বিশ শতকের শুরুর দিকের কথা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ততদিনে ভালোই উন্নতি লাভ করেছে। বেলের টেলিফোনের গ্রাহক সংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। তবে বেশি দূরে যোগাযোগের জন্য টেলিগ্রাফ তখনো ধরে রেখেছে রাজার আসন। এসব অর্জনের মধ্য দিয়ে আরেকটি কাজ হয়েছে- বৈদ্যুতিক তার ও খুঁটিতে ছেয়ে গেছে শহরগুলো। মোর্স প্রথম যেদিন টেলিগ্রাফের তার টানার জন্য খুঁটি ব্যবহার করেছিলেন তখন তিনি হয়তো জানতেনও না, এই খুঁটি আর তারই একসময় শহুরে জঙ্গল তৈরি করে ফেলবে।
সাধারণ মানুষ ততদিনে বুঝতে পেরেছে বিদ্যুৎ ও তড়িৎচুম্বকের মাহাত্ম্য। টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের মতো দু’টি জলজ্ব্যান্ত প্রযুক্তি চোখের সামনে পেয়েও তড়িৎচুম্বককে অস্বীকার করার সুযোগ কোথায়? ম্যাক্সওয়েল ও ফ্যারাডের গবেষণা যে বৈজ্ঞানিক ভিত তৈরি করেছিল, এ সকল প্রযুক্তিতে তা-ই যথেষ্ট প্রমাণিত হলো।
তবে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের একটি দিক নিয়ে তখনো তেমন একটা চর্চা শুরু হয়নি। সেটি হলো তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের উপস্থিতির সম্ভাব্যতা। এটি পাওয়া গেলে বাঁচা যাবে বৈদ্যুতিক তারের জঞ্জাল থেকে।
তড়িৎচুম্বক তরঙ্গই আজকের ওয়্যারলেস বা তারহীন প্রযুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে সে সম্পর্কে বলার আগে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ মানুষ কীভাবে খুঁজে পেল সে বিষয়ে একটু বলা দরকার। ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত সমীকরণগুলোতে ম্যাক্সওয়েল আলোর গতিতে চলমান আরো একসারি তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের কথা বলেছিলেন। তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলোর চেয়ে ভিন্ন হওয়ার কারণে মানুষ সেসব দেখতে পায় না। কেউ তখনো এ ধরনের তরঙ্গের কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি, তাই কেবল গাণিতিক হিসাব-নিকাশের ওপর ভর করে এর অস্তিত্ব মেনে নেয়া স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না।
তবে অনেকেই ছিলেন যারা ম্যাক্সওয়েলের ওপর ভরসা করেছিলেন। ম্যাক্সওয়েলিয়ানস নামে পরিচিত একদল বিজ্ঞানী নেমেছিলেন এ অদৃশ্য তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সন্ধানে। কিন্তু পনের বছর ধরে বিস্তর খাটা খাটনির পরও তারা কোনো এর সন্ধান পেলেন না। সর্বপ্রথম এ ধরনের তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন জার্মান অধ্যাপক হাইনরিখ হার্জ। আট বছর ধরে লাগাতার তত্ত্বীয় গবেষণা ও দক্ষ পরীক্ষণের পর ১৮৮৮ সালে এসে তিনি সফল হলেন। প্রমাণ করতে সক্ষম হন ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বে বলা তরঙ্গের অস্তিত্ব। ট্রান্সমিটার ও রিসিভার অ্যান্টেনার মাধ্যমে খুবই ক্ষূদ্র পরিসরে তিনি এ তরঙ্গের উপস্থিতি দেখাতে সক্ষম হন।
এ সকল ‘হার্জিয়ান তরঙ্গ’ বৈশিষ্ট্যে ছিল সম্পূর্ণ আলোর মতো, শুধুমাত্র এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছিল আলোর চেয়ে এক মিলিয়ন গুণ বড়। এসব তরঙ্গ ধাতব প্লেটে প্রতিফলিতও হতো, ঠিক আলো যেভাবে প্রতিফলিত হয় আয়নায়। এটি আবিষ্কার হওয়ার পর অনেকেই এর চমকপ্রদ সব প্রয়োগের সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। ব্রিটেনে অলিভার লজ, সার্বিয়ায় নিকোলা টেসলা ও আমাদের জগদীশচন্দ্র বসু সহ অনেকে এ তরঙ্গ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। তবে এ তরঙ্গের সবচেয়ে অসাধারণ প্রয়োগ দেখিয়েছিলেন ইতালির গুগলিয়েমো মার্কনি।
মার্কনি জন্মেছিলেন ১৮৭৪ সালে ইতালির এক সম্পদশালী পরিবারে। শৈশব থেকেই তিনি আগ্রহী ছিলেন তড়িৎচুম্বকত্বের প্রতি। তিনি মাত্র বারো বছর বয়সে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ‘কাইট এক্সপেরিমেন্ট’ নতুন করে সম্পাদন করেছিলেন। বিশ বছর বয়সে এসে হার্জের কাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। তরঙ্গ নিয়ে তার পরীক্ষণটি নতুন করে করেন এবং এটিকে উন্নত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তরঙ্গের প্রতি মার্কনির আগ্রহের কারণ হার্জের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। হার্জ একজন বিজ্ঞানী হিসেবে এ তরঙ্গ খুঁজে বের করেছিলেন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা থেকে, তড়িৎচুম্বকের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী পরিবার থেকে আসা মার্কনি এতে দেখেছিলেন অর্থ-কড়ির সম্ভাবনা।
তিনিই প্রথম যোগাযোগের জন্য টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনে এ তরঙ্গ ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যেহেতু এ তরঙ্গকে সুইচের সাহায্যে বন্ধ ও চালু করা যায়, তাই এটি দিয়ে সহজেই তারবিহীনভাবে মোর্স কোড প্রেরণ করা সম্ভব হবে। নিজের চিলেকুঠুরিটিকে তড়িৎচুম্বক গবেষণাগার বানিয়ে তিনি কাজ শুরু করে দিলেন। চেষ্টা করতে লাগলেন হার্জের ট্রান্সমিটার ও রিসিভারের দূরত্ব বাড়াতে। তিনি দেখলেন ভোল্টেজের পরিমাণ বাড়িয়ে ও দীর্ঘ এন্টেনা ব্যবহার করে অধিক দূরত্ব পর্যন্ত সিগন্যাল পাঠানো সম্ভব হয়। একটি উড়ন্ত ঘুড়ির সাথে এন্টেনা ব্যবহার করে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত সিগন্যাল পাঠাতে সক্ষম হন তিনি।
প্রথমদিকে মার্কনির বাবা এসব প্রযুক্তি নিয়ে তার ঘাঁটাঘাঁটি করার অভ্যাসকে ভীষন অপছন্দ করতেন। তিনি চাইতেন ছেলে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করুক আর ব্যবসায় মন বসাক। কিন্তু একটা সময় এসে মার্কনির ঐকান্তিক আগ্রহের কাছে তিনি হার মানেন এবং এ কাজে তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন। বাবার উৎসাহেই মার্কনি ইতালি সরকারের টেলিকমিউনিকেশন দপ্তরের কাছে এ প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য তহবিল চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু তারা বেশ ভদ্রভাবেই জানিয়ে দেয় এতে সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। নিরাশ হয়ে বিনিয়োগকারী খুঁজতে ইতালি ছেড়ে লন্ডন পাড়ি জমান।
প্রযুক্তিভিত্তিক কোনো ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য তখন লন্ডন ছিল আদর্শ জায়গা, অনেকটা আজকের সিলিকন ভ্যালির মতো। তাছাড়া তার মায়ের দিকের আত্মীয়রা তখন লন্ডনে বেশ অবস্থাপন্ন। তাদের মাধ্যমে তিনি লন্ডনের অভিজাত সমাজের সাথে পরিচিত হলেন। তরুণ, সুদর্শন মার্কনি তাদের মাঝে বেশ চমৎকার ভাবমূর্তি উপস্থাপন করেছিলেন। তার একজন আত্মীয়ের মাধ্যমে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ পোস্ট অফিসের প্রধান প্রকৌশলী স্যার উইলিয়াম প্রিসের সাথে।
উইলিয়াম প্রিস তার কাজ সম্পর্কে জেনে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলেন। ব্রিটিশ টেলিকমিউনিকেশন খাতে প্রিসের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। তিনি মার্কনিকে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের কাছে তার কাজের প্রদর্শনী দেখানোর সুযোগ করে দিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মার্কনি লন্ডনে বেশ আলোচিত হয়ে উঠলেন এবং তার মায়ের পরিবারের সহায়তায় সে সময়ের প্রায় ১ লক্ষ ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেন। ক্রয়ক্ষমতা হিসেবে এটি ২০১০ সালের সাড়ে আট মিলিয়ন ডলারের সমান।
এত পরিমাণ টাকা তরুণ মার্কনি হেলায় নষ্ট করেননি। নিজের তুখোড় ব্যবসায়িক বুদ্ধি দ্বারা তিনি এর উপযুক্ত ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফির সম্ভাবনাময় বাজার বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। এছাড়া ইতিহাস সম্পর্কেও তার ভালোই জানাশোনা ছিল, তাই তিনি তার কাজের স্বত্ব নিরাপদ রাখার গুরুত্বও বুঝেছিলেন। তাই প্রথমেই তিনি ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি সম্পর্কিত একসারি পেটেন্ট নিয়ে তার ভবিষ্যৎ নিরাপদ করে রাখলেন প্রতিযোগিদের কাছ থেকে।
এরপর বাজারে নেমেই সে সময়ে প্রতিষ্ঠিত থাকা তার সংযোগের টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার সাথে কোনো দ্বন্দ্বে জড়াননি। তিনি কেবল সেসব এলাকায় বেতার সংযোগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেসব জায়গায় তার সংযোগ পৌঁছাতে পারেনি। যেমন, জাহাজ থেকে বন্দরে যোগাযোগের ক্ষেত্রে। তিনি বেশ বুদ্ধিমত্তার সাথে মিডিয়ায় তার প্রযুক্তির প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। ব্রিটেনের রাজকীয় ইয়টে এবং রানীর প্রাসাদে বেতার টেলিগ্রাফ প্রতিষ্ঠিত হলো। রানী ভিক্টোরিয়া ও তার ছেলে প্রিন্স অব ওয়ালেস এডওয়ার্ডের বেতার আলাপনের খবর জায়গা করে নিল সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। এ সুযোগে ব্যাপক প্রচার পেল মার্কনির প্রযুক্তি।
এসবের মাধ্যমে মার্কনি বিশ্ববাসীকে দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, দু’টি জায়গা সরাসরি দৃষ্টিরেখা বরাবর না হলেও তাদের মধ্যে বেতার যোগাযোগ সম্ভব। ১৮৯৯ সালে ফরাসি সরকার তাকে দায়িত্ব দিল, ইংলিশ চ্যানেলের দুই পাড়ে বেতার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার। তিরিশ মাইল পানির ওপর দিয়ে মার্কনি বেশ সফলভাবেই এ ব্যবস্থা স্থাপন করলেন। এ সফলতা তাকে আরো বড় লক্ষের দিকে ধাবিত করে। সেবছরই আমেরিকা ভ্রমণের পর মার্কনি চিন্তা করেন, বেতার সিগন্যাল যেভাবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছে, একইভাবে কী এটি আটলান্টিকও পাড়ি দিতে পারবে?
ইংলিশ চ্যানেলের তিরিশ মাইলের পর, এবার লক্ষ্য দু’হাজার মাইল। তাই চ্যালেঞ্জও বেশি। আরো অনেক লম্বা এন্টেনা ও আরো শক্তিশালী বিদ্যুৎ উৎসের দরকার হবে। এছাড়া মৌলিক বিজ্ঞানের অনেক অজানা বিষয়ও ছিল। যেমন, পৃথিবী যেহেতু গোলাকার, তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ কি ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত যাবে নাকি বায়ুমণ্ডল ভেদ করে এটি সোজা মহাশূন্যে পাড়ি জমাবে? এত সব সীমাবদ্ধতা স্বত্বেও মার্কনি সিদ্ধান্ত নিলেন এটি সম্পন্ন করার। তিনি এজন্যে নিয়োগ দেন প্রফেসর জন এমব্রোস ফ্লেমিংকে।
প্রফেসর ফ্লেমিং বৈদ্যুতিক ডিজাইনে অনবদ্য একজন ব্যক্তি ছিলেন, এর আগে তিনি কাজ করেছিলেন এডিসনের সহকারী হিসেবে। তার তত্ত্বাবধানে মার্কনি লোকচক্ষুর আড়ালে এ প্রজেক্ট চালু করলেন, ইংল্যান্ড ও কানাডার দু’টি স্টেশনে। এটি গোপনে করার কারণ ছিল, তিনি এর সফলতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। ব্যর্থ হলে এটি তার খ্যাতির জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠত। তবে তিনি সফল হলেন। দু’বছর ধরে লাগাতার পরিশ্রমের পর, ১৯০১ সালের ১২ ডিসেম্বর এক শীতের দিনে কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডে মার্কনির এয়ারফোনে ভেসে আসলো ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো টেলিগ্রাফের সিগন্যাল “ডি ডি ডি”, যেটি ইংরেজি অক্ষর ‘S’ নির্দেশ করে।
মার্কনির এ অনন্য অর্জনের খবর বেশ দ্রুত বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়। এর পাঁচ সপ্তাহ পর প্রকৌশল মহলে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পান তিনি। ১৯০২ সালের ২ জানুয়ারি ‘আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স’ এর বার্ষিক সভায় সংবর্ধনা দেয়া হয় তাকে। আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল সহ অনেক কিংবদন্তি অতিথি উপস্থিত ছিলেন সেখানে। এডিসন যদিও উপস্থিত ছিলেন না, তবে তিনি অভিনন্দনসূচক টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন মার্কনির জন্য, লিখেছিলেন-
এই ছেলেটির কাজ তাকে আমার পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
এরপর ১৯০৯ সালে মার্কনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন । তিনিই সম্ভবত পদার্থবিজ্ঞানে একমাত্র নোবেল বিজয়ী, যার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী নেই। তবে তার কাজের মাধ্যমে তিনি নিজেকে এর যোগ্য দাবিদার করে তুলেছিলেন। যোগাযোগ খাতে হার্জিয়ান তরঙ্গের যে অনন্য প্রয়োগ তিনি করেছেন এবং নিজের ক্ষুরধার ব্যবসায়িক বুদ্ধি দিয়ে একে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তার পথ ধরেই সম্ভব হয়েছে আজকের বেতার যোগাযোগব্যবস্থা। যার সুফল আমরা প্রত্যহ ভোগ করছি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে এতটা সহজ করে তোলার জন্য মার্কনি সহ এমন অসংখ্য বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন না করলেই নয়।
তথ্যসূত্র
Conquering the Electron by Derek Cheung , Eric Brach , page (70-79)
ফিচার ইমেজ-wallpapereasy.com