প্রভাবশালী গণমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নিক বিলটনের একটি অভিজ্ঞতা আপনাকে চমকে দিতে পারে। টেক জায়ান্ট অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস ২০১০ সালে প্রথমবারের মত যখন আইপ্যাড বাজারে আনলেন, তখন আমন্ত্রিত সাংবাদিকদের মধ্যে নিক বিলটনও ছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্যান্য সাংবাদিকরা যখন আইপ্যাডের বিভিন্ন চমকপ্রদ ফিচার ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ নিয়ে আলাপ করছিলেন, নিকের তখন ঘটলো এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। আলাপচারিতার ফাঁকে তিনি স্টিভ জবসকে জিজ্ঞাসা করলেন-
আপনার বাচ্চারা নিশ্চয়ই অ্যাইপ্যাড খুব পছন্দ করে?
জবাবে স্টিভ বললেন-
না, তারা এটি ব্যবহার করে না। তাদের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত করে দেয়া হয়েছে।
একথা শুনে নিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। টেক জায়ান্ট অ্যাপলের কর্ণধার তার সন্তানদের অবাধ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দিচ্ছেন না? এছাড়া নিজের উৎপাদিত আইপ্যাড থেকেও তাদের দূরে রাখছেন? এজন্য বিষয়টি তিনি ‘ক্রস চেক’ করে নিশ্চিত হতে চাইলেন।
এরপর তিনি অ্যাপলের কয়েকজন ‘টেকনোলজি চিফ এক্সিকিউটিভ’ এর সাথে কথা বললেন। তারা নিককে জানালেন, শুধুমাত্র স্টিভ জবস নয়; তারা নিজেরাও তাদের সন্তানদের ব্যাপারে অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এমনকি তারা মাঝে মধ্যে সন্তানদের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দিচ্ছেন। বিশেষত, যেদিন সকালে সন্তানদের স্কুল থাকে, সেদিন রাতে সন্তানদের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
নিকের এই জানাজানির পরে মিডিয়া জগৎ প্রযুক্তি জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে গবেষণা শুরু করলো। তারা এতে বেশ রহস্যময় তথ্য-উপাত্ত হাতে পেতে লাগল। জানা গেল, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী ও টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফটের কর্ণধার বিল গেটসও তার সন্তানদের প্রযুক্তি পণ্য থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখছেন।
শুধু বিল গেটস কিংবা স্টিভ জবস নয়, ধীরে ধীরে এই তালিকায় যোগ হতে থাকলেন প্রযুক্তি জায়ান্ট ই-বে, গুগল, ইয়াহু, ৩ডি রোবটিকস, মিডিয়াম, ব্লগার সহ বিশ্বের সেরা সেরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের নাম। এ বিষয়ে আমেরিকার প্রভাবশালী প্রযুক্তি বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘উইরিড’ এর সাবেক সম্পাদক এবং রোবট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘৩ডি রোবটিকস’ এর বর্তমান প্রধান নির্বাহী পরিচালক ক্রিস অ্যান্ডারসন বলেন–
আমার স্ত্রী ও সন্তানরা আমার ওপর প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না দেওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ করে। মাঝেমাঝে স্ত্রী তো স্বৈরাচারীর মতো আচরণ করতে শুরু করে। তারা বলে, তাদের কোনো বন্ধুর পরিবারে নাকি এমন কঠোর নিয়ম-কানুন জারি নেই (প্রযুক্তি পণ্য কম ব্যবহারের ব্যাপারে)।
এরপর এই সাবেক উইরিড সম্পাদক পরিবারের সদস্যদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন-
আমি সরাসরি প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি (প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিক হিসেবে গবেষণা করতে গিয়ে)। আমি নিজেও এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমি চাই না, আমার সন্তানদের বেলায়ও এমনটা হোক।
উল্লেখ্য, ক্রিস অ্যান্ডারসনের ঘরে মোট পাঁচটি সন্তান রয়েছে, যাদের বয়স ৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। সন্তানদের প্রযুক্তি পণ্য থেকে দূরে রাখতে তিনি স্ত্রীকেও প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার থেকে দূরে রাখছেন, কেননা সন্তানরা তার মাকে বেশি অনুকরণ করে।
ব্লগার, টুইটার ও মিডিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ইভান উইলিয়ামস ও তার স্ত্রী সারা উইলিয়ামস জানান, তাদের ছোট্ট দুই সন্তানের জন্য আইপ্যাডের পরিবর্তে রয়েছে শতাধিক মূল্যবান বই। তবে হ্যাঁ, বইগুলো অবশ্যই তাদের জন্য উপযোগী কিনা, তা যাচাই করে সংগ্রহ করা হয়েছে।
ইভান ও সারা উইলিয়ামস দম্পতির কাছ থেকে রহস্যটা সম্ভবত আপনি ধরে ফেলতে পেরেছেন! কেন তারা সন্তানদের প্রযুক্তি পণ্য থেকে দূরে রাখছেন? কারণ তারা মনে করছেন, শিশু বয়স এসব ব্যবহারের উপযুক্ত সময় নয়। এ সময় হলো বই পড়ার, মেধা বিকাশের কিংবা সৃজনশীলতা বৃদ্ধির। আপনি হয়তো জানলে অবাক হবেন, এসব কোটিপতি প্রযুক্তিবিদদের সন্তানদের জন্য রয়েছে আলাদা ‘প্রযুক্তি মুক্ত’ স্কুল। যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো কম্পিউটার পর্যন্ত নেই। কোনো কোডিং শিক্ষার বই নেই। আমাদের দেশের মতো আইসিটি শিক্ষার বোঝাও নেই। তাহলে কি তারা প্রযুক্তিবিদ্যায় অনেক পিছিয়ে পড়ছে?
ব্যাপারটি মোটেও সেরকম নয়। বরং, তারা তাদের কাজের কাজটিই করছে। একজন রুটি উৎপাদক যেমন জানেন, এর মধ্যে কী কী উপাদান রয়েছে, আর এসবের মধ্যে কোনগুলো ক্ষতিকর; ঠিক তেমনি এসব প্রযুক্তিবিদগণও জানেন, তাদের তৈরি প্রযুক্তি পণ্যগুলো কীসের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে, আর এসব ব্যবহারে কী কী ক্ষতি রয়েছে। ফলে আমরা যদি বলি, তারা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছেন, তাহলে বিষয়টা ‘মায়ের কাছে মামা বাড়ির গল্প’ বলার মতোই হয়ে যাবে।
মূল কথা হলো, প্রযুক্তিবিদ ও গবেষকগণ বলছেন, সন্তানদের একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত প্রযুক্তি পণ্য থেকে দূরে রাখা উচিত কিংবা সীমিত করা জরুরি। বিশেষত, শিশু ও কৈশোরের সংবেদনশীল সময়ে তাদেরকে বিভিন্ন ইলেকট্রিক ডিভাইসের পর্দা থেকে রক্ষা করা জরুরি। আর এক্ষেত্রে মোবাইল থেকে সতর্ক হতে হবে সবার আগে। অথচ আমাদের দেশের পিতা-মাতারা ছোট্ট শিশুকে খাওয়ানোর সময়েও আদর করে সামনে মোবাইল পর্দা খুলে রাখেন। বিষয়টা এমন হয়েছে যে, অনেক শিশুর সামনে এখন আর মোবাইল না থাকলে খেতেই চায় না।
আমাদের দেশে এসবের ক্ষতিকর দিক নিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কিনা, জানা নেই। তবে ইউরোপে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, সেখানকার ৪৩ শতাংশ শিশু মোবাইল পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পর্যাপ্ত ঘুম থেকে দূরে সরে গিয়েছে। আর শিশুকালের অভ্যাস দূর করা যে কত কঠিন, তা আপনারা হয়তো ভালো করেই জানেন।
এখন কথা হচ্ছে, তাদের ঘুম কমে যাওয়ার ফলে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে? গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সেখানকার ৩২ শতাংশ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া ৩৮ শতাংশ শিশু অদক্ষ হয়ে বেড়ে উঠছে। এ জরিপ পরিচালিত হয়েছে ৫ থেকে ১৬ বছরের সন্তানদের ওপর। জরিপে অংশ নেয়া ৭,০০০ পিতা-মাতার মধ্য থেকে ৬৫ শতাংশ জানিয়েছে, তাদের সন্তানরা একান্ত বেডরুমে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আর মুক্ত ইন্টারনেটের এ যুগে এর দ্বারা তারা যে বিভ্রান্ত হবে না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে?
তবে আশার দিক এতটুকু যে, এদের মধ্য থেকে ৪৯ শতাংশ পিতা-মাতা তাদের সন্তানদেরকে প্রযুক্তি পণ্য থেকে দূরে রাখতে চান। আর হতাশার দিক হলো, তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারছেন না, কীভাবে তারা এটা বাস্তবায়ন করবেন (কেননা, সন্তানরা তা সহজে মেনে নেবে না)। এজন্য আপনাকে সাবেক সম্পাদক ক্রিস অ্যান্ডারসনের মত কঠোর হতে হবে। তিনি বলেন,
“এটি হলো এক নম্বর আইন- তাদের বেডরুমে কোনো স্ক্রিন থাকতে পারবে না। পূর্বেও ছিল না, সামনের দিনেও থাকবে না।”
ক্রিস অ্যান্ডারসনের এই হুমকিতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তিনি তার কিংবা আপনার সন্তানদের চিরতরে প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছেন- বিষয়টি এমন নয়। এসব প্রযুক্তিবিদ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিক থেকে তাদের কিংবা আপনাদের সন্তানদের নিরাপদে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। আর হ্যাঁ, আপনি হয়তো ভাবছেন, এর দ্বারা আপনার সুযোগ্য সন্তান প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু এজন্য আপনাকে একজন মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানতে চাই।
তার নাম অ্যালান ইগল। ২০০৭ সালে তিনি জায়ান্ট সার্চ ইঞ্জিন গুগলে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে ডার্টমাউথ কলেজ থেকে তিনি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। অথচ তিনি স্কুলজীবনে জানতেনই না, গুগল কী জিনিস! তাহলে সফল হওয়ার জন্য আপনার সন্তানের এখনই মোবাইল ফোন ব্যবহার করা কি খুব জরুরি?
তাহলে কোন বয়সে সন্তানদের প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারের অনুমতি দেয়া উচিত? এর সুনির্দিষ্ট কোনো সমাধান নেই। অনেকে ১৮ বছরের প্রস্তাবনা দিয়ে থাকেন, অনেকে আবার আরও বেশি বয়স পর্যন্ত প্রযুক্তি পণ্য নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত দেন। তবে স্কুল জীবনে যে প্রযুক্তি পণ্য সীমিত রাখা উচিত- এ বিষয়ে সকলে একমত। পরিশেষে উল্লেখ করতে হয়, ক্ষতির পাশাপাশি অন্য কোনো কারণে কি জায়ান্ট প্রযুক্তিবিদগণ তাদের শিশুদের প্রযুক্তি পণ্য থেকে দূরে রাখার পক্ষে?
হ্যাঁ, তারা মনে করেন, এ সময়টা সন্তানদের মানবিকতা শেখার, সৃজনশীলতা বৃদ্ধির ও নৈতিক শিক্ষা অর্জনের সময়। তাই এ সময়ে প্রযুক্তি থেকে তাদের দূরে রাখার বিকল্প কোনো উপায় নেই। একজন অভিভাবক কিংবা পিতা-মাতা হিসেবে এটা আপনার জন্য একটি উত্তম পরামর্শ।