সম্প্রতি বাংলাদেশে চালু হয়েছে ফোরজি। সর্ব স্তরের মানুষের মধ্যেই রয়েছে এই ফোরজি প্রযুক্তি নিয়ে নানা জিজ্ঞাসা। ফোরজি প্রযুক্তি আসলে কী? ফোরজি প্রযুক্তি সুবিধা কী কী? এর অসুবিধাও বা কী? কিভাবেই বা পাওয়া যাবে এই ফোরজি সুবিধা? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। তাই আপনাদের এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের এই লেখা। তো চলুন শুরু করা যাক!
ফোরজি প্রযুক্তি কী?
ফোরজি প্রযুক্তি হলো চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। ইংরেজি 4G এর পূর্ণরূপ হলো “4th Generation“। ৩জি প্রযুক্তির পরবর্তী ধাপ হলো এই ফোরজি প্রযুক্তি। ১৯৯০ সালে চালু হওয়া টুজি প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি মোবাইল ফোন থেকে অন্য একটি মোবাইল ফোনে ডিজিটাল ভয়েস কল ও টেক্সট মেসেজ পাঠানো যেত। এরপর ২০০৩ সালে এলো থ্রিজি প্রযুক্তি, যার সাহায্যে রাস্তাঘাটে চলমান অবস্থাতেও দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন ওয়েবপেজ ব্রাউজ করা, ভিডিও কল করা, কিংবা বিভিন্ন গান, ভিডিও ইত্যাদি ডাউনলোড করা যেত।
বর্তমানে আমরা যে ফোরজি প্রযুক্তি দেখছি তার উদ্ভাবন হয়েছে ২০০৯ সালে। এই ফোরজি প্রযুক্তিতে থ্রিজির সব সুবিধাই পাওয়া যাবে এবং তা হবে থ্রিজির থেকেও দ্রুত গতিতে।
ফোরজি প্রযুক্তিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যার প্রথমটি হলো ওয়াইম্যাক্স (WiMAX) যা ২০০৬ সালে প্রথম চালু হয়। আর দ্বিতীয়টি হলো এলটিই (LTE) যা চালু হয় ২০০৯ সালে। এর পূর্ণরূপ হলো ‘Long Term Evolution‘। এই এলটিইকেই মূলত আসল ফোরজি বলা হয়। এটি হলো একটি তারবিহীন উচ্চগতি সম্পন্ন মোবাইল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থা। এখন চলুন জেনে নিই এই ফোরজি বা এলটিইর সুবিধা ও অসুবিধাগুলো সম্পর্কে।
ফোরজি প্রযুক্তির সুবিধা
ফোরজি প্রযুক্তির সুবিধাগুলোকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
- উন্নত ডাউনলোড/আপলোড স্পিড
- কম ল্যাটেন্সি
- পরিষ্কার ভয়েস কল
চলুন এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
উন্নত ডাউনলোড/আপলোড স্পিড
ফোরজি প্রযুক্তির প্রধান সুবিধা হলো উচ্চগতির ইন্টারনেট। একটি আদর্শ ফোরজি নেটওয়ার্কে ইন্টারনেটের গতি থ্রিজি ইন্টারনেট অপেক্ষা পাঁচ থেকে সাত গুণ দ্রুত, যা তাত্ত্বিকভাবে প্রায় ১৫০ মেগাবিট পার সেকেন্ড থেকেও বেশি। তবে বাস্তবে ফোরজি নেটওয়ার্কে ৮০ মেগাবিট পার সেকেন্ড গতি পাওয়া সম্ভব। যেমন, আপনি যদি একটি ২ গিগাবাইট সাইজের এইচডি মুভি ডাউনলোড করতে চান তবে তা ফোরজি নেটওয়ার্কে ৩ মিনিট ২০ সেকেন্ডে ডাউনলোড হয়ে যাবে, যেখানে থ্রিজি নেটওয়ার্কে এটি ডাউনলোড হতে লাগতো প্রায় ২৫ মিনিটেরও বেশি।
এছাড়াও, ফোরজি নেটওয়ার্কের আরো উন্নত একটি রূপ 4G LTE-Advanced সম্প্রতি পৃথিবীর কিছু দেশে চালু হয়েছে যা ফোরজি থেকেও আরো উচ্চ গতি সম্পন্ন। এটি LTE-A, 4.5G কিংবা 4G+ নামেও পরিচিত। এটিতে তাত্ত্বিকভাবে ১.৫ গিগাবিট পার সেকেন্ডের বেশি গতি পাওয়া সম্ভব। তবে বাস্তবে এই নেটওয়ার্কে এখনো পর্যন্ত ৩০০ মেগাবিট পার সেকেন্ড গতি পাওয়া সম্ভব হয়েছে। লন্ডনের কিছু কিছু মোবাইল অপারেটর প্রথম এই সেবা চালু করেছিল যা আস্তে আস্তে অন্যান্য শহর ও দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া এরিকসন সম্প্রতি এমন এক প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছে যার মাধ্যমে ফোরজি ইন্টারনেটের গতি বাস্তবেই ১ গিগাবাইট পার সেকেন্ড পাওয়া সম্ভব হবে। যদিও এটি এখনো বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়নি।
কম ল্যাটেন্সি
শুধু দ্রুত ডাউনলোড/আপলোড স্পিড নয়, ফোরজি প্রযুক্তিতে আপনি পাবেন আরো কম ল্যাটেন্সি। নেটওয়ার্কিং এর ভাষায়, এক প্যাকেট ডাটা একটি প্রান্ত থেকে আরেকটি প্রান্তে পৌঁছতে যত সময় নেয় তাকে ল্যাটেন্সি বা ‘পিং’ বলা হয়। ল্যাটেন্সি কম হলে ইন্টারনেট আরো দ্রুত কানেক্ট হবে। আগে থ্রিজি ইন্টারনেট চালু করতে ডাটা কানেকশন এনাবল বাটনে চাপ দিয়ে আপনাকে ২/৩ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু ফোরজি ইন্টারনেটে আপনি বাটনে চাপার সাথে সাথেই চালু হয়ে যাবে ইন্টারনেট। কম ল্যাটেন্সি হওয়ার ফলে যারা অনলাইনে গেম খেলেন তাদের গেমপ্লে হবে আরো দ্রুত ও বাধাহীন।
থ্রিজি ইন্টারনেটে যেখানে ল্যাটেন্সি ছিল ১২০ মিলিসেকেন্ড সেখানে ফোরজি ইন্টারনেটে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬০ মিলিসেকেন্ডে। ফলে লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং কিংবা অনলাইন গেমিং হবে আরো সহজ।
পরিষ্কার ভয়েস কল
ফোরজি নেটওয়ার্কের অন্যতম চমকপ্রদ একটি সুবিধা হলো ‘Voice over LTE‘ বা VoLTE। স্কাইপ, ফেসবুক কিংবা হোয়াটসএপে আমরা যে ভয়েস কল করি তা VoIP প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আর এই VoIP প্রযুক্তির মতোই একটি প্রযুক্তি হলো VoLTE প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি ফোরজি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে খুবই পরিষ্কার ও হাই কোয়ালিটির ভয়েস কল প্রদান করে থাকে যা থ্রিজি ভয়েস কল থেকেও পরিষ্কার ও নিখুঁত। এই প্রযুক্তি এতটাই পরিষ্কার ভয়েস কল দিতে সক্ষম যার ফলে আপনার মনে হবে আপনার কানের ওপারেই কেউ বুঝি আপনার সাথে কথা বলছে। এই প্রযুক্তি ভয়েস কলের খরচও কমিয়ে দেবে একেবারেই।
পৃথিবীর বহু দেশে এই প্রযুক্তিটি চালু রয়েছে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে ফোরজি নেটওয়ার্ক চালু হলেও VoLTE প্রযুক্তিটি এখনো চালু হয়নি। আশা করা যায় খুব শীঘ্রই হয়তো এই প্রযুক্তিটি আমাদের দেশে চালু হবে।
ফোরজি প্রযুক্তির অসুবিধা
ফোরজি প্রযুক্তির এত সুবিধা থাকার পরও এর রয়েছে কিছু অসুবিধা। যেমন, ফোরজি ইন্টারনেটের গতি অতি দ্রুত হওয়ার ফলে আপনার ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথও দ্রুত শেষ হবে। আগে যদি এক জিবি ইন্টারনেট আপনি এক সপ্তাহ ধরে ব্যবহার করতেন ফোরজি নেটওয়ার্কে হয়তো আপনি সেটি ৩/৪ দিনেই শেষ করে ফেলবেন। আর, দ্রুত ডাটা ইউজ হবে বিধায় ফোনের ব্যাটারিও খরচ হবে দ্রুত। ফলে ফোনের চার্জ আগের তুলনায় কিছুটা দ্রুত শেষ হয়ে যেতে পারে ফোরজি নেটওয়ার্কে।
এছাড়াও আপনার ফোনটি যদি ফোরজি সাপোর্টেড না হয় তবে আপনাকে ফোরজি ব্যবহার করার জন্য নতুন ফোন কিংবা রাউটার কিনতে হবে। ফলে আপনার পকেট থেকে বেরিয়ে যাবে আরো কিছু টাকা। শুধু তা-ই নয়, ফোরজি ইন্টারনেটে ব্যান্ডউইথের দামও হয়তো থ্রিজি থেকে বাড়বে। যদিও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ফোরজি ইন্টারনেটের দাম তুলনামূলক কম, সেদিক দিয়ে আমাদের দেশে ব্যান্ডউইথের দাম বরাবরই বেশি।
ফোরজি সুবিধা পেতে আপনার যা যা প্রয়োজন হবে
ফোরজি সুবিধা পেতে হলে আপনার সবার প্রথমে লাগবে একটি ফোরজি সমর্থিত হ্যান্ডসেট। আপনার ফোনটি যদি ফোরজি বা এলটিই সাপোর্টেড না হয় তবে আপনি ফোরজি ব্যবহার করতে পারবেন না। আপনার ফোনটি যদি ফোরজি সমর্থিত হয়ে থাকে তবে আপনার দরকার হবে একটি ফোরজি সমর্থিত সিম কার্ড। আপনি আপনার পুরাতন থ্রিজি কিংবা টুজি সিমগুলো নিজ নিজ মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে রিপ্লেস করে ফোরজি সিম নিতে পারবেন।
এখন ফোরজি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি প্রয়োজন হবে তা হলো ফোরজি নেটওয়ার্ক। আপনার এলাকায় যদি ফোরজি নেটওয়ার্ক না থাকে তবে আপনার ফোন কিংবা সিম ফোরজি সমর্থিত হলেও আপনি ফোরজি ব্যবহার করতে পারবেন না। তাই ফোরজি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে আপনাকে থাকতে হবে ফোরজি নেটওয়ার্ক যুক্ত এলাকায়। আর এসব শর্ত যদি আপনি পূরণ করে থাকেন তবে আপনি ফোরজি ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য একদম প্রস্তুত। এখন শুধু কোনো একটি ফোরজি ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনুন আর ব্যবহার করতে থাকুন দ্রুত গতির ফোরজি ইন্টারনেট!
ফিচার ইমেজ – alluremedia.com.au