প্রতিদিন ইন্টারনেটের দুনিয়ায় যাদের হরদম যাতায়াত, তারা নিদেনপক্ষে একবার হলেও ভিপিএন শব্দটি শুনেছেন। পাঠকদের মধ্যে অনেকেই হয়ত জানেন ভিপিএন কী; তবে সাধারণত ব্যবহার করেন না। আবার আরও কেউ হয়ত রয়েছেন যিনি নিজের বন্ধুদেরকে ভিপিএন ব্যবহার করতে দেখেছেন, কিন্তু নিজে কখনো ব্যবহার করে নি। আবার কারোর হয়তো ধারণা, কোনো ব্লকড ওয়েবসাইটে প্রবেশ করিয়ে দেওয়াই ভিপিএন নামক বস্তুটির একমাত্র কাজ। কিন্তু আসলে কি তাই? ভিপিএন ব্যবহার করাই বা আপনার জন্য কতটা জরুরি?
চলুন, জেনে নেওয়া যাক তাহলে।
ভিপিএন কী?
ভিপিএন (VPN) এর সম্পূর্ণ রূপ হল Virtual Private Network। প্রথমেই VPN এর প্রথাগত সংজ্ঞায় না গিয়ে বরং একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। ধরুন, আপনি একটি বিশাল সমুদ্রের মধ্যে একটি ছোট দ্বীপে বাস করেন। আপনি যে দ্বীপে বাস করেন সেটা ছাড়াও আরও কয়েকশ দ্বীপ রয়েছে আশেপাশে। কয়েকটি খুব কাছাকাছি; কিন্তু বাকিগুলো অনেক দূরে। আর এই দ্বীপগুলোর মধ্যে যাতায়াতের একমাত্র উপায় হল মাঝারি আকারের একটি নৌকা। এখন আপনাকে যদি আশেপাশের কোনো দ্বীপে যেতে হয়, তাহলে সেই নৌকাতেই আপনাকে উঠতে হবে। কিন্তু আপনি যখন নৌকাতে উঠছেন তখন আপনাকে ধরেই নিতে হবে এখানে আপনার কোনো গোপনীয়তা রক্ষা হচ্ছে না। কারণ, নৌকায় থাকা যে কেউ একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবে আপনি কী কী করছেন।
এবার মনে করুন সেখানকার প্রতিটি দ্বীপ একেকটি LAN (Local Area Network) এবং সেই সমুদ্রটি হলো ইন্টারনেট। সমুদ্র যেভাবে দ্বীপগুলোর মধ্যে সংযোগ দিয়ে রেখেছে, তেমনি LAN-গুলোকে সংযুক্ত করেছে ইন্টারনেট। আর নৌকায় ভ্রমণ করা মানে হলো একটি ওয়েব সার্ভারের সাথে সংযোগ করা। নৌকায় ভ্রমণ করা লোকগুলোর উপর যেমন আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই, একইভাবে আপনার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের উপরও আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অর্থাৎ নৌকায় ভ্রমণকালে একজন চেষ্টা করলেই যেভাবে দেখতে পারে আপনি তখন কী করছেন, ঠিক একইভাবে আপনার ইন্টারনেটে বিচরণের গতিবিধি লক্ষ্য করতে পারে আপনার ISP (Internet Service Provider), অর্থাৎ যে আপনাকে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছে।
কিন্তু দ্বীপে যদি আপনার একটি ছোট্ট সাবমেরিন থাকতো তাহলে কেমন হতো? তাহলে আপনি অনায়াসেই নিজের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা বজায় রেখে এক দ্বীপ হতে অন্য দ্বীপে ভ্রমণ করতে পারতেন! আপনি কী করছেন বা না করছেন সেটা কাউকে না জানিয়েই আপনি ইচ্ছামতো ভ্রমণ করতে পারতেন।
VPN কাজ করে আমাদের গল্পের সাবমেরিনের মতো। আপনি যখন একটি পাবলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন, তখন সেখানে তথ্যের গোপনীয়তা ফাঁসের একটি ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। এই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নিজের প্রাইভেট বা ব্যক্তিগত নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হওয়ার পদ্ধতিই হলো VPN। এটি আপনাকে পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে ছদ্মবেশে ওয়েব ব্যবহার করার সুযোগ করে দেয়।
VPN যেভাবে কাজ করে
VPN আপনার ইন্টারনেট সংযোগকে এনক্রিপ্ট করে আপনার ডিভাইসের IP Adress বদলে অন্য একটিতে রূপান্তরিত করে। এটি আসলে আপনি ও আপনার ইন্টারনেট গন্তব্যের মধ্যে একটি ভার্চুয়াল ‘Tunnel’ বা সুড়ঙ্গ তৈরি করে। আপনার ডিভাইস ও একটি VPN সার্ভারের মধ্যে সংযোগের পর সৃষ্টি হয় এই সুড়ঙ্গ। VPN সার্ভারের সাথে সংযুক্ত হওয়ার পর ঐ সার্ভারই তার এনক্রিপশন প্রোটোকলের মাধ্যমে নিশ্চিত করে আপনার গোপনীয়তা। যার ফলে আপনি কোনো তথ্য আদান-প্রদান করলে তা যাচ্ছে সুরক্ষিত সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে। এই সুড়ঙ্গকে তুলনা করতে পারেন খামে ভরে চিঠি পাঠানোর সাথে। আপনি চিঠিতে কী লিখেছেন তা যেমন খাম না ছিঁড়ে দেখা সম্ভব নয়, তেমনি VPN ব্যবহার করে আপনি কী করছেন, তা জানাও সহজে সম্ভব নয়।
তাহলে ISP অর্থাৎ আপনার ইন্টারনেট সংযোগদাতা কি বুঝতে পারবে না যে আপনি VPN ব্যবহার করছেন বা কী কী করছেন? উত্তর হলো- না, আদতেই নয়! অবশ্য আপনার ISP এটি বুঝতে পারবে যে আপনি VPN ব্যবহার করছেন, কিন্তু তারা বলতে পারবে না আপনি ইন্টারনেটে কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন।
শেষমেশ, আপনি যদি একটু বেশিই গোপনীয়তা চান, তবে আপনার ISP-এর Domain Name Servers (DNS) ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়ে Google Public DNS ব্যবহার করতে পারেন।
কেন VPN ব্যবহার করবেন? কখন করবেন?
VPN কেন ব্যবহার করবেন সেটি অনেকেই আঁচ করতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। কেউ কেউ কি মনে মনে একটি VPN এপ্লিকেশন ইনস্টল করার তোড়জোড়ও শুরু করে দিয়েছেন? যদি তা-ই হয়, তবে ইচ্ছাকে একটু লাগাম দিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়ে যান! কারণ, নিরাপত্তা বজায় রেখে VPN ব্যবহার করার ব্যাপারে কিছু কথা এখনও বলার বাকি আছে যে!
যা-ই হোক, আবার খামে ভরা চিঠির উদাহরণে ফিরে যাওয়া যাক। ধরুন, আপনি কাউকে চিঠি পাঠাতে চাচ্ছেন। চিঠি পাঠানোর জন্য একজন লোকও যোগাড় করেছেন। কিন্তু চিঠিটা খামের ভেতরে না পুরেই আপনি দিয়ে দিলেন সে লোকের কাছে। এখন সে লোকটি চাইলেই কিন্তু আপনার চিঠি পড়ে দেখতে পারে। এই লোকটির মতোই কাজ করতে পারে আপনার ISP; চাইলেই দেখতে পারে আপনি কী কী করছেন ইন্টারনেটে। তাই সেই সমস্যা থেকে বাঁচতে চাইলে VPN ব্যবহার করুন। আবার অনেক পাঠকই ভাবতে পারেন আপনার ISP খুবই বিশ্বস্ত। এটি ভাবা দোষের নয়। কিন্তু একটি ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, ISP নিজে থেকে না চাইলেও অন্য কারোর হস্তক্ষেপে আপনাকে নজরদারিতে রাখতেই পারে কিংবা আপনার তথ্য চুরি করতে পারে। তাই আগে থেকে সতর্ক থাকাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাই সবসময় VPN ব্যবহার না করলেও অন্তত ব্যক্তিগত কিংবা গোপনীয় কোনো তথ্য আদান-প্রদান করার সময় VPN ব্যবহার করুন।
এছাড়াও আরেকটি ব্যাপারে না বললেই নয়। তা হলো পাবলিক Wi-Fi। ফ্রি জিনিসের পেছনে কমবেশি আমরা সবাই ধাওয়া করে বেড়াই! তাই ফ্রি Wi-Fiও এর ব্যতিক্রম নয়। আমরা অনেকেই ফ্রি Wi-Fi এর নাগাল পেলে নিরাপত্তার কথা না ভেবেই ব্যবহার করা শুরু করে দিই। কিন্তু এসব নেটওয়ার্কেই তথ্য চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবথেকে বেশি। তাই এসব নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার সময় VPN ব্যবহার করাই সবথেকে সহজ ও নিরাপদ পন্থা!
নিরাপত্তার ব্যাপার তো আছেই। এসব ছাড়াও কোনো ওয়েবসাইট আনব্লক করার ক্ষেত্রে VPN ব্যবহার করতে পারেন। অর্থাৎ, আপনার ISP যদি কোনো ওয়েবসাইটে আপনাকে প্রবেশ করতে না দেয়, VPN ব্যবহার করে আপনি সহজেই সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন। আবার আপনি যদি আপনার ISP-এর দেওয়া IP Address এর বদলে অন্য কোনো জায়গার IP Address দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চান, তাহলে সেটাও VPN ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভব।
VPN ব্যবহার করা কি বেআইনি?
এতক্ষণ ধরে ছদ্মবেশ, ওয়েবসাইট আনব্লক ইত্যাদি অনেককিছু নিয়েই কথা বললাম। তাই প্রশ্ন আসতেই পারে, এটি কি বেআইনি নয়? এককথায় বললে, না! VPN হল আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কিংবা গোপনীয়তা গোপন রাখার একটি উপায় মাত্র। তবে আপনি VPN ব্যবহার করে যদি কোনো বেআইনি কাজ করে থাকেন, তাহলে সেটি অবশ্যই বেআইনি!
VPN কতটা নিরাপদ?
VPN তো আপনাকে একটি অসৎ ISP থেকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু এমন কি হতে পারে না, সেই VPN প্রদানকারী কোম্পানিই আপনার তথ্য চুরি করা শুরু করলো? কিংবা আপনি অনলাইনে কী কী করছেন, সেগুলো সংরক্ষণ করা শুরু করলো? এমনটা হতেই পারে! কিন্তু সেটা তখনই হবে যখন আপনি একটি অসৎ VPN প্রদানকারী কোম্পানির অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা শুরু করবেন। এখানেও সেই ফ্রি জিনিসের পেছনে ছুটে চলার ব্যাপারটা নিয়ে আসা যায়। আপনি যখন VPN ব্যবহারের জন্য সফটওয়ার খুঁজতে যাবেন, তখন দেখবেন এসব সফটওয়্যারের সংখ্যা অসংখ্য। অনেকগুলো কোম্পানিই বিনামূল্যে সীমাহীন VPN ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে থাকে। আবার অনেককে তাদের VPN সার্ভিস ব্যবহারের জন্য টাকা দিতে হয়। তাই স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে- এসব দেখেই ছুটে চলে যাবেন না। আগে জানার চেষ্টা করুন VPN সার্ভিস প্রদানকারী কতটুকু বিশ্বস্ত। সেজন্য ওয়েবে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করুন, জানার চেষ্টা করুন কোন VPN প্রদানকারী কোম্পানি আপনাকে কী কী সুবিধা দিচ্ছে।
VPN নিঃসন্দেহে ইন্টারনেটে আপনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা বজায় রাখার একটি অন্যতম সেরা মাধ্যম। তবে এমনটা ভাববেন না যে, গোপনীয়তা রক্ষার জন্য VPN-ই একমাত্র পথ। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এর থেকেও অনেক শক্তিশালী অনেক উপায় রয়েছে। টর ব্রাউজার হল তার অন্যতম উদাহরণ। তবে সেটা VPN ব্যবহারের থেকে অনেক বেশি জটিল। তাই সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ একজন ব্যবহারকারীর জন্য VPN ব্যবহার করাই সবথেকে ভালো। তবে যারা একটু অনন্য উচ্চতার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত তাদের জন্য টর ব্রাউজারের খুঁটিনাটি নিয়ে নাহয় হাজির হবো পরবর্তী কোনো লেখা নিয়ে!
ফিচার ইমেজ- Fossbytes.com