উনিশ শতকের শেষদিকে আসতে আসতে তড়িৎ-চুম্বকের জ্ঞান ব্যবহার করে অসাধারণ সব প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হতে থাকে। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন ও তারবিহীন যোগাযোগ প্রযুক্তির উদ্ভাবন আমূলে বদলে দিয়েছিল মানবজাতির যোগাযোগ ব্যবস্থাকে। তবে তড়িৎ-চুম্বক যে কেবল যোগাযোগ খাতেই প্রভাব ফেলছিল এমনটা নয়। এ সময় ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে শুরু করেছিল, শুরু হয়েছিল বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার। এ প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রায় আরো বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে।
বিদ্যুতায়ন ও বৈদ্যুতিক বাতির কথা বলতে গেলে সবার আগে আসে টমাস আলভা এডিসনের নাম। আধুনিক বৈদ্যুতিক বাতির উদ্ভাবক হিসেবে আমরা সবাই চিনি তাকে। তবে তিনিই প্রথম ব্যক্তি নন, যিনি বিদ্যুৎ থেকে আলো উৎপাদনের জন্যে কাজ করেছিলেন। এ প্রচেষ্টা চলে আসছিল ১৮০৭ সাল থেকে। এডিসনের সময়ে আসতে আসতে বৈদ্যুতিক বাতির প্রভূত উন্নতি হয়েছে, তবুও এটি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্যে উপযুক্ত ছিল না। এর পেছনে একটি বড় কারণ ছিল বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহের সমস্যা। এছাড়াও বৈদ্যুতিক বাতির দুর্বলতা তো ছিলই।
তখনকার বৈদ্যুতিক বাতিগুলোর জন্য প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তির প্রয়োজন হতো। এ শক্তি সরবরাহের জন্যে ব্যবহার করা হতো ব্যাটারি। ব্যাটারি ছিল বেশ ব্যয়বহুল এবং এর ধারণক্ষমতাও ছিল কম। এডিসন বুঝতে পারলেন, বাতিকে জনপ্রিয় করে তুলতে হলে বিদ্যুৎ সরবরাহের নতুন ব্যবস্থা করতে হবে। কম খরচে, একটানা, প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করতে হবে। পাশাপাশি সেই শক্তিকে কার্যকরভাবে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে। কিন্তু এটি করার জন্যে গোটা সিস্টেমের বিশাল পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, যা কোনো এক ব্যক্তির পক্ষে করা অসম্ভব।
সমস্যাটি সমাধানের সম্ভাবনা দেখা দেয় ১৮৭০ এর দশকের শেষ দিকে এসে। এ সময় ইউরোপিয়ান প্রযুক্তিবিদরা বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশাল অগ্রগতি অর্জন করেন। একটানা প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন সম্ভব হয়ে ওঠে। তবে তখনো ঘরে ঘরে বিদ্যুৎশক্তি বণ্টনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেই সমস্যা সমাধানের জন্যই কাজ শুরু করেন এডিসন।
দূরদর্শী এডিসন দুটি পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামেন। প্রথমত, তিনি বৈদ্যুতিক বাতির উন্নয়ন করবেন। দ্বিতীয়ত, গ্রাহকদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার জন্যে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা তৈরি করবেন। প্রায় দেড় লক্ষ ডলারের তহবিল গঠন করে বিশাল আড়ম্বরের সাথে এ প্রকল্প শুরু করেন তিনি। প্রাথমিক লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা ছিল নিউইয়র্কের সকল রাস্তায় গ্যাস-বাতির বদলে বৈদ্যুতিক বাতি স্থাপন করা ও এর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি করা।
সেই লক্ষ্যে একইসাথে তার বৈদ্যুতিক বাতির জন্যে সঠিক ফিলামেন্ট খোঁজার কাজ ও বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার ডিজাইনের কাজ চলতে লাগলো। এডিসন ও তার দল যে নমুনা ডিজাইনটি প্রস্তুত করেন তাতে ছিল একটি বাষ্পচালিত জেনারেটর, ট্রান্সমিশন ক্যাবল, সুইচ, ফিউজ এমনকি পাওয়ার মিটারও। পাওয়ার মিটার ব্যবহার করা হয় কে কতটা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছে সেই তথ্য রাখার জন্যে। বিলের হিসেব করার জন্য এটি জরুরী। এডিসন তখনই ঠিক করে রেখেছিলেন, বিদ্যুৎ সেবার জন্য নির্দিষ্ট ফি নয়, বরং ব্যবহার করা শক্তির পরিমাণ অনুযায়ী বিল নেবেন গ্রাহকের কাছ থেকে।
এ ডিজাইন তৈরির পাশাপাশি এডিসন ততদিনে বৈদ্যুতিক বাতির উন্নয়নেও সফল হয়েছেন। অর্থাৎ তিনি ও তার দল তখন বৈদ্যুতিক বাতি, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও এর জন্য উপযুক্ত ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু ঝামেলা হলো এসব করতে গিয়ে তাদের তহবিল ফুরিয়ে গেছে প্রায়। এডিসন বুঝতে পারলেন, তাকে এখন গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে এসে ধনকুবেরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
কিন্তু তাদের অধিকাংশই তখন টেলিগ্রাফ ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বসে আছেন। সদ্য উদ্ভাবিত হওয়া টেলিফোনের কথাও বিবেচনা করছেন কেউ কেউ। এসবের বদলে বৈদ্যুতিক বাতিতে বিনিয়োগের জন্য তাদের আগ্রহ কিছুটা কমই ছিল। কিন্তু এডিসন জানতেন, তার উদ্ভাবনের ক্ষমতা ঠিকভাবে দেখাতে পারলে সবচেয়ে সংশয়বাদী ব্যক্তির মনও ঘুরিয়ে দিতে পারবেন তিনি।
এজন্য ১৮৭৯ সালে, বছরের শেষ দিনে, তার মেনলো পার্কের গবেষণাগারে এক জমকালো প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। আমন্ত্রণ জানানো হয় নিউ ইয়র্ক শহরের সাংবাদিক, পৌর-সরকারের কর্মকর্তা ও বাছাই করা অতিথিদের। দিনের প্রথমভাগে তুষারপাত হয়েছিল সেদিন। তুষারশুভ্র প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অতিথিরা ঠিক জানতেন না, কী দেখতে যাচ্ছেন তারা।
একসময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো। অন্ধকার হয়ে উঠতে শুরু করলো চারদিক। এডিসন তার জেনারেটরটি চালিয়ে দিলেন। এরপর একটিমাত্র সুইচ অন করে দিতেই একসাথে ২৯০টি বাতির আলোতে আলোকিত হয়ে উঠলো জায়গাটি। চোখ ধাঁধানো তীব্র কোনো আলো নয়, তুষারের চাদরের ওপর মৃদু ও আরামদায়ক আলো অভিভূত করে দিল অতিথিদের।
এডিসন এখানেই থেমে থাকেননি। এরপর অন্য এক সেট সুইচে হাত দেন তিনি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে একের পর এক বাতির সারি জ্বলতে-নিভতে লাগলো। বলা যায়, এটিই ছিল সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক ক্রিসমাস লাইট, যা দেখে উপস্থিত নিউ ইয়র্ক শহরের গ্যাস-বাতির নিয়ন্ত্রকরাও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। কেননা তখনকার অন্য কোনো আলোর উৎস এত সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না।
পরেরদিন, ১৮৮০ সালের পহেলা জানুয়ারি, নিউইয়র্কের সবগুলো পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয় এডিসনের কীর্তিগাঁথা। মানবজাতির ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা বলে আখ্যায়িত করা হয় একে। মেনলো পার্কের এ প্রদর্শনী একইসাথে এডিসনের বৈদ্যুতিক বাতি এবং পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের ব্যবহারিক ক্ষমতা যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই এটি বিনিয়োগকারীদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়।
এরপরে আর বিনিয়োগের অভাব হয়নি এডিসনের। তিনি এবার তার গবেষণার ফসলকে ব্যবসায় রূপান্তরের কাজে লেগে পড়েন। তার প্রথম প্রকল্প ছিল ম্যানহাটন শহরের কেন্দ্রে একটি ছোটখাট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা। এর আশেপাশেই ছিল তখনকার সম্পদশালী সব ব্যক্তিদের বসবাস। প্রথমে তাদের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই হয়তো তিনি এ জায়গাটি পছন্দ করেন।
১৮৮২ সালে তার এ প্রকল্প সম্পন্ন হয়। তৈরি হয় পৃথিবীর প্রথম পাওয়ার গ্রিড। ১০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জেনারেটর ব্যবহার করা হয় এখানে। ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানীদের করা ডিজাইন থেকে এডিসন নিজে কিছুটা উন্নত করে তৈরি করেন এ জেনারেটর। ১১০ ভোল্টেজে ডিসি কারেন্ট সরবরাহ করতো এটি। তার সরবরাহ করা বিদ্যুৎশক্তি একইসাথে বারোশ বাতি জ্বালাতে সক্ষম ছিল। সে সময়ের বিবেচনায় এটি ছিল বিশাল সংখ্যা।
এর কল্যাণে এডিসনের ৫৯ জন গ্রাহকের ঘরে প্রতি সন্ধ্যায় জ্বলে উঠতো বৈদ্যুতিক আলো। নিউ ইয়র্কের দর্শনার্থীদের জন্যে এটি ছিল দেখার মতো দৃশ্য। এ প্রকল্পের সফলতার পরে তাকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি। তার প্রযুক্তির পেটেন্ট ও লাইসেন্স ব্যবহার করে গোটা দেশজুড়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হতে থাকে। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে আমেরিকা জুড়ে শতাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়।
এ সময় ‘এডিসন জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি’ (এডিসন জি.ই) প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কোম্পানিটি বৈদ্যুতিক পণ্য, যেমন- বাতি, জেনারেটর ইত্যাদি তৈরি করতে শুরু করে। ১৮৮২ সালে এডিসন জি.ই পঞ্চাশ হাজার বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করে। ১৮৮৭ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। সব মিলিয়ে অর্থ ও খ্যাতির জোয়ার বইতে শুরু করে এডিসনের দিকে। বলা হয়ে থাকে, সেসময়ে রানী ভিক্টোরিয়ার পরে পৃথিবীর দ্বিতীয় বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন তিনি।
তবে একটি কথা না বললেই নয় যে, তার এ উদ্ভাবনের পেছনে ইউরোপিয়ান প্রযুক্তিবিদদের বিশাল অবদান ছিল, যারা বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাকে উন্নত করেছিলেন। এছাড়াও বৈদ্যুতিক বাতি নিয়ে এর আগে কাজ করা বিজ্ঞানীদের অবদানও অনস্বীকার্য। তবে এডিসনের মতো দূরদর্শী কেউই ছিলেন না। তার মতো অসাধারণ ব্যবসায়িক মননও ছিল না কারো।
এডিসনের দিক থেকে সব কিছু বেশ ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু ১৮৮৭ সালের শেষদিকে এসে তিনি লক্ষ্য করেন, তার কোম্পানির বিক্রি অনেকটা কমে যাচ্ছে। অনেক গ্রাহকই তার কোম্পানির বদলে অন্য একটি ছোট কোম্পানি থেকে বৈদ্যুতিক পণ্য কিনছে। ‘ওয়েশিংটনহাউস ইলেকট্রিক’ নামের পিটাসবার্গের এ কোম্পানিটি অনেক ছোট হলেও বেশ দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল। এডিসনের জন্য আরো অবাক করা বিষয় ছিল, ওয়েস্টিংহাউস ডি.সি বা ডিরেক্ট কারেন্টের বদলে এ.সি বা অল্টারনেটিং কারেন্ট ব্যবহার করছিলো।
এখান থেকেই সূত্রপাত হয় প্রযুক্তির ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত দ্বন্দ্বের। ‘এ.সি বনাম ডি.সি ওয়ার’ বা ‘ওয়ার অব ইলেক্ট্রিসিটি’ নামে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে এটি। এ সময়ে এডিসনের কিছু কার্যক্রমের জন্যই ভীষণ নিন্দিত হন তিনি। অন্য কোনো লেখায় আলোচনা করা যাবে সে বিষয়ে। আজ এ পর্যন্তই থাক।