ইন্টেল বনাম এএমডি: প্রযুক্তির সবচেয়ে পুরনো দ্বৈরথ

প্রযুক্তির দুনিয়ায় ইন্টেল এক চিরপরিচিত নাম। বিশ্বের প্রথম সফল মাইক্রোপ্রসেসর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেল, যার উদ্ভাবনীয় আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে অনন্য উচ্চতায়, যার হাত ধরে আজকের কম্পিউটিং প্রযুক্তি এক অনন্য জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি তারা পিছিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এএমডির কাছে। দশকের পর দশক ধরে রাজত্ব করে গেলেও এবার রাজত্ব হারাতে বসেছে ইন্টেল। কিন্তু কেন? এএমডির সগৌরবে উত্থান এবং ইন্টেলের পতন নিয়েই কথা হবে আজ।

মাইক্রোপ্রসেসর এবং ইতিহাসে ইন্টেল ও এএমডি

‘ইন্টেল ৪০০৪’ পৃথিবীর প্রথম একক প্রসেসিং ইউনিটবিশিষ্ট মাইক্রোপ্রসেসর, যা ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে ইন্টেল। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে। রবার্ট নয়েস এবং গর্ডন মুর ছিলেন ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানির দুজন ইঞ্জিনিয়ার। সেই বছর ফেয়ারচাইল্ড কোম্পানি থেকে অনেকেই বের হয়ে নিজেদের কোম্পানি তৈরিতে নেমে পড়েছিলেন। এই আলোড়নের কল্যাণেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে ইন্টেল। ফেয়ারচাইল্ড থেকে যারা বেরিয়েছিলেন, তাদের ফেয়ার-চিলড্রেন বলে অভিহিত করা হয়েছিল তখন।

ইন্টেল ৪০০৪; Image Source: Supinfo

এই আলোড়ন থেকে বাদ পড়েননি জেরি স্যান্ডার্সও। সাতজন সহকর্মী নিয়ে ইন্টেল প্রতিষ্ঠার ১০ মাস পরেই তিনিও ফেয়ারচাইল্ড থেকে বের হয়ে অ্যাডভান্সড মাইক্রো ডিভাইসেস (Advanced Micro Devices) বা AMD প্রতিষ্ঠা করেন। এখন এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা উল্লেখ করা যাক।

কোম্পানি হিসেবে এএমডি ও ইন্টেল দুটি ভিন্ন ধাঁচের। ইন্টেলের চেয়ে এএমডি পরিসরে অনেক ছোট কোম্পানি। এএমডি নিজেদের চিপ নিজেরা তৈরি করে না, তারা শুধু ডিজাইন করে। ম্যানুফ্যাকচার করে TSMC এর মতো থার্ড পার্টি কোম্পানিগুলো। কিন্তু ইন্টেলের রয়েছে ডজনেরও বেশি নিজস্ব ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট, যেগুলোর অধিকাংশ আমেরিকা, চীন, ইসরায়েল ও আয়ারল্যান্ডে অবস্থিত।

অনেকেরই মনে হতে পারে, এএমডির নামই তো শুনলাম কয়েকদিন আগে। এতদিন কোথায় ছিল এরা, এখন কোথা থেকেই বা আসলো। আসলে, প্রসেসরের রেসে এএমডি কখনোই ইন্টেলকে টেক্কা দেয়ার মতো প্রতিযোগী ছিল না। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি দিয়ে ইন্টেল এমনভাবে তাদের প্রসেসরকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল যে, এএমডি ইন্টেলের তুলনায় কয়েক প্রজন্ম পিছিয়ে পড়েছিল। ১৯৭৪ সালে ইন্টেল তাদের ৮০৮০ প্রসেসর বাজারে ছাড়ে। x86 আর্কিটেকচারের (প্রসেসর আর্কিটেকচার বলতে বোঝায়, প্রসেসরের ডিজাইন এবং ইন্সট্রাকশন সেট, অর্থাৎ কীভাবে প্রসেসরটি কাজ করবে) এই প্রসেসর ডেস্কটপ কম্পিউটিংয়ের ভিত্তি স্থাপন করে। প্রায় ৩০ বছর এই প্লাটফর্মের চিপ বাজার তার অস্তিত্ব ধরে রাখে।

বাঁ থেকে গর্ডন মুর, রবার্ট নয়েস ও জেরি স্যান্ডার্স; Image Source: wccftech

পরবর্তীতে x86 বা ৩২ বিটের এই প্লাটফর্মের চিপকে ইন্টেল তাদের পেন্টিয়াম সিরিজের অন্তর্ভুক্ত করে, যা প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর থেকে তারা তাদের চিন্তাধারা আরো বিস্তৃত করে। একনজরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইন্টেল প্রসেসরের টাইমলাইন দেখে নেয়া যাক।

  • ১৯৭১: পৃথিবীর প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর প্রবর্তন। ইন্টেল ৪০০৪।
  • ১৯৭৪: ইন্টেল ৮০৮০। প্রথম ডেস্কটপ কম্পিউটার চিপ।
  • ১৯৭৮: ইন্টেল ৮০৮৬। প্রথম ১৬ বিট প্রসেসর।
  • ১৯৮২: নতুন সিরিজ ইন্টেল ২৮৬ উন্মোচন। কিন্তু বিল গেটস একে ব্রেইন ডেড চিপ বলে আখ্যায়িত করেন। কারণ, এটি একের অধিক ডস এপ্লিকেশন চালাতে পারতো না।
  • ১৯৮৯: প্রথম প্রসেসর, যার ট্রানজিস্টর সংখ্যা ছিল ১০ লাখের অধিক।
  • ১৯৯৩:  জনপ্রিয় পেন্টিয়াম সিরিজের প্রবর্তন। ৩২ বিটের এই প্রসেসরে ট্রানজিস্টর সংখ্যা ছিল ৩০ লাখের বেশি। এরপর থেকেই প্রতিটি প্রসেসরকে একেকটি সিরিজের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
  • ১৯৯৫: সার্ভার এবং ওয়ার্ক-স্টেশনের জন্য প্রথম প্রসেসর বের করে, যার নাম ছিল পেন্টিয়াম প্রো। এটিই সর্বপ্রথম সুপার কম্পিউটারে এক টেরাফ্লপ অতিক্রম করে।
  • ১৯৯৮: ইন্টেল সেলেরন সিরিজ উন্মোচন। নিম্ন বাজেটের মার্কেটে এএমডি-কে টেক্কা দেয়ার জন্যই এই সিরিজ বের করে ইন্টেল।
  • ২০০০: ইন্টেল পেন্টিয়াম ৪। সকল একক চিপের প্রসেসরকে এই সিরিজ এর অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই প্রসেসরের মাধ্যমে, যেগুলো ডেস্কটপ থেকে শুরু করে ল্যাপটপেও ব্যবহার হতে থাকে।
  • ২০০১: Xeon ব্রান্ড উন্মোচন। একে সার্ভার, ওয়ার্ক-স্টেশনের জন্য আলাদা করে তৈরি করা হয়।
  • ২০০৬: Intel core solo and Duo বের করা হয়। এটি ইন্টেলের সর্বপ্রথম দুই কোরের মোবাইল, অর্থাৎ ল্যাপটপ বা নোটবুকে ব্যবহারের প্রসেসর। এটি প্রথম ম্যাকবুকে ব্যবহার করা হয়।
  • ২০০৭: এই সাল থেকে ইন্টেল টিকটক প্রসেসর মডেল প্রবর্তন করে। টিক দ্বারা বোঝানো হয় নতুন ম্যানুফ্যাকচার প্রযুক্তির প্রসেসর তৈরি হবে সেই বছর, আর টক দিয়ে বোঝানো হয় নতুন মাইক্রো আর্কিটেকচার।
  • ২০০৮:  Intel Core i7 সিরিজ চালু। এটি টার্গেট করা হয় ব্যবসায়িক এবং গেমিং এর জন্য। কোর ডুও এর সাকসেসর বলা হয় একে। বর্তমানে এর কোর সংখ্যা ৪ থেকে ১০টি হতে পারে ।
  • ২০০৯:  Intel core i5 সিরিজ চালু। Turbo boost technology এর উদ্ভাবন যা প্রয়োজন মাফিক পারফরমেন্স দিতে সক্ষম । এই সিরিজকে অনেকটা মধ্যবিত্তের সিরিজ বলা যায়।
  • ২০১০: Intel core i3 সিরিজ, যা এন্ট্রি লেভেল সিরিজ নামে পরিচিত। এটি এন্ট্রি লেভেলের ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপের জন্য তৈরি করা হয়।  
  • ২০১৭: ২০১০ থেকে টিকটক নিয়মেই চলতে থাকে ইন্টেল। প্রতি বছর নতুন নতুন ফিচার এবং উন্নত পারফরমেন্স সম্বলিত প্রসেসর বের করে তারা। এই সালে প্রযুক্তিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে Core i9 সিরিজ বের করে ইন্টেল। এই সিরিজটি মূলত কম্পিউটারে উদ্যমশীল ব্যক্তি বর্গের জন্য যারা তাদের সিস্টেমকে সর্বোচ্চ লেভেলের প্রযুক্তি দিয়ে মাতিয়ে রাখতে চান।

এএমডির পথচলা

ইন্টেল সম্পর্কে বলা হলো অনেক। এবার এএমডি নিয়ে বলা যাক। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও তখন থেকেই তারা প্রসেসর নির্মাণ করা শুরু করেনি। প্রথমদিকে রেজিস্টার এবং কাউন্টার জাতীয় প্রোডাক্ট তৈরি করে তারা, এবং ১৯৭২ সালে পাবলিক কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৫ সালে এএমডি নিজেদের প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর AM9080 বের করে। ইন্টেলের প্রসেসরকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে তারা এটি বের করে। পরবর্তীতে ইন্টেল এবং এএমডির মধ্যে একটি চুক্তি হয়- এএমডি ইন্টেলের ডিজাইনকৃত প্রসেসর ম্যানুফেকচার করতে পারবে। এতে যেমন তাদের ব্যবসায়িক লাভ হয়, তেমনি প্রযুক্তিগত দিক থেকেও সুবিধা লাভ করে। আরও অনেক দিন পর ইন্টেল তাদের x86 আর্কিটেকচার এএমডির কাছে লাইসেন্স করে দেয়, যার ফলে আইবিএম কোম্পানির জন্য এএমডি নিজেদের ডিজাইন এবং ম্যানুফ্যাকচারকৃত প্রসেসর তৈরি করা শুরু করে।

সান্টা ক্লারা, ক্যালিফোর্নিয়াতে এএমডির হেডকোয়ার্টার; Image Source: Britannica

লাইসেন্স পাওয়া সত্ত্বেও এএমডি থেকে ইন্টেল অনেক এগিয়ে ছিল তাদের প্রযুক্তিগত প্রাধান্যের দিক দিয়ে। ১৯৯৬ সালে এএমডি তাদের নিজস্ব ডিজাইনকৃত K5 প্রসেসর রিলিজ করে, যা ইন্টেলের প্রথম জেনারেশন পেন্টিয়ামের সাথে প্রতিযোগিতা করে। এর পরের বছরই তারা k6 প্রসেসর বাজারে ছাড়ে, যা তাদের প্রসেসর দুনিয়ায় নাম-যশ এনে দেয়। এই প্রসেসর সিরিজগুলোর একটি ফিচার ছিল ফ্লোটিং পয়েন্ট ক্যাপাবিলিটি, যা প্রসেসরের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিচার ছিল। এএমডি ইন্টেলের সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য বরাবরই তাদের প্রসেসরের দাম ইন্টেলের তুলনায় কম রাখত, যার ফলে এএমডির K6-2 চিপটি ইন্টেলের পেন্টিয়াম ২ এবং ৩ এর সাথে প্রতিযোগিতা করে ৭০ ভাগেরও বেশি মার্কেট দখল করে নেয় ১৯৯৮ সালের দিকে। ১৯৯৯ সালে এএমডি তাদের Athlon সিরিজ বের করে, যা ইন্টেলের পেন্টিয়াম ৩-এর চেয়েও বেশি দ্রুত কাজ করতে পারত। এর পরের বছরগুলোতে এএমডি নিশ্চুপ থাকলেও ২০০৩ সালে তারা প্রসেসর জগতে বিশাল এক অগ্রযাত্রা বয়ে আনে।

৬৪ বিটের আর্কিটেকচার; Athlon 64 প্রসেসর দ্বারা তারা এটি প্রকাশ করে। ইন্টেলকে হারিয়ে তারা প্রথম ৬৪ বিট ডেস্কটপ প্রসেসর নির্মাতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এবার পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় আবার, শুধু এবার ইন্টেল এএমডির কাছে থেকে তাদের ৬৪ বিটের আর্কিটেকচার লাইসেন্স করে নেয়। যা ইন্টেলের জন্যেও সুখকর কোনো মুহূর্ত ছিল না। এজন্য ৩২ বিটের ক্ষেত্রে ইন্টেলের i386 এবং ৬৪ বিটের ক্ষেত্রে amd64 টার্ম দুই কোম্পানিকেই ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে ৬৪ বিটের প্রসেসরের পরিসর বৃদ্ধিতে এএমডির টার্মই বেশি ব্যবহার হয়।

Athlon 64 ও ৩২ এবং ৬৪ বিটের মধ্যে কিছু পার্থক্য; Image Source: Windows club

২০০৫ সালে এএমডি প্রসেসর জগতে আবার নতুন প্রযুক্তি দিয়ে নিজেদের খ্যাতি ছড়িয়ে দেয়। Athlon X2 প্রসেসর দিয়ে তারা মাল্টিকোর, অর্থাৎ একের অধিক চিপ দিয়ে তৈরি প্রসেসরের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, যার বর্তমান জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। কিন্তু এরপরেই তাদের ব্যবসায় ধস নামে। ইন্টেল তাদের বুদ্ধি এবং মার্কেটিংয়ের ফলে দ্রুতই এগিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু এএমডি বাজে সিদ্ধান্তের কারণে পিছিয়ে পড়ে। ইন্টেলের মতো এএমডিরও নিজস্ব ম্যানুফ্যাকচার ল্যাব ছিল। কিন্তু সেগুলোর বাজে ব্যবসার কারণে তাদের পক্ষে আর তদারকি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, ফলে তারা ল্যাবগুলো বিক্রি করে দেয়। বর্তমানে তাদের নিজস্ব ল্যাব নেই বললেই চলে। এএমডির লক্ষ্য ছিল অধিক কোর সম্বলিত প্রসেসর তৈরি করে বাজারে ফিরে আসা, কিন্তু ইন্টেল সিঙ্গেল কোর এবং মাল্টিকোর পারফরমেন্সে আরও এগিয়ে যেতে থাকে। এএমডির PhenomX4 এবং FX সিরিজ এর মাঝে কিছু জনপ্রিয়তা লাভ করে ।

জেন আর্কিটেকচার; Image Source: Wccftech

এরই ধারাবাহিকতায় এএমডি তাদের সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি ZEN আর্কিটেকচার প্রকাশ করে, যা কোম্পানির ভবিষ্যতের নতুন দুয়ার খুলে দেয় আর ইন্টেলকে ধরাশায়ী করে ফেলে।

রাইজেন এবং এএমডির উত্থান

২০১৭ সালে এএমডি তাদের রাইজেন সিরিজ বাজারে ছাড়ে। ইন্টেলের সিরিজগুলোর সাথে মিল রেখে তারা বের করে রাইজেন ৩, রাইজেন ৫ ও রাইজেন ৭। এগুলোর কোর সংখ্যাও ইন্টেলের আই ৩, ৫ ও আই ৭ এর সাথে মিল ছিল। রাইজেন এএমডির সম্পূর্ণ নতুনভাবে ডিজাইন করা প্রসেসর, যার সিঙ্গেল কোর এবং মাল্টিকোর পারফরমেন্স আগের এফ এক্স সিরিজের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। ১৪ ন্যানোমিটার প্রযুক্তিতে তৈরি এই প্রসেসর ইন্টেলের সর্বোচ্চ প্রসেসর লাইন আপ অর্থাৎ আই ৭ এর প্রতিযোগী হয়ে ওঠে, যা দশক ধরে ইন্টেল একাই রাজত্ব করছিল।

প্রসেসর এরিয়া ন্যানোমিটারে; Image Source: Anand Tech

সাধারণ ইউজার, গেমার এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটর- এই তিন ভাগের মানুষদের লক্ষ্য করে প্রসেসর তৈরি করা হয়। সাধারণ ইউজারদের প্রসেসর নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে হয় না। কারণ মোটামুটি একটি প্রসেসর সব সাধারণ কাজ, যেমন- টাইপিং, ফেসবুকিং, ইউটিউব ইত্যাদি খুব ভালোভাবে করতে পারে। কিন্তু গেমারদের প্রয়োজন কোর সিঙ্গেল থ্রেডে বেশি পারফর্মেন্স, আর ক্রিয়েটরদের প্রয়োজন মাল্টিকোর পারফর্মেন্স। ইন্টেল প্রসেসরগুলোর সিঙ্গেল কোর পারফর্মেন্স বরাবরই ভালো ছিল এবং দীর্ঘদিন রাজত্ব করায় গেমিং ইন্ডাস্ট্রিতে ইন্টেলের প্রসেসরকে লক্ষ্য করে গেমগুলো অপ্টিমাইজ করা হতো। কিন্তু জেন সিরিজে নতুন করে এএমডি সিঙ্গেল কোর পারফর্মেন্স উন্নতির দিকে মনোযোগ দেয়, আর মাল্টিকোর নিয়ে তারা আগে থেকেই অনেক এগিয়ে থাকার ফলে এই নতুন প্রসেসরগুলোর মাল্টিকোর পারফর্মেন্সও ইন্টেলের প্রসেসরগুলোকে ছাড়িয়ে যায়।

এএমডির আরেকটি আকর্ষণীয় দিক ছিল তাদের প্রোডাক্টের দাম। প্রতিযোগিতায় টিকতে তারা তাদের প্রসেসরের দাম ইন্টেলের তুলনায় কম রাখতো। রাইজেন আসার আগে টপ টিয়ারের প্রসেসর লাইনআপগুলোয় ইন্টেল একচেটিয়া ছিল। ফলে প্রসেসরগুলোর দাম অনেক বেশি ছিল। রাইজেনের সহজলভ্যতা ও পারফর্মেন্সের জন্য খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে ইন্টেলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় এএমডির ZEN 2 আর্কিটেকচার। ৭ ন্যানোমিটার প্রযুক্তিতে তৈরি এই প্রসেসরগুলো ক্রিয়েটর এবং গেমারদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১৯ এর জুলাইয়ে রাইজেন ৯ উন্মোচন করে এএমডি, যার বেজ মডেলের কোর সংখ্যা ইন্টেলের আই ৯ এর সর্বোচ্চ মডেলকেও ছাড়িয়ে যায়।  

পারফরমেন্সে ইন্টেল ও এএমডির টপ লাইনাপ; Image Source: Tweak Town

ওয়ার্কস্টেশনের জন্য ইন্টেল তাদের XEON প্রসেসর তৈরি করতো, কিন্তু কোর সংখ্যা হিসেবে এই প্রসেসরগুলোর দাম ছিল আকাশছোঁয়া। এএমডি তাদের টেক্কা দেয়ার জন্য বাজারে ছাড়ে EPYC সিরিজ। এদের কোর সংখ্যা ইন্টেলের Xeon এর থেকে ৩ গুনেরও বেশি এবং দাম ছিল ইন্টেলের চেয়ে ৩ গুন কম।

এএমডির সার্ভার প্রসেসরের রোডম্যাপ; Image Source: AMD

এএমডি প্রথম ডেস্কটপ এবং ওয়ার্কস্টেশনের মাঝে নতুন এক সিরিজ বাজারে ছাড়ে। এগুলোকে বলা হয় HEDT (High End Desktop) প্রসেসর। রাইজেন থ্রেডরিপার তাদের HEDT সিরিজের প্রসেসর। ২৮, ৩২ ও ৬৪ কোরের এই প্রসেসরগুলো একদম উচ্চ পর্যায়ের ক্রিয়েটরদের জন্য। উল্লেখ্য, থ্রেডরিপারের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো ইন্টেলের কোনো প্রসেসর নেই। এএমডি যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে অতি শীঘ্রই তাদের মার্কেট শেয়ার ইন্টেলের তুলনায় বেড়ে যাবে। এক রিপোর্টে জানা গিয়েছে, ইন্টেলের পুরো লাইনআপের চেয়ে Ryzen 5 3600 প্রসেসরটি বেশি বিক্রি হয়েছে।

প্রসেসর বিক্রির পরিমাণ ,এপ্রিল ২০১৮ থেকে মে ২০১৯; Image Source: Mindfactory

এতকিছুর পরেও ইন্টেল এখনও রাজা। কারণ, এএমডির সর্বশেষ হাই এন্ড প্রসেসর রিলিজ হয় ২০১২ সালে। আর প্রতি বছর নতুন প্রসেসর বাজারে ছেড়ে ইন্টেল প্রায় পুরো সিপিইউ মার্কেট দখল করে নেয়। পাস মার্ক অনুযায়ী, রাইজেনের পর এএমডির মার্কেট শেয়ার এখন ৪০ শতাংশ ছুঁই-ছুঁই। সর্বশেষ ২০০৬ সালে এই মার্কেট শেয়ার ছিল তাদের, যা ২০১৬-তে এএমডির ছিল ১৮ শতাংশ।

রাইজেনের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। ইন্টেলের মার্কেট শেয়ারের একটি বড় অংশ আসে ল্যাপটপ থেকে। এ বছর রাইজেন ৪০০০ সিরিজকে ল্যাপটপে দেখা যাবে, যেগুলোর পারফরমেন্স ইন্টেলের ডেস্কটপ প্রসেসরের চেয়েও বেশি বলে এএমডি দাবি করছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে ইন্টেলের জন্য সামনে আরও বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছে। 

আসন্ন রাইজেন ৪০০০ সিরিজ; Image Source: AMD

৫০ বছরের ইতিহাসকে তুলে ধরতে হলে বিশাল বড় লেখনীর প্রয়োজন। আপাতত এতটুকুই। তবে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ ভোক্তাদের জন্য ভালো দিক। এতে দাম অনুযায়ী ভালো জিনিস পাওয়া যায়। এএমডির চাপে ইন্টেলও তাদের পণ্যের দাম কমিয়ে এনেছে। এতে সুবিধা হচ্ছে সাধারণ জনগণেরই, সে যে-ই হোক- ইন্টেল কিংবা এএমডির ফ্যান!

Related Articles

Exit mobile version