চায়ের কাপে ঝড় তোলার মতোই সংবাদে পরিণত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, যেভাবে কোটি কোটি ডাটা তৈরি হচ্ছে, জটিল থেকে জটিলতর গাণিতিক গণনা করার জন্য কম্পিউটারগুলো যেভাবে উন্নত হচ্ছে, নতুন নতুন সব এলগরিদম তৈরি হচ্ছে তাতে বোঝা যায় যে গত শতককে যেমন শুধু কম্পিউটারের উন্নতিকরণের শতক বলে মনে করা হয়, তেমনই একবিংশ শতক মনে থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের জন্য।
এককথায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের জীবনকে সহজতর করে তুলছে। মানুষ কোনো একটি কাজে নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছে এবং সেই ভুল শুধরে নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই কাজের উপর প্রয়োগ করে। মানুষ যে কাজ করতে পারে না, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সেই কাজটুকুও করা যাচ্ছে, মানুষের যে কাজ করতে হয়তো একশ দিন সময় লাগতো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সেই কাজ হয়তো দুই দিনেই করে ফেলা যাচ্ছে। একটি কাজ করতে হয়তো দশ জন লোকের প্রয়োজন, সেই কাজটি মাত্র একটি রোবট একাই এবং আরও কম সময়ে করে দিচ্ছে। এসব কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে।
শুধুমাত্র কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলগরিদম অনুসরণ করে কোনো একটি জং ধরে যাওয়া মেশিনকে দিয়ে যা ইচ্ছা করানো যায়। এসবই সম্ভব হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বদৌলতে। তাহলে কি এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই একদিন কর্মক্ষেত্রগুলোতে মানুষের জায়গা দখল করে নিবে? কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তারা কি সময় বাঁচানোর জন্য, কাজে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য, দশজনকে বেতন দিতে হবে না দেখে সেই দশজনের কাজ একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট বা কোনো প্রোগ্রাম দিয়ে করাবে? তাহলে এটা ধরে নেয়া যায় যে, অদূর ভবিষ্যতে মানুষের বেকারত্বের জন্য দায়ী হবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট? যেখানে নতুন নতুন প্রযুক্তি থেকে নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কথা সেখানে কাজের পরিমাণ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমনটি মনে হওয়ার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। প্রযুক্তিতে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই সবুজ দেশ। এই বাংলাদেশেও এখন রোবট ওয়েটার দিয়ে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। গত বছরই ঢাকার একটি হোটেলে প্রথম রোবটরা অতিথিদের খাবার পরিবেশন করেছে। জাপানে প্রথম রোবট সংবাদ পাঠিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এরিক নামের একটি রোবট। মলি হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম এমন একটি রাঁধুনি প্রতিষ্ঠান যেখানে রোবট দিয়ে রান্না করা হয়। রোবট নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অবশ্যই একজন অপারেটর সেখানে সবসময় থাকে। কিন্তু রান্না থেকে শুরু করে খাবার পরিবেশন সেখানে রোবট করে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেই রোবটগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে।
কলকারখানায় শ্রমিকরা যে কাজ করে সেই কাজগুলো এখন রোবটদের দিয়ে করা হয়। জার্মানির বেশ কয়েকটি শিল্প কারাখানাতে এমনটি শুরু হয়েও গিয়েছে। ছোট ছোট কাজ, যেমন- মালির কাজ, কুরিয়ার ডেলিভারির কাজ, বাসায় কাজের লোকদের করা কাজগুলো ভবিষ্যতে যে রোবটই করবে সেটাতে কোনো সন্দেহ নেই। গাড়ি চালানোর যে পেশা সেটাও এখন আস্তে আস্তে কমে যাওয়া শুরু করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে এখন বিশ্বের টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো চালকবিহীন গাড়ি তৈরি করছে। বড় বড় এবং উঁচু উঁচু দালানকোঠা নির্মাণ করার জন্যও এখন মানুষের পাশাপাশি রোবট বা প্রোগ্রাম করা কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এই খাতেও আস্তে আস্তে হয়তো কর্মীদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে।
প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে এখন নতুন নতুন সফটওয়্যার তৈরি করা যাচ্ছে, যেগুলো শুধুমাত্র ওই বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিই পরিচালনা করতে পারবে। এতে কোনো ফার্মে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অনেকজনের যে একটা মতামতের প্রয়োজন পড়তো আস্তে আস্তে ভবিষ্যতে হয়তো সেটার দরকার পড়বে না। একজন মানুষই নিজের চিন্তাকে বিভিন্নভাবে সাজিয়ে গাণিতিকভাবে সম্ভাব্য সঠিক এবং দক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। তখন হয়তো অনেক অনেক বেতন দিয়ে কোম্পানিতে কর্মচারী রাখার প্রয়োজন পড়বে না।
কথাগুলো কিন্তু মোটেও কাল্পনিক কথা নয়। ব্যাপারগুলো আস্তে আস্তে এমনই হচ্ছে। মানুষের ব্যবহার, সামাজিক বিভিন্ন স্তরে তার আচার আচরণ পর্যবেক্ষণ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গণিত প্রয়োগ করে সেগুলোর মডেল এখন বের করা যাচ্ছে, ইংরেজিতে যাকে বলে Social Force Model। তাই বলে পুরো পৃথিবীই যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ভরে যাবে তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু কাজ আছে যেগুলো রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে করাতে গেলে অনেক অনেক সময় লাগবে। কারণ বিষয়গুলো গাণিতিকভাবে মডেল করা অনেক জটিল।
ভবিষ্যতে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে কিনা, প্রযুক্তি উন্নতির সাথে সাথে চাকরির বাজারে কোনো সমস্যা হবে কিনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ কী- এসব নিয়ে কথা বলেছেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন। তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমার চাকরি এখনও পর্যন্ত আছে। কোনো সুপার রোবট এসে আমার জায়গা নিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের পড়াবে এমনটা হতে অনেক সময় বাকি এবং আদৌ হবে কিনা সেটা নিয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না।”
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং নিয়ে এখন অনেক বেশি কাজ হচ্ছে। এই দুটি বিষয় নিয়ে গবেষণার ফলে মানুষের বেশ কিছু কর্ম উৎস তাদের জন্য আর বহাল থাকছে না। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবার এবং সেখানে যারা শিল্প-কারখানায় কাজ করে তাদের মধ্যে চাকরি চলে যাওয়ার একটি ভয় বেশি কাজ করে। কিন্তু যেসব কাজে মানুষের ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয়, যেসব কাজের জন্য একটি নিপুণ পরিচালনার প্রয়োজন পড়ে, সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করলে ঠিক ফল পাওয়া যাবে না। যেসব কাজ মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং সৃজনশীলতার উপর নির্ভর করে, সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ আদৌ সম্ভব নয়।
রঘুরাম রাজন এ ব্যাপারে ইংল্যান্ডের National Health Service এর একটি উদাহরণ টেনে বলেন যে, মেডিকেলেও এখন শুধুমাত্র ডাটা পর্যবেক্ষণ করে এমন সব কাজ করা হচ্ছে যেটা আগে ডাক্তাররা নিজে হাতে করতো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে সমাজে পরিবর্তন আসছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যেটা ভাবেন যে পরিবর্তনটা অনেক জলদি আসবে সেরকমটি কিন্তু হচ্ছে না। এর পেছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে।
অনেক মানুষই চাইবে না যে মানুষের সাথে একটি মেশিনের তুলনা করা হোক। ধরে নিলাম যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সকল কাজ করা যাচ্ছে। এমনকি একদিন এটা ব্যবহার করে হয়তো চিকিৎসক ছাড়াই অস্ত্রোপচার করা যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ নীতিগতভাবে কিংবা নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে কখনও কি নিজেদেরকে একটি মেশিনের উপর নির্ভার হয়ে সঁপে দিতে পারবে? এখানে সমাজের এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়ার একটা ব্যাপার কাজ করছে।
জীবনকে সহজ করার জন্য মানুষ এখন হয়তো মেশিনের উপর নির্ভর করছে। কারণ সে নিজে জানে যদি মেশিন ভুল করে সে নিজে ঠিক করে কাজটা করতে পারবে অথবা মেশিনকে নিজের মতো করে পরিচালনা করতে পারবে। কিন্তু যেখানে মেশিনকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, সেখানে সমাজ কতটুকু তা মেনে নিবে সেটা সময় আসলেই বোঝা যাবে। তবে পরবর্তী জেনারেশন যদি এসব মেনে নেয়ও, তবুও ধারণা করা যায় যে সেই দিন আসতে এখনও অনেক বছর বাকি। এমনও তো হতে পারে যে ভবিষ্যতে বিশ্বের সকল দেশ মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়াদি ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর কোথাও প্রয়োগ করা যাবে না!
আমাদের সবার মধ্যে একটি প্রবণতা আছে, সেটা হচ্ছে আমরা যেকোনো বিষয় বাস্তবায়ন হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেটা নিয়ে বিরাট এক জল্পনা করে ফেলি এবং মনে করতে থাকি যে আমাদের হাতে সময় অনেক কম, হয়তো খুব তাড়াতাড়িই এমন কিছু একটা ঘটে যাবে যেটা আমাদের নিজেদের জন্য ভালো না। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে আসলেই বেকারত্বের সংখ্যা বাড়বে কিনা সেটা আগেভাগেই আমরা বলতে পারবো না। যেমন, চালকবিহীন গাড়ি খুব দ্রুত উন্নতি সাধন করছে, উন্নত বিশ্ব খুব দ্রুত এটা রাস্তায় নামিয়ে ফেলবে এবং চালকদের চাকরি চলে যাবে এমনটা অনেক চিন্তাবিদ ভাবতেই পারেন। কিন্তু আমরা একটু চিন্তা করে দেখি তো যে ঢাকার মতো জায়গায় কি এই চালকবিহীন গাড়ি ছেড়ে দেয়া যাবে? যদি ছাড়া হয়ও, তাহলে তার ফলাফল কেমন হবে? মনে করি, আমেরিকাতে বা জাপানের গাড়িগুলোতে এখন আর চালকের দরকার পড়ে না। এখন ঢাকায় বসে আমরা যদি ভেবে থাকি যে এখানেও একই অবস্থা খুব দ্রুত বিরাজ করবে তাহলে বলতে হবে আমাদের চিন্তার মধ্যে একটু ভুল আছে।
বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটতে এখনও অনেক দেরি আছে। তাই এখনই এসব নিয়ে মাথা ব্যথা না করলেও চলবে। তবে একটা কথা সত্যি যে প্রযুক্তির উৎকর্ষ নিয়ে এরকম সন্দেহ থাকার পরও কিন্তু বসে থাকলে চলবে না কিংবা প্রযুক্তিকে আরও কীভাবে উন্নত করা যায় সেটার ভাবনা বন্ধ করে দিলে চলবে না। সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই প্রযুক্তি খাতে আরও অনেক অনেক উন্নতি করতে হবে, দেশের স্টার্টআপ কোম্পানি বাড়াতে হবে, প্রযুক্তির উন্নতিকে কীভাবে জনসাধারণের কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে।
মানুষ যখন দু’শ বছর আগে শিল্পক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করলো, তখনও অনেকে মনে করেছিলো হয়তো কলকারখানা হয়ে যাওয়ার ফলে মানুষের কাজের উৎস কমে যাবে। কিন্তু আদতে তা হয়নি। মানুষের কাজ কিন্তু কমেনি, বরং আরও বেড়ে গিয়েছে। তাই সব কিছু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়ে গেলেও মানুষের জন্যও তখন নতুন কোনো কাজের উৎস হয়তো এমনি এমনি তৈরি হয়ে যাবে।
আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। যেকোনো পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে, মোকাবেলা করতে এবং নিজেদের জায়গা করে নিতে কখনই মানবজাতির সমস্যা হয়নি এবং হবেও না।
ফিচার ইমেজ সোর্সঃ ournewsreport.com