আধুনিক যুদ্ধে হেলিকপ্টার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফরাসিরা তাদের গ্যাজেল হেলিকপ্টারে অস্ত্রশস্ত্র জুড়ে সফলতা পায়। পরে আফগান যুদ্ধের সময় সোভিয়েতরা তাদের সেনাপরিবহন বা পর্যবেক্ষণ হেলিকপ্টারগুলোর সাথে অস্ত্রশস্ত্র জুড়ে দিতে থাকে। এই ভারী অস্ত্রের বহর নিয়ে হেলিকপ্টারগুলো সমান তালে সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশ নিত। প্রয়োজনে আহতদের তুলে নিয়ে যেত বা সেনাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নামিয়েও দিতে যেত। যুদ্ধবিমানের তুলনায় ধীরগতির হলেও অ্যাটাক হেলিকপ্টার বা এই হেলিকপ্টার গানশিপের ধারণাটা পদাতিক সেনাদের সাথে খুব যুতসইভাবে কাজ করে। ফলশ্রুতিতে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, ইরান, তুরস্কসহ বেশ কিছু দেশ হেলিকপ্টার বানানো শুরু করেছে।
আজকে বিশ্বের দুর্ধর্ষ কিছু অ্যাটাক হেলিকপ্টার আর হেলিকপ্টার-গানশিপের ব্যাপারে জেনে নেওয়া যাক।
মিল এমআই ২৪ (ন্যাটো নাম: হাইন্ড)
১৯৬৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে আকাশে ওড়ে মিল এমআই ২৪। তর্কসাপেক্ষে বিশ্বের সেরা হেলিকপ্টার গানশিপটি অস্ত্রের পাশাপাশি সৈন্য বহনে সক্ষম। পঞ্চাশটির বেশি দেশ মিল-২৪ ব্যবহার করেছে বা করছে। উড়ন্ত ট্যাংক, কুমীর বা পানপাত্র জাতীয় অদ্ভুত সব নামের অধিকারী এই গানশিপের পুরু বর্ম এবং প্রচুর অস্ত্র বহনের ক্ষমতা একে শত্রুর কাছে আতংকের বস্তুতে পরিণত করেছিল। আফগানিস্তানের মুজাহিদরা মিল-২৪ কে শয়তানের রথ বলে ডাকতো। একেকটির মূল্য ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রায় ৬০ ফুট লম্বা মিল-২৪ ঘন্টায় ৩৩৫ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে, পাল্লা দিতে পারে ৪৮০ কিলোমিটার। আটজন সৈন্য পরিবহনে সক্ষম এই হেলিকপ্টারে গ্যাটলিং গান, অটোক্যানন, বোমা ও অনেকগুলো করে রকেট বহন করা যায়। এর পুরু বর্ম যন্ত্রপাতি এবং চালককে নিরাপত্তা দেয়। হেলিকপ্টারটি চালানো অপেক্ষাকৃত সহজ হওয়ার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে এটি বিশেষ জনপ্রিয়।
ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরাকি বাহিনীর হয়ে প্রভূত সাফল্য অর্জন করে মিল-২৪। হেলিকপ্টারটি লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা আর এশিয়াতে অসংখ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তবে এর সবথেকে বড় শিকার ছিল সম্ভবত আফগান মুজাহিদরা। সোভিয়েত মিল-২৪ গুলো ২, ৪ অথবা ৮ জনের দলে বিভক্ত হয়ে উড়তো। বাড়তি নিরাপত্তার জন্য হেলিকপ্টারের পেছনের অংশে আরেকটি মেশিনগান ফিট করা হয়। যেহেতু ২৩ মিলিমিটার শেলের থেকে কম শক্তিশালী অস্ত্রে মিল-২৪ এর কিছু হতো না, এটা অনুমেয় যে হালকা অস্ত্রে সজ্জিত মুজাহিদদের কাছে হেলিকপ্টারগুলো শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা দিত। রাতেও যুদ্ধ করতে সক্ষম এই গানশিপগুলো মোকাবেলার জন্য পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র মুজাহিদদেরকে স্টিঙ্গার মিসাইল প্রদান করে।
বোয়িং এএইচ ৬৪ অ্যাপাচি
২০০৩ এর ইরাক যুদ্ধের একদম শুরুর দিকে একটি বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের পাশে রাইফেল হাতে উল্লাসরত এক ইরাকি কৃষকের ভিডিও প্রচুর সম্প্রচারিত হয়েছিল। হেলিকপ্টারটি ছিল বোয়িং এএইচ ৬৪ অ্যাপাচি মডেলের। বোয়িং কোবরা এর বিকল্প এএইচ-৬৪ অ্যাপাচি মার্কিন বাহিনীতে যুক্ত হয় ১৯৮৬ সালে। দিনে-রাতে যেকোনো সময় আক্রমণে সক্ষম এই নিখাদ হেলিকপ্টার গানশিপটি মিসাইল, রকেটসহ ৩০ মিলিমিটার মেশিনগান বহন করে। মার্কিন বাহিনীর মুখ্য আক্রমণ হেলিকপ্টার হিসেবে অ্যাপাচি অনেক যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ভার্সনভেদে দাম ২০ থেকে ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অ্যাপাচি সময়ের সাথে সাথে অনেক আধুনিক হয়েছে। প্রায় ২,০০০ অ্যাপাচি এ পর্যন্ত বানানো হয়েছে। উপসাগরীয় যুদ্ধ, ইরাক বা আফগান যুদ্ধসহ ইজরায়েলের হয়ে, সৌদি আর আরব আমিরাতের বিমানবাহিনীর হয়ে অ্যাপাচি বহু অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে।
কামোভ কেএ ৫০ (ন্যাটো নাম: হোকাম এ)
কামোভ কেএ ৫০ ওরফে কালা হাঙ্গর ১৯৯৫ সালে রুশ বাহিনীতে যুক্ত হয়। এটি একক সিটবিশিষ্ট হেলিকপ্টার। বিশ্বের প্রথম হেলিকপ্টার হিসেবে এর পাইলটের সিটে অটো-ইজেকশান সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। কামোভ-৫০ পুরু বর্মবিশিষ্ট হেলিকপ্টার গানশিপ। নানা মিসাইল ও মেশিনগান বহনে সক্ষম। শত্রুপক্ষের ব্যাপারে গোপনে খোঁজখবর নেওয়া ছাড়াও এই হেলিকপ্টার শত্রুকে খুঁজে ধ্বংস করবার কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রচলিত হেলিকপ্টারে সাধারণত মূল রোটরের পাশাপাশি লেজের দিকে আরেকটি ছোট রোটর বসানো থাকে। কামোভ-৫০ এ দুটি রোটরই ওপরের দিকে, একটির ওপরে অন্যটি বসানো থাকে।
৫২ ফুট লম্বা হেলিকপ্টারটি রুশ বাহিনীর পক্ষ হয়ে চেচনিয়া আর সিরিয়াতে যুদ্ধ করেছে। এর গতিবেগ ঘন্টায় ৩৫০ কিলোমিটারের মতো। রেঞ্জ প্রায় সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার। কামোভ-৫০ ছাড়াও এরদোগান এবং কামোভ-৫২ নামের একটি দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট ভার্সন আছে। কামোভ কেএ ৫০ এর বাজারমূল্য প্রায় ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অগুস্তা এ১২৯ মানগুস্তা (বেজী)
১৯৮৩ সালে আকাশে উড়ে ইতালীর বানানো আগুস্তো এ১২৯ মানগুস্তা হেলিকপ্টার গানশিপ। এটিই প্রথম হেলিকপ্টার গানশিপ, যেটা কি না সম্পূর্ণ ইউরোপীয় প্রযুক্তির সাহায্যে বানানো হয়েছে। তুরস্কের টার্কিশ অ্যারোনটিকস ইন্টারন্যাশনালের সাথে যৌথভাবে নির্মিত এর একটি ভার্সন আছে।
৪০ ফুট লম্বা মানগুস্তা দুই সিট বিশিষ্ট হেলিকপ্টার। এর গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ২৮০ কিলোমিটার, রেঞ্জ প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার। মেশিনগানসহ নানা মিসাইল আর রকেটবহনে সক্ষম এই গানশিপ ইতালীয়দের হয়ে আফ্রিকা, ইরাক আর আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালন করেছে।
ইউরোকপ্টার টাইগার
ফ্রান্স আর জার্মানির যৌথ প্রচেষ্টার ফল ইউরোপকপ্টার টাইগারের। ২৭ থেকে ৩৬ মিলিয়ন ইউরো মূল্যমানের এই হেলিকপ্টার গ্লাস ককপিট, স্টেলথ প্রযুক্তি এবং শক্তিশালী ইঞ্জিনের কারণে বেশ বিপদজনক সমরযান হিসেবে পরিচিত।
৪৬ ফুট লম্বা, দুই ক্রু বিশিষ্ট টাইগার এর গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় তিনশো কিলোমিটার। পাল্লা দিতে পারে প্রায় আটশো কিলোমিটার। হেলিকপ্টারটি দিনে রাতে, সমুদ্রে বা যেকোনো আবহাওয়ায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। টাইগার অত্যন্ত ক্ষিপ্র হেলিকপ্টার, ওজনেও তুলনামূলকভাবে হালকা। গোয়েন্দাগিরি বা তথ্য সংগ্রহ করা, ভারী শত্রুযানের বিরুদ্ধে অভিযান থেকে শুরু করে পদাতিক বাহিনীকে সাহায্য করা, সব ভূমিকাতেই এটি পারঙ্গম। ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন আর অস্ট্রেলিয়ার হয়ে লিবিয়া আর ইরাক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এই হেলিকপ্টারটি।
বেল এএইচ ১ ভাইপার
মার্কিন মেরিন সেনাদের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে বেল এএইচ ১ ভাইপার ওরফে জুলু কোবরা। দুই ইঞ্জিন আর দুই সিট বিশিষ্ট ভাইপারের মূল্যমান প্রায় ত্রিশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মেশিনগানের পাশাপাশি এটি সাইডউইন্ডার, লংবো বা হাইড্রার মতো মারাত্মক সব রকেট আর মিসাইল বহনে সক্ষম। দিনে-রাতে যেকোনো সময় অভিযান চালাতে পারে এটি। ২০১০ সালে এটি মেরিন সেনাদলে যুক্ত হয়।
ভাইপার ৫৮ ফুট লম্বা, গতিবেগ ঘন্টায় তিনশো থেকে চারশো কিলোমিটার, রেঞ্জ প্রায় সাতশো কিলোমিটার। তবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উড়লে রেঞ্জ বা গতিবেগ অনেক কমে আসে। অত্যাধুনিক এভিওনিকস যুক্ত গানশিপটি যুদ্ধক্ষেত্রে অবশ্য এখনো সেভাবে ব্যবহৃত হয়নি। পাকিস্তানসহ বেশ কিছু দেশ হেলিকপ্টারটির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
মিল এমআই ২৮ (ন্যাটো নাম: হ্যাভক)
পনেরো মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের মিল এমআই-২৮ ১৯৮২ সালে প্রথম আকাশে উড়লেও নিয়মিত বাহিনীতে যুক্ত হতে হতে সময় লেগে যায় পঁচিশ বছরেরও বেশি। মিল-২৪ এর মতো এটি কোনো সৈন্য পরিবহন করতে পারে না। দুই সিটবিশিষ্ট হেলিকপ্টারটি নিছকই আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করবার জন্য বানানো হয়েছে। শত্রুর ভারী যানবাহন আর ট্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে এর মুখ্য উদ্দেশ্য।
কামান, মেশিনগান, রকেট আর মিসাইল বহনে সক্ষম এমআই-২৮ এর দৈর্ঘ্য ৫৮ ফুট। গতিবেগ ঘন্টায় ৩০০ কিলোমিটারের বেশি, পাল্লা দিতে পারে প্রায় সাড়ে চারশো কিলোমিটার। সিরিয়ার পালমিরার যুদ্ধে এই হেলিকপ্টার রাশিয়ার পক্ষে অংশ নিয়েছে। এছাড়াও ভেনেজুয়েলা আর আলজেরিয়া মিল-২৮ কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। স্ট্রাইক হেলিকপ্টার হলেও এতে তিনজন বাড়তি মানুষ নেওয়ার মতো জায়গা রাখা থাকে।
ফিচার ইমেজ – Wikiwand