করোনাভাইরাসের প্রকোপ যে শুধু আমাদের প্রত্যাহিক জীবনে পড়েছে তা-ই নয়, একইসাথে এই ভাইরাস পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থাকেও নড়বড়ে করে তুলেছে। আর এই তালিকা থেকে বাদ পড়েনি টেক কোম্পানিগুলোও। মার্চের মধ্যভাগ থেকেই বড় বড় সব টেক কোম্পানিতে ছাটাই শুরু হয়েছে। প্রথম দুই মাসে বিশ্বে ছোট-বড় টেক কোম্পানি মিলিয়ে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৪০,০০০ কর্মী। মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই উবার মোট ৩,৭০০, এয়ারবিএনবি ১,৯০০ এবং লিফট প্রায় ১,০০০ জন কর্মী ছাটাই করতে বাধ্য হয়েছে। করোনার ঝড়ে যখন পরিচিত আর বড় এই কোম্পানিগুলোর এমন অবস্থা, সেখানে সারা বিশ্বে এই সংখ্যাটা কত সেটা অনুমান করা খুব একটা কষ্টকর নয়।
টেক কোম্পানিগুলোই কেন আর্থিক অস্থিরতার সম্মুখীন হচ্ছে?
প্রযুক্তিনির্ভর বলেই নয়, অনেক টেক কোম্পানিই সফটওয়্যার বিক্রির মাধ্যমেই টিকে থাকলেও আর্থিক অনিরাপত্তার কারণে বর্তমানে ক্রেতা নতুন কোনO লগ্নি করতে চাইছেন না। ফলে তৈরি সফটওয়্যার বিক্রি হচ্ছে না। আর্থিকভাবে ধ্বসে পড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
যদি অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানের কথা বলতে হয়, তাহলে চলে আসে এমন রাইড শেয়ারিং বা ফুড ডেলিভারির মতো অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম, যাদের মূল কাজটাই আবর্তিত হচ্ছিলো প্রযুক্তিকে ঘিরে। অ্যাপনির্ভর প্রতিষ্ঠান হওয়ায়, অ্যাপের ব্যবহার কমে যাওয়ায় সরাসরি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে তারা। গ্রাহক না থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ছে পুরো প্রক্রিয়া।
তবে এই পুরো ব্যাপারটায় গত কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা টেক কোম্পানিগুলোকেও কিছুটা দোষারোপ করা যায়। বিশেষ করে গত এক যুগের প্রথমভাগেই টেক কোম্পানির পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে অনেক পরিমাণে। নতুন করে লাভজক এই টেক ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ করেছে অনেক কোম্পানি। ২০১৮ সালেও বেশ ভালো গতিতেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো কোম্পানিগুলো। তবে এই বছরে সেই যাত্রা অনেকটাই থমকে গিয়েছে। মূলত আর্থিক লগ্নির মাধ্যমে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে তুলনামূলক কম কর্মী নিয়েও সফল হতে পারলেও বর্তমান আর্থিক অস্থিরতাকে সামাল দেওয়া অনেক টেক কোম্পানির জন্যই বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই অনেকেই আর্থিক এই সমস্যাকে কর্মী ছাটাইয়ের মাধ্যমে দূর করার চেষ্টা করছেন, অনেকে আপাতকালীন প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখছেন কিংবা পাকাপাকিভাবেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছেন।
সব টেক কোম্পানিই কি নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে?
না, করোনার কারণে থমকে যাওয়া জীবনব্যবস্থায় বেশিরভাগ টেক কোম্পানিই ক্ষতির মুখোমুখি হলেও সব কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ অ্যামাজনের কথাই বলা যায়। এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি বাড়তি অর্ডারের চাপ সামাল দিতে এ বছর আরো ১,৭৫,০০০ কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। ঠিক একইভাবে খারাপ পরিস্থিতি খুব ভালোভাবেই সামলে গিয়েছে ফেসবুক এবং অ্যাপলের মতো কোম্পানিগুলো। কিছুদিন পরেই গুগল নতুন কর্মী নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবছে। মহামারির সময়ে সবগুলো টেক কোম্পানিকে খারাপ অবস্থা পার করতে হয়নি। বিশেষ করে অনেক কোম্পানির প্রযুক্তির ব্যবহার এখন আরো বেড়ে গিয়েছে। আর এর মূল কারণ হলো, মহামারিতে এই প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা বেড়েছে।
বর্তমানে অধিকাংশ মানুষকে ঘরে বসে অফিসের কাজ সামলাতে হচ্ছে। ফলে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সবাই ভিডিও কল করছেন, ফোনে কথা বলছেন। এই প্রযুক্তিগুলোর পেছনে থাকা টেক কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। অন্যদিকে, বর্তমানে অনলাইনের দিকে সবাই মনোযোগী হয়ে পড়ায় সুপার শপ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়েবসাইটের দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে বাড়ছে অনেক টেক কোম্পানির কার্যক্রম। টেলিমেডিসিন ওয়েবসাইট তৈরি করছে অনেক কোম্পানি।
খুব নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে এই পুরো আর্থিক ক্ষতির অনেকটাই সামাল দিচ্ছে ভ্রমণ এবং যাতায়াত সেবা সংক্রান্ত কোম্পানিগুলো। সেখানে যেমন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পালা চলছে, তেমনি কর্মী ছাটাই হচ্ছে অনেক বেশি পরিমাণে। উবার বা এয়ারবিএনবি ছাড়াও ট্রিপঅ্যাডভাইজর কর্মী ছাটাই করেছে। রিটেইল এবং ফুড সেবাগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার এই তালিকায় তৃতীয় ধাপে আছে গ্রাহক সেবাভিত্তিক কোম্পানি, যেমন- রিভিউ বা ইভেন্ট সাইটগুলো। বিশেষ করে, বিয়েকে কেন্দ্র করেই অনেক ফটোগ্রাফি ও ইভেন্ট ওয়েবসাইট গড়ে উঠেছিলো, যেগুলোর প্রত্যেকটিই এখন থমকে আছে।
টেক কোম্পানির নতুন দিগন্ত: শুরু কি এখানেই?
অনেকেই বর্তমান পরিস্থিতিকে নেতিবাচকভাবে দেখলেও, বাকিরা আবার একে ইতিবাচক কিছু ভাবছেন। আমরা সবসময় যে প্রচলিত টেকনির্ভর শিল্পকে অনুসরণ করে এসেছি, এবার সেটা ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন একটা আকৃতি নেবে- এমনটাই মনে করছেন তারা। একদিকে একের পর এক লাগামহীনভাবে টেক কোম্পানি তৈরি হওয়া কিছুটা হলেও কমে আসবে। বর্তমান সময়ে অনেক টেক কোম্পানিই নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। আর সেটা তারা করেছে দুটি পদ্ধতিতে।
১) প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে
কর্মক্ষেত্রে যেতে না পারা মানেই সব কাজ গুটিয়ে বসে থাকা নয়। এই ব্যাপারটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনেক টেক কোম্পানি। আগে থেকেই দূর থেকে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় বর্তমান পরিস্থিতিতেও দূর থেকেই কাজ পরিচালনা করছেন তারা সহজেই। একইসাথে, নিজেদের এই পদ্ধতিকে বাকিদের বেলাতেও প্রয়োগ করেছে তারা। ফলে ক্লায়েন্টদের সামলানোটাও তাদের পক্ষে সহজ হয়েছে।
২) উদ্ভাবন ও পরিকল্পনার মাধ্যমে
কোনো একদিক দিয়ে থেমে গেলেও টেক কোম্পানিগুলো অন্য কোনোভাবে কাজ চালিয়ে যেতেই পারে। অনেক কোম্পানিই সেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। তাই যাতায়াতের দিকে সমস্যা তৈরি হওয়ার সাথে সাথে প্রশাসনের অনুমতিতে জরুরি যাতায়াত সেবা চালু করেছে তারা; সুপারশপ, যোগাযোগ, টেলিমেডিসিন বা পড়াশোনাভিত্তিক ওয়েবসাইটের দিকে ঝুঁকে গিয়েছে। একইসাথে ক্লায়েন্টকেও সেদিকে যেতে উৎসাহিত করেছে। আর তাই, কিছুটা কষ্টকর হলেও বর্তমানে তাদের আর্থিক সমস্যাকে অনেকটাই সামাল দিয়েছে তারা।
ব্যাপারটি এমন না যে বর্তমান এই পরিস্থিতি খুব দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে। আবার এমনটা যে হবে না, তা-ও সঠিক বলা যায় না। এতদিন ধরে প্রযুক্তিকে একভাবে ব্যবহারের মাধ্যমেই অনেক টেক কোম্পানি টিকে ছিল। ক্রেতার চাহিদানুসারে প্রতিনিয়ত পণ্যের চেহারা বদলে যায়। আর ঠিক তেমনই এক পরিবর্তনের সময় এসেছে বর্তমানে। বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন, এবার প্রচলিত ডিজিটাল হয়ে ওঠার চিন্তাকে আরেকটু বদলে হয়তো নতুন এক ডিজিটাল বিশ্বের দিকে এগিয়ে যাবে সবাই। আর সেটার শুরু হয়ে গিয়েছে এই বছরে, মহামারীর প্রকোপের সাথেই।