দুটি শহরের মাঝে সাড়ে চার ঘণ্টার পথ এই ট্রেনটি পাড়ি দেয় মাত্র ৯০ মিনিটে! একাধিক ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই ট্রেন মোট ১২টি বগি নিয়ে ছুটে চলে সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতে। আর এর শক্তিশালী ইঞ্জিনগুলো সর্বোচ্চ গতিতে উঠতে সময় নেয় মাত্র ১৫ মিনিট। গতির সাথে এই ট্রেনে রয়েছে নিরাপত্তার সুব্যবস্থা। বাই-ডিরেকশনাল অপারেশন, ফায়ার অ্যান্ড স্মোক ডিটেক্টর, ইনস্ট্যাবিলিটি ডিটেক্টর এবং স্টেশন স্টপ কন্ট্রোলের মতো সব আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাই রয়েছে এই ট্রেনে। জাপানের তিনটি বড় কোম্পানি কাওয়াজাকি, নিপ্পন ও হিটাচি তৈরি করেছে এই টিএইচএসআর ৭০০-টি ট্রেন। বর্তমানে তাইওয়ানের হাইস্পিড রেলওয়েতে মোট ৩০টি টি-৭০০ ট্রেন চলাচল করে।
৯. ইটিআর-৫০০ ফ্রেচিয়ারোসা, ইতালি
তাইওয়ান থেকে এবার ইতালিতে যাওয়া যাক। ইতালির দ্বিতীয় দ্রুতগামী ট্রেনের নাম ইটিআর-৫০০ ফ্রেচিয়ারোসা। এই ইটিআর-৫০০ ট্রেনগুলো ইতালিতে অনেকদিন আগে থেকেই চলতো। তবে ফ্রেচিয়ারোসা হচ্ছে ইটিআর-৫০০ এর আধুনিক একটি সংস্করণ। ফ্রান্সের এলস্টোম এবং বম্বার্ডিয়াম কোম্পানির তত্ত্বাবধানে তৈরি এই ট্রেনগুলোর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার। ইতালির ত্রেনিতালিয়া কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত এই ট্রেনগুলো চলাচল করে মিলান-রোম-নেপলস রুটে। এই রুটে বর্তমানে মোট ২৮টি ফ্রেচিয়ারোসা ট্রেন চলাচল করে। মিলান থেকে রোমে পৌঁছুতে ফ্রেচিয়ারোসার লাগবে মাত্র আড়াই ঘণ্টা, যা বিমান যাত্রার তুলনায় মাত্র ৪০ মিনিট বেশি। ফ্রেচিয়ারোসাতে চার ক্যাটাগরির বগি রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড, প্রিমিয়াম, বিজনেস এবং এক্সিকিউটিভ। তবে ক্যাটাগরি নির্বিশেষে রয়েছে ফ্রি ওয়াই-ফাই সুবিধা।
৮. টিজিভি ডুপ্লেক্স, ফ্রান্স
ফ্রান্সের দ্রুততম ট্রেন টিজিভি ডুপ্লেক্স ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩১৯ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। ডাবল ডেকের এই দ্রুতগামী ট্রেনগুলো সংযুক্ত করেছে ফ্রান্সের সকল প্রধান শহরগুলোকে। দেশী কোম্পানি এলস্টোম এই ট্রেন তৈরিতে ব্যবহার করেছে উচ্চমানের অ্যালুমিনিয়াম, যা এই ট্রেনের ওজন হ্রাস করে। অন্যদিকে প্রতিটি বগিই এতোটা অনমনীয় যে, সর্বোচ্চ গতিতেও যদি একটি টিজিভি ট্রেন দুর্ঘটনা কবলিত হয়, তাহলেও এর বগিগুলো একেবারে দুমড়ে মুচড়ে যাবে না। ফ্রান্সের ‘এসএনসিএফ’ কোম্পানির তত্ত্বাবধানে এই ট্রেন ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচল শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড ও টিজিভি প্রো, এই দুটি ক্যাটাগরির যথাক্রমে ৬টি ও ৪টি বগি নিয়ে যাতায়াত করে টিজিভি ডুপ্লেক্স।
৭. এলস্টোম ইউরোডুপ্লেক্স, ফ্রান্স
টিজিভি ডুপ্লেক্সেরই একটি সংস্করণ হচ্ছে ইউরোডুপ্লেক্স, যা এলস্টোম কোম্পানিরই তৈরি। এর গতিও টিজিভি ডুপ্লেক্সের সমান। তবে বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি আন্তঃইউরোপীয় রুটে চলাচল করে। ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও লুক্সেমবার্গ, এই চারটি দেশকে সংযুক্ত করা এই ট্রেন সার্ভিস শুরু হয় ২০১১ সালের শেষের দিকে। ১,০২০ জন যাত্রী বহনক্ষম এই ট্রেনের আরো একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, ট্রেনটি অনেক কম শক্তি খরচে অধিক গতিতে চলতে পারে।
৬. ই-৫ শিনকানশেন হায়াবুসা, জাপান
২০১১ সালে ফ্রান্সে দুটি দ্রুতগামী ডুপ্লেক্স ট্রেন চালু হবার বছরই জাপানে চালু হয় তাদের সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন ই-৫ শিনকানশেন হায়াবুসা। ই-৫ সিরিজের ট্রেনগুলোর মধ্যে হায়াবুসাই সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন এবং এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার। ট্রেনের সামনের অংশে অর্থাৎ ইঞ্জিন বগিতে রয়েছে ১৫ মিটার লম্বা একটি নাক সদৃশ গঠন। তবে এটি নিছক একটি ডিজাইন নয়। এর আকার এরকম হওয়ায় কোনো টানেলের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলাকালীন শব্দ কমে যায় অনেকাংশে! ৭৩০ জন যাত্রী বহন করা এই ট্রেন আওমরি শহরের সাথে টোকিও শহরের সংযোগ স্থাপন করে। ই-৫ সিরিজের প্রতিটি ট্রেনে রয়েছে তিন ক্যাটাগরির কম্পার্টম্যান্ট- স্ট্যান্ডার্ড, গ্রিন ও গ্রান(বিজনেস ক্লাস)। পুরো ট্রেন জুড়ে রয়েছে সাউন্ডপ্রুফ ব্যবস্থাও।
৫. তালগো ৩৫০, স্পেন
আবার ইউরোপে ফিরে যাওয়া যাক। এবারের গন্তব্য স্পেন। আর এবারের ট্রেন তালগো ৩৫০, চলাচল করে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈরি রুটে! উঁহু, প্রাকৃতিকভাবে বৈরি আবহাওয়া কিংবা ভঙ্গুর রাস্তার জন্য নয়, বৈরিতা ফুটবলকে ঘিরে! তালগো ৩৫০ চলাচল করে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবলের শহর মাদ্রিদ-বার্সেলোনায়। ১২টি বগি নিয়ে এই ট্রেনগুলো ছুটে চলে সর্বোচ্চ ৩৫০ কিলোমিটার গতিতে! ফার্স্ট, ব্রিস্টো, ক্লাব এবং কোচ- এই চারটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত তালগো ৩৫০ ট্রেনের প্রতিটি কামরাতেই আছে ভিডিও, অডিও এবং ইন্টারনেটের সুব্যবস্থা। স্পেনে এই ট্রেনের স্থানীয় নাম ‘পাতো’।
৪. সিমেন্স ভেলারো এভিএস-১০৩, স্পেন
স্পেনের সবচেয়ে দ্রুতগামী এই ট্রেন ভেলারো-১০৩ এর পরীক্ষামূলক চলাচলের সময় সর্বোচ্চ ৪০২ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতে চলতে সক্ষম হয়েছিল! তবে উদ্বোধনের পর এর গড় সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩৫৪ কিলোমিটার। ২০০৭ সাল থেকে স্প্যানিশ ন্যাশনাল রেলওয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে এই দ্রুতগামী ট্রেন সার্ভিস। ৮টি বগিবিশিষ্ট এই ট্রেনগুলোর যাত্রী ধারণক্ষমতা ৪০০ জন।
৩. এজিভি ইটালো, ইতালি
ইতালির দ্বিতীয় দ্রুতগামী ট্রেনের সাথে পরিচয় হয়েছে আগেই। এবার পরিচিত হওয়া যাক ইতালির সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন এজিভি ইটালোর সাথে। এর সর্বোচ্চ অপারেশনাল গতি ৩৬০ কিলোমিটার/ঘণ্টা। তবে প্রাথমিক পরীক্ষার সময় এই ট্রেন তৎকালীন সর্বোচ্চ গতির রেকর্ড গড়েছিল। ২০০৭ সালে একটি বিশেষ পরীক্ষামূলক ট্রায়ালে এজিভি ইটালিয়ানো ছুটেছিল ঘণ্টায় ৫৭২ কিলোমিটার গতিতে! একই বছর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাতায়াত শুরু করে ইটালো। ইতালিয়ান কোম্পানি এনটিভি (নভো ত্রান্সপোর্তো ভিজিয়াতোরি) এই ট্রেন পরিচালনা করছে। তারা এলস্টোন কোম্পানি কর্তৃক ৬৫০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ২৫টি এজিভি ট্রেন তৈরি করিয়ে নেয়। ইতালির রোম ও নেপলস শহরের মধ্যে চলাচল করা এই ট্রেন খুবই পরিবেশবান্ধব। এর প্রায় ৯৮ শতাংশই পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। চারটি ক্লাব, চারটি প্রাইমা এবং তিনটি স্মার্ট বগিসহ মোট ১১টি বগি নিয়ে ছুটে চলে এই ট্রেন।
২. হারমোনি সিআরএইচ ৩৮০এ, চীন
পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী দশটি ট্রেন নিয়ে আলোচনা হবে, কিন্তু চীনের কোনো ট্রেনের নাম থাকবে না, তা কি করে হয়? নিজেদের এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় দ্রুতগামী ট্রেন হারমোনি সিআরএইচ ৩৮০এ চলাচল করছে চীনের সাংহাই-নানজিং রুটে। এই ট্রেন ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। অক্টোবর ২০১০ সাল থেকে চীনের সরকারি রেলওয়ে সংস্থা ‘চায়না রেলওয়ে’ এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে এই দ্রুতগামী ট্রেন। মাছের মাথার মতো আকৃতির ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই ট্রেন তৈরি হয়েছে অত্যন্ত পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের অ্যালয় সংকর থেকে। মাছের মাথার মতো আকৃতি এই ট্রেনকে দ্রুতগতিতে চলার সময় এরোডাইনামিক চাপ থেকে রক্ষা করে। অন্যদিকে এই ট্রেন সম্পূর্ণরূপে ঝাঁকুনি মুক্ত। ঘুমন্ত কোনো ব্যক্তিকে হারমোনি ৩৮০-তে তুলে দিলে সেই ব্যক্তিটি ঘুম ভেঙে জানালার বাইরে দেখার আগ পর্যন্ত টের পাবেন না যে, তিনি ঘণ্টায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার গতিতে ছুটছেন!
১. সাংহাই ম্যাগলেভ, চীন
বিশ্বের সর্বোচ্চ গতির ট্রেন চীনের সাংহাই ম্যাগলেভ। এটি অনায়াসে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪৩১ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে! পৃথিবীতে সাংহাই মাগলেভই একমাত্র ট্রেন, যার অপারেশনাল গতি ঘণ্টায় চারশো কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। সাংহাই ম্যাগলেভ রেলওয়ে কোম্পানি এই ট্রেনগুলো পরিচালনা করে। পৃথিবীর অন্যান্য হাই স্পিড রেলওয়ের সাথে এই ট্রেনের রেলওয়ের রয়েছে গুণগত পার্থক্য। এটি বিশেষ ধরনের ‘ম্যাগনেটিক লেভিটেশন’ রেললাইনের উপর দিয়ে চলে। রেললাইনের নামের সংক্ষিপ্ত রূপই এর নাম। ম্যাগ-লেভ বা ম্যাগনেটিভ লেভিটেশন। এর অর্থ, চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা কোনো বস্তুকে ভাসিয়ে তোলা। শুনতে অবাক লাগলেও এই ট্রেনের কোনো চাকা নেই! এমনকি এই ট্রেন প্রকৃতপক্ষে চলে না, উড়ে! হ্যাঁ, ম্যাগলেভ ট্রেন চলাকালীন রেললাইনের সাথে এর কোনো সংযোগ থাকে না। এর শক্তিশালী অসংখ্য চুম্বক রেললাইন এবং ট্রেনের মাঝে অত্যাধিক শক্তিশালী একপ্রকার বিদ্যুতচুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে, যা লাইন থেকে ট্রেনকে ভাসিয়ে রাখে এবং লাইনের উপর দিয়ে ট্রেন বুলেট গতিতে ভেসে চলে! তবে ২০০৪ সাল থেকে শুরু হওয়া এই ট্রেন চলাচল করে স্বল্প পরিসরে। সাংহাইয়ের সেন্ট্রাল পুডং থেকে পুডং এয়ারপোর্ট পর্যন্ত মাত্র ৩০ কিলোমিটারেই ম্যাগলেভের ছুটে চলা। ৫৭৪ জন যাত্রী নিয়ে এই ৩০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে ম্যাগলেভ সময় নেয় মাত্র ৭ মিনিট। যাত্রা শুরুর ৪ মিনিটের মধ্যেই যদিও ম্যাগলেভ এর সর্বোচ্চ গতিপ্রাপ্ত হয়, তথাপি সর্বোচ্চ গতিতে চলবার প্রয়োজনই পড়ে না। তবে এই ৭ মিনিটের ভ্রমণের জন্যই গুণতে হবে বাংলাদেশি টাকায় ৬৬০ টাকা। আর যদি ভিআইপিতে যেতে চান তাহলে দ্বিগুণ, ১৩২০টাকা!