ধরুন আপনি একটি লটারির টিকিট কিনলেন। কিন্তু লটারি জেতার বিষয়ে আপনার তেমন একটা বিশ্বাস ছিল না। হেলাফেলায় হারিয়ে ফেললেন টিকিটখানা। কিছুদিন পরে জানতে পারলেন সে টিকিটই জিতেছে কোটি টাকার পুরষ্কার। কেমন লাগবে বলুন?
রোনাল্ড ওয়েনের গল্পটা এর চেয়েও করুণ। ভদ্রলোক টেক-জায়ান্ট অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। কিন্তু অ্যাপল শুরুর মাত্র বারো দিনের মাথায় নিজের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিনি। বিনিময়ে তিনি পেয়েছিলেন সর্বমোট তেইশশো ডলার। অথচ তার সে শেয়ার থাকলে বর্তমানে তিনি কয়েক বিলিয়ন ডলারের মালিক হতে পারতেন।
ভাবতে পারেন কত বিশাল লটারির টিকিট হারিয়েছেন তিনি! দু-একটা সিদ্ধান্ত একটু ভিন্ন হলেই আজ বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় থাকতো তার নাম। অবাক করা বিষয় হচ্ছে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো আফসোসও নেই তার। কিন্তু কেন তিনি এমনটা করেছিলেন? তার পরবর্তী জীবনই বা কেমন ছিল? সেই গল্প নিয়েই আজকের লেখাটি।
ওয়েনের জন্ম ১৯৩৪ সালে। স্টিভ জবস ও স্টিভ ওজনিয়াকের তুলনায় প্রায় বছর বিশেকের বড়। তার বেড়ে উঠাও তাদের মতো সিলিকন ভ্যালির আশেপাশে হয়নি। তিনি জন্মেছেন ওহিওর ক্লিভল্যান্ডে। ১৯৫৬ সালের দিকে আসেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। তবে প্রযুক্তিগত দক্ষতা ছিল তার। নিউইয়র্কের ‘স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন টেকনিক্যাল ড্রয়িংয়ের উপর।
ব্যবসা খাতে তার প্রথমদিকের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। স্লট মেশিন বিক্রির একটি কোম্পানি শুরু করেছিলেন। কোম্পানিটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। তিনি কোনোরকমে বেঁচে গিয়েছিলেন দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে। ওয়েন বুঝতে পেরেছিলেন ব্যবসা জিনিসটা ঠিক তার জন্য নয়, তার জন্যে বরং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে যাওয়াটাই মঙ্গল।
ব্যবসায় নেমে তার নিজের যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েছে, তবে নিজের কারণে অন্য কারো ক্ষতি হওয়াটা মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। তাই তার সকল কর্মী ও বিনিয়োগকারীর ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছিলেন। শেয়ার ক্রেতাদের কাছ থেকে ঠিক আগের দামে সব শেয়ার কিনে নিয়েছিলেন তিনি।
জবস ও ওজনিয়াকের সাথে তার পরিচয় উনিশশো সত্তরের দশকে, আটারিতে কাজ করতে গিয়ে। ওজনিয়াক তো রীতিমতো তার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। অতীতে ব্যবসায়িক উদ্যোগের সাথে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা, জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে ওয়েনের চিন্তা ও সৃজনশীলতা মুগ্ধ করে ওজকে। আর ওজনিয়াক সম্পর্কে ওয়েন বলেন, “ও আমার গোটা জীবনে দেখা সবচেয়ে উদার ব্যক্তি। ওর ব্যক্তিত্ব অনেক প্রভাব বিস্তারকারী ছিল।”
তবে জবসের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল কিছুটা ভিন্ন। বছর বিশেকের বড় হলে কী হবে, জবসকে যেন একটু ভয়ই পেতেন ওয়েন। জবস সম্পর্কে তার বক্তব্য, “ও প্রচণ্ডরকমের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। আপনি কখনো ও আর ওর লক্ষ্যের মাঝে দাঁড়াতে চাইবেন না, তাহলে আপনাকে মাড়িয়েই সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাবে।” তবে জবসের শীতল ব্যক্তিত্বকে সমীহও করেন তিনি। কারণ তার জন্যই অ্যাপলকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।
অ্যাপল শুরু করার আরো আগে জবস একবার ওয়েনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি আবার তার স্লট মেশিন বিক্রির ব্যবসা শুরু করতে চান কি না। করলে, তার পক্ষে পঞ্চাশ হাজার ডলারের মতো বিনিয়োগ যোগাড় করা সম্ভব। ওয়েন জবাব দিয়েছিলেন, পঞ্চাশ হাজার ডলার খোয়ানোর জন্যে এর চেয়ে সহজ রাস্তা আর নেই। এরপরে আর কখনো জবস এ বিষয়ে আর কিছু বলেনি।
জবস আর ওজ তাদের জ্যেষ্ঠ বন্ধুটির কথা স্মরণে রেখেছিল। তারা দুজনে যখন অ্যাপল শুরু করতে যান, তখন ওয়েনকে ডাকা হয় অ্যাপলে যোগ দেওয়ার জন্যে। ১৯৭৬ সালের ২ এপ্রিল, যখন অ্যাপল প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনজন- স্টিভ জবস, স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন। তার প্রথম কাজ ছিল তাদের দায়িত্ব বণ্টন করে অ্যাপলের জন্যে একটি আইনি চুক্তিপত্র তৈরি করা।
সে চুক্তিপত্রের প্রথম খসড়া অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত বড়সড় সব কাজের দেখভাল করবে ওজনিয়াক, জবস থাকবেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও মার্কেটিংয়ের দায়িত্বে, আর ওয়েন নথিপত্র ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক কাজ সামলাবেন। এ দায়িত্বের বিনিময়ে ওজনিয়াক ও জবস অ্যাপলের ৪৫ শতাংশ করে শেয়ারের মালিক হন। বাকি ১০ শতাংশ শেয়ার আসে ওয়েনের হাতে।
অ্যাপলের প্রথম লোগোটিও ছিল তার ডিজাইন করা। লোগোটিতে দেখা যায় স্যার আইজ্যাক নিউটন নির্জনে বসে আছেন। আর একটি আপেল ঝুলছে তার মাথার উপরে। ছবির চারপাশের ফ্রেমে লেখা উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি উক্তি- A mind forever wandering through strange seas of thought, alone. অবশ্য এর এক বছরের মাথায় এটি পরিবর্তন করে বর্তমানের বিখ্যাত আপেলের লোগোটি বাছাই করা হয়।
প্রচণ্ড উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে জবস ও ওজ তাদের নতুন কোম্পানি শুরু করলেন। কিন্তু ওয়েনের পক্ষে তা করা সম্ভব হলো না। মাত্র বারো দিনের মাথায় তিনি অ্যাপল থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার শেয়ারের বিনিময়ে আটশো ডলার পান তিনি। পরবর্তীতে আরো ১৫০০ ডলার দেওয়া হয় যাতে ভবিষ্যতে তিনি আর কোনো দাবি না তুলতে পারেন। এভাবে মাত্র ২৩০০ ডলারের বিনিময়ে তিনি বিক্রি করে দেন অ্যাপলের ১০ শতাংশ শেয়ার।
কিন্তু কেন ওয়েন এ ‘বোকামো’ করে বসলেন? কয়েকটি কারণ আছে। প্রথম কারণটি অর্থনৈতিক। ওয়েন ভয় পাচ্ছিলেন যে, কোম্পানি শুরু করতে যেসব ধার-দেনা করতে হচ্ছে, ব্যর্থ হলে তা একসময় তার ঘাড়েই এসে পড়বে। জবস আর ওজের বয়স বিশের ঘরে, হারানোর কিছুই নেই তাদের। কিন্তু বিয়াল্লিশ বছর বয়স্ক ওয়েনের সম্পদ আছে, বাড়ী আছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির দায়ভার যে তারই নিতে হবে এটি বেশ বুঝতে পারছিলেন তিনি। এ চিন্তার জন্যে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। কে তখন ভাবতে পেরেছিল যে, অ্যাপল এতটা সফল হতে পারবে।
নিজের দায়িত্বটিও ওয়েনের পছন্দ হয়নি। বাকি জীবন বসে বসে নথিপত্র ঘাঁটার কাজটি মনে ধরেনি তার। তাছাড়া ওজনিয়াক ও জবসের মতো দুজন ভীষণ উৎসাহী ও দুর্দান্ত মেধাবী তরুণের সাথে তাল মেলাতে পারছিলেন না তিনি। বুঝতে পেরেছিলেন এখানে থাকলে তাদের ছায়া হয়েই থাকতে হবে তাকে। সব মিলিয়ে অ্যাপল ছাড়ার যথেষ্ট যুক্তি ছিল তার কাছে।
সাধারণত বড় কোম্পানিগুলোতে বিভাজন ঘটলে তা অংশীদারদের সম্পর্কে ভীষণ তিক্ততা এনে দেয়। কখনো তো আদালতেও গড়ায়। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটেনি। ওয়েনের চলে যাওয়ায় ওজনিয়াক ও জবস অবাক হলেও, তারা কখনো তার সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলেননি। ওয়েন এরপর ছোটখাটো একটি কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরি নিয়েছিলেন। তবে যোগাযোগ রেখেছিলেন পুরনো বন্ধুদের সাথে। পরবর্তীতে অ্যাপলের কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতও হয়েছিলেন তিনি। যথাযোগ্য সম্মানের সাথে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল তাকে।
অ্যাপল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ওয়েনের তেমন কোনো আফসোস নেই। কারণ তখনকার সময়ের নিরিখে সব যুক্তি বিবেচনা করেই তিনি তার সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। কিন্তু একটা বিষয়ে তার কিছুটা আফসোস রয়ে গেছে। অ্যাপলের প্রথম আইনি চুক্তিপত্রের মূল কপিটি অনেকদিন ধরে তিনি যত্নে রেখেছিলেন। একদিন পত্রিকায় একজন অটোগ্রাফ সংগ্রাহকের দেওয়া একটি বিজ্ঞাপন দেখে তিনি ভাবলেন, এটি জমিয়ে রেখে আর কী হবে? তাই সেটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন ৫০০ ডলারে। এটি ঘটেছিল নব্বইর দশকের শেষের দিকে এসে। পরবর্তীতে ২০১১ সালের এক নিলামে সে চুক্তিপত্রটিই ১.৬ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। আগের ঘটনারই যেন পুনঃমঞ্চায়ন হলো তার জীবনে।
ওয়েনের দুর্ভাগ্যের গল্প এখানেই শেষ নয়। তার বয়স যখন সত্তর বছর, তার সারা জীবনের জমানো সব সম্পদ ডাকাতি হয়ে যায়। ১৪৫ আউন্স স্বর্ণ, ও রৌপ্যমুদ্রায় ৩ হাজার ডলার তিনি তার বাড়ির একটি সিন্দুকে রেখেছিলেন। সিন্দুকটি ভেঙ্গে সবকিছু নিয়ে যায় ডাকাত দল। এ ক্ষতি সামাল দিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। আর্থিক অবস্থা সামলাতে গিয়ে বিক্রি করতে হয়েছিল তার বাড়িটিও। সব মিলিয়ে চরম দুরবস্থায় পড়তে হয় তাকে।
আর্থিকভাবে তার একের পর এক ধাক্কা খেতে দেখে পুরনো প্রশ্নটি ফের আবার জাগে। এতকিছুর পরেও তিনি কীভাবে আফসোসে না ভুগে থাকতে পারেন। তার বন্ধুরাও অবাক হয় এ নিয়ে- এত কিছুর পরেও ওয়েন কীভাবে স্বাভাবিক থাকতে পারেন। এ বিষয়ে ওয়েনের জবাবটি বেশ স্পষ্ট-
আচ্ছা আমি কী করতে পারতাম? যা ঘটে গেছে বা একের পর এক যা হচ্ছে এসব নিয়ে পড়ে থেকে নিজেকে অসুস্থ করে ফেলতাম? এর কোনো মানে হয় না। আমি স্রেফ নিজেকে তুলে ধরেছি আর চেষ্টা করেছি এগিয়ে চলার। আমি গতকালকের কথা ভেবে আমার আগামীকালকে নষ্ট করতে চাই না। এর মানে এই নয় যে আমি আবেগহীন বা কোনো কষ্ট অনুভব করি না। বরং আমি সামনে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই আমার কষ্টকে সামাল দিই। এমন অবস্থায় আমাদের যে কারো পক্ষে সর্বোচ্চ এটুকুই তো করা সম্ভব।