আগের পর্বে একুশ শতকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য নতুন নতুন আর কী কাজ করার সুযোগ আছে এবং নতুন শতকে কী কী চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে আসতে পারে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিলো। আজকের পর্বে সিভিল বিভাগেও যে প্রযুক্তির মিশেল ঘটিয়ে নতুন কিছু করা যায় এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে এবং এখানে দেখানো হবে যে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগার কারণে এমন সব বিষয় বের হচ্ছে যেগুলো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টগুলোর সিলেবাসের মধ্যে না আনলেই নয়। কারণ গবেষণা এবং চাকরির বাজারে এই বিষয়গুলো ভবিষ্যতে প্রচুর চাহিদা পাবে। একজন ইঞ্জিনিয়ার যখন পাস করে বের হবে এই বিষয়গুলো জানা তখন বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়াবে।
আধুনিক যুগ হচ্ছে তথ্য-প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের যুগ। Structural, Materials, Transportation এবং Environmental Engineering এ নতুন নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। মজার কথা হচ্ছে, ১৯৫০ সালের দিকে যখন কম্পিউটারের উন্নতি হওয়া শুরু করেছিলো, তখন সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা সবচেয়ে বেশি এটা ব্যবহার করেছে, নতুন নতুন সফটওয়ার তৈরি করেছে উঁচু উঁচু বিল্ডিং ডিজাইন করার জন্য। এমনকি সেসময় Finite Element প্রযুক্তির গুরুত্ব বুঝে সেটা নিয়ে সেসময়ের সবচেয়ে আধুনিক গবেষণা করেছিলো সিভিল ইঞ্জিনিয়াররাই। কম্পিউটারের গণনার ক্ষমতা যত বেড়ে যেতে লাগলো, ততই সেই ক্ষমতা নিজেদের গবেষণার জন্য ব্যবহার করা শুরু করেছিলো পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষকরা। তখনকার সময়ের ইঞ্জিনিয়াররা নতুন প্রযুক্তিকে নিজেদের কাজে বেঁছে নিয়েছিলো বিধায় নতুন কিছু তৈরি করতে পেরেছিলো তারা। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে অনেকের ডক্টরাল থিসিস হতো Computerized High Rise Building নিয়ে।
বর্তমানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাথে যে যে বিষয়গুলোকে এক করা যেতে পারে সেগুলো হচ্ছে- তথ্য প্রযুক্তি, ন্যানো প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি এবং সেন্সর প্রযুক্তি। ম্যাটেরিয়াল (Material Engineering) বিষয়টি পুরকৌশল বিভাগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এখনও কংক্রিট এবং স্টিল ম্যাটেরিয়াল নিয়ে যেসব গবেষণা করা হচ্ছে সেগুলোর সবগুলো খুব বেশি উন্নতমানের নয়। ভালো গবেষণার মধ্যে এসব ম্যাটেরিয়াল একধরনের গবেষণা এখন হচ্ছে আর তা হচ্ছে- ইট, পাথর ইত্যাদি কমে যাওয়ার কারণে এগুলোর বদলে অন্য আর কী ম্যাটেরিয়াল Aggregate হিসেবে কংক্রিটে ব্যবহার করে এর শক্তি বাড়ানো যায় এবং সেগুলো দালান কোঠা তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। আরেকটি কাজ হচ্ছে কংক্রিটকে অনেক দিনের জন্য টেকসই এবং মজবুত (Durability) কীভাবে করা যায় এবং রাস্তায় ছিদ্রযুক্ত (Porous) কংক্রিট ব্যবহার করে কীভাবে মাটির নিচের জমা হওয়া পানির পরিমাণ (Ground Water Table) বাড়ানো যায়।
এগুলো গবেষণার সবই হচ্ছে Sustainability এর কথা মাথায় রেখে। কিন্তু এখানে প্রযুক্তির ছোঁয়া কম। ম্যাটেরিয়াল নিয়ে আরও উন্নত গবেষণা করা সম্ভব, যেমন- নতুন কোনো ম্যাটেরিয়াল নিয়ে আমরা কাজ করতে পারি যেটা হবে হালকা, মজবুত এবং ভারবাহী। ম্যাটেরিয়াল বিষয়ের মধ্যে ন্যানো প্রযুক্তি ঢুকিয়ে এর গবেষণার পরিসরকে আরও বিস্তৃত করা সম্ভব।
স্মার্ট ফাইবার এবং কার্বন ন্যানোটিউব নিয়ে কাজ করে হালকা, মজবুত, শক্ত, বিস্ফোরণেও যার কিছু হবে না এমন ম্যাটেরিয়াল তৈরি নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে, যেগুলো পরবর্তীতে উঁচু ইমারত তৈরিতে ব্যবহার করা সম্ভব। এ ধরনের গবেষণার ফলে অনেকগুলো নতুন নতুন বিষয় বের হয়ে আসবে। যেমন- উঁচু দালানকোঠা কিংবা বড় ব্রিজগুলোর উপর বিভিন্ন দিক থেকে আসা বল এবং চাপ বহন করার সামর্থ্য কতটুকু তা নিয়ে কাজ করা, অবকাঠামোর উপাদানগুলোকে কীভাবে আরও হালকা করা যায় এবং এসব নির্মাণে কীভাবে আরও খরচ কমানো যায় সেসব নিয়ে নতুন করে গবেষণা করা সম্ভবপর হবে।
অবকাঠামোগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা (Structural Health Monitoring) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে I-35W ব্রিজ এবং আমাদের দেশের রানা প্লাজার ভেঙে যাওয়ার পর ব্যাপারটি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। এই Health Monitoring বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার জানতে হবে। অবকাঠামোর গায়ে সেন্সর লাগিয়ে দিলে এই কাজটি সহজেই করা যায়। এই সেন্সর লাগানোর ফলে অবকাঠামোর কোথায় কতটুকু ফাটল ধরছে বা পরবর্তীতে কতটুকু ধরতে পারে, কাঠামোর উপর কী কী ধরনের এবং কী পরিমাণের ভার এবং চাপ আসছে, অবকাঠামোর উপাদানগুলোর স্থায়িত্ব আর কতদিনের, কবে কাঠামোটিকে নতুন করে ঠিক করতে হবে এসব বিষয় সেন্সর প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই বের করা যায়।
এসব সেন্সর তৈরিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা সাহায্য করতে পারে, এসব সেন্সর কোনো কাঠামো সম্পর্কে যে যে তথ্য সিগন্যাল হিসেবে পাঠাবে সেগুলোর উপাত্ত বা ডাটা বিশ্লেষণ করে নতুন নতুন গবেষণা করা সম্ভব। এমনকি এসব বিশ্লেষণ করে বাস্তবে প্রয়োগ করাও সম্ভব। ২০০৭ সালে ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে একটি গবেষণা হয়, যেখানে দেখানো হয় যে কীভাবে Pseudospectra, Multiple Signal Classification Method এবং Dynamic Neural Network দিয়ে কোনো উঁচু ইমারতের কোথায় কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে সেগুলো শনাক্ত করা যায়। পরে এ নিয়ে আরও গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে।
ভবিষ্যতে যে স্মার্ট অবকাঠামো তৈরি হবে সেগুলোর ভেতর থাকবে Actuator, Sensor এবং Computers। ভারী ভারী ম্যাটেরিয়াল হয়তো ব্যবহার করা হবে না। তার বদলে এগুলো ব্যবহৃত হবে। সেই অবকাঠামোতে Actuator কাজ করবে কম্পিউটারের মাধ্যমে, যেখানে স্মার্ট এলগরিদম তৈরি করে দেয়া থাকবে এবং সেই এলগরিদমের মাধ্যমে Actuator নিজে বাইরে থেকে আসা চাপ এবং বলের বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা ঠিক করবে। এখানে সেন্সর থাকবে যেটা সর্বক্ষণ অবকাঠামোর চারপাশে বাতাসের গতিবেগ, ভূমিকম্পের ত্বরণ ইত্যাদি আরও নানা বিষয় যেগুলো একটি অবকাঠামো নির্মাণের সময় ডিজাইনে ধরতে হয় সেগুলো নিজে থেকে টের পাবে।
এসব তৈরি করার জন্য যে যে জ্ঞান দরকার সেটা একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে জানতে হবে এবং সেটা দিয়ে এরকম জিনিস তৈরি করে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। যারা উদ্যোক্তা হতে চায় তারাও এসব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে পড়াশোনার পরে নিজেদের ব্যবসা খুলে বসতে পারে। অর্থাৎ মূল কথা হচ্ছে, প্রযুক্তিকে যদি আমরা নিজেদের পড়াশোনার বিষয়ের ভেতর গ্রহণ করি এবং প্রয়োগ করি, তার ফল কখনই খারাপ হবে না, বরং নতুন নতুন আরও কিছু কাজের সুযোগ সন্ধান চলে আসবে।
পরিবেশবিদ্যাতে দূষণ এবং দূষক শনাক্ত করতে Biosensor এর বিকল্প নেই। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। কোথাও যদি শারীরিক, জৈবিক এবং রাসায়নিক পরিবর্তন হয় তাহলে Biosensor খুব সহজে সেই পরিবর্তনটুকু বুঝতে পারে। Biosensor যে এই পরিবর্তনটি বুঝতে পারলো সেটা এর থেকে পাওয়া সিগন্যালকে বিশ্লেষণ করলে খুব সহজেই বোঝা যায়। Biosensor যেটা শনাক্ত করলো সেটা Transducer এর মাধ্যমে বিশ্লেষণযোগ্য একধরনের সিগন্যালে রূপান্তর করা হয় এবং সেই রুপান্তরিত সিগন্যালগুলো গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করলে সেই পরিবর্তনগুলো বোঝা যায়। অনেক ধরনের Biosensor আছে, যেমন- DNA sensors, Quartz-based Piezoelectric Oscillators, Surface Acoustic Wave Detectors ইত্যাদি। এই সেন্সর প্রযুক্তি দিয় Transportation Engineering এ বড় বড় সব কাজ করা হচ্ছে, যেটা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে।
অনেকের ধারণা যে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করলে সেখানে প্রযুক্তির কোনো প্রয়োগ নেই। এই কথাটি একদম ভুল। এর বিভিন্ন বিষয়ে প্রযুক্তির কী পরিমাণ মিশেল ঘটতে পারে সেটা উপরের আলোচনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসগুলোতে এসব নিয়ে আলোচনা করা হয় না এবং শিক্ষার্থীদের এসব নিয়ে পড়ানোও হয় না। এমনকি আমাদের দেশেও না। তাই আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদেরকে নতুন নতুন যা কিছু তৈরি হচ্ছে এবং চারদিকে যা ঘটছে সেগুলো সিলেবাসের ভিতর আনতে হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা যেমন উপকারী হবে, ঠিক তেমনি একজন শিক্ষক এবং গবেষকও নিজের গবেষণা করার সুযোগ পাবেন, বিশ্বকে তার গবেষণা দিয়ে নতুন কিছু দিতে পারবেন।
ফিচার ইমেজ সোর্স: modern technology.com