অটোমোবাইল শিল্পের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। এ শিল্পের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে ইতিহাস বই ধরে চলে যেতে হয় অনেকটা পেছনে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বর্তমানে বিলিয়ন ডলারের এ শিল্পের সূচনা কোনো একক ব্যক্তির হাত ধরে ঘটেনি। বরং বিভিন্ন উৎসুক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল আজকের অটোমোবাইল শিল্প।
প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা অটোমোবাইল শিল্প সাক্ষী হয়ে আছে ছোট-বড় অসংখ্য যুগান্তকারী উদ্ভাবনের। কিন্তু সেসব কিছুই তো আর এক লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই আজকের লেখায় অটোমোবাইল শিল্পের পাঁচটি অন্যতম যুগান্তকারী উদ্ভাবন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
১. স্টিম ইঞ্জিন
আধুনিক অটোমোবাইলের যাত্রা শুরু হয় মূলত স্টিম ইঞ্জিন উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে। শিল্প বিপ্লবের অন্যতম প্রধান প্রাপ্তি এই স্টিম ইঞ্জিনই পরবর্তীকালে অটোমোবাইল শিল্পকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে আজকের অবস্থানে। বাষ্পীয় চাপ থেকে সৃষ্ট শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সিলিন্ডারের অভ্যন্তরে থাকা একটি পিস্টনকে চালনা করা হয় এ ইঞ্জিনে।
১৬৯৮ সালে থমাস স্যাভেরি নামক একজন ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার বাষ্পীয় চাপকে কাজে লাগিয়ে একটি পানির পাম্প উদ্ভাবন করেন। এর ১৪ বছর পর থমাস নিউকোমেন নামের আরেকজন ইংরেজ উদ্ভাবক প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি করতে সক্ষম হন। তবে নিউকোমের তৈরি ইঞ্জিনটিতে অনেক বেশি শক্তির অপচয় হতো এবং এটি ঠাণ্ডা রাখতে প্রচুর পানি লাগত। পরবর্তীকালে ১৭৭৫ সালে জেমস্ ওয়াট নিউকোমের ইঞ্জিনটির উন্নতি সাধন করে একে আরও নির্ভরযোগ্য করে তোলেন।
অটোমোবাইলে ব্যবহারের পূর্বে প্রাথমিকভাবে ট্রেন এবং জাহাজের ইঞ্জিন হিসেবে অভিষেক ঘটে স্টিম ইঞ্জিনের। পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ধীরে ধীরে স্টিম চালিত অটোমোবাইলের প্রচলন ঘটে এবং একসময় এসব গাড়ি দখল করে নেয় ইউরোপ ও আমেরিকার রাস্তাঘাট।
তবে স্টিম চালিত গাড়ির বেশ কিছু অসুবিধা ছিল, যেমন- উচ্চ শব্দ, ধোঁয়া নিঃসরণ, বিশালাকৃতি ইত্যাদি। এসব সমস্যার কারণে অটোমোবাইলে স্টিম ইঞ্জিনের বিকল্প কিছু একটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বিকল্প হিসেবে একসময় আবির্ভূত হয় অপেক্ষাকৃত সস্তা, উন্নত ও কার্যকরী অন্তর্দহন ইঞ্জিন। ফলে আস্তে আস্তে স্টিম ইঞ্জিনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসে এবং একসময় অটোমোবাইল থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যায় এ ধরনের বাষ্প চালিত ইঞ্জিন।
২. সিটবেল্ট এবং এয়ারব্যাগ
বর্তমান পরিবহনগুলোতে যাত্রী নিরাপত্তার জন্য অন্যতম দু’টি অপরিহার্য উপাদান সিটবেল্ট ও এয়ারব্যাগ। অটোমোবাইলের ইতিহাসে শুধুমাত্র এই দু’টি উদ্ভাবনের কারণে যত মানুষের প্রাণ বেঁচেছে, অন্য কোনো উদ্ভাবন বা আবিষ্কারের দ্বারা আর তা সম্ভব হয়নি।
পঞ্চাশের দশকের আগে থেকেই বিভিন্ন গাড়িতে টু-পয়েন্ট সিটবেল্টের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেসব সিটবেল্ট শুধুমাত্র শরীরের নিচের অংশকে গাড়ির সাথে আটকে রাখতে পারত। ফলে, দুর্ঘটনার সময় কোমর থেকে উপরের অংশ অরক্ষিতই থেকে যেত।
এ সমস্যার একটি সমাধান বের করেন নীলস বলিন। তিনি ছিলেন ভলভো কোম্পানির একজন সেফটি ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৫৯ সালে তিনি উদ্ভাবন করেন থ্রি-পয়েন্ট সিটবেল্ট এবং এটি সর্বপ্রথম ‘ভলভো পিভি ৫৪৪’ মডেলের একটি গাড়িতে ব্যবহার করা হয়। খুব দ্রুতই বলিনের এই উদ্ভাবন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং আজ অবধি এটি প্রায় সকল প্রকার অটোমোবাইলের একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
থ্রি-পয়েন্ট সিটবেল্ট সিস্টেমে শরীরের নিচের অংশকে আটকে রাখার জন্য রয়েছে একটি ল্যাপবেল্ট বা কোমরবন্ধনী এবং উপরের অংশকে সিটের সাথে ধরে রাখার জন্য রয়েছে অপর একটি আড়াআড়ি বেল্ট। এই সিস্টেমে বেল্টের স্ট্র্যাপগুলো আটকানোর জন্য থাকে মোট তিনটি সংযোগস্থল। তাই এর নাম থ্রি-পয়েন্ট সিটবেল্ট। শুধুমাত্র সিটবেল্ট ব্যবহারের কারণেই আমেরিকাতে প্রতি বছর প্রায় ১১ হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষা পায়।
এটি মূলত একটি বাতাসের কুশন। স্টিয়ারিং হুইল এবং প্যাসেঞ্জার সাইড ড্যাশের পেছনে ব্যাগটি রাখা থাকে। গাড়ি বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে এয়ারব্যাগটি স্ফীত হয়ে বের হয়ে আসে এবং ড্রাইভার বা প্যাসেঞ্জারের মাথাকে গাড়ির সাথে গুরুতর সংঘর্ষের হাত থেকে রক্ষা করে।
ষাট ও সত্তর দশকের মধ্যেই এয়ারব্যাগ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে যাত্রী নিরাপত্তার জন্য একটি আদর্শ উপকরণ হিসেবে এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করে নব্বইয়ের দশকে এসে। ১৯৮৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ৪৪,৮৬৯ জন মানুষের প্রাণ রক্ষা পায় এয়ারব্যাগ ব্যবহারের কারণে।
৩. ইলেক্ট্রনিক স্ট্যাবিলিটি কন্ট্রোল
যাত্রী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সিটবেল্ট এবং এয়ারব্যাগের মতোই আরেকটি বহুল ব্যবহৃত সিস্টেম হলো ইলেক্ট্রনিক স্ট্যাবিলিটি কন্ট্রোল বা ইএসসি। এটি মূলত গাড়ির স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি এবং কোনোকিছুর সাথে সংঘর্ষ এড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়।
ইএসসি উদ্ভাবনের পেছনে একটি মজার কাহিনী আছে। ১৯৮৯ সালে একদিন মার্সিডিজ-বেঞ্জের ইঞ্জিনিয়ার ফ্র্যাঙ্ক ওয়ার্নার মোহন সুইডেনের একটি বরফ ঢাকা রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার গাড়িটি বরফে পিছলে নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং পাশের খাদে আটকে যায়। তখনই তার মাথায় আসে, যদি গাড়ির প্রতিটি চাকার গতি আলাদাভাবে নির্ণয় করা যায় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিটি চাকায় পৃথকভাবে ব্রেকিং পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়, তাহলে হয়তো হঠাৎ পিছলে যাওয়া বা মোড় ঘোরানোর সময় অনিয়ন্ত্রিত গতির কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে।
তার এ ভাবনার কথা তিনি মার্সিডিজ-বেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে জানান এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে তিনি ইএসসি সিস্টেম নিয়ে কাজ শুরু করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গাড়িকে স্থিতিশীল করার জন্য কোন চাকায় কতটুকু ব্রেক প্রয়োগ করা দরকার, তা নিরূপণের জন্য তিনি একটি অ্যালগোরিদম দাঁড় করান। তার অ্যালগোরিদমকে কাজে লাগিয়ে মার্সিডিজ-বেঞ্জ একসময় পূর্ণাঙ্গ ইএসসি সিস্টেম তৈরি করে ফেলে। ১৯৯৫ সালে তাদের এস৬০০ মডেলের গাড়িতে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় ইলেক্ট্রনিক স্ট্যাবিলিটি কন্ট্রোল।
পরে ২০১০ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে সকল গাড়িতে ইএসসি ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়।
৪. ফোর হুইল স্টিয়ারিং সিস্টেম
ফোর হুইল স্টিয়ারিং সিস্টেম অটোমোবাইল শিল্পের আরো একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন। এটি এমন একটি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে সামনের চাকার পাশাপাশি পেছনের দু’টি চাকাকেও স্টিয়ারিং হুইলের মাধ্যমে ডান-বামে ঘোরানো সম্ভব। এ পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে স্টিয়ারিং হুইল দ্বারা শুধুমাত্র সামনের দু’টি চাকাকেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
মূলত স্টিয়ারিং রেসপন্স আরও উন্নত করার লক্ষ্যে আবির্ভাব ঘটে ফোর হুইল স্টিয়ারিং সিস্টেমের। এ প্রযুক্তিতে গাড়ির গতি যখন কম থাকে, তখন স্টিয়ারিং হুইল ঘোরানোর সাথে সাথে পেছনের চাকা দু’টি সামনের চাকার বিপরীতদিকে ঘুরে যায়। এর ফলে অল্প জায়গার মধ্যেই ইউ টার্ন নেয়া সম্ভব হয়। আবার গাড়ির গতি যখন বেশি থাকে, তখন পেছনের চাকা দু’টি সামনের চাকার দিকে ঘুরে যায় এবং মোড় ঘোরার সময় গাড়িকে আরও স্থিতিশীলতা দান করে।
বিশ্ববাসীর সাথে ফোর হুইল স্টিয়ারিং সিস্টেমের প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৮৮ সালে। হোন্ডা কোম্পানির তৈরি ‘১৯৮৮ হোন্ডা প্রিক্লুড’ মডেলের গাড়িটিতে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় এ প্রযুক্তি। এরপর থেকে অন্যান্য অটোমোবাইল কোম্পানিও একে একে ব্যবহার করা শুরু করে এই ফোর হুইল স্টিয়ারিং। বর্তমানে অডি কিউ ৭, বিএমডব্লিউ ৫ সিরিজ, ফেরারি ৮১২ সুপারফাস্ট, ল্যাম্বরগিনি ইউরাস ইত্যাদির মতো সুপারকারগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফোর হুইল স্টিয়ারিং সিস্টেম।
৫. চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় গাড়ি
বর্তমানে অটোমোবাইল খাতের অন্যতম আলোচিত একটি নাম হোল অটোনমাস কার বা চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় গাড়ি। প্রচলিত গাড়ি চালনার ধারণায় বিপ্লব নিয়ে আসা এ প্রযুক্তি আসলে নতুন কোনো উদ্ভাবন নয়। বরং বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকেই গবেষণা শুরু হয় চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে।
গবেষণার ফলস্বরূপ ১৯২৫ সালে আলোর মুখ দেখে প্রথম চালকবিহীন গাড়িটি। কিন্তু পরবর্তীকালে উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবে দীর্ঘদিন এটি নিয়ে কাজ বন্ধ থাকে। পুনরায় স্বয়ংক্রিয় গাড়ি নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয় একবিংশ শতাব্দীতে এসে এবং গত কয়েক বছরে অডি, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ-বেঞ্জ, টেসলা এবং ভলভোর মতো জায়ান্ট অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো এ প্রযুক্তির উন্নয়নে আদাজল খেতে মাঠে নামে। ফলে, চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায় বহুগুণে।
স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকে বর্তমানে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে টেসলা। তাদের তৈরি ‘মডেল এস’, ‘মডেল এক্স’ এবং ‘মডেল ৩’ গাড়িগুলোতে ব্যবহৃত অটোপাইলট মোড পরিস্থিতি অনুযায়ী স্টিয়ারিং, ব্রেক এবং জ্বালানি খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
এসব চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় গাড়িকেই অটোমোবাইল শিল্পের ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিকট ভবিষ্যতেই হয়তো গাড়ি চালনার জন্য আর ড্রাইভারের প্রয়োজন হবে না। কারণ তখন রাস্তাঘাট দাপিয়ে বেড়াবে এসব চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় গাড়ি।