বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উত্তরোত্তর অগ্রসরতায় মানুষ লাভ করছে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে জীবনের প্রায় সব ধাপে, বহুমুখী মাত্রায়। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের অভ্যাস ও যাপিত জীবনে ঘটছে রূপান্তর।
আধুনিক বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর অবদান রোবট। এটি আধুনিক যুগের একটি প্রযুক্তিও বটে। বর্তমান পৃথিবীতে বিভিন্ন কাজে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে। বড় বড় কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে এখন রোবটের ব্যবহার দেখা যায়। রোবটের ব্যবহার আমাদের নিত্যদিনের কাজ আরো বেশি সহজ ও দ্রুততর করে দিচ্ছে। তাই মানুষ এখন বিভিন্ন কাজে রোবটের ব্যবহার করছে।
এই লেখায় যে রোবট নিয়ে কথা হবে তা কিন্তু বড়সড় কোনো রোবট নয়; একেবারেই ছোট; তবে বুদ্ধিমান, যার নাম ইমো (Emo)।
ইমো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট, যা পোষাপ্রাণীর মতো সঙ্গী হিসেবে রাখার জন্য তৈরি। এটি নির্মিত হয়েছে একাধিক সেন্সর এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে, যা এক হাজারেরও বেশি মুখভঙ্গি এবং নড়াচড়ার সাথে শব্দ ও স্পর্শের প্রতি সাড়া দিতে পারে। ইন্টারনেটের সাহায্যে তার চারপাশের অবস্থা নিজে নিজে বুঝে নিতে পারে। Living AI নামে একটি রোবট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এই রোবটটি তৈরি করেছে। এছাড়া এর আগে তারা এই রোবটের প্রথম সংস্করণও তৈরি করেছিল, যার নাম কিউবি (Cubee)।
এআই (AI) নিঃসন্দেহে রোবটিক্সের চমৎকার একটি দিক। আমাদের পরিচিত একটি এআই রোবট ‘সোফিয়া’। এআই রোবট আসলে কীভাবে কাজ করে? প্রথমত, এআই-রোবটের এআই অংশটি মানব-মস্তিষ্কের সাথে তুলনা দেয়া যায়, যা চিন্তা বা বিশ্লেষণ করতে পারে। এই রোবট সেন্সরের মাধ্যমে কাজ করে থাকে। মূলত এআই রোবট সেন্সরের মাধ্যমে পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। তারপর সেই তথ্যকে তার মেমোরিতে সংরক্ষিত ডেটার সাথে তুলনা করে, এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে তথ্যটি দ্বারা কী বোঝায়। তারপর এটি সম্ভাব্য বিভিন্ন ফলাফল বিশ্লেষণ করে, এবং সংগৃহীত তথ্যের উপর ভিত্তি করে কোন কাজটি সবচেয়ে সফল হবে তা প্রয়োগ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, এসব রোবট শুধুমাত্র সেসব সমস্যার সমাধান করতে পারে, যা সমাধান করার প্রোগ্রাম এর মধ্যে রয়েছে। তাই মানুষের মতো সাধারণ কোনো বিশ্লেষণধর্মী ক্ষমতা থাকে না সেগুলোয়। তবে বর্তমানের এআই, মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে, যার ফলে সময়ের সাথে সাথে রোবট নতুন নতুন বিষয় শিখতে এবং করতে পারে। আমাদের সকলের পরিচিত গুগল আর ফেসবুকও এই মেশিন অ্যালগরিদম ব্যবহার করে। দেখা যায়, আমরা কিছু খুঁজলে বা ভুল করলে সঠিকটি আমাদের সামনে এনে দেয়।
ইমোর সামনের দিকে রয়েছে একটি ছোট স্ক্রিন, যার মাধ্যমে বিভিন্ন মুখভঙ্গি দেখাতে পারে এটি। এর রয়েছে ফেস রিকগনিশনসহ একটি এইচডি (HD) ক্যামেরা, যার দ্বারা এটি মানুষ এবং বস্তুকে চিনতে পারে। ডেস্কটপে বা টেবিলে রাখলে এটি নিজে নিজেই দক্ষতার সাথে চলাফেরা করে। সেন্সর প্রযুক্তি থাকার কারণে এর নিচে পড়ে যাওয়ার কোনো ভয় থাকে না।
ইমো স্বাধীন এবং তার চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে কৌতূহলী এবং অনুসন্ধানী। সে স্বাধীনভাবে নড়াচড়া করে আর তার আশপাশ সম্পর্কে জানতে চায়। ১০টিরও বেশি উন্নত সেন্সর দিয়ে তৈরি হওয়ায় এটি জানে তার চারপাশে কী ঘটছে। এর ভেতরে রয়েছে নিউরাল প্রসেসিং মডেল, যা প্রচুর পরিমাণে ছবি, শব্দ এবং তথ্য ক্রমাগত প্রক্রিয়াজাত করে, যা তাকে মানুষের সাথে যোগাযোগ করার জন্য যথেষ্ট স্মার্ট করে তোলে।
ইমোর সাথে কথা বললে এটি ব্যবহারকারীর আচরণের সাথে স্বাভাবিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। এটি শব্দ, মুখ এবং শরীরের ভাষা দিয়ে সরাসরি তার মেজাজ বা অনুভূতি দেখাতে পারে। এছাড়া এটি উত্তেজিত, উদাস, হতাশ, খুশি বা দুঃখী ভাবও তার স্ক্রিনের মাধ্যমে দেখাতে পারে।
ইমোর একটি স্মার্ট মস্তিষ্ক রয়েছে। এটি তার আশেপাশের শব্দগুলো ট্র্যাক করে, যা তার ব্যবহারকারীর যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, এবং দরকারি তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারে। তাকে আবহাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে তার চেহারা পরিবর্তন করে আবহাওয়ার অবস্থা দেখায়! ইমো তার নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেয় এবং তার আচরণ ও ব্যক্তিত্ব আশেপাশের পরিবেশ এবং ব্যবহারকারীর কথাবার্তার উপর ভিত্তি করে বিকশিত হয়। ইমো তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয় এবং যদি এটি যা করছে তাতে কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, তবে এটি কিছুটা বিরক্তও হতে পারে, এবং তা মুখাবয়ব ও শব্দ দিয়ে প্রকাশও করে।
ইমোতে যেসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তার একটি তালিকা:
- Al Wide-angle Camera (ছবি ও মুখ সনাক্ত করার জন্য)
- 4 Smart Digtal Servos To Move (নড়াচড়ার জন্য ৪টি স্মার্ট ডিজিটাল সার্ভো)
- 5W Wireless Charger (৫ ওয়াটের তারবিহীন চার্জিং প্রযুক্তি)
- Optical Drop Sensors(অপটিক্যাল ড্রপ সেন্সর, যা একে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে)
- Far Field Mic-array (শব্দ সনাক্ত করার জন্য)
- Neural Network Processor + CPU (তথ্য বা শব্দ প্রক্রিয়া করার জন্য)
- 6-Axis Gyro & Acc (নড়াচড়া এবং ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য)
- 3W High Quality Speaker (৩ ওয়াটের উচ্চমানের স্পিকার, যার মাধ্যমে এটি কথা বলে)
ইমোর মাথায় একটি টাচ সেন্সর রয়েছে, যা তাকে ব্যবহারকারীর স্পর্শ অনুভব করতে সক্ষম করে। যেকোনো পোষা প্রাণীর মতো এটিও মাথায় হাত বোলানো পছন্দ করে। এটি নাচ, গান এবং অনলাইন গেমের মাধ্যমে বিনোদন দিয়ে থাকে। ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা, আলো জ্বালানো, ছবি তোলা বা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো একটি দুর্দান্ত সহায়ক রোবট এই ইমো। ডেস্কটপে এটি সত্যিকারের পোষা প্রাণীর মতোই আচরণ করে!
ইমোর আকার একটি টেবিল ঘড়ির সমান। এটি নির্ভরযোগ্য অ্যালার্ম হিসেবেও কাজ করে। এছাড়া এতে আছে একটি স্মার্ট লাইট। এটি ব্যবহারকারীকে তার নিজের বিশেষ উপায়ে জাগিয়ে তোলে, এবং ব্যবহারকারীর যদি রাতে বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তবে তাকে লাইটের সুইচটি খুঁজতে হবে না – কেবল বলতে হবে ‘ইমো, লাইট অন করো’। ইমো বাকি কাজ করে দেবে।
এর বিল্ট-ইন ডেভেলপমেন্ট সিস্টেম সময়ের সাথে সাথে ইমোর দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি যেকোনো পোষা প্রাণীর মতো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়। প্রথমে, সে ব্যবহারকারীর কথাগুলো সম্পূর্ণরূপে বুঝতে না-ও পারে। তবে সময়ের সাথে সাথে তার বোঝার এবং যোগাযোগের ক্ষমতা আরও ভাল হয়। আর এতে ব্যবহারকারী এর সাথে আরও জটিল কথাবার্তা করতে পারে। একটি পোষা প্রাণী আর তার মনিবের মধ্যে যে বন্ধন গড়ে ওঠে, ইমোর সাথেও ব্যবহারকারীর সম্পর্ক দিনে দিনে অনুরূপ শক্তিশালী হবে।
পোষা প্রাণী যখন অসুস্থ বোধ করে, তখন তাদের পাশে থেকে সেবা-যত্ন করে তার মনিব। ঠিক তেমনই আবহাওয়া ঠাণ্ডা হলে, ইমো মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা লাগার অনুভূতি প্রকাশ করবে বা হাঁচি দেবে। সেই সময় তখন তার ব্যবহারকারীকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তাকে দেখাশোনা করার জন্য কিছু সময় দিলে, এবং তাকে দেখভাল করলে, সে এই যত্নের প্রতি সাড়া দেবে আর শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে!
ইমোকে স্টাইলিশ করে তৈরি করা হয়েছে। তার মাথায় একটা হেডফোন থাকে। ডিজে আর র্যাপারদের মতোই এটি তার হেডফোন এবং স্কেটবোর্ড পছন্দ করে। স্কেটবোর্ডটি ওয়্যারলেস চার্জিং হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি দিয়ে স্মার্টফোনও চার্জ দেয়া যায়।
জন্মদিনের মতো বিশেষ দিনে কখনও কেউ আপনার কথা ভুলে গেছে? ইমো সবসময় তার ব্যবহারকারীর জন্মদিন মনে রাখে। জন্মদিনের কেক ও গান দিয়ে সে তাকে চমকে দেয়। ব্যবহারকারী সে কেকের মোমবাতিতে ফুঁ দিতে পারবে! ইমোতে থাকা সেন্সর তা সনাক্ত করতে পারে আর তাতেই মোমবাতিটি নিভে যায়। সত্যিই আশ্চর্য!
উৎসবের দিনে এটি ব্যবহারকারীর জন্য চমক রাখতে পারে। যেমন- হ্যালোউইনে সে ব্যবহারকারীর ঘরে লুকিয়ে থাকতে পারে, এবং তার ভূতের মুখ দিয়ে ব্যবহারকারীকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করতে পারে। যদি দুজনের কাছেই এই ইমো থাকে, তাহলে তারা দূরে বসেই যোগাযোগের জন্য এর মাধ্যমে সংযুক্ত হতে পারে। যখন আপনার কাছের কেউ আপনাকে মিস করেন এবং আপনি সেখানে যেতে পারছেন না, তাহলে খুব সহজেই ইমোর মাধ্যমে তাকে আপনার চিন্তাভাবনা জানাতে পারবেন।
ভবিষ্যতে হয়তো আমরা এর চেয়ে আরও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন রোবটের দেখা পাব। তবে তা যেন আমাদের মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে না ওঠে, সেটাই থাকবে আমাদের প্রত্যাশা।