বর্তমানে স্মার্টফোন আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে জিনিসটি আপনাকে সব সময় সঙ্গ দেয় সেটি হলো আপনার স্মার্টফোন। নানা রকম দরকারি ফিচার ও ব্যবহারের কারণে স্মার্টফোনের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। সেই সাথে গ্রাহকের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে নিত্য নতুন নানা ধরনের, নানা ব্রান্ডের, নানা কনফিগারেশনের স্মার্টফোন আসছে বাজারে। ফলে নতুন স্মার্টফোন কিনতে গেলে ফোন পছন্দ করার ক্ষেত্রে একজন ক্রেতাকে কিছুটা বিপদে তো পড়তেই হয়!
কোনটা রেখে কোনটা কিনবেন? আবার কোনটা কিনলেই বা আপনার সব প্রয়োজন মিটবে? এসব বুঝে কিনতে পারেন না বলেই অনেক ক্রেতা ফোন কেনার পর নানা সমস্যায় পড়েন। কোনো কোনো ক্রেতা আবার ফোন কেনার ক্ষেত্রে দোকানদারের পছন্দ কিংবা মতামতের প্রাধান্য দেন। এক্ষেত্রে জেনে রাখা ভালো, একজন দোকানদার আপনার প্রয়োজন কিংবা সুবিধার দিকে না তাকিয়ে বেশিরভাগ সময়েই তার নিজের জন্য যে ফোনটি বিক্রি করা লাভজনক হবে সেটাই আপনার কাছে বিক্রি করবে।
তাই দোকানদারের পছন্দের ফোনটি না কিনে ফোন কেনার আগে নিজে সব কিছু বিবেচনা করে যে ফোনটি আপনার জন্য ভালো হবে সেটি ঠিক করে যাওয়াটাই কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ। আর এই নতুন ফোন কেনার ক্ষেত্রে ঠিক কী কী বিষয় আপনার জেনে রাখা উচিত ও ঠিক কোন কোন দিকে আপনার খেয়াল রাখা উচিত সেটাই জানাতেই আজকের এই আয়োজন।
বাজেট
স্মার্টফোন কেনার সময় সর্বপ্রথম যা আপনার করা উচিত তা হলে বাজেট ঠিক করা। তারপর সেই বাজেটের মধ্যে যে ফোনটি আপনার সব প্রয়োজন মেটাবে সেটাই আপনার কেনা উচিত। বর্তমানে বাজারে একেবারেই কম দামী থেকে শুরু করে উচ্চ দাম সম্পন্ন স্মার্টফোন রয়েছে। তবে আপনার বাজেট যদি কম হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনাকে লো-এন্ড বা সস্তা মানের ফোন কিনতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনি আপনার চাহিদা মতো সব কিছু সেই ফোনে না-ও পেতে পারেন। সুতরাং বাজেট ঠিক করার আগে আপনার নিজের প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখা উচিত। বাজেট ঠিক করা হলে আপনার পছন্দ করার ক্ষেত্রে ফোনের তালিকা কিন্তু কমে এলো। এখন আপনার বাজেটের মধ্যে যে ফোনগুলো রয়েছে সেগুলো থেকেই আপনার জন্য যেটি সেরা, সেটি বেছে নেওয়ার পালা। এই সেরাটি বেছে নিতে আপনাকে লক্ষ্য রাখতে হবে কিছু বিষয়ের দিকে। চলুন এখন জেনে নিই সেগুলো।
১. প্রসেসর
প্রসেসর কিংবা সি. পি. উ. (CPU) হলো একটি স্মার্টফোনের অন্যতম প্রধান একটি অংশ। অথচ স্মার্টফোন কেনার সময় আমাদের দেশের খুব কম মানুষই এটার দিকে নজর দেন। একটি স্মার্টফোনের প্রায় সমস্ত কাজ নিয়ন্ত্রণ করে প্রসেসর। ফলে আপনার ফোনে কাজ কত দ্রুত হবে কিংবা কত ভালো ভাবে হবে তা কিন্তু এই প্রসেসরের উপরই নির্ভর করে। বাজারে যত রকম স্মার্টফোন পাওয়া যায় তাতে দামের উপর নির্ভর করে নানা রকম প্রসেসর ব্যবহার করা হয়। মিডিয়াটেক, স্প্রেডট্রাম, স্নাপড্রাগন, এক্সাইনোস ইত্যাদি ব্রান্ডের প্রসেসর বর্তমানে বাজারের বেশিরভাগ ফোনে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত সস্তা ফোনগুলোতে দামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তুলনামূলক সস্তা মিডিয়াটেক ও স্প্রেডট্রামের প্রসেসরগুলো ব্যবহার করা হয়। এ প্রসেসরগুলোর একটি খারাপ দিক হলো এগুলো কাজ করার জন্য তুলনামূলক বেশি চার্জের প্রয়োজন হয়। ফলে ফোনের চার্জ কিছুটা দ্রুত শেষ হয় ও ফোন ব্যবহারের সময় গরম হয়। সে দিক দিয়ে স্নাপড্রাগন প্রসেসরে এ অসুবিধাগুলো নেই। ফলে ফোন কেনার সময় আপনার বাজেটের মধ্যে যে ফোনটিতে স্নাপড্রাগন প্রসেসর ব্যবহৃত হয়েছে সেটি বেছে নেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তবে আপনি যদি হেভি ইউজার না হন অর্থাৎ কথা বলা, গান শোনা কিংবা ভিডিও দেখার মতো সাধারণ কাজের জন্য আপনি ফোন কিনতে চান কিংবা আপনার বাজেট যদি খুব কম হয় সেক্ষেত্রে আপনি মিডিয়াটেক প্রসেসর যুক্ত ফোনগুলো নির্দ্বিধায় বেছে নিতে পারেন। তবে গেমিং কিংবা ভারী কাজের জন্য আপনাকে অবশ্যই ভালো প্রসেসর যুক্ত ফোন কিনতে হবে।
২. ডিসপ্লে
আপনি ঠিক কী ধরনের কাজে আপনার স্মার্টফোনটি ব্যবহার করবেন তার উপরই আপনার স্মার্টফোনের ডিসপ্লের আকার ও কোয়ালিটি নির্ভর করবে। আপনি যদি প্রধানত গেমিং কিংবা ভিডিও দেখার জন্য ফোন কিনতে চান তবে আপনাকে ভালো রেজুলেশন ও বড় আকারের ডিসপ্লে যুক্ত ফোন কিনতে হবে। এক্ষেত্রে IPS, LCD ও AMOLED ডিসপ্লে যুক্ত ফোনগুলো আপনার জন্য ভালো হবে। আবার স্মার্টফোনের ডিসপ্লের আকার যদি অতিরিক্ত বড় হয় তবে অনেকেই ব্যবহারে অসুবিধা বোধ করেন। সাধারণত ৫.৫ ইঞ্চি থেকে ৬ ইঞ্চির ডিসপ্লের ফোনগুলো ব্যবহারের জন্য আরামদায়ক হয়। আবার ফোনের ডিসপ্লের ব্রাইটনেস কেমন সেটাও খেয়াল রাখা উচিত। ঘরের বাইরে উজ্জ্বল আলোতে যাতে ভালোভাবে দেখা যায় এমন ডিসপ্লে যুক্ত ফোনই কেনা উচিত।
৩. ক্যামেরা
স্মার্টফোনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর ক্যামেরা। সাধারণত সব ব্যবহারকারীরই কম-বেশি ক্যামেরার প্রয়োজন হয়। তাই স্মার্টফোন কেনার সময় ক্যামেরার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। অনেকেই মনে করেন ক্যামেরার মেগাপিক্সেল যত বেশি হবে ছবির মানও তত ভালো হবে। এই ধারণাটি আসলে ভুল। স্মার্টফোন কেনার সময় শুধু ক্যামেরার মেগাপিক্সেলের দিকে দেখলে হবে না, বরং ক্যামেরার অ্যাপারচার, ISO লেভেল, ফোকাসের ক্ষমতা ইত্যাদি দিক মাথায় রাখা উচিত। এক্ষেত্রে অ্যাপারচার যত কম হবে তত ভালো। আবার অন্য কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যেমন- ইমেজ স্টাবিলাইজেসন, ডুয়াল লেন্স, HDR এসবের দিকেও খেয়াল রাখা উচিত। এছাড়া সাধারণভাবে কম আলোতে কেমন ছবি ওঠে এবং ক্যামেরার সেন্সরটির নির্মাতা কারা এটিও খোঁজ নিতে পারেন। সাধারণত সনি, স্যামসাং ইত্যাদি ব্রান্ডের ক্যামেরা সেন্সরযুক্ত ফোনগুলো ভালো ছবি তুলতে সক্ষম হয়। তবে সাধারণত বাজেট ফোনগুলোতে খুব একটা ভালো মানের ক্যামেরা ব্যবহার করা হয় না। ভালো মানের ক্যামেরা যুক্ত ফোন নিতে চাইলে আপনাকে বাজেট কিছুটা বাড়াতেই হবে।
৪. ব্যাটারি
নতুন ফোন কেনার সময় ফোনের মূল চালিকাশক্তি ব্যাটারিটি কেমন তার দিকে অবশ্যই নজর দেওয়া উচিত। আপনি যদি হেভি ইউজার হন কিংবা গেমিংয়ের জন্য ফোন কিনতে চান তবে অবশ্যই আপনার ফোনের ব্যাটারির ধারণ ক্ষমতা বেশি হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে ৩৫০০ mAh কিংবা তার বেশি ধারণক্ষমতার ব্যাটারি যুক্ত ফোন কেনা উচিত। তবে সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৩০০০ mAh বা তার নিচের ধারণক্ষমতার ব্যাটারি যুক্ত ফোন আপনার জন্য যথেষ্ট হবে।
৫. র্যাম ও রম
র্যাম হলো ফোনের কোনো কাজ সম্পন্ন হওয়ার জন্য অস্থায়ী মেমরী। আপনি যদি একজন হেভি ইউজার হন কিংবা একসাথে অনেকগুলো অ্যাপ ব্যবহার করতে চান তবে আপনাকে বেশি র্যাম যুক্ত ফোন কিনতে হবে। এছাড়াও ভালোভাবে গেমিংয়ের জন্য অবশ্যই আপনার বেশি র্যাম যুক্ত ফোন দরকার হবে। বর্তমানে স্মার্টফোনগুলোর অপারেটিং সিস্টেমের আপডেটের সাথে সাথে অ্যাপগুলোও আপডেট হচ্ছে। এ আপডেটেড অ্যাপগুলো চালাতে আপনার ফোনের বেশি র্যামের প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে আপনাকে কমপক্ষে ১.৫ থেকে ২ গিগাবাইট বা তার বেশি র্যামযুক্ত ফোন কিনতে হবে। এছাড়া ফোনের র্যাম বেশি হলে ফোনে কাজ করাও কিছুটা দ্রুত হয়।
অপরদিকে রম হলো ফোনের স্টোরেজ। রম যত বেশি হবে তত বেশি জিনিস আপনি আপনার ফোনের ইন্টারনাল মেমোরিতে রাখতে পারবেন। আপনি যদি প্রচুর অ্যাপ ব্যবহার করে থাকেন তবে অবশ্যই আপনাকে বেশি রম যুক্ত ফোন কিনতে হবে। অনেক স্মার্টফোনে আবার এক্সটারনাল এসডি কার্ড বা মেমরি কার্ড ব্যবহার করা যায় না। এমন ফোনে আপনার ইন্টারনাল স্টোরেজ বা রমই একমাত্র ভরসা। সেক্ষেত্রে ফোনের রম অবশ্যই বেশি হতে হবে।
উপরের বিষয়গুলো ছাড়াও ফোনের বিল্ড কোয়ালিটি কেমন, ফোনটি ফোরজি নেটওয়ার্কের মতো নতুন প্রযুক্তি সমর্থন করে কিনা, ফোনটিতে ফিংগার প্রিন্ট সেন্সর সহ নানা সেন্সর আছে কিনা কিংবা ফোনের ইউজার ইন্টারফেসটি কেমন এসব বিষয়ে খেয়াল রেখে আপনার পছন্দ ও চাহিদার উপর ভিত্তি করে ফোন নির্বাচন করা উচিত। এসব দিক খেয়াল রেখে ফোন কিনলে আশা করা যায় আপনার স্মার্টফোনটি আপনার সব চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে আর আপনিও আপনার স্মার্টফোনটি ব্যবহার করে সন্তুষ্টি লাভ করবেন।
ফিচার ইমেজ – veraveg.org