গেমিং জগতে ইলেকট্রনিক আর্টস (EA) একটি পরিচিত নাম। দশকের পর দশক ধরে তারা ভিডিও গেম জগতে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে আসছে। প্রতিনিয়ত তাদের ভিডিও গেম বিক্রির পরিমাণ বেড়েই চলছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও গেম FIFA, Need For Speed, Madden NFL, SIMS তাদেরই তৈরি। কিন্তু বিক্রির পরিমাণ বাড়লেও বাড়েনি খ্যাতি, বরং লোকমুখে পরিচিতি পেয়েছে Evil Empire নামে। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বাজে কোম্পানি নিয়ে একটি জরিপে ইলেকট্রনিক আর্টস সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। আরো অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে তারা পরের বছরেও সবচেয়ে বেশি ভোট পায় যা একটি ভিডিও গেম কোম্পানি হিসেবে ছিল দুর্লভ একটি ব্যাপার। কিন্তু কেন এই কোম্পানির উপর মানুষের এত ঘৃণা?
ইলেকট্রনিক আর্টসের সূচনা
১৯৮২ সালে ট্রিপ হকিংস ইলেকট্রনিক আর্টস প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে হকিংস তার কোম্পানির নাম দিয়েছিলেন ‘Amazin Software’ যা ১৯৮৩ সালে পরিবর্তন করে ইলেকট্রনিক আর্ট রাখা হয়। ব্যক্তি হিসেবে তিনি একজন মেধাবী মানুষ ছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে এমবিএ করেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ছিলেন অ্যাপলের প্রথম ৫০ কর্মচারীদের একজন। ৪ বছর অ্যাপলে কাজ করার তিনি নিজের কোম্পানি খোলার উদ্যোগ নেন। শুরু থেকেই তার চিন্তাধারা ভিডিও গেম নিয়ে ছিল, এবং তিনি ভেবেছিলেন প্রতিটি ভিডিও গেমই ডেভেলপারের তৈরি করা একেকটি আর্ট! এজন্যই তিনি পরবর্তীতে কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করেছিলেন।
প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় তিনি কিছু গোপন বিনিয়োগকারী থেকে প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার পান। তা দিয়ে শুরু হয় ইলেকট্রনিক আর্টসের আসল পথচলা। ১৯৮৩ সালে তারা প্রকাশ করে কয়েকটি ভিডিও গেমস যার মাঝে বাস্কেটবল গেমটি দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। উল্লেখ্য যে এই গেমগুলোর আইডিয়া তারা নিয়েছিল কোম্পানির বাইরের মানুষদের থেকে। গেমগুলোর জনপ্রিয়তার মুল কারণ ছিল কভার ডিজাইন এবং ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের ভিডিও গেমে উপস্থাপন করা। আশির দশকের শেষের দিকেই তারা ভিডিও গেম কোম্পানি হিসেবে শীর্ষে নাম লেখায়।
কিন্তু সেসময় পিসির চেয়ে কনসোলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় কনসোল ছিল Nintendo। EA যখন Nintendo-র সাথে চুক্তি করতে চাইলো তখন তাদের পক্ষ থেকে একটি শর্ত জুড়ে দেয়। তারা বললো ইলেকট্রনিক আর্টসকে শুধুমাত্র তাদের মাধ্যমেই ভিডিও গেম বিক্রি করতে হবে। কিন্তু EA এই শর্তে রাজি না হয়ে তখন সদ্য উন্মোচন হওয়া Sega Genesis কনসোলের জন্য গেম বানাতে শুরু করে। যা তাদের জন্য একটি ‘ক্রিটিক্যাল’ সিদ্ধান্ত ছিল। তবে এই সিদ্ধান্ত দুই কোম্পানির জন্যেই ফলপ্রসূ ছিল। ১৯৯২ সালে কনসোল গেমের বিক্রির পরিমাণ তাদের পিসি গেমসের বিক্রির পরিমাণকে ছাড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে এই খাত থেকে তাদের লভ্যাংশের পরিমাণ দাড়ায় প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ভিডিও গেম ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের অনেকটা সুনামই ছিল।
সুনাম ধ্বংসের সূচনা
কোনো প্রযুক্তি কোম্পানি যখন বিশালাকার কোম্পানিতে পরিণত হয় এবং নিজ ক্ষেত্রের শীর্ষের দিকে অবস্থান করে তখন তারা সবসময় চায় সেই স্থান ধরে রাখতে। আর এর জন্য প্রয়োজন নিত্যনতুন আইডিয়া, আর এই আইডিয়ার জন্য কোম্পানিরা টার্গেট করে ছোট স্টার্টআপগুলোকে। কোনোটিকে পছন্দ হয়ে গেলে দরদামে নেমে যায় তারা। ছোট হওয়ায় বেশিরভাগ স্টার্টআপই এই লোভ সামলাতে না পেরে বিক্রির খাতায় নিজেদের নাম লিখিয়ে ফেলে।
নতুন স্টার্টআপ কিনে নিলেই যে সেটি সফলতা লাভ করবে এমনটি কিন্তু নয়। এটি নির্ভর করে ‘প্যারেন্ট’ তথা মূল কোম্পানির উপর। কোম্পানি নতুন আইডিয়াকে সঠিকভাবে চালনা করতে ব্যর্থ হলে সেই ছোট স্টার্টআপের ভবিষ্যতের ইতি শুরুতেই ঘটে যায়। এটি একটি প্রযুক্তি কোম্পানির সামগ্রিক চিত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১৯৯২ সালে নিজেদের ব্যবসার পরিধি আরো বিস্তৃত করার জন্য ইলেকট্রনিক আর্টস ‘অরিজিন সিস্টেমস’ নামক একটি ভিডিও গেম ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিকে কিনে নেয়। অরিজিনের ভিডিও গেম সিরিজ Ultima গেমারদের মাঝে অনেক জনপ্রিয় ছিল। EA অরিজিনকে কিনে নিলে আল্টিমার স্বত্ব চলে যায় তাদের হাতে। ইলেকট্রনিক আর্টসের পক্ষ থেকে যখন ULTIMA 8 ও ULTIMA 9 সিরিজ রিলিজ করা হয় তার দুটোই ছিল ত্রুটিতে ভরপুর। ULTIMA সিরিজের সুনাম ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তার সাথে কমতে থাকে বিক্রির পরিমাণও। বিক্রির পরিমাণ কমার ফলে EA এই সিরিজটি বাতিল ঘোষণা করে এবং ২০০৪ সালে অরিজিন সিস্টেমস বন্ধ করে দেয়।
বলা যায় একটি সফল ভিডিও গেম কোম্পানিকে কিনে নিয়ে ধ্বংসই করে ফেলে তারা। এগুলো ছাড়াও BullFrog, Westwood Studios-এর পরিণতিও একই দাড়ায়। ইলেকট্রনিক আর্ট তাদের কিনে নিয়ে কয়েক বছর পর বন্ধ করে দেয়।
সর্বশেষ ২০০৭ সালে তারা BioWare-কে ৮৬০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়। সফলতম গেম নির্মাতাদের মাঝে BioWare ছিল অন্যতম। তাদের তৈরি গেমগুলোর মাঝে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে Mass Effect। কয়েক বছর পর স্টুডিওটির প্রাক্তন স্রষ্টা গ্রেগ জেসুক এবং রে মুজাইকার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই চুক্তিটি তাদের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১২ সালে তারা কোম্পানিটি থেকে চলে যান।
BioWare এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ট্রেন্ট অস্টার বলেছিলেন যে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তিনি আরো বলেছিলেন, “ভিডিও গেম তৈরি করতে আপনাকে গেমটিকে ভালোবাসতে হবে এবং সময় দিয়ে পরিচর্যা করতে হবে, সময়ের চাপে ফেলে ভালো গেম তৈরি করা সম্ভব নয়।” Need For speed সম্পর্কে যারা জানেন তারা Criterion Games নামটির সাথেও পরিচিত থাকবেন। ২০১৫ সালে Criterion Games এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরও কোম্পানিটি থেকে চলে যান অনুরূপ কারণেই। তবে যে কাজের জন্য কোম্পানিটি সবচেয়ে বাজে কোম্পানির খেতাব জিতেছে সেটি নিয়ে এখনো বলা শুরু করা হয়নি।
মাইক্রো-ট্রানজ্যাকশন ও লুটবক্স
লুটবক্স হচ্ছে বাস্তব অর্থ ব্যবহার করে ভিডিও গেমে কোনো কিছু ক্রয় করা। গেমিং জগতে ইলেকট্রনিক আর্টস এই লুটবক্সের জন্য কুখ্যাত হিসেবে নিজেদের পরিচয় তৈরি করেছে। সাধারণত লুটবক্স দেয়া হয়ে থাকে কোনো ভিডিও গেমের ‘স্পেশাল’ বিষয়বস্তু আনলক করার জন্য। কিন্তু ইলেকট্রনিক আর্টস প্লেয়ারদের উপরে এই লুটবক্স অনেকটা চাপিয়ে দেয়। অর্থাৎ প্রথমে গেমটি টাকা দিয়ে ক্রয় করলেও সেখানে ভালোভাবে আগানোর জন্য আপনাকে আরো অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে লুটবক্স কিনতেই হবে। এটি নিয়ে ইলেকট্রনিক আর্টস সবচেয়ে বেশি সমালোচনার শিকার হয় Star Wars Battlefront II গেমটির মাধ্যমে।
এন্টারটেইনমেন্ট জগতে স্টার ওয়ার্স সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উত্তেজনাপূর্ণ ফ্রাঞ্চাইজির মাঝে অন্যতম। আর এর আছে বিশাল ফ্যানবেজ। Star Wars Battlefront II প্রকাশের পূর্বেই ফ্যানবেজে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কারণ গেমে থাকা লুটবক্স ব্যবহার করে যে কেউ সুবিধা লাভ করে এগিয়ে যেতে পারে, যার ফলে এটি সাধারণ গেমারদের জন্য ক্ষতিকারক। এছাড়া লুক স্কাইওয়াকার ও ডার্থ ভেডারের মতো জনপ্রিয় চরিত্র আনলক করতে হলে কমপক্ষে ৪০ ঘন্টা খেলতে হবে কিংবা লুটবক্স কিনতে হবে এমনটা নির্ধারণ করা ছিল, যা গেমারদের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সবচেয়ে বেশি।
ইলেকট্রনিক আর্টসের আরেকটি জনপ্রিয় গেম হচ্ছে ফিফা। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ফিফাতেই লুটবক্সের মাধ্যমে EA-এর রাজস্ব ছিল ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেও বেশি। প্রতি বছরই আগের তুলনায় অধিক রাজস্ব আসছে ফিফা থেকে। এই লুটবক্স ক্রয় থেকে তৈরি হচ্ছে জুয়ার নেশা। যার ফলে বেলজিয়াম সহ কয়েকটি দেশে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এই মাইক্রো ট্রানজ্যাকশন ব্যবস্থা। কিন্তু এতকিছুর পরেও EA তাদের ব্যবসায় সফল। কেন?
প্রতিনিয়ত বাড়ছে ই-স্পোর্টসের প্রসার। আর এটি নির্দ্বিধায় সত্য যে ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গেম। এখানেই ইলেকট্রনিক আর্টস তাদের বাজার টিকিয়ে রেখেছে। শুধু বিক্রির পরিমাণ হিসেব করলেই ২০২০-২১ সময়ে এখন পর্যন্ত ফিফা ২১ বিক্রি হয়েছে প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন কপি। এর সাথে ইন-গেম লুটবক্স তো রয়েছেই। লুটবক্সে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে তারা বিভিন্ন অনলাইন টুর্নামেন্টেরও আয়োজন করছে। ফিফা ছাড়াও অন্যান্য ই-স্পোর্টস বাজার যেমন Madden, UFC, NHL এসবেও ইলেকট্রনিক আর্টসের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বললেই চলে।
শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবেই অনেকটা নিরুপায় হয়েই ইলেকট্রনিক আর্টসের ভিডিও গেম কিনছেন ক্রেতারা। সাথে আয়ের মূল উৎস হয়ে গিয়েছে লুটবক্স এবং বিভিন্ন অনলাইন স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম। কোনো কোম্পানি যখন একচেটিয়া হয়ে উঠে তার খেসারত যে সাধারণ মানুষদেরই দিতে হয় ইলেকট্রনিক আর্টস তার জ্বলন্ত একটি উদাহরণ। এজন্যই ঘৃণিত হলেও বেস্টসেলার অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার কারিগরও আমরা নিজেই।