বর্তমানে ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের কল্যাণে আমাদের সবাই হয়তো কখনো না কখনো বিটকয়েন শব্দটি শুনেছি। কিন্তু বিটকয়েন সম্পর্কে বিস্তারিত আমরা অনেকেই ভালোভাবে জানি না। বিটকয়েন কী? কীভাবে কাজ করে? কী কী কাজে ব্যবহার করা হয়? চলুন জেনে নেয়া যাক এসব প্রশ্নের উত্তর।
বিটকয়েন কী?
বিটকয়েন হলো একধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি। আর ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো এমন একধরনের ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা যার কোনো ফিজিক্যাল বা বাস্তব রূপ নেই। বিটকয়েন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি।
সাধারণত আমরা টাকা-পয়সা লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি তৃতীয় পক্ষীয় সংস্থার আশ্রয় নেই। যেমন মনে করুন, আপনি আপনার বন্ধুকে কিছু টাকা পাঠাবেন। এক্ষেত্রে আপনি আপনার ফোনের বিকাশ/রকেট একাউন্ট থেকে আপনার বন্ধুকে টাকাটি পাঠিয়ে দিলেন। এখানে আপনি প্রেরক, আপনার বন্ধু প্রাপক এবং বিকাশ/রকেট তৃতীয় পক্ষ, যে কিনা সমস্ত লেনদেন প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করলো এবং এর জন্য কিছু চার্জ আদায় করলো।
কিন্তু বিটকয়েন এমন একটি মুদ্রা ব্যবস্থা যাতে অর্থ আদান-প্রদানের জন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন হয় না। প্রেরকের কাছ থেকে সরাসরি বিটকয়েন প্রাপকের কাছে পৌছে যায়। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘পিয়ার টু পিয়ার’ (peer-to-peer)। এক্ষেত্রে সমস্ত লেনদেন প্রক্রিয়াটি হয় ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করে যা অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি প্রক্রিয়া। যেহেতু কোনো তৃতীয় পক্ষীয় সংস্থা এই লেনদেন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না, সেহেতু বিটকয়েনের লেনদেনের গতিবিধি নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ কে কাকে বিটকয়েন পাঠাচ্ছে তার পরিচয় কেউ জানতে পারে না। পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রেখেই বিটকয়েন লেনদেন করা যায়।
যেভাবে এলো এই বিটকয়েন
২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট। এই দিনে ইন্টারনেট জগতে ‘bitcoin.com’ নামের একটি ওয়েবসাইটের ডোমেইন রেজিস্টার করা হয়। এ বছরেরই নভেম্বর মাসে ‘সাতোশি নাকামোতো’ ছদ্মনামে এক ব্যক্তি বা একটি দল ‘Bitcoin: A Peer-to-Peer Electronic Cash System’ নামে একটি গবেষণাপত্র অনলাইনে প্রকাশ করেন। এই গবেষণাপত্রটিতেই সর্বপ্রথম বিটকয়েন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়।
২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সাতোশি নাকামোতো বিটকয়েন তৈরি করার সফটওয়্যারের কোড অনলাইনে রিলিজ করেন। তৈরি হয় বিটকয়েন ‘মাইনিং’ এর সফটওয়্যার। বিটকয়েন মাইনিং হলো এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে বিটকয়েন তৈরি করা হয়। ২০০৯ সালের এই জানুয়ারি মাসেই সাতোশি বিশ্বের প্রথম বিটকয়েন তৈরি করেন।
বহু বার বহুজনকে সাতোশি নাকামোতো সন্দেহে গ্রেফতার করা হলেও প্রকৃত সাতোশি নাকামোতো কে, বা এই নামের পেছনে কে বা কারা আছে তা আজও জানা যায়নি।
যেভাবে কাজ করে বিটকয়েন
সাধারণ মুদ্রার মতো বিটকয়েন আপনি হাতে নিয়ে লেনদেন করতে পারবেন না। কোনো ব্যাংক কিংবা প্রতিষ্ঠান এটি নিয়ন্ত্রণ করে না। পিয়ার টু পিয়ার ব্যবস্থার কারণে বিটকয়েন প্রেরক থেকে সরাসরি প্রাপকের ‘ওয়ালেটে’ চলে যায়। ওয়ালেট হচ্ছে আপনার মানিব্যাগের মতো, যেখানে আপনার নিজের বিটকয়েন জমা থাকে। ওয়ালেট অনলাইন কিংবা অফলাইন দু’ধরনেরই হয়। অনলাইন ওয়ালেট ব্যবহারকারী তার স্মার্টফোন কিংবা কম্পিউটারের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারে।
প্রতিটি ওয়ালেটের একটি নির্দিষ্ট এড্রেস বা ঠিকানা থাকে। ঠিকানাটি সম্পূর্ণ এনক্রিপ্টেড হয় বলে এটি মনে রাখা অসম্ভব। বিটকয়েন লেনদেনের জন্য ব্যবহারকারী তার এই ঠিকানাটি ব্যবহার করে থাকেন।
এক এড্রেস থেকে অন্য এড্রেসে বিটকয়েন পাঠালে তা সাথে সাথে একটি উন্মুক্ত খতিয়ানে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়, যার নাম ‘ব্লকচেইন’। এটি এমনই বিশাল একটি খতিয়ান ব্যবস্থা যাতে এযাবতকালে যত বিটকয়েন লেনদেন হয়েছে তার সবগুলোরই রেকর্ড রয়েছে। প্রতিটি লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে নেটওয়ার্কে একটি নতুন বিট কয়েন তৈরি হয়। পদ্ধতিকেই বলা হয় বিটকয়েন মাইনিং।
যেভাবে করা হয় বিটকয়েন মাইনিং
বিটকয়েন মাইনিং একটি জটিল প্রক্রিয়া। একটি নির্দিষ্ট মাইনিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা হয়। এজন্য প্রয়োজন হয় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার। কম্পিউটারের সিপিইউ এবং জিপিইউ ব্যবহার করে জটিল কিছু গাণিতিক এলগরিদমের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
প্রতিটি বিটকয়েন লেনদেন করা হলে তা ব্লকচেইনে লিপিবদ্ধ হয়। এ সময় বিটকয়েন মাইনাররা মাইনিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রতিটি লেনদেনের বৈধতা নির্ণয় করেন। আর এ সময়ই একটি নতুন বিটকয়েন তৈরি হয়।
বিটকয়েন লেনদেন ও নতুন বিটকয়েন তৈরির এই সমস্ত প্রক্রিয়াটিই ঘটে অত্যন্ত সুরক্ষিতভাবে। ফলে এতে কোনো ধরনের ছলচাতুরী কিংবা প্রতারণার সম্ভবনা থাকে না। উভয় পক্ষেরই পরিচয় থাকে গোপন।
বিটকয়েনের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য
- বিটকয়েন একটি সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীভূত মুদ্রা ব্যবস্থা। সরকার কিংবা কোনো কর্তৃপক্ষ এটি নিয়ন্ত্রণ করে না। পিয়ার টু পিয়ার ব্যবস্থার ফলে এখানে প্রত্যেক ব্যবহারকারী তাদের বিটকয়েনের প্রকৃত মালিক। অন্য কেউ তাদের বিটকয়েন নেটওয়ার্কের মালিকানা নিতে পারে না।
- বিটকয়েন লেনদেনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিই হয় নাম বিহীনভাবে। একজন বিটকয়েন ব্যবহারকারী একাধিক বিটকয়েন একাউন্ট খুলতে পারে। এসব একাউন্ট খোলার জন্য কোনো ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন ব্যবহারকারীর নাম, ঠিকানা ইত্যাদি প্রয়োজন হয় না। ফলে ব্যবহারকারীর প্রকৃত পরিচয় থাকে গোপন।
- বিটকয়েন লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে। প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড ব্লকচেইনে জমা থাকে যা যে কেউ পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যখন তখন দেখতে সক্ষম। ফলে এখানে কোনো দুর্নীতির সুযোগ নেই।
- বিটকয়েন একাউন্ট খোলা খুবই সহজ। এক্ষেত্রে সাধারণ ব্যাংক একাউন্ট খোলার মতো কোনো ঝামেলাযুক্ত ফর্ম পূরণ করতে হয় না। কোন এক্সট্রা ফি-ও প্রয়োজন হয় না। কোনো কাগজপত্রও জমা দেওয়া লাগে না।
- বিটকয়েন লেনদেন প্রক্রিয়া খুবই দ্রুত। পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই বিটকয়েন পাঠানো হোক না কেন তা কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রাপকের কাছে পৌঁছে যাবে।
বিটকয়েনের কিছু অসুবিধা
- বিটকয়েন সম্পূর্ণ অফেরতযোগ্য। অর্থাৎ কেউ ভুল করে কোনো ভুল ঠিকানায় বিটকয়েন পাঠিয়ে দিলে তা আর ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়।
- বিটকয়েন লেনদেন প্রক্রিয়া কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে না। প্রেরক-প্রাপক উভয়ের পরিচয়ই সম্পূর্ণ গোপন থাকে। ফলে অনেক অপরাধমূলক কাজে বিটকয়েন ব্যবহার করা সম্ভব। অবৈধ পণ্যের কেনা বেচাতেও বিটকয়েন ব্যবহৃত হয়। ইন্টারনেটের গোপন অংশ ডার্ক ওয়েবের সমস্ত লেনদেন হয় বিটকয়েনের মাধ্যমে।
- বিটকয়েনের মূল্য অনেকটাই অস্থিতিশীল। কখনো বিশাল পরিমাণে বাড়ে তো কখনো বিশাল ধস নামে।
বর্তমান বিশ্বে বিটকয়েনের মূল্য ও বাংলাদেশে এর অবস্থা
বিটকয়েন প্রথম চালু হওয়ার পর থেকে দিন দিন এর মূল্য বেড়েই চলেছে। ২০১১ সালে বিটকয়েনের বাজারমূল্য সর্বপ্রথম ০.৩০ ডলার থেকে ৩২ ডলারে উঠে। এরপর ২০১৩ সালে এর দাম উঠে যায় ২৬৬ ডলারে। এভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বিটকয়েনের দাম। ২০১৬ সালের শেষের দিকে এই দাম চলে আসে ৬০০ ডলারের উপরে। এরপর ২০১৭ সালে বিটকয়েনের দাম বেড়ে যায় রেকর্ড পরিমাণ। প্রতি মাসে প্রায় এক হাজার করে বাড়তে বাড়তে এ বছরের নভেম্বরে বিটকয়েনের দাম উঠে যায় ৯,০০০ ডলারের কাছাকাছি। আর এই ডিসেম্বর মাসেই এই দাম বেড়ে পরিণত হয় ১৫,০০০ ডলারেরও বেশিতে যা সত্যিই অভূতপূর্ব একটি ঘটনা।
বিশ্বের বহু দেশে বিটকয়েন অনেক জনপ্রিয়। ওয়ার্ডপ্রেস, মাইক্রোসফট, উইকিপিডিয়া, ওভারস্টকের মতো বিশ্বের প্রায় ত্রিশ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান বিটকয়েন গ্রহণ করে। দিন দিন এর জনপ্রিয়তা ক্রমাগত বাড়ছে। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস পর্যন্ত বিটকয়েন নিয়ে মন্তব্য করছেন, “Bitcoin is better than currency“।
এখন চলুন দেখি বাংলাদেশে বিটকয়েনের অবস্থান নিয়ে। বাংলাদেশ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসাবে বিটকয়েন ফাউন্ডেশনে অন্তর্ভুক্ত হয় ২০১৪ সালের ১৫ আগস্টে। কিন্তু বিটকয়েন ফাউন্ডেশনে যুক্ত হওয়ার ঠিক এক মাসের মধ্যেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় বিটকয়েনের সকল লেনদেনের উপর। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দেশে বিটকয়েনের সকল প্রকার লেনদেন থেকে জনগণকে বিরত থাকতে অনুরোধ জানায়। অর্থাৎ বিটকয়েন লেনদেনকে সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে বিটকয়েনের উপর এই নিষেধাজ্ঞা বজায় রয়েছে।
ফিচার ইমেজ: lavca.org