অগমেন্টেড রিয়েলিটি কী, তা জানার আগে চলুন একটু কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে আসা যাক। ধরুন, অচেনা কোনো এক স্থানে ঘুরতে গেলেন গাড়িতে করে। আপনি ড্রাইভ করার সময় চোখের ইশারাতেই আপনার সামনে ভেসে উঠছে রাস্তা কিংবা আশেপাশের বিভিন্ন তথ্য। কখনও কখনও আপনি চাইলেই ইশারায় শুনে নিতে পারছেন দরকারি বিভিন্ন নির্দেশনা, যেমন- আজকের দিনের সম্ভাব্য আবহাওয়ার তথ্য। রাস্তায় জ্যাম থাকলে আপনার সামনে চলে আসছে শর্টকাট পথের নেভিগেশন, যা আপনার জন্য নিরাপদ এবং সময় সাশ্রয়ী। কিংবা যাবার পথে খাবার জন্য হোটেল খুঁজছেন? রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ই আপনি আপনার স্মার্টফোনটি বিল্ডিংগুলোর দিকে তাক করাতেই সেগুলোর ট্যাগ আপনার ফোনে স্ক্রিনে উঠে বলে দিচ্ছে, কোন বিল্ডিংটি কীসের আর সেটির কোনো বিখ্যাত ইতিহাস আছে কিনা। সাথে সাথে আপনি জেনে নিতে পারছেন আশেপাশে কোনো হোটেল থাকলে।
কিংবা ধরুন আপনি একজন শিক্ষার্থী, পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের লেখাগুলো একঘেয়ে লাগছে? বুঝতে সমস্যা হচ্ছে? তাহলে একটু মজা করে পড়া যাক। চোখের সামনেই বইয়ের উপরেই বইয়ের সব তথ্যের উপর ভিত্তি করে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে আপনার কাছে পুরো ব্যাপারটি স্পষ্ট করে দেওয়া হলো, মনে হবে যেন তা বাস্তবেই হচ্ছে। কিংবা গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন আর টিভি সেটে যেভাবে স্কোর দেখানো হয় আপনি ঠিক সেভাবেই আপনার সামনে সেই স্কোর বোর্ডটি দেখতে পাচ্ছেন, যা প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে খেলার সাথে সাথে।
এতক্ষণ যেসব কল্পনা করলেন তার মধ্যে কিন্তু একটি ব্যাপার ছিল, তা হলো বাস্তব জগতের সাথে ভার্চুয়াল জগতের সংমিশ্রণ। আর এটিই হলো অগেমেন্টেড রিয়েলিটি। একসময় যা কেবল বিজ্ঞান কল্পগল্পেই সীমাবদ্ধ ছিল, আজ প্রযুক্তির বদৌলতে তা বাস্তব। অগমেন্টেড রিয়েলিটির ইতিবৃত্ত নিয়েই আজকের লেখা।
অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR)
অগমেন্টেড রিয়েলিটি হলো এমন এক প্রযুক্তি, যাকে বাস্তব জগতের এক বর্ধিত সংস্করণ বলা যেতে পারে। আপনি বাস্তবে যা দেখবেন, তার উপর কম্পিউটার নির্মিত একটি স্তর যুক্ত করে দেবে অগমেন্টেড রিয়েলিটি। আর তখন সেই বাস্তব এবং ভার্চুয়ালের সংমিশ্রণে তৈরি হবে এক নতুন অনুভূতি, সব কিছুকে এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা। ‘Augmented Reality’ শব্দগুচ্ছের মূল শব্দ হলো ‘Augment’, যার অর্থ হলো কোনো কিছু যুক্ত করা। মূলত বাস্তবিক পরিবেশের সাথে যে কম্পিউটার নির্মিত ভার্চুয়াল স্তর যুক্ত করা হয়, এখানে তা-ই বোঝানো হয়েছে। আপনি যা দেখতে চাইবেন, আপনার চাহিদা অনুযায়ী আপনাকে তা-ই দেখাবে অগমেন্টেড রিয়েলিটি। শুধু কম্পিউটার নির্মিত চিত্রই নয়, এতে থাকতে পারে শব্দ, ভিডিও, গ্রাফিক্স, স্পর্শ করার অনুভূতি, এমনকি জিপিএস ডাটাও! এটি অনেকটা Computer Mediated Reality এর মতো, কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশি উন্নত। CMR-এ বাস্তব বিষয়কে কম্পিউটারের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয় ‘অগমেন্ট’ করার বদলে। এবার একটু দেখে আসা যাক ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আর অগমেন্টেড রিয়েলিটির মধ্যে বোঝাপড়াটা কেমন!
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) বনাম অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR)
বিগত বছর দুয়েক ধরে যেসব প্রযুক্তি বেশ সাড়া ফেলেছে পৃথিবীতে, তার মধ্যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ছিল শীর্ষে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহারকারীকে নিয়ে যাবে সম্পূর্ণ আলাদা জগতে, যা তৈরি করা হয় কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে। হতে পারে তা কোনো বাস্তব জগতের বিশেষ কোনো স্থানে, কিংবা হতে পারে তা কাল্পনিক জগতের জুরাসিক পৃথিবী অথবা পৃথিবীর বাইরে ভিন্ন কোনো গ্রহে। এর সাথে আপনার বাস্তব অবস্থানের কোনো মিল থাকবে না। এই জগৎ তৈরি করা হয় কম্পিউটার গ্রাফিক্স, সাউন্ড এবং অন্যান্য উপাদান যোগ করে, যাতে আপনি বাস্তব জগতের মতোই স্বাদ পান। মূলত ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আপনার মস্তিষ্ককে ধোঁকা দিয়ে আপনাকে ভার্চুয়াল জগতের আনন্দ নিতে সাহায্য করে। বাস্তবে আপনি পৃথিবীতে থাকলেও আপনার মনে হবে যেন সেই ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করছেন। ভিআর হেডসেটেই থাকে এ কাজের জন্য সকল প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ভিত্তি যেখানে পুরোটাই ভার্চুয়াল তথ্য কেন্দ্রিক, সেখানে অগমেন্টেড রিয়েলিটির ভিত্তি হলো প্রাকৃতিক পরিবেশ আর ভার্চুয়াল তথ্য দুটোই। ওদিকে অগমেন্টেড রিয়েলিটি তৈরিতে অনেক বাড়তি প্রযুক্তিগত সুবিধা পাওয়া যায়। আর এই বৈশিষ্ট্যই এআর-কে এনে দিয়েছে এক অনন্য রূপ। এর সাহায্যে বাস্তব জগতের সাথে আপনি আরো গভীরভাবে প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ পাবেন। ভয়েস কমান্ডের মতো সাধারণ কাজ থেকে শুরু করে এআর-কে মানুষের শরীরে জটিল অস্ত্রোপচারের মতো জটিল কাজেও ব্যবহার করা যায়।
কীভাবে কাজ করে এআর
এআর দেখতে যতটা সরল, এর কার্যপদ্ধতি কিন্তু ঠিক ততটাই কঠিন। এআর প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা হয় উচ্চ গতির প্রসেসর, ডিসপ্লে গ্লাস, অডিও ইনপুট-আউটপুট ডিভাইস, জিপিএস, বিভিন্ন ধরনের মোশন সেন্সর, ক্যামেরা ইত্যাদি। গ্লাস ছাড়াও যেকোনো ধরনের ডিসপ্লে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় এতে। অগমেন্টেড রিয়েলিটির জন্য হেডসেট থাকলেও এই প্রযুক্তিগুলো স্মার্টফোনেও থাকে বলে এআর-কে স্মার্টফোনেও ব্যবহার করা যায়। সম্প্রতি বাজারে আসা আইফোন ৮ এবং আইফোন ১০ এ এআর ব্যবহার করার সুবিধা আছে। এআর-এর জন্য দরকার হয় Real Time Data, যার ফলে আপনি বাস্তব পরিবেশের সাথে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করতে পারেন।
একটি এআর ডিভাইসের বাইরে থাকে সাধারণত সেন্সর এবং ক্যামেরা। সেন্সর আপনার চারপাশের পরিবেশ থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করবে, যেমন- আপনার নড়াচড়া, শব্দ, আলো এসব। আর বাস্তব জগতের চিত্রায়িত তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ক্যামেরা প্রধান ভূমিকা পালন করে। অগমেন্টেশনের জন্য ছবি তোলা কিংবা ভিডিও ধারণ করার মতো কাজগুলো করে ক্যামেরা।
যেসব এআর ডিভাইসে প্রোজেক্টর ব্যবহার করা হয়, সেগুলো যেকোনো তলকেই ‘ইন্টারএ্যাক্টিভ স্ক্রিন’ বানিয়ে ফেলতে সম্ভব। আপনার হাতের ‘ডাটা গ্লাভস’ থেকে সেটি ইনপুট গ্রহণ করে প্রসেস করবে সেক্ষেত্রে।
এখন কথা হলো, এত এত ডাটা যায় কোথায়! আসলে প্রতিটি এআর ডিভাইস হলো একেকটি কম্পিউটার। আর তাই ডাটা প্রোসেস করার জন্যে আছে প্রসেসর, RAM, মেমোরি প্রভৃতি। ব্যবহারকারীর কাছ থেকে ডাটা নিয়ে সেগুলোকে নির্দিষ্ট কিছু অ্যালগরিদমের ভিত্তিতে তৈরি সফটওয়্যার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর এই কাজগুলোর জন্যই দরকার হয় উচ্চগতির প্রসেসর। যতই দিন যাবে, আকারে ছোট হয়ে আসবে এই প্রযুক্তি। আপনার প্রতিটি নড়াচড়া ট্র্যাক করে সেন্সর। ফলে ইশারা করলেই আপনার ইশারা বুঝে সে অনুযায়ী কাজ করবে এআর। বাস্তব জগতের সাথে সে অনুযায়ী মিলিয়ে এটি তথ্য তুলে ধরবে আপনার সামনে।
অগমেন্টেড রিয়েলিটির ক্রমিক ইতিহাস
আধুনিক এআর প্রযুক্তির আধুনিক ধারণাটা কিন্তু এসেছিল সেই ১৯০০ সালের দিকেই। The Wonderful Wizard of Oz এর লেখক L. Frank Baum ১৯০১ সালে একটি ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে স্ক্রিনের ধারণা দেন, যাতে বিভিন্ন তথ্য বাস্তব পরিবেশের সাথে মিশ্রিত হয়ে পরিবেশিত হবে। ১৯৬৮ সালে প্রথম হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে তৈরি করেন Ivan Sutherland। এরপর ১৯৮০ সালে প্রথম শরীরে সংযুক্ত করা যায় এমন কম্পিউটার তৈরি করেন Steve Mann, যেটি ছিল একটি কম্পিউটার ভিশন সিস্টেম। এতে ব্যবহৃত হয়েছিল টেক্সট এবং গ্রাফিক্স নির্মিত পরিবেশ। ১৯৯৯ সালে সাবেক বোয়িং গবেষক Thomas P. Caudell সর্বপ্রথম ‘অগমেন্টেড রিয়েলিটি’ শব্দগুচ্ছটি প্রকাশ করেন। কিন্তু অগমেন্টেড রিয়েলিটির পথচলা শুরু হয় মার্কিন বিমান বাহিনীর আর্মস্ট্রং ল্যাব এর হাত ধরে। ১৯৯২ সালে Louis Rosenberg একটি এআর সিস্টেম তৈরি করেন, এর নাম দেওয়া হয়েছিল Virtual Fixtures। এতে ব্যবহার করা হয়েছিল ফুল আপার বডি এক্সোস্কেলিটন, যেটা ব্যবহারকারীকে পরানো হত কন্ট্রোল করার জন্য আর ছিল দুটি রোবোটিক আর্ম এবং আইগ্লাস।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালে এমআইটি মিডিয়া ল্যাব এর ফ্লুইড ইন্টারফেয়ার গ্রুপের হয়ে একটি এআর গ্যাজেট তৈরি করেন প্যাটি মেইজ এবং প্রণব মিস্ত্রী মিলে। তারা এর নাম দিয়েছিলেন SixthSense। এতে ব্যবহার করা হয়েছিল ক্যামেরা, ছোট প্রজেক্টর, স্মার্টফোন, আয়না এবং আঙুলের জন্য বিশেষ ক্যাপ। এর একটি বিশেষত্ব ছিল, তা হলো এটি যেকোনো সারফেসকে ইন্টারএ্যাক্টিভ স্ক্রিন বানিয়ে কাজ করার সুবিধা দিত। কিন্তু ২০১৩ সালে গুগল গ্লাস বাজারে আসার পর মানুষের মাঝে এআর নিয়ে সাড়া পড়ে যায়। গুগল গ্লাস ব্যবহারকারীর কথা, স্পর্শ বা মাথার নড়াচড়াতে সাড়া দিতে সক্ষম ছিল। এটি দেখতে ছিল অনেকটা সাধারণ ফ্রেমের চশমার মতো। বেশ সাড়া ফেললেও বাণিজ্যিকভাবে তেমনটা সফল না হওয়াতে সেটি উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং এর আরো উন্নত ভার্শনের জন্য কাজ শুরু করে গুগল।
২০১৬ সালের মার্চে মাইক্রোসফট বাজারে আনে HoloLens, যা ছিল গুগল গ্লাসের চেয়ে উন্নত ও সফল ডিভাইস। এটি ছিল উইন্ডোজ টেন ভিত্তিক ‘মিক্সড রিয়েলিটি ডিভাইস’। এছাড়াও ২০১৬ সালে ব্যাপক সাড়া ফেলে Pokemon Go গেমটি। একে অনেক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ অগমেন্টেড রিয়েলিটির একটি ট্রেলার বলে উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, অগমেন্টেড রিয়েলিটি কেমন হতে পারে, তার আভাস রয়েছে এতে। কিন্তু একে পুরোপুরিভাবে অগমেন্টেড রিয়েলিটির উদাহরণ বলা যায় না।
এআর প্রযুক্তি পাল্টে দিতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ। চিকিৎসা, শিক্ষা, যোগাযোগ, নিরাপত্তা, কনফারেন্স, ডিজাইনিং, বিনোদন সব ক্ষেত্রেই আছে এর ব্যাপক চাহিদা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এআর অন্যান্য সব প্রযুক্তির জায়গা দখল করে নিতে পারে। সাথে সাথে এটি আমাদের জন্য খুলে দিতে পারে অপার সম্ভাবনার দ্বার। যদিও এই প্রযুক্তি এখনো সেভাবে বিস্তার লাভ করেনি, অভাব রয়েছে এআর উপযোগী কনটেন্টের। তবে গুগল, ফেসবুক কিংবা মাইক্রোসফটের মতো বড় বড় কোম্পানি বসে নেই। এই খাতে বিনিয়োগ শুরু করেছে তারা। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এআর হবে আমাদের নিত্য সঙ্গী। কিন্তু মানুষ কতটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে এই প্রযুক্তিকে, সেটিই মূলত ভাববার বিষয়।