স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠান, যেমন- হাসপাতাল, ওষুধ কোম্পানি, এনজিও ইত্যাদির জন্য একটি সুখবর। আধুনিক প্রযুক্তি ব্লকচেইনের উৎকর্ষের দিনে এর বাস্তব প্রয়োগের আরেকটি উদাহরণ হতে যাচ্ছে এই স্বাস্থ্যখাত। রোগীদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ, সেগুলোর গোপনীয়তা, নিরাপত্তা রক্ষা ইত্যাদি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব তথ্যের ভেতর অনেক সময় সংবেদনশীল তথ্যও থাকে, যা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়। বিভিন্ন সময়ে এসব তথ্য হাতিয়ে নেয়ার ফলে এই গোপনীয়তা লঙ্ঘন হয়। তাই স্বাস্থ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন কিছু দরকার ছিল যার মাধ্যমে তারা রোগীদের তথ্য গোপন এবং নিরাপদ রাখতে পারবে। আবার যখন অন্য কোথাও কোনো নির্দিষ্ট কাজে এই তথ্যগুলো ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়বে তখন যেন নিরাপত্তা রক্ষা করে তা ব্যবহার করা যায় ।
যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে। সাধারণত দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সময়ের নানা ধরনের উপাত্তের প্রয়োজন হয়। যেমন- রোগীদের রোগ, চিকিৎসক, মেডিকেল অফিস, হাসপাতাল, ফার্মাসিউটিকেল কোম্পানি, মেডিকেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ইত্যাদির নানা তথ্য দরকার পড়ে। এই উপাত্তগুলোর পরিমাণ হয় অনেক বেশি। তাই সঠিকভাবে এসব তথ্য গুছিয়ে রাখা এবং এসবের রক্ষণাবেক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।
এছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, একই রোগীকে দেয়া ওষুধের পরিমাণ মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী একেক সময় একেক রকম হয়। তাই অনেক সময় রোগীর সম্পর্কে নতুন তথ্য সংযোজন করা হয় না, যার ফলে তথ্যে ত্রুটি দেখা দেয়। আবার স্বাস্থ্য সম্পর্কীয় তথ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকর্তৃক সংগ্রহ করা হয় বিধায় এসব তথ্যের গোপনীয়তা কোনোভাবে যেন সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে বাইরে বের হয়ে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু অনেক সময় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই যাদের তথ্য এবং উপাত্ত সরবরাহ করা হয়, তাদের উপর নজর রাখা যায় না। এসব নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্র ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ব্লকচেইনের নাম শুনলেই সাথে সাথে মাথায় আরেকটি শব্দ আসে- বিটকয়েন। আসলে বিটকয়েন নামক ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে লেনদেন করার জন্য এই ব্লকচেইন তৈরি হয়েছিল। কারণ ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে যে লেনদেন করা হবে সেগুলোর একটি ডাটাবেজ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। কখন কী ধরনের লেনদেন কোথায় হচ্ছে সেটার একটি রেকর্ড রাখা জরুরি। কিন্তু ব্লকচেইনের সুবিধা হচ্ছে এই তথ্যগুলো কখনও মুছে ফেলা যাবে না এবং কে কোথায় কীভাবে নিজের লেনদেন সম্পন্ন করছে তা শুধু সে নিজেই নিয়মিত হালনাগাদ করতে পারবে, অন্য কেউ নয়। এই হালনাগাদ করার কাজটি করবে শুধুই প্রবেশাধিকার দেয়া হবে যাকে সে, অন্য কেউ নয়। এছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে সবসময় একে অন্যের সাথে সংযুক্ত থাকার ফলে ব্লকচেইন সিস্টেমের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। কারণ এটা ক্লাউড স্টোরেজের মতো কাজ করে।
ব্লকচেইন এখানে আসলে কীভাবে ব্যবহার করা হবে সেটা একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে প্রায় ২৪টি প্রতিষ্ঠান আছে যারা স্বাস্থ্যখাত থেকে বিভিন্ন উপাত্ত ব্যবহার করে থাকে। তারা ইলেক্ট্রনিক হেলথ ডাটা প্রস্তুত করে এবং তথ্য জমা রাখে, আবার প্রয়োজনে সেসব তথ্য অন্যের সাথে ভাগাভাগিও করে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজেদের মধ্যে কিন্তু কোনো যোগাযোগ নেই। আবার এভাবে উপাত্ত সংগ্রহ করে রাখা হলে তা হ্যাক হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। আবার নিজেরা নিজেরাই হয়তো সেই তথ্য পরিবর্তন করে ফেলতে পারে বা অন্য কোনো অসদুপায় অবলম্বন করতে পারে। ব্লকচেইনের মাধ্যমে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান, যারা একই ধরনের উপাত্ত ব্যবহার করবে, তাদের মধ্যে একটি যোগাযোগ থাকবে এবং কে কোথায় কীভাবে এসব উপাত্ত ব্যবহার করছে সেসব তথ্য ব্লকচেইন মারফত জানা যাবে। এর মাধ্যমে যা-ই সংরক্ষণ করা হোক না কেন, এর ভিতর যে কাজই করা হোক না কেন, সেটার রেকর্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হয়ে যায়। তাই কেউ যদি অসদুপায় অবলম্বন করতেও যায়, তাহলে ধরা পড়ে যেতে পারে।
ব্লকচেইনের মাধ্যমে ডাটা সংরক্ষণ করলে ডাটা জমা রাখার সময় যদি কোনো ভুল হয় তাহলে তা বোঝা যায় এবং ভুল সমাধান করা যায়। এমনকি রোগী নিজেও তার রোগের তথ্য সিস্টেমে ঢুকে সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে। আর এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, যেহেতু এই পদ্ধতি কেন্দ্রীয় কোনো কিছু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় এবং এর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে লেনদেনের জগতে সবাইকে একত্রিত করা (যেটা ইন্টারনেট নিজেও করে), তাই হ্যাকারদের জন্য এরকম সিস্টেমে অনুমতি ছাড়া ঢুকে যাওয়া কঠিন। এর জন্য দরকার পড়বে অতি উন্নতমানের কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
ব্লকচেইনের মাধ্যমে আরও কিছু কাজ করা যায়। যেমন- বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে নানা রকমের রোগবালাই মহামারী হিসেবে দেখা যায়। বিভিন্ন প্যথোজেন, যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির কারণে এ সমস্ত রোগ হয়ে থাকে। এসব আণুবীক্ষণিক জীবের কারণে কীভাবে রোগ ছড়ায়, কতদিন পর পর এই রোগবালাই হয়, এর ছড়ানোর পেছনে কোনো প্যাটার্ন আছে কি না, কোথা থেকে বেশি ছড়ায়, কোন আবহাওয়াতে মহামারী বেশি হয়, এসব রোগ মানুষের কোথায় কী ধরনের ক্ষতি করে, বিভিন্ন মহামারীর কারণে আগে কত মানুষ মারা গিয়েছে, কতদিনে এরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, এসব রোগ প্রতিকারের উপায় কী, এসব রোগের রাসায়নিক গঠন কী রকম, প্রতিকারের জন্য যে টীকা তৈরি করা হয় সেগুলোর রাসায়নিক গঠন কী ইত্যাদি বিষয়ের উপর তথ্য গুছিয়ে ব্লকচেইনের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যায়, যাতে যে কেউ এসব নিয়ে নির্ভুল তথ্য পেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং নিবারণ কেন্দ্র ব্লকচেইনের মাধ্যমে এরকম একটি বিরাট তথ্য সংরক্ষক তৈরি করছে। এছাড়া ওপিওয়েডের ব্যবহার এবং অপব্যবহার নিয়ে তারা আরেকটি তথ্যসংরক্ষক তৈরি করছে। ওপিওয়েড হচ্ছে একধরনের ড্রাগ, যা পেইনকিলার বা ব্যথা নিবারক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ওষুধপত্র বিভিন্ন অঞ্চলে বণ্টন এবং সরবরাহ করার ক্ষেত্রে- ওষুধগুলো ঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে কি না, সময়ের আগে বা পরে কখন এগুলো গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করতে যুক্তরাষ্ট্রে ব্লকচেইন সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। ইউরোপ এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। কিছুদিন আগে ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বিরাট এক গ্রান্ট এবং ফান্ড পেয়েছে। এই ফান্ডিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো ব্লকচেইনের মাধ্যমে কীভাবে মেডিকেল গবেষণায় সাহায্য করা যায়। তাদের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন স্বাস্থ্য-প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসালয় এবং রোগীদের মধ্যে কীভাবে তথ্যের আদান-প্রদান করা যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করা।
বিটকয়েন আসার পর ব্লকচেইন কথার সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছিলো। ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে অর্থ লেনদেন করার মধ্যেই যে ব্লকচেইনের ব্যবহার সীমাবদ্ধ নয় সেটা একটু একটু করে প্রকাশ পাচ্ছে। তবে উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, স্বাস্থ্যখাতে ব্লকচেইনের ব্যবহার সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে এ খাতে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: ETGNews.com