স্কুলের সেই ঘণ্টার কথা মনে আছে? যে ঘণ্টাটি শোনার আশায় কান পেতে থাকতেন। কখন বেজে উঠবে, আর শিক্ষক জানবে তার ক্লাসের সময় শেষ। স্কুলের এ ঘণ্টাটি কিন্তু টেলিযোগাযোগের জন্যে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের একটি আদর্শ উদাহরণ। এ ঘণ্টাটি একটি সংকেত পাঠাতো, যা থেকে আমরা জানতে পারতাম ক্লাস শেষ হওয়া বা ছুটি হয়ে যাওয়ার তথ্য।
হর্ন, সাইরেন সহ এমন শব্দ-সংকেতের উদাহরণ আমাদের চারপাশে অনেক আছে। এগুলো বিভিন্ন তথ্য বহন করে। তবে এগুলো কেবল নির্দিষ্ট কিছু তথ্যই বহন করতে পারে। যেমন- ফায়ার এলার্ম শুনলে আপনি বুঝতে পারেন আগুন লেগে গেছে। রাস্তায় গাড়ির হর্ণ শুনলে বুঝতে পারেন আপনার পেছনে একটি গাড়ি আছে। এর বেশি তথ্য এ শব্দ-সংকেতগুলো বহন করতে পারে না। কথা বলা বলতে যা বোঝায় তা এগুলো পারে না।
অবশ্য একটি ঘণ্টার কথা বলার কোনো দরকারও নেই এ যুগে। পুরো এলাকাকে কিছু জানাতে চাইলে আমরা সহজেই একটি মাইক বা সাউন্ডবক্স ব্যবহার করতে পারি। নির্দিষ্ট কাউকে কিছু বলতে ব্যবহার করতে পারি মোবাইল ফোন। বর্তমানে ইলেকট্রনিক যোগাযোগের যুগে ঘণ্টাকে দিয়ে কথা বলানো স্রেফ আজব খেয়াল বলেই মনে হবে।
তবে আজকে আমাদের আলোচ্য বিষয় বর্তমান যুগ নয়। সেসময়ের কথা চিন্তা করুন, যখন ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, রেডিও, টেলিভিশন এমনকি টেলিগ্রাফও। তখন একটি কথা বলা ঘণ্টা থাকলে কী অসাধারণ ব্যাপারই না হত! মুহূর্তের ব্যবধানে দূর দূরান্তে আপনি পৌঁছে দিতে পারতেন আপনার কথা, যে দূরত্বে মানুষের কণ্ঠস্বর পৌঁছাতে পারে না।
বাস্তবে এমন অসাধারণ প্রযুক্তি কিন্তু ছিল সেসময়। তবে ইউরোপ-আমেরিকা বা আধুনিক কোনো দেশে নয়, পশ্চিমাদের মতে যারা ‘নিরক্ষর’, ‘বর্বর’ সেই আফ্রিকায়। ড্রামের বাদ্য ব্যবহার করে কথা বলতে পারতো আফ্রিকানরা। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে মুহূর্তের মধ্যে পাঠাতে পারতো যেকোনো সংবাদ। আফ্রিকার কথা বলতে পারা সেই ড্রামগুলো নিয়েই আলোচনা করা হবে আজকের লেখায়।
দূর-যোগাযোগের চাহিদা মানুষের আদ্যিকাল থেকেই রয়েছে। কিন্তু ইলেকট্রনিক যোগাযোগ আসার পূর্বে এর জন্যে উপযুক্ত কোনো মাধ্যম তারা উদ্ভাবন করতে পারেনি। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। রাজা-রাজড়াদের থাকতো বিশেষ বার্তাবাহক, দ্রুতগামী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে যারা পৌঁছে যেত এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে। কিন্তু এর কোনোটিই পর্যাপ্ত ছিল না। দেখা যেত, বার্তাবাহী দূত রওয়ানা দিয়েছে কোনো জায়গায় সম্রাটের আগমন সংবাদ পৌঁছাতে, কিন্তু তার আগেই সেখানে সম্রাট গিয়েই হাজির।
তবে জরুরি কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে কিছু সংকেতের প্রচলন ছিল। পতাকা, শব্দ বা আলোর সাহায্যে এ সকল সংকেত আদান-প্রদান করা হতো। কিন্তু ঐ যে প্রথমে যেমনটা বললাম, এটি স্রেফ একটি নির্দিষ্ট তথ্যই পাঠাতে পারতো। শত্রুর আগমন, যুদ্ধজয়ের সংবাদ বা প্রার্থনার সময় এরকম কিছু বিষয়ের সংবাদ দেয়ার জন্য এ সকল সংকেত ব্যবহার করতে পারতো। কিন্তু আফ্রিকান যে ড্রামগুলো ছিল, সেগুলো কোনো সংকেত নয়, বরং ‘কথা’ পাঠাতে পারতো, এমনকি কবিতা, গান বা কৌতুকও পাঠানো যেত এর সাহায্যে।
ইউরোপীয়রা আফ্রিকার এ প্রযুক্তির বিষয়ে জেনেছে উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে। এর আগ থেকে আফ্রিকাতে তাদের যাতায়াত থাকলেও তাদের ড্রাম যে কথা পাঠাতে সক্ষম তা লক্ষ্য করেনি কেউ। তারা একে স্রেফ সাংকেতিক যোগাযোগের মাধ্যমই ভেবেছিল। তাদের এ অজ্ঞতার প্রমাণ মেলে ফ্রান্সিস মু্রের একটি লেখা থেকে। মুর ১৭৩০ সালের দিকে ব্রিটিশ দাস ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছিলেন আফ্রিকায়। আফ্রিকান ড্রামগুলোকে তিনি প্রধানত বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেন। এছাড়া শত্রুর আগমন ও প্রতিবেশি গ্রাম থেকে সাহায্যের আবেদন করার জন্যেও এর ব্যবহার লক্ষ্য করেন। এর বাইরে এসব ড্রামের কোনো বিশেষত্ব চোখে পড়েনি তার।
এর প্রায় এক শতক পর ক্যাপ্টেন উইলিয়াম অ্যালান, আফ্রিকা ভ্রমণে গিয়ে ড্রামগুলোর সত্যিকার ব্যবহার লক্ষ্য করেন। তার জাহাজের নাবিক ছিলেন একজন আফ্রিকান। তারা যখন নাইজার নদীর ওপর দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ অ্যালান তার নাবিকের মুখভাবের পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছিল সে। কিছুক্ষণ শোনার পর তাদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা কি শুনতে পারছেন না যে, আমার সন্তান আমাকে ডাকছে? যেহেতু কোনো কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল না, তাই বিষয়টি ধরতে পারেননি তারা।
এরপর সে নাবিক তাদের এ শতাব্দী প্রাচীন প্রযুক্তিটির পরিচয় করিয়ে দেয়। আফ্রিকার প্রতিটি গ্রামেই এ ড্রামের মাধ্যমে কথা বলার প্রচলন ছিল। সবাই ড্রামের মাধ্যমে বার্তা পাঠাতে না পারলেও, ছোট বড় সবাই এর বার্তা বুঝতে পারতো। ইউরোপীয়দের কাছে এটি অত্যাশ্চর্যের মতো ছিল। এ ড্রামের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে ছয়-সাত মাইল দূরে বার্তা পাঠানো যেত। সেখান থেকে আবার নতুন করে পাঠালে এভাবে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই এ বার্তাকে শ’খানেক মাইল দূরে পাঠিয়ে দেয়া যেত। বুঝতেই পারছেন, এটি ছিল আধুনিক ইউরোপের সবচেয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ায় সওয়ার বার্তাবাহকের চেয়েও বহু গুন দ্রুত।
এ প্রযুক্তি সম্পর্কে জানার পরেও এর কর্মকৌশল সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিল না ইউরোপীয়দের। ক্যাপ্টেন অ্যালান যে সময় এটি লক্ষ্য করেন তার কাছাকাছি সময়েই আমেরিকায় টেলিগ্রাফের প্রচলন শুরু হয়েছিল। পশ্চিমারা ভাবতে শুরু করেছিল, আফ্রিকার এ যোগাযোগ প্রযুক্তিটিও মোর্সের নীতি মেনেই কাজ করে। অর্থাৎ সেখানেও মোর্স কোডের মতো কোনো কোড রয়েছে। মোর্স কোড প্রত্যেকটি অক্ষরের জন্যে ডট-ড্যাশ ও বিরতির মাধ্যমে একপ্রকার সাংকেতিক ভাষা তৈরি করেছিল। তারা ভেবেছিল, আফ্রিকানরা ড্রামেরও বিভিন্ন ধরনের সুরের (নোট) মাধ্যমে এরকম কোনো সংকেত পাঠায়।
বাস্তবে বিষয়টি সেরকম ছিল না। মোর্স কোডের মতো কোনো কোড তৈরি করতে অক্ষরের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ আফ্রিকান ভাষাগুলোরই তেমন সুসংগত লেখ্যরূপ ছিল না, যে তারা বিভিন্ন অক্ষরের জন্যে বিভিন্ন সংকেত নির্দিষ্ট করে দেবেন। তবে তারা কীভাবে ড্রামের সাহায্যে যোগাযোগ করতেন? বিষয়টি সর্বপ্রথম বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন জন এফ ক্যারিংটন।
ক্যারিংটন ছিলেন একজন ইংরেজ মিশনারি। চব্বিশ বছর বয়সে তিনি আফ্রিকা যান। পরবর্তী জীবনের পুরোটা সেখানেই কাটান তিনি। আফ্রিকান সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল তার। আফ্রিকানরাও তাকে তাদেরই একজন ভাবতো, ভুল করে যার আত্মা বিদেশে জন্ম নিয়ে ফেলেছিল। ড্রামের বিষয়টি তার নজর কাড়ে শুরুতেই। তিনি একবার কোনো পূর্ব-সংবাদ না পাঠিয়ে তার আবাসস্থল থেকে বেশ দূরে একটি শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি অবাক হয়ে দেখলেন বেশ কয়েকজন তার অভ্যর্থনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্যারিংটন অবাক হয়ে যখন জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে তারা তার আসার খবর জানলো? তারা জবাব দিলো, ড্রামের মাধ্যমে এ খবর পেয়েছেন তারা। ক্যারিংটনের বিস্ময় শুরু হয় সেখান থেকেই। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে নিবিড়ভাবে ড্রামের কলাকৌশল পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। ক্যারিংটন অত্যন্ত মেধাবী একজন ব্যক্তি ছিলেন। আফ্রিকান ভাষার কাঠামো নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল তার। এ কারণেই তার জন্যে ড্রামের কর্ম-কৌশল বোঝা সহজ হয় তার পক্ষে। ১৯৪৯ সালে তিনি তার গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল প্রকাশ করেন ‘Talking Drums of Africa’ শিরোনামের একটি বইয়ে।
আফ্রিকান ভাষার লেখ্যরূপ না থাকলেও অন্য একটি বিশেষত্ব ছিল, যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোয় অনুপস্থিত। তাদের ভাষায় কণ্ঠস্বরের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। বিভিন্ন শব্দে জোর দেয়া বা না দেয়ার ফলে এর অর্থ বদলিয়ে যায়। আমাদের ভাষায় যেমন কোনো শব্দ যে সুরেই বলি তার অর্থ একই থাকে। ধরুন, আমি বললাম, ‘আপনি খুব ভালো মানুষ’ এ বাক্যে সুরের যত তারতম্য করিই না কেন এর অর্থ একই থাকবে। কিন্তু আফ্রিকান ভাষাগুলোয় সুরের তারতম্যে অর্থ আকাশ পাতাল বদলে যায়।
ধরুন, একটি কিলি শব্দ লিসাকা (lisaka) এর তিনটি শব্দাংশ (লি-সা-কা)। আপনি যদি এ শব্দের শেষ শব্দাংশটিতে জোর দিয়ে বলেন লিসা‘কা’, তখন এর অর্থ প্রতিশ্রুতি। যদি একটির বদলে শেষ দুটি শব্দাংশে জোর দিয়ে বলেন লি‘সাকা’, তবে তার অর্থ বিষ। এখানে সুরের একটু তারতম্যে অর্থ সম্পূর্ণ বদলে গেল। এমনটা অধিকাংশ শব্দের ক্ষেত্রেই হতো। পশ্চিমারা যখন আফ্রিকান ভাষা শেখে তখন এ নিয়ে তাদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হত। কারণ চর্চা না থাকায় এ সুরের তারতম্য ধরার জন্যে তাদের শ্রবনেন্দ্রিয় প্রস্তুত ছিল না।
আফ্রিকান ভাষার সুরের গুরুত্বকেই তারা আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় ড্রামের মাধ্যমে। ড্রামে আর কোনো শব্দ নয়, সম্পূর্ণ সুরের ওপর ভর করেই যোগাযোগ করতো তারা। কথা বলা ড্রামগুলোয় কয়েক ধরনের শব্দ (pitch/note) বাজানো যেত। সেগুলো দিয়ে প্রকাশ করা হতো তাদের ভাষা। কিন্তু একই সুর তো বেশ কয়েকটি শব্দের জন্য হতে পারে। কোনটির কথা বলা হচ্ছে তারা বুঝবে কীভাবে? এর জন্যে খুবই চমৎকার একটি কৌশল ছিল তাদের।
এ সমস্যা দূর করতে আফ্রিকান ড্রামগুলোয় কখনো সরাসরি কোনো বার্তা দেয়া হতো না। এগুলোতে কথা বলা হতো অনেকটা কাব্যিক ঢঙে। ধরুন, কাউকে বলা হবে, ‘ঘরে ফিরে এসো’। এর জন্যে বার্তা পাঠানো হত,
“ফিরিয়ে আনো তোমার পা দু’টোকে, যেভাবে তারা গিয়েছিল
ফিরিয়ে আনো তোমার চরণ যুগল যেভাবে চলে গিয়েছিলো তারা
ফিরিয়ে আনো সে গাঁয়ে, যেখানে আমাদের বসবাস”
শস্যকে বোঝানোর জন্যে বলতো “যা মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকে”। বুঝতে পারছেন কেন তারা এমনটি করতো? নাহ স্রেফ কবিতার প্রতি ভালোবাসা বা কাব্যিক সৌন্দর্যের জন্যে নয়। তারা এটি করতো শ্রোতাকে প্রসঙ্গ ধরিয়ে দিতে। কোনো একটি নির্দিষ্ট শব্দ বললে, সুরের মিলের জন্যে তা কেউ ভুল বুঝে বসতে পারে। কিন্তু এমন বর্ণনা করে বললে, ভুল হবার সম্ভাবনা খুবই কম। যেমন ধরুন, একটি বানান ভুল হওয়া শব্দ দেখলে আমরা সবসময় বলতে পারি না যে, এর আসল শব্দটি কী হবে। কিন্তু যদি এটি কোনো বাক্য বা অনুচ্ছেদের ভেতর থাকে, তবে আমরা সহজেই বুঝতে পারি কী বলতে চাইছে।
এই যে কোনো তথ্যকে সঠিকভাবে পৌঁছাতে অতিরিক্ত তথ্যের ব্যবহার, এটি কিন্তু বর্তমানের ডিজিটাল কমিউনিকেশন সিস্টেমে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা। কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ‘Error Correction Code’ নামে পরিচিত এটি। এ কোডের প্রচলন হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। এর আগের ইঞ্জিনিয়াররা তথ্যকে যতোটা সম্ভব সংক্ষেপে পাঠাতে চাইতেন। অথচ আফ্রিকার নিরক্ষর মানুষেরা এ অসাধারণ ধারণাটি কয়েক শতাব্দী ধরে চর্চা করে আসছেন।
শুধু যোগাযোগ প্রযুক্তি হিসেবেই নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এ কথা বলা ড্রামগুলো বেশ তাৎপর্যবহ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ চর্চা এখন বিলুপ্তপ্রায়। অবশ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির দিক থেকে দেখলে এর প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে। তবে প্রযুক্তির ইতিহাসে এটি যে অনন্য একটি উদ্ভাবন ছিল এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আফ্রিকানদের উদ্ভাবনী ক্ষমতারও একটি অনন্য দৃষ্টান্ত এই কথা বলা ড্রাম।