সিলিকন ভ্যালি, অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি আর উদ্যোক্তাদের আঁতুড়ঘর। এলিজাবেথ হোমস সিলিকন ভ্যালিতে বেশ পরিচিত একটা নাম। তবে বর্তমানে তিনি সিলিকন ভ্যালিতে পরিচিত নেতিবাচক কারণেই। অথচ একসময় সেখানে তার নামটা ছিল পূজনীয় ও ঈর্ষনীয়। কাল পরিক্রমায় এলিজাবেথ হোমস কীভাবে আসমানসম উচ্চতা থেকে ধুলোয় লুটিয়ে পড়লেন?
ছোটবেলা থেকেই এলিজাবেথ ছিলেন প্রচণ্ড উচ্চাভিলাসী, নয় বছর বয়সেই তার ইচ্ছা ছিল বিলিওনিয়র হবার। স্কুল জীবনেও তিনি ছোটখাটো স্টার্ট আপ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন। দারুণ প্রতিভাবান এলিজাবেথ সুযোগ পান স্ট্যানফোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম থেকেই চেষ্টা করছিলেন কোনো বড় প্রফেসরের সাথে গবেষণায় যুক্ত হবার জন্য, তবে সেসময় তার সুযোগ হয়নি।
হাসপাতালের সূচে খানিকটা ভয় পেতেন এলিজাবেথ, বিভিন্ন মেডিক্যাল টেস্টে বেশ খানিকটা রক্ত নিতে হয় সিরিঞ্জে। তাই এলিজাবেথ ভাবতে থাকেন যদি এত রক্ত না নিয়ে সামান্য রক্ত নিয়ে অনেকগুলো টেস্ট করা যেত তাহলে কেমন হতো?
এই ক্ষুদ্র চিন্তা থেকেই এলিজাবেথ মাত্র ১৯ বছর বয়সে শুরু করেন তার আরেকটি স্টার্ট আপ ‘থেরানোস’। থেরানোসের পেছনে সময় দিতে স্ট্যানফোর্ড থেকে ড্রপ আউট হন। থেরানোসের মূল যে সার্ভিস বা যে কনসেপ্ট সেটা ছিল একটা খুব ছোট ক্যাপসুলে, যেটাকে তারা বলে ন্যানোটেইনার (NanoTainer), মানুষের ব্লাড স্যাম্পল কালেক্ট করে অনেক ধরনের মেডিক্যাল টেস্ট করে সেটার রেজাল্ট দেয়া। যে যন্ত্রের মাধ্যমে এই মেডিক্যাল রেজাল্ট তৈরি হবে তার নাম ছিল এডিসন। এই যন্ত্র নির্মাণ করার কারিগরি দক্ষতা এলিজাবেথের ছিল না, তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের মাধ্যমে যন্ত্রটি নির্মাণ করেন।
ডাক্তারি বা মেডিক্যাল টেস্ট জীবনে করিয়েছেন এমন সবাই নিশ্চয়ই দেখেছেন যে একটা সিরিঞ্জ দিয়ে কয়েকটা টেস্টের জন্য বেশ খানিকটা রক্ত শরীর থেকে নিতে হয়। সেখানে একটা ন্যানোকন্টেইনারে ডায়াবেটিস টেস্ট করতে যতটুকু রক্ত লাগে তার চেয়ে কিছুটা বেশি রক্ত দিয়ে অনেকগুলো (১০০-এর অধিক) টেস্টের রেজাল্ট থেরানোস দিতে পারবে এমন দাবিই করেছিলেন এলিজাবেথ হোমস। বুঝতেই পারছেন বিষয়টা অনেক যুগান্তকারী-আকর্ষণীয়, অনেক রক্ত নেয়ার চেয়ে সামান্য কিছু রক্ত দিয়ে অনেকগুলো টেস্টের রেজাল্ট!
প্রথম প্রথম কেউই তার কথা মানতে চায়নি। অনেকে তার যন্ত্র টেস্ট করার জন্য স্যাম্পল দিতেও রাজি হয়নি। পরবর্তীতে বহু দ্বারে ঘুরে ব্লাড স্যাম্পল কালেক্ট করে তার এডিসন যন্ত্রের কার্যকারিতা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই সফলতা থেরানোস বা এলিজাবেথের জয়যাত্রার সূচনা করে। এলিজাবেথ ইনভেস্টরদের কাছে ধর্না দেওয়া শুরু করেন। ইনভেস্টররাও তার থেরানোস কোম্পানিতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে এলিজাবেথের থেরানোস সিলিকন ভ্যালির আরেকটি ইউনিকর্ন স্টার্ট আপ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। মাত্র ২৭ বছর বয়সে এলিজাবেথ ইতিহাসের সবচেয়ে কমবয়সী বিলিয়নারদের একজন বনে যান। বছরখানেক পরেই থেরানোসের মোট আর্থিক সম্পদের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৯ বিলিয়ন ডলারে।
এতটুকু পর্যন্ত আপনার মনে হতে পারে এটা একটা অনুপ্রেরণাদায়ী গল্প। কিন্তু না, এলিজাবেথ হোমসের ন্যানোটেইনারের মাধ্যমে অল্প রক্ত নিয়ে ১০০-এর অধিক টেস্টের রেজাল্ট দেয়ার দাবিটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। এত অল্প রক্ত দিয়ে কোনোভাবেই এতগুলো টেস্ট সম্ভব নয়। এটি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও প্রচলিত ডাক্তারি পরীক্ষার নিয়মের বিরুদ্ধে যায় এবং এটি প্রায় অসম্ভব। তিনি এটা নিজেও ভালোভাবেই জানতেন। তার কোম্পানিতে প্রচণ্ড রকম কড়াকড়ি ছিল, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনভাবেই এডিসন যন্ত্রের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে জানতে দেওয়া হতো না। এত কড়াকড়ি ছিল যে ওয়াশরুমে পর্যন্ত সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর কথা শোনা যায়।
যারা এলিজাবেথের বিরোধিতা করতেন তাদেরকে চাকরীচ্যুত করার পাশাপাশি মামলা মোকদ্দমার ফাঁদে ফেলে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়া করানো হতো। এমনকি জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির গবেষকদের মাধ্যমেও কোনো একটি প্রক্রিয়ার থেরানোস ও এডিসন যন্ত্রের কাজকর্মের একটি রিপোর্ট করাতে সক্ষম হন যাতে থেরানোসের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
এলিজাবেথ স্বজনপ্রীতিও করেছেন তার কোম্পানিতে। থেরানোস হেডকোয়ার্টারে এডিসন যন্ত্রের মাধ্যমে মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট তৈরি না করে বরং বাজারে প্রচলিত যন্ত্রগুলো দিয়েই রোগী থেকে সংগৃহীত সামান্য ব্লাড স্যাম্পল দিয়েই যতটুকু পারা যায় টেস্টের রেজাল্ট তৈরি করা হতো। কিন্তু প্রচার করা হতো সে রেজাল্ট এডিসন যন্ত্র দিয়েই করা।
একটা সময় কেউ একজন উনাকে অ্যাপলের স্টিভ জবসের সাথে তুলনা দিয়েছিল। এটা তাকে এত প্রভাবিত করে যে তিনি স্টিভ জবসের মতো কালো রঙের কাপড় পরা শুরু করেন। স্টিভ জবসের মতো ফটোশুট করাতেন।
সাধারণত ভারী কণ্ঠের মেয়েদের কথাকে বেশি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ভাবা হয় এরকম একটি গবেষণা রয়েছে। এলিজাবেথ এই গবেষণাকে সম্ভবত এত গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন যে উনি তার প্রভাব আর দাপট দেখাতে তার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরকেও বদলে ভারী গলায় কথা বলা শুরু করেন। বড়ই অদ্ভুত ও বিচিত্র শোনায় তার সেই ভারী কণ্ঠ। থেরানোস যখন ব্যবসার চূড়ায় ছিল তখন ফোর্বস, ফরচুনের মতো প্রভাবশালী ম্যাগাজিনে এলিজাবেথকে কভার পেইজে দেখা গেছে।
টেড টকে বক্তব্য দিয়েছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, আলিবাবার জ্যাক মা এবং এলিজাবেথ একসাথে একটি আলোচনা সভাতেও কথা বলেছেন।
তার পতনের শুরু ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটা খবরের মাধ্যমে। ওই পত্রিকার সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন থেরানোসের সাবেক একজন কর্মকর্তা এবং তার দেয়া তথ্যেই থেরানোসের গোমর ফাঁস করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। হইচই পড়ে যায় সবখানে। একে একে ইনভেস্টররা থেরানোসকে ছেড়ে যেতে থাকে। এলিজাবেথ সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন মিডিয়ার সাহায্য পেতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তে বেরিয়ে আসে থেরানোসের মিথ্যাচার এবং ভুয়া ডাক্তারি রিপোর্টের আদ্যোপান্ত।
কারসাজি ও লোক ঠকানোর মামলায় ৩৮ বছর বয়সী এলিজাবেথের ৮০ বছরের সাজা হয়েছে এবং বিশাল অংকের জরিমানা হয়েছে। এবং ১০ বছরের জন্য সব রকম পাবলিক মেডিক্যাল টেস্টিং করার নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। কিছুটা বিচিত্র যে এলিজাবেথের সাজা হয়েছে মূলত ইনভেস্টরদের ঠকানোর কারণে, আদালতের রায়ে পেশেন্টদের ঠকানোর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর কারণটা হলো থেরানোস আসলে নিজেদের যন্ত্র এডিসন দিয়ে টেস্ট না করে ব্লাড টেস্ট করত অন্যান্য সাধারণ প্রচলিত মেডিক্যাল টেস্টে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলো দিয়েই।
এলিজাবেথের জীবনের উত্থান এবং পতনের রোমাঞ্চকর কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে ওয়েব সিরিজ দ্যা ড্রপ আউট (The Dropout). এলিজাবেথ হোমসের চরিত্রে অ্যামান্ডা সেয়ফ্রিড দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন।
এলিজাবেথের কাহিনী আমাদের এটাই শেখায় যে সব বড় দাবি বা যুগান্তকারী দাবিই আসলে সবসময় সত্য হয় না। এজন্য কেউ একজন হুট করে বড় কিছু দাবি করে বসলে বা সে সফল হয়ে গেলেও তাকে আসলে কখনোই পুরোপুরি সন্দেহের বাইরে রাখা যাবে না। কারণ সিলিকন ভ্যালির শতশত সত্যিকারের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একজন এলিজাবেথ হোমস হয়তো তার ভুয়া ব্যবসা খুলে বসে আছেন সবার চোখে ধুলো দিয়ে।