কখনো ভেবে দেখেছেন কি আমাদের দৈহিক প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন কত প্রাণী আমাদের পাকস্থলীর অভ্যন্তরে নিষ্পেষিত হয়ে বৃহদন্ত্র-ক্ষুদ্রান্ত্র অতিক্রম করছে? জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে এর চাহিদাও। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান টিকে থাকবে তো?
এমন ভাবনা আপনার মাথায় না আসলেও, এসেছে বিজ্ঞানীদের ভাবনায়। আর যেই ভাবনা, সেই কাজ। তারা কাজ করেছেন কীভাবে প্রাণ না নিয়েই প্রাণিজ প্রোটিন এবং এর স্বাদ পাওয়া যায়। এখন তারা সফলতাও পেয়েছেন। আর এই সাফল্য পাওয়া গিয়েছে বায়োটেকনোলজির ব্যবহারের মাধ্যমে।
বায়োটেকনোলজির ব্যবহার করে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে আজ তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম মাংস। স্বাদ, গন্ধ একেবারে আসল মাংসের। শুধু তা-ই নয়, এর পুষ্টিমানও শতভাগ অক্ষুণ্ণ থাকে। এই কৃত্রিম মাংসকে ‘কালচারড মাংস’, ‘সিনথেটিক মাংস’, ‘কোষ-কালচারড মাংস’, ‘পরিস্কার মাংস’, ‘ভ্যাট মিট’, ‘ল্যাব- উৎপাদিত মাংস’ বা ‘ইন-ভিট্রো মাংস’ বলা হয়ে থাকে।
সূচনার গল্প
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী থেকে ভাবনার সূত্রপাত হয়ে পরবর্তীতে ইন্ডাস্ট্রি সেটিংয়ে করার ভাবনা আসে ১৯৩১ সালে উইনস্টন চার্চিলের। তিনি বলেন, “চিকেন ব্রেস্ট বা উইংস খাবার জন্য একটা আস্ত মুরগি উৎপাদনে সময় ব্যয় না করে আমরা উন্নত মিডিয়াম কালচারে তো আলাদা আলাদা পার্ট উৎপাদন করতে পারি।” (সূত্র- দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন)
এরপর ১৯৭১ সালে মিডিয়ামে আট সপ্তাহের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ল্যাবে মাস্কুলার ফাইবারের চাষ করেন রাসেল রস। প্রথম প্রথম এক স্তরের মাংসপেশি তৈরি করেছিলেন তিনি। তবে এরপর অনেকগুলো ওভারল্যাপিং স্তর তৈরি করতে পেরেছিলেন। তারপরও ১৯৯০ এর আগ পর্যন্ত স্টেমসেল উৎপাদন করা হয়নি।
প্রথম ভোজ্য মাংসপেশি ২০০২ সালে NSR/Tuoro Applied BioScience Research Consortium উৎপাদন করেছিল। সেটি ছিল গোল্ডফিশের কোষ। এছাড়া ২০০১ সালে ডারমাটোলজিস্ট উইতে অয়েস্টারহফ, ডাক্তার উইলিয়েম ভ্যান এলেন এবং ব্যবসায়ী উইলিয়েম ভ্যান-কুতেন ঘোষণা করেন যে, তারা কালচারড মাংস উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তাদের বর্ণিত পদ্ধতি অনেকটাই সাধারণ টিস্যু কালচার করার মতোই।
এই মাংস উৎপাদনে উৎসাহিত করতে PET এর পক্ষ থেকে এক মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করা হয় এবং বলা হয়, ভোক্তাদের জন্য ২০১২ সালের মধ্যে যে কোম্পানি সর্বপ্রথম এই কালচারড মাংস আনতে পারবে, এই পুরষ্কার তারাই পাবে। এদিকে ডাচ সরকার চার মিলিয়ন ইউএস ডলার প্রদান করে কালচারড মাংস উৎপাদনের খরচ হিসাবে। ২০১২ সালের মধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ৩০টি গবেষণাগার ঘোষণা করে তারা কালচারড মাংস উৎপাদনে কাজ করছে।
নতুন স্বাদে আলোড়িত পৃথিবী
২০১৩ সালের ৫ আগস্ট গবেষণাগারে প্রস্তুত মাংস দিয়ে প্রথমবারের মতো বার্গার প্রস্তুত করা হয় এবং লন্ডনে এক উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেটি ছিল বিফ বার্গার। বিজ্ঞানীরা একটি গরুর শরীরের কোষ নিয়ে নেদারল্যান্ডের এক প্রতিষ্ঠানকে দেন যারা কোষগুলোকে মাংসপেশির টুকরায় পরিণত করেন এবং এর থেকে বার্গারে ব্যবহৃত পেটি প্রস্তুত করেন। এর রাঁধুনি ছিলেন শেফ রিচার্ড ম্যাকগিওন। উপস্থিত সকলের মধ্যে ২ জন বার্গারটি টেস্ট করেছিলেন।
খাদ্য সমালোচক হ্যানি রুজলার টেস্ট করে বলেন, “এর প্রতিটি কামড়ে রয়েছে মাংসের স্বাদ। তবে আমি জানি, এর ভেতরে কোনো ফ্যাট নেই, তাই এটি মাংসের মত রসালো হতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। তবে মাংস বলতে কোনো দ্বিধা নেই আমার। তবে এর গঠনটা আরেকটু নরম হলে ভাল হতো।”
অপর খাদ্য সমালোচক এবং লেখক জোস সোনাল্ড বলেন,
“এটা আসলে মাংসের মতোই। কিন্তু আমি ফ্যাট মিস করছি খুব। সবমিলিয়ে এটা একেবারে আসল হ্যামবার্গারের মতো খেতে।”
তবে হ্যাঁ, এ মাংস খেতে আসল মাংসের মতো হলেও দেখতে তেমনটা নয়। এটা সাদাটে বর্ণের। আর তাই তো এতে লালচে বর্ণ আনতে প্রাকৃতিক মায়োগ্লোবিন ব্যবহারের কথা বলছেন হেলেন ব্রিড।
নতুন নতুন কোম্পানির এগিয়ে আসা
বার্গার উপস্থাপনের পর অনেকেই স্টার্টআপ করেন কালচারড মাংস নিয়ে। ‘মেমফিস মিট’ কোম্পানি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিফ মিটবল তৈরি করে দেখায়। পরবর্তীতে মার্চ মাসেই তারা মুরগি এবং হাঁসের কালচারড মাংস নিয়ে আসে সকলের সামনে। তবে এ মাংস এখনই আপনার বা আমার পক্ষে টেস্ট করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে রয়েছে প্রবল সংশয়। কেননা প্রতি কেজি মুরগির মাংসের দাম পড়বে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা! দাম কমানো সম্ভব হলে, অচিরেই বিশ্ববাজার দখল করবে এ মাংস, তা আশা করা যায়।
ইসরায়েলি কোম্পানি ‘সুপার মিট’ ২০১৬ সালে কালচারড মিটের একটি ভাইরাল ক্রাউডফান্ডিং ক্যাম্পেইন করেছিল। মার্ক পোস্টের আরেকটি স্টার্টআপ হলো ‘মোসা মিট’।
কীভাবে তৈরি করা হচ্ছে এই মাংস?
বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত হচ্ছে এই মাংস। এ প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। মোটামুটি তিনটি ধাপে তৈরি করা হয় এই কালচারড মাংস।
প্রথম ধাপ: কোষ সংগ্রহ
গরু, মুরগি বা হাঁস- যে প্রাণীর কৃত্রিম মাংস তৈরি করা হবে, সেটির সুস্থ জীবিত একটি সদস্যের দেহ থেকে বর্ধনশীল কোষ সংগ্রহ করতে হবে। স্টেমসেল সবচেয়ে বেশি বর্ধনশীল।
দ্বিতীয় ধাপ: গ্রোথ মিডিয়ামে স্থাপন
কোষ সংগ্রহের পরপরই তা জীবাণুমুক্ত করতে হবে এবং গ্রোথ মিডিয়ামে স্থাপন করতে হবে যেখানে প্রোটিন রয়েছে। এ প্রোটিনই কোষের বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় শক্তি প্রদান করে থাকে।
তৃতীয় ধাপ: স্তর বিন্যাসকরণ
ত্রিমাত্রিক মাংস প্রস্তুত করতে লেয়ার প্রস্তুতি খুব জরুরি। আর নির্দিষ্ট স্তরবিন্যাস না থাকলে তা খাবার উপযোগীও হবে না। তাই একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর ঐ মাংসপেশিতে স্ক্র্যাচ ফেলা হয়।
এভাবে প্রস্তুতকৃত মাংসকে স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে দিলে, তাতে ইস্ট এবং ফাঙ্গাসের আক্রমণ হতে পারে। তাই একে সোডিয়াম বেঞ্জোয়েট দ্রবণে ডুবিয়ে রাখতে হয়। এছাড়া প্রস্তুতির সময় কোলাজেন পাউডার, জ্যান্থান গাম, ম্যানিটল ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়।
জৈব-প্রাণিজ মাংসের সাথে পার্থক্য
কৃত্রিমতাকে আপনি কখনোই বাস্তবতার সাথে হুবহু তুলনা করতে পারবেন না। স্বাদে মিল থাকলেও একই স্বাদ বলা যাবে না। এতে কোনো চর্বি বা হাড় নেই, যার ফলে ক্যালসিয়াম এবং ফ্যাটের ঘাটতি রয়েছে যা বাচ্চাদের পুষ্টির ক্ষেত্রে ভাল কথা নয়।
কৃত্রিম মাংসের ভবিষ্যৎ
কৃত্রিমভাবে মাংস উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ সম্ভব হলে বাস্তুসংস্থানের উপরের খারাপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রতি বছর মার্কিন যুক্তরাজ্যে প্রায় এক বিলিয়ন মুরগি মেরে ফেলা হয় শুধুমাত্র খাবার জন্য! এছাড়া ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইন্সটিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হয়, পশুপাখি পালনে, বিশেষ করে পোল্ট্রি ফার্মে বিশ্বের প্রায় ৫১ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়। তাই এই কৃত্রিম মাংস উৎপাদনের মাত্রা বাড়ানো গেলে তা পরিবেশের জন্য আশীর্বাদই হবে।
যাদের কোলেস্টেরলে সমস্যা, চর্বি খাওয়া বারণ বা অ্যালার্জির সমস্যা, তারাও নির্দ্বিধায় খেতে পারবেন এই মাংস। তাই এই কৃত্রিম কালচারড মাংসের ভবিষ্যৎ আলোকিতই বলা চলে।
পরিশেষে, বায়োটেকনোলজির ব্যবহার নিয়ে অনেক নৈতিকতার প্রশ্ন উঠলেও এ কৃত্রিম ভোজ্য মাংস উৎপাদনে অনৈতিক কিছুই হচ্ছে না তা বিভিন্ন আইন দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। তাই এখন শুধু অপেক্ষা দামটা নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা।