শুরুর আলাপ
টেক দুনিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে নানারকম কানাঘুষা শোনা যায়, আমাদের সুপরিচিত ইন্টারনেট নাকি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। পুরানো চেহারা পাল্টে নতুনরূপে তার আবির্ভাব ঘটার আগমনী বার্তা শোনা যাচ্ছে চারপাশে। নতুন এই ইন্টারনেটকে বলা হচ্ছে ওয়েব ৩.০। কিন্তু খুব কম মানুষই জানেন আদতে কী কী পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে সামনের দিনগুলোয় আর তা কিভাবে বদলে দেবে আজকের ইন্টারনেট ইন্ডাস্ট্রিকে। রোর বাংলার পাঠকদের সে বিষয়ে জানিয়ে রাখতেই এই আয়োজন।
ওয়েব ৩.০ সম্পর্কে জানার আগে আমাদের ভালোভাবে জানা প্রয়োজন এর পূর্বতন দুটি ভার্সন সম্পর্কে। তাই আগে আমরা ওয়েব ১.০ এবং ওয়েব ২.০ সম্পর্কে জেনে নেবো সংক্ষেপে।
ওয়েব ১.০
কতিপয় স্ট্যাটিক ওয়েবসাইট নিয়ে গড়ে উঠেছিলো প্রথম যুগের ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। একটি সাইট তখন হাজার রকমের তথ্য দিয়ে বোঝাই ছিলো, ছিলো না কোনো ব্যবহারকারীর সাথে ইন্টার্যাক্ট করতে পারে এমন কোনো কন্টেন্ট। সেসময় ইন্টারনেটের সাথে কানেক্ট করাও ছিলো বিশাল ঝক্কির ব্যাপার। বারে বারে মডেম দিয়ে ডায়াল করা বা টেলিফোন ক্যাবল ব্যবহার করে বাসার অন্য সবাইকে টেলিফোন ব্যবহার করতে না দেয়া ছিলো খুবই পরিচিত দৃশ্য। যারা অনেক পুরোনো ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, তাদের হয়তো ঘটনাগুলোর ফ্ল্যাশব্যাক হয়ে গেলো একে একে।
ইন্টারনেট বোঝাতে অনেকেই তখন বুঝতেন এওএল চ্যাট রুম বা এমএসএন ম্যাসেঞ্জার, আস্ক জিভস বা আলতা ভিসতা। আর ইন্টানেটের গতি যেন ছিলো দুঃস্বপ্নের মতো। এখনকার সময়ে ভিডিও এবং মিউজিক স্ট্রিম করা যেমনটি পানি-ভাত হয়ে গিয়েছে, তখনকার দিনে তা কল্পনাই করা যেত না। ভাগ্য ভালো থাকলে, একটি গান ডাউনলোড হতে সময় নিতো পুরো একটি দিন!
তারপর এলো ওয়েব ২.০
বিপ বিপ করতে থাকা মডেম আর ঘুম ধরানো ওয়েবসাইট ইন্টারফেসের হাত থেকে মুক্তি মিললো তখন। এপার থেকে শুধুমাত্র চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়াও ব্যবহারকারীরা ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারছেন। ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি পেলো, হরেক রকম ইন্টারেক্টিভ কন্টেন্টে ভরে উঠলো ইন্টারনেট। সর্বোতভাবে তথ্য আদান প্রদানের যে সংস্কৃতি, তা গড়ে উঠলো ফেসবুক, ইউটিউব, উইকিপিডিয়া, ফ্লিকার, টুইটার ইত্যাদির মাধ্যমে। অর্থাৎ বর্তমান সময়ের এই ইন্টারনেটই হলো ওয়েব ২.০।
ওয়েব ২.০-র এই যুগটি নিঃসন্দেহে অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছে আমাদের। তথ্য আদান প্রদান করার ক্ষেত্রেপড়ো-লেখো-শেয়ার করো-র এই ওয়েবটি তো সবকিছু চলছে ঠিকঠাকই, অন্তত সাদাচোখে তো তাই দেখছি আমরা। তবে নতুন করে কি হলো? কেনই বা আসছে ওয়েব ৩.০?
তথ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
জাতিসংঘের এক হিসাব মতে, ২০০০ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিলো মাত্র সাতশো আটত্রিশ মিলিয়ন। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন দশমিক দুই বিলিয়ন। অর্থাৎ, মাত্র পনের বছরের ব্যবধানে এখন পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত, যেখানে ২০০০ সালে মোট জনসংখ্যার আটভাগের একভাগ মানুষও ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন না।
এখন এতসব মানুষের হাজার রকম তথ্য, তাদের পরিচয়, শেয়ার করা বিভিন্ন লেখা, ছবি বা ভিডিও ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে আগামী বিশ্বে, টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলো তা বুঝে নিয়েছে আগেভাগেই। মানুষ জানুক কিংবা না জানুক, গুগল, আমাজন, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহারকারীদের সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, যেমন তাদের পরিচয়, অবস্থান, ইন্টারনেট ব্রাউজ করার ধরণ, সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহারের ধরণ, অনলাইন শপিং ইত্যাদি বিক্রি করে থাকে। বিভিন্ন সেবা পেতে ব্যবহারকারীরাও নিরাপত্তার প্রশ্নে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে মাথা ঘামাচ্ছেন না।
ওয়েব ৩.০: শুরুর যাত্রা
আমাদের দৃশ্যমান ইন্টারনেটের দুনিয়ার পেছনের মঞ্চে ইতোমধ্যেই আবির্ভাব হয়েছে ওয়েব ২.০ এর পরবর্তী প্রজন্মের ইন্টারনেট। আগামীর ইন্টারনেট হতে যাচ্ছে আরো মানবিক এবং তথ্যের গোপনীয়তা খুবই দৃঢ়ভাবে রক্ষিত হবে সেখানে, ঠিক যেমন ভিশন ছিলো ওয়েব ১.০ যাত্রার প্রাক্কালে। অর্থাৎ তথ্যের স্বার্থে এবং তার গোপনীয়তার প্রশ্নে আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি ওয়েব ১.০-এ, কিন্তু তাদের বৈশিষ্ট্যে থেকে যাচ্ছে বিস্তর ফারাক।
টেক জায়ান্টদের হাতে তথ্যের সর্বময় ক্ষমতার সমাপ্তি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, নতুন ওয়েবে তথ্যের একচ্ছত্র অধিকার থাকবে শুধুমাত্র ব্যবহারকারীর।
২০০৬ সাল নাগাদ তুলনামূলক স্বচ্ছ এবং তথ্যের নিরাপত্তাদানে যে ভিশন তৈরি হয়েছিলো, তা বাস্তবে রূপদানের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং টেকনোলজি আমাদের কাছে ছিলো না। তথ্যের বিকেন্দ্রিকরণ, পিয়ার-টু-পিয়ার ডিজিটাল স্টোরেজ বা ব্যবহারকারীকেন্দ্রিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা যা-ই বলি না কেন, ব্লকচেইন প্রযুক্তির আবির্ভাবের পর ইন্টারনেটকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়ার শুরু হয় পুরোদমে। অর্থাৎ নতুন ইন্টারনেট তৈরিতে আমাদের প্রধান অস্ত্রই হচ্ছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি।
তথ্যের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং মোড়লবিহীন ইন্টারনেট
ওয়েব ২.০ আমাদের সামনে সম্ভাবনার নানা রাস্তা খুলে দেয়, কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুব বেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে মনোপলি। অর্থাৎ এই ভার্চুয়াল দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে কতিপয় মোড়ল তৈরি হয়। ফেসবুক, উবার, এয়ার বিএনবিসহ সমজাতীয় সাইবার প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তাদের ডোমিনেশানের জায়গাগুলোয়। ওয়েব ৩.০ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বলা হচ্ছে, সকল লাভের কেন্দ্রিকতার বিকেন্দ্রিকরণ হবে নতুন ওয়েবে এবং গড়ে উঠবে তথ্য আদান-প্রদানের মুক্ত এক নেটওয়ার্ক।
এ বিষয়গুলো কল্পনা করা খুব বেশি কঠিন নয়। এ খবরগুলো আমাদের সামনে উঁকি দিচ্ছে, কারণ ইতিমধ্যেই ক্রিপ্টোকারেন্সি, ক্রিপ্টোফোন, ভিপিএন এবং স্টোরেজের বিকেন্দ্রিকরণ ইত্যাদি আমাদের সামনে চলে এসেছে এবং তা ভবিষ্যতের সকল প্রযুক্তির আমূল বদলে দেবার ইঙ্গিত। ব্লকচেইনই আমাদের কাছে নতুন হাতিয়ার, নিরাপদ তথ্যের আদান-প্রদান এবং মোড়লবিহীন ওয়েব তৈরিতে। আসছে ওয়েব ৩.০ এর কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে নেওয়া যাক একে একে।
১. ইন্টারনেটের কোনো মোড়ল থাকছে না
তথ্যের আদান-প্রদানে তৃতীয়পক্ষ থাকছে না আর। ইথারিয়াম বা বিটকয়েনের মতো ব্লকচেইনগুলো এমন প্লাটফর্ম আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, যার নিয়মগুলো অমান্য করার সুযোগ নেই এবং সকল তথ্যই যেখানে সম্পূর্ণরূপে এনক্রিপ্টেড। প্রতিষ্ঠানগুলো তাই তার ব্যবহারকারীদের তথ্যের উপর একচ্ছত্র অধিকার হারাতে চলেছে। কোনো সরকার বা অথোরিটি চাইলেই কোনো সাইট বা সার্ভিস বন্ধ করে দিতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি পারবে না অন্য কারো তথ্য নিয়ন্ত্রণ করতে।
২. তথ্যের মালিকানা
প্রান্তিক ব্যবহারকারীরাই হবেন তার আদান প্রদান করা সকল তথ্যের একমাত্র নিয়ন্ত্রক। অনুমতি ব্যতিরেকে তথ্যের আদান-প্রদান কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বর্তমানে যেমন আমাজন, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিশাল বিশাল সার্ভারে তার ব্যবহারকারীদের যাবতীয় তথ্যের সংগ্রহ করে রাখে এবং তা কেনা বেচা করতে বিলিয়ন ডলারের একটি মার্কেট গড়ে উঠেছে, সকল তথ্য এনক্রিপ্টেড হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো সেই ক্ষমতা হারাবে।
৩. হ্যাকিং এবং ডাটা ব্রিচিংয়ের হাত থেকে পরিত্রাণ
যেহেতু সকল তথ্যের বিকেন্দ্রিকরণ ঘটছে এবং তা সমগ্র ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকছে, হ্যাকারদের তা হাতিয়ে নিতে সমগ্র নেটওয়ার্কেই হানা দিতে হবে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের সরকার এবং সিকিউরিটি এজেন্সিগুলো যে ধরনের টুল ব্যবহার করে থাকে, তা-ও হয়ে যাচ্ছে অকেজো। তাই ব্যক্তিগত তথ্যের লিকেজ থেকে আমরা মুক্তি পেতে যাচ্ছি, এই হলো মোদ্দাকথা।
৪. বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমের মাঝে সম্পর্ক
বর্তমানে আমরা যেসব মোবাইল বা ওয়েব অ্যাপ ব্যবহার করি, তার সবই ওপারেটিং সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল। যেমন বিভিন্ন অ্যান্ড্রয়েড ভিত্তিক ক্রিপ্টোকারেন্সি আইওএসে অচল। সামনের দিনগুলো ওপারেটিং সিস্টেমের ওপর এমন নির্ভরশীলতা কমতে থাকবে।
৫. ব্লকচেইনভিত্তিক অবাধ সেবা
অর্থ বা অন্যান্য ডিজিটাল সম্পদগুলো মুহূর্তেই দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে পৌছাবে। ডেটা অসংখ্য আন্তঃসম্পর্কিত নোডের দ্বারা যুক্ত থাকবে তথ্যের প্রাচুর্যতা নিশ্চিত করতে এবং কয়েক ধাপে ব্যাকআপ রাখা হবে যা সার্ভার কোনো জটিলতা বা চুরি হওয়া ডেটার উদ্ধারে ভূমিকা রাখবে
যেভাবে কাজ করবে ওয়েব ৩.০
আগামির প্রযুক্তি হিসেবে সম্পূর্ণ তৈরি হতে ওয়েব ৩.০ কে পাড়ি দিতে হবে আরো কিছুটা পথ। থিওরি থেকে বাস্তবে রূপ নিতে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। ওয়েব ৩.০ অর্থাৎ যে ডিসেন্ট্রালাইজ ওয়েব গড়ে উঠছে, তাতে প্রবেশের জন্য দরকার হবে একটি মাত্র সিড। এই একটি মাত্র পরিচয় নিয়েই আমরা বিভিন্ন ডিঅ্যাপ এবং ওয়েব সার্ভিস ব্যবহার করতে পারবো। একটি ওয়েব ব্রাউজার তখনও লাগবে এবং সেগুলোকে গড়ে তোলা হবে ওয়েব ২.০ এর সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ।
সাদাচোখে দেখা যাবে, ওয়েব ২.০ থেকে ওয়েব ৩.০ তে পরিবর্তিত হবে তেমন কোনো বেগ পেতে হবে না সাধারণ ব্যবহারকারীদের। কিন্তু তারা এখন যা ব্যবহার করে এবং ওয়েব ৩.০ তে যা ব্যবহার করবে, তার গঠনে থাকবে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। বর্তমানের কিছু প্রযুক্তিকে যারা প্রতিস্থাপন করে দিবে সামনের দিনগুলো, তাদের একনজরে দেখে নেওয়া যাক এবার।
ওয়েব ২.০ যেমনটি ওয়েব ১.০ কে একেবারে বিলুপ্ত করে দেয়নি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনও এমন ওয়েবসাইট আমাদের চোখে পড়ে এবং প্রয়োজন হয়, তেমনি ওয়েব ৩.০ সময়ের সাথে আমাদের বিদ্যমান ইন্টারনেট ব্যবস্থায় নিজের জায়গা করে নেবে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়তো আগামি তিন বছরের মধ্যেই ওয়েব ৩.০ আমাদের যাপিত জীবনের অংশ হবে উঠবে। ওয়েব ৩.০ এর ট্রেনটি ইতিমধ্যে তার প্লাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা। তথ্যভিত্তিক দুনিয়ায় ঘটতে যাওয়া আগাম এই বিপ্লবের খবর শেষ করছি তথ্যের নিরাপদ আবাদের সাইবার দুনিয়ার অপেক্ষায়।
ফিচার ইমেজ: academcity.com