সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ না হলেও, বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীর বর্ণনা এবং নানা সময়ে বিস্ফোরণ পরীক্ষার ফলাফল থেকে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা আঁচ করতে শিখে গেছে বিশ্ববাসী।
কিন্তু কতটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে একটি বিস্ফোরণ? এটি মূলত নির্ভর করছে কোন শহরে বা অঞ্চলে আক্রমণ করা হচ্ছে এবং কোন ধরনের পারমাণবিক বোমা সেখানে নিক্ষেপ করা হচ্ছে।
১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমাতে ফেলা আমেরিকার ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমাটি যদি বর্তমান ঢাকার জিরো পয়েন্টে ফেলা হতো, তাহলে কী হতো?
আগেই জানিয়ে রাখি, পারমাণবিক বোমার শক্তিমাত্রা নির্দেশ করা হয় কিলোটন/কিলোগ্রাম এককে। ‘লিটল বয়’ এর শক্তিমাত্রা ছিল ১৫ কিলোটন/কিলোগ্রাম। অর্থাৎ ১ কেজিরও কম পরিমাণ ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর ভাঙ্গনের ফলে ১৫ কিলোটন পরিমাণ শক্তি নির্গত হতো।
এখন ঢাকার জিরো পয়েন্টে যদি এই লিটল বয় ফেলা হতো, তাহলে মুহূর্তেই জিরো পয়েন্টের চারপাশে ৩৪০ মিটার পর্যন্ত জনমানুষ এবং সভ্যতার চিহ্ন বিলীন হয়ে যেত। সহজ কথায়, বাষ্প হয়ে উড়ে যেত!
তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব থাকত চারপাশে ১.২ কিলোমিটার পর্যন্ত। অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক থেকে শুরু করে হাতিরঝিল পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে যেত।
নীলক্ষেত, মগবাজার, কমলাপুর, রায় সাহেবের বাজার পর্যন্ত প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ত। আর বিস্ফোরণের প্রভাব টের পাওয়া যেত জিরো পয়েন্টের চারপাশে পাঁচ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত।
এ তো গেলো লিটল বয়-এর কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত পরীক্ষা করা সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা হলো রাশিয়ার ‘জার বোম্বার’, যার শক্তিমাত্রা ৫০ মেট্রিক টন/কিলোগ্রাম। এটি ঢাকার জিরো পয়েন্টে ফেলা হলে, পুরো ঢাকা শহর মুহূর্তের মধ্যে বাষ্প হয়ে যাবে। আর আগুন ছড়িয়ে পড়বে ৬০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত। এমনকি ভারতের আগরতলা থেকেও এই বিস্ফোরণের প্রভাব টের পাওয়া যাবে।
বুঝতেই পারছেন কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে একটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই পুরো নগরী গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এগুলো। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়া যে একবারে ঘটে যায়, এমন না ব্যাপারটি।
তিনটি ধাপে একটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের প্রক্রিয়া বর্ণনা করা যায়। এই প্রক্রিয়াগুলো নিয়েই এখন বিস্তারিত আলোচনা করবো, যাতে একটি বিস্ফোরণস্থলে আপনি উপস্থিত থাকলে ঠিক কী অনুভব করতেন, তা বুঝতে পারেন।
আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা জাপানের হিরোশিমায় ফেলা লিটল বয়কে উদাহরণ হিসেবে ধরে নেব। আর কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে বা এর ভয়াবহতা কেমন হবে, তা নির্ভর করে শহরের উপাদানগুলোর উপর।
ঢাকার ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি বিপুল পরিমাণ শিল্প কারখানা, রাস্তায় অসংখ্য যানবাহন, লক্ষ লক্ষ টন প্লাস্টিক এবং শহরে জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্যাস লাইন। এগুলোই যথেষ্ট একটি শহরকে ছাই করে দিতে।
এবার আসি মূল আলোচনায়। তিনটি ধাপে আমরা জানবো একটি পারমাণবিক বিস্ফোরণের রূপ কেমন হতে পারে।
১ম ধাপ
একটি শান্ত শহরে মানুষজন চলাফেরা করছে। ঢাকার কথা ধরে নিলে প্রতিদিনকার ব্যস্ততা চোখে পড়ছে। যে যার মতো কর্মস্থলে যাচ্ছে। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। এমন সময় একটি পারমাণবিক বোমা এসে শহরের বুকে আছড়ে পড়লো। এরপর যা হবে, তার জন্য ১ সেকেন্ডেরও কম সময় লাগবে।
১৮০ মিটার ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট আগুনের একটি বলয় তৈরি হবে। এই বলয়ের মধ্যে যা যা আছে, তা সব বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। যেন আলোর এক সুনামি এসে সব গ্রাস করে নিচ্ছে। এই বলয়ের সামনে কোনোকিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। প্রচুর উত্তপ্ত একটি পাতিলের মধ্যে পানির একটি ফোঁটা ছেড়ে দেয়ার মতো হবে ব্যাপারটি। মুহূর্তেই বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে।
সেই একই সেকেন্ডে ১.৭ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে যা যা আছে, সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। কংক্রিটের দেয়াল এর সামনে কিছুই না। ঝড়ের বেগের সামনে বাধা হতে দাঁড়ানোর মতো উপাদান থাকলেও মানুষ সৃষ্ট এই দুর্যোগের সামনে কিছুই বাধা হতে পারে না।
আগুনের বলয় তৈরির ঠিক পরের সেকেন্ডেই ২ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের সবকিছুতে আগুন লেগে যাবে। যেন এই মাত্র একটি আলোর ঝলকানি দেখলেন, আর ঠিক পরের সেকেন্ডেই দেখলেন, আপনার সামনে আগুন লেগে গেছে।
শুধু আপনি একা না। আপনার আশে পাশে যা কিছু আগুনে পুড়তে পারে, সব কিছুতে আগুন লেগে গেছে। গাছপালা, বাড়িঘর, বৈদ্যুতিক খুঁটি সবকিছুতেই আগুন। আরও খারাপ অবস্থা হবে, যখন গ্যাসের সিলিন্ডারগুলো একটি একটি করে ফাটতে শুরু করে দেবে।
এগুলোর সাথে নতুন মাত্রা যোগ করার জন্য প্রায় ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে যাবে। যদি ঢাকার কেন্দ্রস্থলেই বোমা ফেলা হয়, তাহলে উপর্যুক্ত অঞ্চলগুলো পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে। এগুলো কেবল বোমা আঘাত হানার প্রথম ২ সেকেন্ডের কথা। ধীরে ধীরে অবস্থা আরও ভয়াবহতার দিকে এগোবে।
২য় ধাপ
বোমা বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার দূর থেকে আপনি দেখতে পাবেন, কোথায় যেন ভয়াবহ আগুন লেগেছে। বিশাল শোরগোল শোনা যাচ্ছে। দেখবেন ধীরে ধীরে মাশরুমের আকৃতি নিয়ে ধোঁয়া উঠছে আকাশের দিকে। ততক্ষণে প্রায় ৩০ সেকেন্ড পার হয়ে গিয়েছে।
মাশরুমটির উচ্চতা খুব কম করে হলেও ২০ হাজার ফুট হবেই। আর প্রায় ২ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ ধরে মাশরুমটির আকার ছড়িয়ে গিয়েছে। আপনি যদি জানালার কাছ থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখতে থাকেন, তাহলে বিশাল ভুল করবেন। কারণ প্রথম কয়েক সেকেন্ডেই সব ধ্বংসলীলা শেষ হয়ে যায়নি।
মাশরুমটি থেকে শক ওয়েভ ধেয়ে আসছে আপনার দিকে। শক ওয়েভটির মাত্রা কেমন? আপনার জানালার কাচ ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কংক্রিটের পেছনে থাকলে হয়তো বেঁচে যাবেন, কিন্তু এই শক ওয়েভ দিয়ে আপনাকে শূন্যে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য খুব একটা কষ্ট করতে হবে না।
ধীরে ধীরে দেখবেন, ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। সেইসাথে তেজস্ক্রিয়তাও ছড়িয়ে পড়ছে শহর জুড়ে। একটু পরেই শুরু হবে তেজস্ক্রিয় কালো বৃষ্টি। বিষাক্ত বাতাসে চারপাশ ছেয়ে যাবে। এগুলো সব হবে বোমা বিস্ফোরণের প্রথম কয়েক মিনিটের মধ্যে।
এখানেই আপনার প্রাথমিক আঘাত শেষ হয়ে যাবে। পরবর্তী ধাপে ক্রমান্বয়ে আপনি বুঝতে পারবেন, এই অল্প কয়েক মিনিটের আঘাতে কত বড় দুর্যোগের সামনে আপনি পড়ে গিয়েছেন।
৩য় ও শেষ ধাপ
পুরো শহর কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। তেজস্ক্রিয় কালো বৃষ্টিতে পুরো বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। প্রতিটি শ্বাসের সাথে নিজের মৃত্যুকেই যেন আরও কাছে টেনে আনছেন।
আশপাশের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সব ভেঙে গেছে। সবধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ। বিশুদ্ধ পানির কোনো সন্ধান নেই। যারা বেঁচে আছেন, তাদের অধিকাংশই ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে আছেন। আশপাশ থেকে যে সাহায্য আসবে, সে অবস্থাও নেই। সাহায্য আসতেও অনেক দেরি আছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের বেলায় একসাথে একটির বেশি দুর্যোগ সাধারণত আসে না। কিন্তু এখানে ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি, দাবানল এবং পারমাণবিক দুর্ঘটনা- সব একসাথে ঘটছে। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কথা, আপনার কাছেই বিশাল এক এলাকা জুড়ে সবকিছু বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। তাই অন্য শহর বা দূর থেকে সাহায্য আসতে গেলেও বেশ সময় লাগবে।
ঢাকার আশেপাশে নারায়ণগঞ্জ কিংবা গাজীপুরের মতো শহরগুলোরও তখন বেহাল দশা। রাস্তাঘাট, ট্রেন লাইন, বিমানের রানওয়ে সবকিছু যখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, তখন যোগাযোগ করার তেমন কোনো রাস্তাই নেই। আর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া বর্তমান সভ্যতা কাজও করতে পারে না। তাই আকাশপথে হেলিকপ্টার ছাড়া সাহায্য আসার আর কোনো উপায় নেই।
দূরবর্তী শহরগুলোর দিকে তখন তাকিয়ে থাকা লাগবে সাহায্যের আশায়। কিন্তু আকাশপথে যারা সাহায্য নিয়ে আসবে, তারাও তেজস্ক্রিয় পরিবেশে কাজ করতে প্রশিক্ষিত না। সেক্ষেত্রে খুব সহজে তারাও এই পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফল ভোগ করতে থাকবে।
ধরে নিলাম, কোনো না কোনোভাবে আপনি উদ্ধার হলেন। কিন্তু এখানেও আছে বিপত্তি। আশেপাশের এলাকার সব হাসপাতাল এই বিপুল বিপর্যয় সামলানোর জন্য প্রস্তুত না। আপনাকে যে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেবে, সেটিও সম্ভব না। কারণ আপনি এখন ক্যান্সার বহনকারীদের একজন। বাংলাদেশে উন্নত চিকিৎসা হয়, এমন বেশিরভাগ হাসপাতালই রয়েছে ঢাকায়, যেগুলোর প্রায় সবকটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গিয়েছে।
আপনি একা নন। পুরো আক্রান্ত এলাকা জুড়েই তেজস্ক্রিয়তার জন্য ক্যান্সার ছড়িয়ে গিয়েছে। আর আপনার আবাস এলাকাতেও আর ফেরত যাওয়া সম্ভব না। কারণ দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সেটি পরিত্যক্ত অঞ্চল হিসেবে পড়ে থাকবে।
সরকারি অফিস-আদালতও যেহেতু একইসাথে বিলীন হয়ে যাবে, তাই পুরো জাতি একপ্রকার নেতৃত্বহীন হয়ে পড়বে। সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনার জন্য কারো কাছ থেকে পরামর্শ নেয়ার উপায় তখন থাকবে না।
পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা এতই বেশি যে, এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা চুক্তিতে অনেকগুলো দেশই চুক্তি সই করেছে। কিন্তু যারা সই করেনি, তাদের প্রায় সবাই পারমাণবিক শক্তির ক্ষমতাধর। সামান্য একটি গোলযোগ পুরো পৃথিবীর জন্য ডেকে আনতে পারে এক করুণ পরিণতি।
নিউকম্যাপ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানবার জন্য একটি ওয়েবসাইট আছে, যেখান থেকে কোনো অঞ্চলে বিভিন্ন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পরিণতি কেমন হতে পারে, তা সহজে জানা যায়। পাঠক চাইলে সেখান থেকে পুরো প্রক্রিয়াটি যাচাই করে দেখতে পারেন।