বছর দশেক আগেও প্রযুক্তি জগতে এক স্মার্ট ফোন জায়ান্টের নাম ছিল ব্ল্যাকবেরি। এমনকি, একসময় স্মার্ট ফোন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্ল্যাকবেরি সদর্পে নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছিল। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই ৫০ শতাংশ শেয়ার বাগিয়ে নিয়ে ব্ল্যাকবেরি ছিল সবার শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের গ্লোবাল মার্কেট শেয়ার ছিল প্রায় ২০ শতাংশের কাছাকাছি। ২০১১ সালে ৫০ মিলিয়নেরও বেশি স্মার্ট ফোন বিক্রি করতে সক্ষম হয় তারা। কিন্তু মাত্র ৫ বছর যেতে না যেতেই তাদের ব্যবসায় নামে বিরাট এক ধস। যার ফলে মার্কেট শেয়ার নেমে যায় প্রায় ০ শতাংশের কাছাকাছি। ব্ল্যাকবেরির সাথে কী এমন হয়েছিল, যার কারণে বিশাল সাফল্যের আলো ছড়িয়ে যাওয়ার পরেও তাদের পথচলা পুরোপুরি থমকে যায়? এবং ঠিক কী কারণে তারা স্মার্টফোন উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়?
বোঝার সুবিধার্থে ব্ল্যাকবেরির উত্থান-পতনের যাত্রাকে তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে।
- প্রথম ধাপ – প্রতিযোগিতার দৌড়ে ব্ল্যাকবেরি যখন সবাইকে পেছনে ফেলে স্মার্ট ফোন ইন্ডাস্ট্রির সিংহাসনে আসীন হয়।
- দ্বিতীয় ধাপ – যখন প্রযুক্তির বাজারে আইফোনের আগমন ঘটে।
- তৃতীয় ধাপ – যখন ব্ল্যাকবেরি খেই হারানো শুরু করে, এবং সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাকি সবার থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে।
একটুখানি ইতিহাস
ব্ল্যাকবেরির যাত্রার শুরু মূলত কানাডায়। ১৯৮৪ সালে মাইক লাজারিডিস ও ডগলাস ফ্রিগিন নামে দুজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থী ‘Research In Motion’ বা ‘RIM’ নামে একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন। কোম্পানিটির কাজ ছিল ‘ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক টেকনোলজি’ নিয়ে। শুরুতেই তারা নিজস্ব নেটওয়ার্ক সিস্টেম ডেভেলপের দিকে যায়নি। এর বদলে তারা জেনারেল মোটর্সের ‘LED’ সিস্টেম এবং আইবিএম-এর লোকাল নেটওয়ার্কসহ আরও বেশ কিছু প্রজেক্টের সাথে যুক্ত হয়। ১৯৮৯ সালে কানাডিয়ান ফোন কোম্পানি রজার্স RIM এর সাথে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল RIM রজার্সের একটি মেসেজিং নেটওয়ার্ক সিস্টেমে কাজ করে দেবে। এই চুক্তির ফলে RIM মোবাইল নেটওয়ার্কের জগতে প্রবেশ করার দুর্দান্ত এক সুযোগ পায়।
১৯৯৬ সালে RIM তাদের প্রথম পেজার ‘Inter@ctive Pager 900’ ডেভেলপ করে। পেজার মূলত একটি ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন ডিভাইস যেটাতে ট্রান্সমিটারের সাহায্যে টেক্সট বা ভয়েস মেসেজ পাঠানো এবং রিসিভ করা যেত। 900 এর সফলতার পর তারা আইবিএম-এর জন্য Inter@ctive Pager 800 তৈরি করে। আইবিএম ১৯৯৮ সালে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে কিনে নেয়। পরের কয়েক বছর তারা সেই পেজার ডেভেলপে অধিক সময় ব্যয় করতে থাকে। কালার, ডিসপ্লে, ওয়াই-ফাই, ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজিং এবং ওয়েব ব্রাউজিংয়ের মতো আরও বেশ কিছু ফিচার নিয়ে আসা হয় তাতে। এর কিছুদিন পর ব্র্যান্ডিং নাম থেকে Inter@ctive বাদ দিয়ে BlackBerry যুক্ত করা হয়। BlackBerry-র প্রথম পেজার আসে ‘BlackBerry 850’ নামে, ১৯৯৯ সালে। BlackBerry নামটা বাছাই করে মার্কেটিং কোম্পানি লেক্সিকন ব্র্যান্ডিং। কারণ, ওই ব্ল্যাকবেরি ডিভাইসের বাটনগুলো দেখতে BlackBerry ফলের মতো লাগত। এই যন্ত্রের বিশেষত্ব ছিল, এতে যুতসই কি-বোর্ডের পাশাপাশি যখন-তখন যেখান থেকে ইচ্ছে ই-মেইল এক্সেস করা যেত। তখনকার সময়ের কথা চিন্তা করলে সেটি ছিল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।
প্রথম ধাপ
নব্বই দশকের দিকে যখন হাতে বহনযোগ্য মুঠোফোন কিছুটা সহজলভ্য হতে শুরু করে, তখন মানুষ এমন একটি ডিভাইস চাচ্ছিল, যাতে কথা বলার পাশাপাশি ইমেইল পাঠানো বা ওয়েব ব্রাউজিংও করা যাবে। এর ফলে কষ্ট করে আলাদাভাবে ল্যাপটপ বা পেজার বহন করা লাগবে না, একটি ডিভাইস থেকেই সব ঝামেলা চুকিয়ে ফেলা যাবে। ব্যবহারকারীদের চাহিদা পূরণে এরিকসন, আইবিএম-এর মতো জায়ান্ট কোম্পানিগুলো উঠে-পড়ে লাগে। কিন্তু ব্ল্যাকবেরি মোবাইল ফোনের এই বাজারকে ভিন্ন এক দৃষ্টিতে বিবেচনা করছিল। তাদের পরিকল্পনার নকশা ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। তারা চাইলে অনেক আগেই বাজারে তাদের কোম্পানির ফোন ছাড়তে পারত। কিন্তু সবার চেয়ে আলাদা এক পথে হাঁটার দরুন তারা ক্রমাগত মার্কেট বিশ্লেষণ করতে থাকে। বিভিন্ন গবেষণা ও অনুসন্ধান শেষে, ২০০২ সালে তাদের প্রথম মোবাইল ফোন ‘BlackBerry 5810’ বাজারে আসে। ব্ল্যাকবেরি বেশ কিছু নয়া ধাঁচের ফিচার যুক্ত করে ফোনটি নিয়ে আসে। তারা পেজারে ব্যবহৃত ফুল বাটন কি-বোর্ড লেআউট যুক্ত করে মোবাইলটিতে। ফলে, ইমেইল লেখা বা ইন্টারনেট ব্রাউজ করা হয়ে গেল আরও সোজা। ব্ল্যাকবেরি এমনভাবে তাদের মোবাইল ফোনটি তৈরি করেছিল, যাতে ল্যাপটপ বা পেজারের বিকল্প হিসেবে সেটি ব্যবহার করা যায়। সেই সাথে এতে কল করার সুবিধাও পাওয়া যেত। এই কারণে ব্ল্যাকবেরি বাকি সবার থেকে এক ধাপ এগিয়ে ছিল। আবার, সেই যুগে ডেটা ট্রান্সমিশনের জন্য ব্যান্ডউইথ খুবই সীমিত ছিল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন ব্ল্যাকবেরির তৎকালীন প্রধান নির্বাহী মাইক লাজারিডিস। তিনি ব্ল্যাকবেরি ডিভাইসগুলোতে এমন এক সুবিধা নিয়ে আসেন, যার মাধ্যমে কোনোপ্রকার নেটওয়ার্ক ওভারলোড ছাড়াই ডেটা ট্রান্সমিশন করা সম্ভব।
যেখানে ওভারলোডেড নেটওয়ার্কের জন্য অন্য মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারারদের কল কোয়ালিটি ততটা যুতসই ছিল না, সেখানে ব্ল্যাকবেরি একই নেটওয়ার্কে তার চেয়ে ভালো কল কোয়ালিটি এবং ভোক্তা সেবা প্রদান করতে পারছিল। এটি তাদের ব্যবসাকে চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে ছিল বিশেষ এক নিয়ামক। ব্ল্যাকবেরির সাফল্যের আরেকটি কারণ ছিল তাদের সুকৌশলী ব্র্যান্ডিং। সবসময় ল্যাপটপ দিয়ে কাজ করে, এমন ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন কনফারেন্সে গিয়ে খুঁজে বের করা ছিল ব্ল্যাকবেরির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাদের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। তারা সেই ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করত, ল্যাপটপের বদলে ব্ল্যাকবেরি মোবাইল ব্যবহার করে দেখার জন্য, এবং এক মাসের জন্য তাদেরকে একটি ব্ল্যাকবেরি মোবাইল বিনামূল্যে চালানোর সুযোগ দিত। মোবাইলগুলোতে পুরো কি-বোর্ড বাটন ইন্সটল থাকাতে অফিসের বাইরেও এটা দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের কাজ করা যেত। ই-মেইল পাঠানো, টেক্সট পাঠানো, ওয়েব ব্রাউজিংসহ একটি ল্যাপটপে করা যায় এমন প্রায় সকল কাজই সামলাতে পারত ব্ল্যাকবেরির মোবাইলগুলো। ফলে অল্প সময়েই ব্যবসায়ী মহলে ব্ল্যাকবেরি জনপ্রিয়তা কুড়ানোর পর ব্যবসার দুনিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে ফেলে।
ব্ল্যাকবেরি তাদের মোবাইলগুলো এমনভাবে ব্র্যান্ডিং করতে পেরেছিল যে, তখন ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব মানেই তার কাছে একটি ব্ল্যাকবেরি ফোন থাকবে। এমনকি বিভিন্ন মুভিতেও দেখা যেত ব্যবসায়ীরা ব্ল্যাকবেরি ফোন দিয়েই কথা বলছে। পরের ধাপে ব্ল্যাকবেরি তাদের লক্ষ্য তাক করে নন-বিজনেস ইউজার বা সাধারণ মানুষের দিকে। সেজন্য তারা ব্ল্যাকবেরির মোবাইল ফোনগুলোতে নিয়ে আসে ‘ব্ল্যাকবেরি মেসেঞ্জার’ ফিচার। এটি ব্ল্যাকবেরির সাফল্য যাত্রায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সেসময় ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের মতো কোনো অনলাইনভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম না থাকার দরুন ব্ল্যাকবেরির এমন একটি সার্ভিস ছিল বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ। কোনোপ্রকার মেসেজ লিমিট এবং চার্জ ছাড়াই অফুরন্ত মেসেজ পাঠানো সম্ভব ছিল বলে ফিচারটি সবাইকে ব্ল্যাকবেরি ফোন কিনতে প্রভাবিত করতে থাকে। যার ফলে ব্যবসায়ী হোক কিংবা সাধারণ মানুষ; প্রায় সকল ব্যবহারকারীর কাছেই ব্ল্যাকবেরি ছিল চাহিদার শীর্ষে। এমনকি বারাক ওবামা, কেটি পেরি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, কিম কার্দাশিয়ানের মতো বেশ কিছু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বকে ব্ল্যাকবেরি ফোন ব্যবহার করতে দেখা যায়।
ব্ল্যাকবেরিকে সাফল্যের আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছিল তাদের সিকিউরিটি সিস্টেম। বলা যায়, তখন ব্ল্যাকবেরি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ মোবাইল ফোন। হ্যাকারদের জন্য ব্ল্যাকবেরির অপারেটিং সিস্টেমটি হ্যাক করা ছিল বেশ কঠিন। তাছাড়া, ব্ল্যাকবেরি মোবাইলের মাধ্যমে ডাটা ট্রানজিটের ক্ষেত্রে বাড়তি সুরক্ষা দেওয়া হতো। ডাটা এনক্রিপশন, অ্যাপ রেস্ট্রিকশনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ডাটা নিরাপদ থাকত ব্ল্যাকবেরি ফোনগুলোতে। ২০০৭ সালে ব্ল্যাকবেরির গ্লোবাল মার্কেট শেয়ার ২০ শতাংশে পৌঁছায়, এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৫০ শতাংশ শেয়ার নিয়ে ব্ল্যাকবেরি ছিল স্মার্টফোন মার্কেট লিডার। সে বছরই ব্ল্যাকবেরির রাজস্ব ছিল প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে, এবং নেট ইনকাম ছিল ৬৩১ মিলিয়ন ডলার।
দ্বিতীয় ধাপ
আইফোনের আগমনের সাথে সাথে ব্ল্যাকবেরির উত্থান-পতনের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়। অ্যাপল তাদের প্রথম আইফোন লঞ্চ নিয়ে আসে ২০০৭ সালে। নতুন ফিচার হিসেবে এতে দেয়া হয় বড় ডিসপ্লে, এবং ফুল টাচ স্ক্রিন, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি। আইফোন ভোক্তাদের অত্যাধুনিক বেশ কিছু ফিচার দিলেও শুরুতেই তা ব্ল্যাকবেরির সাথে টেক্কা দিয়ে উঠতে পারেনি।
সেসময় ব্ল্যাকবেরির প্রধান নির্বাহী মাইক লেজারিডিস আইফোন সম্পর্কে বলেন, আইফোন যেসব ফিচার নিয়ে এসেছে, তা নেটওয়ার্ক লোড নিতে সক্ষম হবে না। তাই আইফোনের এই ধারণাটি অনেকটা উদ্ভট। লেজারিডিসের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে রূপ নিতে বেশি দেরি করেনি। আইফোনে কল ড্রপ করা থেকে শুরু করে বেশ বড় বড় কিছু ত্রুটি দেখা দিতে থাকে। যার ফলে প্রথম আইফোনটি ব্ল্যাকবেরির জন্যে সেরকম কোনো হুমকি হয়ে উঠতে পারেনি। এই কারণে শুরুতে ব্ল্যাকবেরি আইফোনকে তাদের প্রতিযোগী হিসেবে তেমন পাত্তা দেয়নি। ২০০৮ সালে ব্ল্যাকবেরি প্রথম ফ্লিপ ফোন নিয়ে আসে, এবং সে বছরই তারা তাদের প্রথম টাচ স্ক্রিন ফোন ‘ব্ল্যাকবেরি স্ট্রম’ বাজারে নিয়ে আসে। কিন্তু ব্ল্যাকবেরির এই টাচ-স্ক্রিন ফোনটি জনসাধারণের মাঝে খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ, ব্ল্যাকবেরির অপারেটিং সিস্টেম টাচ-স্ক্রিনের সাথে খুব একটা খাপ খাইয়ে চলতে পারেনি। ফলে ফোনটিতে বেশ কিছু ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ব্ল্যাকবেরির ফোনগুলো আইফোনকে ছাপিয়ে বাজারে বিক্রি হতে থাকে। এর পেছনে অবশ্য কিছু কারণ ছিল। আইফোন কিনতে হলে একজনে চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হতো। সেই হিসেবে ব্ল্যাকবেরির দাম ছিল অনেকটা হাতের নাগালে।
আবার ২০১১ সাল পর্যন্ত আইফোনের একমাত্র সার্ভিস প্রোভাইডার ছিল AT&T। সেজন্য আইফোন কিনতে হলে সার্ভিস প্রোভাইডার পরিবর্তন করতে হতো। এসকল কারণে ব্ল্যাকবেরি তখনও বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছিল। ২০০৮-১১ পর্যন্ত ‘ব্ল্যাকবেরি কার্ভ’, ‘ব্ল্যাকবেরি টোর’, ‘ব্ল্যাকবেরি বোল্ড’সহ আরও বেশ কিছু মডেলের স্মার্ট ফোন বাজারে আনে ব্ল্যাকবেরি। ২০০৮ সালে ব্ল্যাকবেরি বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫ মিলিয়ন ইউনিট ফোন বিক্রি করে। একই বছর ব্ল্যাকবেরির ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্টক প্রাইজ ১৪৭.৫৫ ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। ২০১০ সালে এসে ব্ল্যাকবেরির বিক্রির পরিমাণ ৩০ মিলিয়ন ইউনিট ছাড়িয়ে যায়। সেই বছর ব্ল্যাকবেরির রাজস্ব ছিল ১৪.৯ বিলিয়ন ডলার।
তৃতীয় ধাপ
বেশ কিছুদিন ব্ল্যাকবেরির স্মার্টফোন মার্কেটে নিজেদের ভালো অবস্থান বজায় রাখতে পারলেও এই মার্কেট প্রতিনিয়তই পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে থাকে, যেটাকে ব্ল্যাকবেরি আমলে না নিয়ে একপ্রকার এড়িয়েই যাচ্ছিল। ২০০৭ সালে প্রথম আইফোন লঞ্চের পর থেকে অ্যাপল প্রতি বছর একটি নতুন মডেলের আইফোন বাজারে নিয়ে আসছিল। পাশাপাশি মটোরোলা এবং এইচটিসি-র মতো কোম্পানিগুলো তাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোন দিয়ে বাজারে ক্রমশ নিজেদের স্থান পাকাপোক্ত করে নিচ্ছিল। তারা সব ধরনের ব্যবহারকারীর কথা মাথায় রেখে ফোন তৈরি করলেও ব্ল্যাকবেরির লক্ষ্য ছিল শুধু ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্বরাই। কিন্তু মানুষের চাহিদায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আসছিল। মোবাইল ফোনে শুধু কথা বলার পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাও চাচ্ছিল সবাই।
অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস-এ অ্যাডভান্সড অপারেটিং সিস্টেম এবং উন্নত অ্যাপ স্টোরের পাশাপাশি অত্যাধুনিক ও নজরকারা সব ফিচার থাকলেও ব্ল্যাকবেরির অপারেটিং সিস্টেমে তেমন কোনো নতুনত্ব ছিল না। আবার বেশ কিছু ডিভাইস ব্ল্যাকবেরি বাজারে নিয়ে আসে যা ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয়। সেসবের মধ্যে অন্যতম ‘BlackBerry Playbook’। ব্ল্যাকবেরির নতুন ডিভাইসগুলো তাদের অপারেটিং সিস্টেমের সাথে খুব একটা সংগতিপূর্ণ ছিল না। বরং তারা বিক্রিবাট্টা বজায় রেখেছিল পুরাতন ফোনগুলো দিয়েই। এসব কারণে ব্যবহারকারীদের কাছে ব্ল্যাকবেরির গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে। ফলশ্রুতিতে, ব্ল্যাকবেরির মার্কেট শেয়ারেরও পতন হতে থাকে।
২০০৯ সালে ব্ল্যাকবেরির শেয়ার ২০.৭ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে ১৫ শতাংশে নেমে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে নিজেদের মার্কেট শেয়ার হারাতে থাকে ব্ল্যাকবেরি। তবে ব্ল্যাকবেরির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় ২০১১ সালে আসা অ্যাপলের ‘iPhone 4’। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই নতুন আইফোন পুরো প্রতিযোগিতার খোলনচলে পাল্টে দেয়। ব্ল্যাকবেরি থেকে আইফোনটি সব দিক থেকেই এগিয়ে ছিল। বড় ডিসপ্লে, মাল্টি-টাচ স্ক্রিন, উন্নত মাল্টিমিডিয়া ফিচার, উন্নতমানের ক্যামেরা, এমনকি ওয়েব ব্রাউজিংয়ের দিক থেকেও আইফোনটি ব্যবহারকারীদের আরও ভাল ও আরামদায়ক অভিজ্ঞতা দিচ্ছিল। কিছুদিন পর অ্যাপল তাদের নিজস্ব ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট সিরি-কে বিশ্ববাসীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এসব কারণে অ্যাপল তখন ভোক্তাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়।
আবার ব্ল্যাকবেরির Qwerty কি-বোর্ড থেকে আইফোনের বড় আকারের মাল্টি-টাচ স্ক্রিনে অপারেট করতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে থাকে ব্যবহারকারীরা। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই অ্যাপলের বিক্রি ব্ল্যাকবেরিকে ছাড়িয়ে যায়। ২০১১ এর শেষপর্যন্ত অ্যাপল মোট ৭১.২৯ মিলিয়ন আইফোন বিক্রি করতে সক্ষম হয়, অপরদিকে ব্ল্যাকবেরির বিক্রি ছিল প্রায় ৫২ মিলিয়ন ইউনিট। তবে রাজস্বের কথা হিসেব করলে অ্যাপল ছিল ব্ল্যাকবেরির চেয়ে অনেক এগিয়ে। সে বছরই অ্যাপলের রাজস্ব ছিল ১০৮ বিলিয়ন ডলার। আর ব্ল্যাকবেরির রাজস্ব ছিল মাত্র ১৯.৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
তাছাড়া ২০১১ সালের পর থেকে অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন মার্কেটে কর্তৃত্ব ফলানো শুরু করে দেয়। যেখানে অ্যাপল প্রিমিয়াম কাস্টমারদের টার্গেট করে বাজারে ফোন ছাড়ছিল, সেখানে মটোরোলা, এইচটিসি, স্যামসাং-এর মতো কোম্পানিগুলো সাশ্রয়ী মূল্য ও আধুনিক ফিচার সম্বলিত স্মার্ট ফোন দিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে, ব্ল্যাকবেরি ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতায় বাকিদের থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। নিজেদের অবস্থানের কথা টের পেয়ে ব্ল্যাকবেরি তাদের ডিভাইসগুলোতে কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়। তারা বড় ডিসপ্লের ফোন বের করলে ফিজিক্যাল Qwerty কি-বোর্ড তখনও বিদ্যমান ছিল তাদের ডিভাইসগুলোতে। এছাড়া তারা তাদের জাভাভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম পরিবর্তন করে QNX নামে একটি নতুন অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে আসে বাজারে। কিন্তু ডেভেলপাররা বুঝতে পারছিল, ভবিষ্যতে অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস-ই বাজার দখল করবে। সেই কারণে তারা ব্ল্যাকবেরির এই নতুন অপারেটিং সিস্টেমের জন্য অ্যাপ তৈরি করতে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। কারণ, তাদের ধারণা ছিল- ব্ল্যাকবেরির জন্য অ্যাপ ডেভেলপ করলে খুব একটা লাভের সম্ভাবনা দেখা যাবে না। ব্ল্যাকবেরির অ্যাপ স্টোরে থার্ড পার্টি অ্যাপের সংখ্যা কম হওয়ায় ব্যবহারকারীরা ব্ল্যাকবেরির প্রতি খুব একটা আকৃষ্ট ছিল না। আবার সেসময় মানুষের মধ্যে মোবাইলে গেম খেলার প্রবণতা বাড়তে থাকে। সেদিক থেকেও পিছিয়ে ছিল ব্ল্যাকবেরি। গুগল প্লে-স্টোর এবং অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে গেমারদের আকৃষ্ট করার মতো বিভিন্ন গেম আনা হলেও ব্ল্যাকবেরি স্টোরে সেরকম কোনো চটকদার গেমই ছিল না।
২০১২ সালে ব্ল্যাকবেরির মার্কেট শেয়ার কমে ৫ শতাংশে নেমে আসে। সেসময় প্রতিনিয়তই ব্ল্যাকবেরির সিইও পরিবর্তন করা হচ্ছিল। তাই সঠিক ও স্থায়ী নেতৃত্বের অভাবে ব্ল্যাকবেরি ক্রমশ পতনের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ২০১৩ সালে অফিসিয়ালি কোম্পানির নাম RIM পরিবর্তন করে BlackBerry রাখা হয়। তাদের অনুমান ছিল, ব্ল্যাকবেরির অনুগত ও বিশ্বস্ত ক্রেতারা এর ফলে হয়তো ফিরে আসবে। কিন্তু পতনের এই ভার কাটিয়ে তারা আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। ততদিনে সবাই অন্যান্য মোবাইল কোম্পানিকে কাছে টেনে নিয়েছে।
২০১৩ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যাপলের মার্কেট শেয়ার ছিল ৪০ শতাংশ। এরপরেই ছিল স্যামসাং এবং এইচটিসি, যাদের মার্কেট শেয়ার ছিল যথাক্রমে ২৪.৭ শতাংশ এবং ৯.৪ শতাংশ। অপরদিকে মাত্র ৩ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে ব্ল্যাকবেরি এক ধাক্কায় চলে যায় ষষ্ঠ স্থানে। ২০১৪ সালে এসে ব্ল্যাকবেরির বিক্রি কমে ২০ মিলিয়ন ইউনিটে নেমে আসে। যুগের সাথে তাল মেলাতে ২০১৫ সালে ব্ল্যাকবেরি তাদের প্রথম অ্যান্ড্রয়েড ফোন ‘ব্ল্যাকবেরি প্রিভ’ নিয়ে আসে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফোনটি ব্যবহারকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভে ব্যর্থ হয়, কেননা ব্ল্যাকবেরি তখন অ্যান্ড্রয়েড জগতে সবেমাত্র নতুন পথচলা শুরু করেছে। স্যামসাং-এর নোট সিরিজ অনেকটাই ব্ল্যাকবেরির বিজনেস মার্কেট দখল করে ফেলেছিল। আবার শাওমি, অপোর মতো ব্র্যান্ডগুলো সাধ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো মানের ক্যামেরা, উন্নত ডিসপ্লে, দ্রুতগতির প্রসেসর সেবা প্রদান করছিল। তখন ব্ল্যাকবেরি আটকে যায় গোলকধাঁধায়। তারা বিজনেস মার্কেটে ফোকাস করবে, নাকি কম বাজেটের স্মার্ট ফোন মার্কেট ধরবে- সেটা বুঝে উঠতে পারে না। এভাবেই দোটানায় পড়ে তারা আরও পিছিয়ে পড়তে থাকে। ২০১৬ এর শেষ কোয়ার্টারে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪৩২ মিলিয়ন স্মার্টফোন বিক্রি হয়। এর মধ্যে ব্ল্যাকবেরির স্মার্ট ফোন ছিল মাত্র ২,০৭,৯০০। বলতে গেলে তখন ব্ল্যাকবেরির মার্কেট শেয়ার প্রায় ০ শতাংশে নেমে আসে।
সেই বছরই চীনা ইলেকট্রনিক কোম্পানি টিসিএল ব্ল্যাকবেরির মোবাইল সেক্টর কিনে নেয়, এবং ব্ল্যাকবেরির সাথে একটি চুক্তি করে। চুক্তি মোতাবেক, টিসিএল ব্ল্যাকবেরির মোবাইল ফোনগুলোর হার্ডওয়্যার, ডিজাইন এবং ম্যানুফ্যাকচার করত, এবং ব্ল্যাকবেরি মোবাইলগুলোর জন্য সফটওয়্যার ডেভেলপ করত। এর পরের দুই বছর ‘Key One Motion’ এবং ‘Key2’ এর মতো বেশ কিছু মডেলের ব্ল্যাকবেরি ফোন বাজারে আনে টিসিএল। ফোনগুলোতে বিভিন্ন উন্নত ফিচার থাকা সত্ত্বেও তা অ্যাপল এবং স্যামসাংয়ের সাথে টেক্কা দিয়ে উঠতে পারেনি। শেষবারের মতো চেষ্টা করেও ব্ল্যাকবেরি তাদের হারানো মার্কেট শেয়ার আর ফিরে পায়নি। ২০১৯ সালে নতুন কোনো ব্ল্যাকবেরি ফোনও মার্কেটে লঞ্চ করেনি টিসিএল। একই বছর ব্ল্যাকবেরির রাজস্ব কমে ৯০৪ মিলিয়ন ডলারে নেমে যায়, এবং অ্যাভারেজ স্টক প্রাইজ নেমে আসে ৪.৯ ডলারে। অবশেষে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে টিসিএল ঘোষণা দেয়, তারা আর কোনো ব্ল্যাকবেরি ফোন প্রস্তুত করবে না। ঐ বছরের আগস্ট মাসের পর থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় ব্ল্যাকবেরির উৎপাদন এবং বিক্রি।
একসময় মার্কেটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একচেটিয়া ব্যবসা করে গেছে ব্ল্যাকবেরি। অথচ, আজ তারা মার্কেট থেকে তাদের ফোন সম্পূর্ণ উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। ব্ল্যাকবেরি যদি সময় ও সুযোগ বুঝে ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করত, তাহলে হয়ত পুরো দৃশ্যই আজ অন্যরকম থাকত।