দৃশ্যপট ১
– কী ব্যাপার, তোরা নিজেরা নিজেরাই সিক্রেট গ্রুপ খুলে অ্যাসাইনমেন্টের সব আলোচনা সেরে ফেলেছিস, আমাকে তো অ্যাড দিলি না!
– কীভাবে অ্যাড দেবো, সবার সুবিধার কথা মাথায় রেখে আমরা গ্রুপ খুলেছি মেসেঞ্জারে। কিন্তু তুই তো ফেসবুক মেসেঞ্জার থেকে পুরোপুরি নির্বাসন নিয়েছিস। হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া কিছু চালাসই না।
দৃশ্যপট ২
– আপনাকে আমি সেই এক মাস আগে ইনস্টাগ্রামে মেসেজ দিয়েছি। এখনও সেটার রিপ্লাই দিলেন না।
– ইনস্টাগ্রামে মেসেজ দিয়েছেন! কই আমি দেখিনি তো! মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপেই সবার সাথে কথা হয় নিয়মিত। ইনস্টাগ্রামে গিয়ে তাই মেসেজ চেক করা হয়ে ওঠে না।
এই ধরনের বিড়ম্বনা নতুন কিছু নয়। আমরা সকলেই কমবেশি এগুলোর সাথে পরিচিত। ভার্চুয়াল জগতে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়েই এসেছে বটে, কিন্তু কখনও কখনও এগুলো ভোগান্তির কারণও হয়ে দাঁড়ায়। সবার পছন্দ তো আর সমান হয় না। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্বাচনেও একেকজন একেকটিকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ফলে প্রায়শই কারও সাথে নির্দিষ্ট একটি মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার নাগাল পাওয়া যায় না।
তবে এমন ভোগান্তির দিন ফুরোতে চলেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ফেসবুক সিইও মার্ক জাকারবার্গ পরিকল্পনা করছেন মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রামকে এক করে দেয়ার, যাতে করে যেকোনো একটি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করেই ব্যবহারকারীরা বাকি দুই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে (তবে আলাদাভাবে তিনটি অ্যাপ্লিকেশনেরই অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে)। ধারণা করা হচ্ছে, এটি জাকারবার্গের একেবারেই ব্যক্তিগত প্রকল্প, এবং এটি সম্পন্ন করতে ফেসবুককে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনের একত্রীকরণ
নিউ ইয়র্ক টাইমসের দাবি, জাকারবার্গ চাচ্ছেন এই প্রকল্পের মাধ্যমে তিনটি প্ল্যাটফর্মের এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনকে একীভূত করতে। এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন বলতে বোঝায়, যেখানে মেসেজগুলো কেবল প্রেরক ও প্রাপকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সেগুলো রিট্রিভ হবে না।
এখন পর্যন্ত, কেবল হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের মেসেজগুলোই বাই-ডিফল্ট এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনের আওতাভুক্ত। ২০১৬ সাল থেকে হোয়াটসঅ্যাপে এই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, যে কারণে ব্যক্তিগত মেসেজ আদান-প্রদানে প্রায় দেড় বিলিয়ন ব্যবহারকারীর কাছে হোয়াটসঅ্যাপই নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। ফেসবুকেও চাইলে ‘সিক্রেট কনভার্সেশনস’ ফিচার চালু করে কিছু মেসেজকে কেবল প্রেরক ও প্রাপকের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখা যায়, কিন্তু বাকি সাধারণগুলো তৃতীয় পক্ষের কাছেও পৌঁছে যায়। অপরদিকে ইনস্টাগ্রামে এখন পর্যন্ত কোনো প্রকারের এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনই চালু হয়নি।
আশঙ্কা রয়েছে বিভ্রান্তি সৃষ্টির
ফলে এই তিনটি ভিন্ন ধরনের মেসেজিং প্ল্যাটফর্মকে একীভূত করতে গেলে, সেক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ক্রস-অ্যাপ ট্রাফিকের ফলে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন কার্যকর থাকবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞই। এ ব্যাপারে জন্স হপকিন্সে কর্মরত ক্রিপ্টোগ্রাফার ম্যাথিউ গ্রিন বলেন,
“আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কেবল হোয়াটসঅ্যাপেরই ডিফল্ট এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন আছে। এখন যদি তাদের (ফেসবুকের) উদ্দেশ্য হয়ে থাকে ক্রস-অ্যাপ ট্রাফিক বাস্তবায়ন করা, আর সেক্ষেত্রে এনক্রিপশনের প্রয়োজন না হয়, তাহলে কী হবে? এর ফলে অনেক ধরনের ফলাফলই বের হয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।”
উদাহরণস্বরূপ, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীরা জানেন যে, তাদের সকল চ্যাটই এন্ড-টু-এন্ড এনিক্রিপ্টেড। কিন্তু এখন যদি তারা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী কাউকে মেসেজ পাঠায়, কিংবা কারও কাছ থেকে মেসেজ পায়, তাহলে কী হবে? তার তরফ থেকে হয়তো মেসেজগুলো সুরক্ষিত থাকবে, কিন্তু অপর পক্ষের কাছ থেকে যদি তথ্য তৃতীয় পক্ষের কাছে পাচার হয়ে যায়?
এই বিষয়টি নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কারণ হলো, এতদিন হোয়াটসঅ্যাপের সকল মেসেজ এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড থাকায়, হোয়াটসঅ্যাপের দেড় বিলিয়ন ব্যবহারকারী থাকা সত্ত্বেও, ঐসব মেসেজের তথ্য বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে শেয়ারের মাধ্যমে অর্থ আয়ের কোনো উপায় ছিল না ফেসবুকের কাছে। কিন্তু এখন তিনটি প্ল্যাটফর্ম একীভূত করা গেলে, স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে তারা অপেক্ষাকৃত বেশি তথ্য হস্তান্তর করতে পারবে। তবে তা করতে গিয়ে ব্যবহারকারীরা এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনের মাধ্যমে পাওয়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তার সুবিধাটি হারাবে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
ফেসবুকের বক্তব্য
অবশ্য শুক্রবার ফেসবুকের এক মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমে দেয়া বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তিনটি প্ল্যাটফর্ম একীভূত করার পরও ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি যেন বিঘ্নিত না হয়, বরং আরও সুরক্ষিত হয়, সে ব্যাপারে তারা সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট থাকবেন।
“আমরা মেসেজিংয়ের সেরা অভিজ্ঞতা তৈরি করতে চাই; ঠিক যেমনটি সব মানুষ চায় যে তাদের মেসেজিং হবে দ্রুত গতির, সহজবোধ্য, নির্ভরযোগ্য ও ব্যক্তিগত। আমরা চাচ্ছি আমাদের আরও বেশি মেসেজিং ব্যবস্থা যেন এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনের আওতায় আসে, এবং বিভিন্ন নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে থাকা বন্ধু ও পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ যেন সহজতর হয়ে ওঠে। যেমনটি আপনারা ভাবছেন, আমাদের ভিতরে ইতিমধ্যেই অনেক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হয়ে গেছে, এবং আমাদের কাজগুলো ঠিকভাবে এগোনোর জন্য আমাদেরকে একটি লম্বা প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।”
দেখা দিতে পারে আরও সমস্যা
নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছানো যদি যায়ও, পরবর্তীতে আরেকটি সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। সেটি হলো: ইউজারনেম। একজন ব্যক্তি হয়তো ফেসবুকে এক নামে আছে, ইনস্টাগ্রামে অন্য নামে। তাহলে এই দুই ভিন্ন নামের মধ্য থেকে কোন নামটি তার ইউজারনেম হিসেবে ব্যবহৃত হবে? একটি সম্ভাব্য সমাধান হলো, ব্যবহারকারী নিজে যেটি চাইবে, সেটিই থাকবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্য প্ল্যাটফর্ম থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে, যেটি কিনা নতুন একটি বিড়ম্বনার সৃষ্টি করবে। এছাড়া এমন যদি হয় যে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলবে একজন ব্যবহারকারীকে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে অভিন্ন নামে থাকতে হবে, সেটিও হয়তো অনেকের মনঃপুত হবে না।
একত্রীকরণের ফলাফল
মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রামের মেসেজিং ব্যবস্থা যদি একীভূত হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে ফেসবুকের অনেক লাভ হবে। যেহেতু তিনটি প্ল্যাটফর্মেরই মালিকানা ফেসবুকের হাতে, তাই এই একত্রীকরণই সম্ভবত তাদের জন্য সেরা অপশন। কেননা:
- এর মাধ্যমে তাদের পক্ষে ব্যবহারকারীর বিভিন্ন তথ্য একত্র করে, সে অনুযায়ী বিজ্ঞাপন প্রদান সুবিধাজনক হবে। ফলে বিজ্ঞাপনকেন্দ্রিক আয়ও এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যাবে। কেননা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ফেসবুকের বিজ্ঞাপন কেন্দ্রিক আয় এই মুহূর্তে খুবই কম। আর ইনস্টাগ্রাম থেকে বিজ্ঞাপনকেন্দ্রিক আয় থাকলেও, মেসেজিং ফিচার থেকে আলাদা করে কোনো বিজ্ঞাপনকেন্দ্রিক আয় তাদের হচ্ছে না। সুতরাং একত্রীকরণের ফলে হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম থেকে আয়ের অনুপাত বাড়বে।
- তিনটি প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারকারীদেরকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার ফলে ফেসবুকের সাম্রাজ্য আরও মজবুত ও অপরাজেয় হয়ে যাবে। গুগলের মেসেজিং সার্ভিস ও অ্যাপলের আই-মেসেজ এখন পর্যন্ত যেটুকু যা প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করতে পারছে, তখন সেটুকুও আর থাকবে না।
- ক্রস-প্ল্যাটফর্ম যোগাযোগের ফলে অনেক ব্যবহারকারীই হয়তো নতুন একটি প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধনের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে। যেমন: একজন ব্যক্তি হয়তো শুধুই ফেসবুক চালায়। ইনস্টাগ্রামে তার অ্যাকাউন্ট নেই। কিন্তু ইনস্টাগ্রামের কারও সাথে যোগাযোগের পর তার মনে হতেই পারে, ঐ ব্যক্তির সাথে কেবল মেসেজিংয়েই সে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে না, ঐ ব্যক্তির মূল ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টও সে অনুসরণ করবে। এভাবে ঐ ব্যক্তি নিজেও একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলবে।
তবে তিনটি প্ল্যাটফর্ম একত্রীকরণের ফলে ফেসবুক অনেক লাভবান হলেও, পৃথক পৃথকভাবে ক্ষতির স্বীকার হতে পারে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ। এতদিন একই মালিকানাধীন থাকার পরও মেসেঞ্জারের সাথে তাদের, এবং পরস্পরের মধ্যেও প্রতিযোগিতা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু একত্রীকরণের ফলে সেই প্রতিযোগিতা আর থাকবে না। তাই সার্বিকভাবে ফেসবুক অনেক উন্নতি করলেও, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের স্বতন্ত্র উন্নতির রাস্তা আরও সংকুচিত হয়ে যাবে। জানা গেছে, গত বছরের ‘প্রাইভেসি স্ক্যান্ডাল’ কাটিয়ে উঠতে জাকারবার্গ বেশ অনেকদিন ধরেই এই পরিবর্তনের পরিকল্পনা করে আসছিলেন। কিন্তু জাকারবার্গের ফেসবুককে উপরে তুলতে গিয়ে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের ভবিষ্যতকে জলাঞ্জলি দেয়ার এমন পরিকল্পনায় ফেসবুকে ‘অন্তর্দ্বন্দ্ব’ সৃষ্টি হয়েছিল, যার জের ধরে গত বছর ফেসবুক ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন হোয়াটসআপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যান কউম ও ব্রায়ান অ্যাক্টন, এবং ইনস্টাগ্রামের সহ-প্রতিষ্ঠাতা কেভিন সিস্ট্রোম ও মাইক ক্রিগার।
শেষ কথা
মেসেঞ্জার, হোয়াটসআপ ও ইনস্টাগ্রামকে এক করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, এবং এই বছরের শেষ দিকে কিংবা সামনের বছরের শুরুর দিকে তা শেষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য এই নতুন ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনকই হবে, এবং এর মাধ্যমে ভার্চুয়াল মেসেজিং নতুন মাত্রা লাভ করবে। ফেসবুকও সাম্প্রতিক সব কেলেংকারিকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে তাদের ভিত আরও মজবুত করতে পারবে। তবে ফেসবুক ২০১২ সালে ইনস্টাগ্রাম এবং ২০১৪ সালে হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নেয়ার পরও, প্ল্যাটফর্ম দুটি এতদিন স্বাধীনভাবে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে এসেছে। কিন্তু এই নতুন ব্যবস্থা চালু করার ফলে, অদূর ভবিষ্যতে তারা যে তাদের স্বকীয়তা হারিয়ে পুরোপুরি ফেসবুকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে না, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এই সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) ফেসবুক মার্কেটিং
২) Social Media Marketing : Strategies for Engaging in Facebook, Twitter and other Social Media
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/