১৯৮২ সালের দিকে মিতসুবিশি মোটরসের হাত ধরে সূচনা হয় গাড়ির জগতের নতুন এক কিংবদন্তীর। বহুমুখী যান হিসেবে বাজারে আসে মিতসুবিশির নতুন গাড়ি, মিতসুবিশি পাজেরো। একদম আনকোরা নতুন ডিজাইনে তৈরি এই গাড়ি গতানুগতিক সামরিক ধাঁচে গড়া গাড়িগুলো থেকে ছিল একদম আলাদা। আশির দশকের চার চাকার গাড়িগুলো এবড়ো-থেবড়ো পথে চলাচলের সুবিধার্থে বেশ কিছু সংস্করণ বের করেছিলো, যা মোটেও আরামদায়ক ছিল না।
কিন্তু মিতসুবিশি পাজেরো সেদিক থেকে যোজন যোজন এগিয়ে ছিল। এটি বসতে যেমন ছিল আরামদায়ক, তেমনি চালানোর দিক থেকেও ছিল তুলনামূলক সহজ। আর অসমতল রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে পাজেরোর হাত ধরে। বলতে গেলে, অসমতল এবড়ো-থেবড়ো পথে চালক যেন নিশ্চিন্তে আরামদায়কভাবে নিজের সেরাটুকু অনুভব করে গাড়ি চালাতে পারে, তা নিশ্চিত করার মূলমন্ত্রই সবকিছু পাল্টে দিলো।
মিতসুবিশি পাজেরোর উন্নয়নের পেছনে ছিল পরিকল্পিত কিছু পদক্ষেপ এবং উদারহস্তে সংযোজিত বেশ কিছু সুনিয়ন্ত্রিত ফিচার, যা কিনা অনেক তৎকালীন যাত্রীবাহী গাড়িগুলোর বৈশিষ্ট্যগুলোকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফিচারগুলোর মধ্যে ছিল ২.০ লিটারের পেট্রোল ইঞ্জিন, ২.৩ লিটার ডিজেল এবং ২.৩ লিটার টার্বো ডিজেল ইঞ্জিন। এছাড়াও এর আসনগুলো ছিল লম্বা, ছিল পাওয়ার স্টিয়ারিং এবং পেছনে ব্যাকপ্যাকের মতো লাগানো একটি অতিরিক্ত টায়ার। গাড়িটি বাজারজাত করার ছ’মাসের মধ্যে চারদিকে এর বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে বাড়তে থাকে কোম্পানির হর্তাকর্তাদের আত্মবিশ্বাস। আর সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই তারা নিয়ে বসেন এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত। তারা ঠিক করেন, নতুন মডেলের গাড়িটি অংশগ্রহণ করবে বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন ক্রস কান্ট্রি রেস ‘ডাকা র্যালি’তে।
ডাকার র্যালির প্রত্যেকটি পর্যায়ে রেস করতে হতো প্রায় কয়েকশ কিলোমিটার করে। এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা, কোথাও বেলে মরুভূমি, কোথাও পাথরের মতো রুক্ষ, আবার কোথাও পঙ্কিল কাদায় ঢাকা। এমন দুর্গম পথে হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তাই এই রেস প্রতিযোগিতা মিতসুবিশি পাজেরোর জন্যে ছিল পুলসিরাত পাড়ি দেয়ার মতো। রেসও জেতা হবে, সাথে জেনে নেয়া যাবে গাড়িটির স্থায়িত্বের সম্ভাব্য সীমা। ব্যাপক সহনশীলতা দেখিয়ে গাড়িটি প্রতিযোগিতায় ট্রিপল ক্রাউন জিতে নেয় এবং আসছে বছরগুলোতে যে জনপ্রিয়তা অপেক্ষা করছে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
রেস প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পরপরই গাড়িতে আনা হয় নতুন কিছু পরিবর্তন। আগের সাসপেনশনগুলো বদলে নবউন্নয়ন হিসেবে এতে যুক্ত করা হয় মাল্টি লিংক কয়েল সাসপেনশন সহ চার চাকার নতুন ইনডিপেন্ডেন্ট সাসপেনশন। আর সেই রেসট্র্যাকেই বারবার সেটা পরীক্ষা ও পরিমার্জন চলে। পাজেরো ২০০৯ সাল পর্যন্ত গত ২৫ বছর ধরে ডাকার র্যালিতে অপ্রতিরোধ্যভাবে মোট ১২ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। যার জন্যে এখনও একে ডাকা হয় মরুভূমির রাজা।
এর প্রায় দীর্ঘ নয় বছরের প্রতীক্ষার পর ১৯৯১ সালে মিতসুবিশি বাজারে নিয়ে আসে পাজেরোর দ্বিতীয় সংস্করণ। আগের মডেল থেকে আলাদা আপগ্রেডেড নতুন গাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল মূলত সড়কপথের কথা মাথায় রেখে। নতুন ডিজাইনের এই গাড়িতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের স্বাধীনতা তো ছিলই এবং সেটা কোম্পানির উন্নয়ন দর্শনকে বাস্তবতার আরও একধাপ কাছাকাছি নিয়ে আসে। নতুন সুপার সিলেক্ট ফোর হুইল ড্রাইভে ‘ভিসিইউ সেন্টার ডিফারেন্সিয়াল’ এর ব্যবহার ছিল এক বড় ধরনের পরিবর্তন। এই গাড়িটি যদিও এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় চলার জন্যে তেমন সুবিধাজনক ছিল না, তবে নতুন সুপার সিলেক্ট সিস্টেম সড়কপথে এর চলাচলকে করে আরও তৃপ্তিদায়ক।
১৯৯৯ সালে এসে মিতসুবিশি পাজেরো এর বিবর্তনের তৃতীয় প্রজন্মের মধ্যে প্রবেশ করে। বাজারে আসে পাজেরোর তৃতীয় সংস্করণ। এবারের বিবর্তনের পেছনে লক্ষ্য ছিল গাড়ির আয়তন স্বতন্ত্রভাবে কমিয়ে আনা এবং ড্রাইভিং মানের আরও উন্নতি সাধন করা। গাড়িটির কাইনেমেটিক পারফর্মেন্স বোঝার জন্য নির্মাতারা রণপোত পর্যালোচনার আশ্রয় নেন। প্রথমে কাঠামোগত পরিবর্তন করতে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই একটি অভ্যন্তরীণ ল্যাডার ফ্রেমের চেসিসের ধারণা উদ্ভাবিত হয়। এতে করে গাড়ি ওজনে হালকা হলেও এর দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়। নতুন মডেলের এই পাজেরো তার রোড ক্লিয়ারেন্স ঠিক রেখেই নিম্ন কেন্দ্রিক-মাধ্যাকর্ষণ ভারসাম্য অর্জন করতে সক্ষম হয়।
এই গাড়িটিতেও ছিল চার চাকার ইনডিপেন্ডেন্ট সাসপেনশন, যার ফলে প্রতিটি চাকাকে সড়কপৃষ্টের উপর আরও সুরক্ষিত গড়িয়ে চলার ক্ষমতা দেয়। তৃতীয় প্রজন্মের এই গাড়িটির হাত ধরে মিতসুবিশি ব্র্যান্ড পরিপূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছুতে সক্ষম হয় এবং এর কাইনেমেটিক পারফর্মেন্সে আসে নাটকীয় পরিবর্তন। অভ্যন্তরীণ ল্যাডার ফ্রেমের চেসিসের সাথে এতে ছিল নতুন মনোকক বডি।
এছাড়াও ছিল ৩.৫ লিটার V6 GDI ইঞ্জিন, একাধিক সিটিং ব্যবস্থাসম্পন্ন তৃতীয় সারির আসন এবং একটি অপসারণযোগ্য টুল বক্স। মিতসুবিশি পাজেরো রাস্তায় নামে আগের চেয়ে উন্নত ও দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে এবং অবিলম্বে নজর কাড়ে গাড়িপ্রেমীদের, বিশেষ করে যারা এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা দিয়ে প্যাসেঞ্জার কারে দীর্ঘ অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন বুনে আসছিলেন বহুদিন ধরে।
যেকোনো কিছুতে পরিপূর্ণতা অর্জন করতে প্রয়োজন ধ্রুব বিবর্তন। আর সেই বিবর্তন ধরে রাখতে হলে দরকার পরিবর্তনের মাঝেই সংবেদনশীলতা খুঁজে নেওয়া যাতে নতুন ড্রাইভিং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরিচিত রাস্তাগুলোও ভিন্নভাবে অনুভূত করা যায়। ঠিক এই ব্যাপারগুলো মাথায় নিয়ে মূল উন্নয়ন দর্শন অপরিবর্তীত রেখেই, ব্র্যান্ডটিকে সর্বক্ষেত্রে নিখুঁতভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যে ২০০৬ সালে মিতসুবিশি পরিচয় করিয়ে দেয় ৪র্থ প্রজন্মের পাজেরোর সাথে। এর মূল লক্ষ্য ছিল দীর্ঘ রুক্ষ পথেও চালকদের চমৎকার ড্রাইভিং পারফর্মেন্স দেওয়া।
নতুন এই বিবর্তন পূর্ববর্তী প্যাটার্ন অনুসরণ করে নতুন সমাধান প্রদানের মাধ্যমে আলোচনায় আসেনি। এই বিবর্তনটি বহুবিধ প্রসেসের মাধ্যমে পরিপক্বতার দিকে পরিচালিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, পরিবর্তনগুলো শুরু হয়েছিল খুবই সাধারণ কর্মক্ষমতা পর্যায়ে পরিশোধনের মাধ্যমে। বিশেষ করে ৫৪টি স্পট ঢালাইয়ের মাধ্যমে এর কাঠামোগত দৃঢ়তার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে।
এ সকল পরিমার্জনার ফলে গাড়ি চালনার যে গুণগত মানের উদ্ভব হয় তা গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতাকে তুলে নিয়ে গেছে এক নতুন উচ্চতায়। এক দশক পরেও মিতসুবিশি পাজেরো তার কিংবদন্তীতুল্য অবস্থান ধরে রেখেছে এবং মোটরগাড়ির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি ধারার অংশ হয়ে রয়েছে।
প্রথম পর্ব: ইয়াতারো ইওয়াসাকি: বিশ্বজয়ী এক উদ্যোক্তার উত্থানপর্ব
দ্বিতীয় পর্ব: মিতসুবিশি মোটরস: ইয়াতারো ইওয়াসাকির স্বপ্নের পথচলা
ফিচার ইমেজ: Mitsubishi Motors