শুধু জাতীয় গ্রিড থেকে নয়, এবার নিজ বাসা থেকেই বিদ্যুৎ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যাবে

প্রথমে শুরু হলো ভ্রমণের সময় অনেকজন মিলে একটি গাড়ি অংশীদারে ব্যবহার করা, এরপর শুরু হলো একই ঘরে ভাড়া ভাগ করে ঘরে অংশীদারি করা। এবার শুরু হলো সরাসরি শক্তির ক্ষেত্রেও অংশীদারিত্ব। বোঝা যায়নি? একটু পরিষ্কার করেই বলা যাক তাহলে।

টেসলা পঞ্চাশ হাজার বাড়িতে সৌর প্যানেল এবং লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি বসাবে; Source: theguardian.com

টেসলা এরকম একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়াতে। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সরকার গত মাসে ঘোষণা দিয়েছে যে টেসলা সেখানে পঞ্চাশ হাজার বাড়িতে সৌর প্যানেল এবং লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি বসাবে। এই প্রকল্পের মূল আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভার্চুয়াল পাওয়ার প্ল্যান্ট এবার বসানো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াতে।

সনাতন পদ্ধতিতে বাসায় বাসায় শক্তি, যেমন বিদ্যুৎ বা গ্যাস সরবরাহ করা হয় একটি কেন্দ্রীয় জায়গা থেকে, যেখানে শক্তি তৈরি হয়। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যেটা হবে সেটার ধারণা অনেকটা এরকম- বাসাতেও শক্তির একটি অংশ তৈরি হবে এবং সেটাকে সর্বক্ষণ সফটওয়্যারের মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে নজর রাখা হবে। যদি কোনো বাসায় বিনা কারণে শক্তির অপচয় হয়, তাহলে কেন্দ্র থেকে সেটা বন্ধ করা হবে এবং যদি অন্য কোনো বাসায় শক্তির কম ব্যবহার হয় বা কোনো কারণে কম শক্তির সরবরাহ হয় তাহলে আগের বাসায় যে অতিরিক্ত শক্তির খরচ হচ্ছিলো সেটা পরের বাসায় সরবরাহ করা হবে। এর ফলে শক্তির অপচয় কমিয়ে আনা যাবে এবং ভার্চুয়াল সিস্টেমের কারণে বাসাগুলো একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে। মোবাইলে টাকা রিচার্জের মতো শক্তিও কিনে রিচার্জ করা যাবে। অস্ট্রেলিয়ার এখানে শুধু বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য এমন প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এই প্রকল্পের ফলে শক্তির অপচয় কমিয়ে আনা যাবে এবং ভার্চুয়াল সিস্টেমের কারণে বাসাগুলো একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে; Source: greentechmedia.com

যেহেতু বাসায় বাসায় নিজেদের বিদ্যুৎও নিজেরা তৈরি করা যাবে তাই এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিদ্যুৎ বিল আগের তুলনায় ৩০ শতাংশের মতো কম খরচ হবে। যতটুকু শক্তি একটি বাসায় দিনে তৈরি হবে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি ব্যবহারের পর অতিরিক্ত উৎপন্ন শক্তি কেন্দ্রীয় গ্রিডে চলে যাবে এবং সেখান থেকে অন্য জায়গায় ঐ শক্তি প্রয়োজনমত সরবরাহ করা হবে। এতে শক্তির কিন্তু কোনো অপচয় হচ্ছে না, বরং শক্তিগুলো সবজায়গায় প্রয়োজনমতো বণ্টন করে দেয়া যাচ্ছে যার জন্য খরচ কমে যাচ্ছে এবং গ্রিডের উপর চাপও কম পড়ছে। হিসাব অনুযায়ী এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বিদ্যুৎ বিলের খরচ ১৪০ মিলিয়ন ডলারের মতো বাঁচানো যাবে।

এটা এমন একটি উদ্যোগ যেটা বাস্তবায়ন করতে পারলে লাভ হবে সবার। অনেকটা সবাই জয়ীর মতো অবস্থা। এরকম প্রকল্পের পরিকল্পনা করা গিয়েছে শুধুমাত্র ব্যাটারি এবং সোলার প্যানেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে। মাত্র দুই বছর আগেও এখনকার দাম থেকে ব্যাটারির দাম দ্বিগুণ ছিল। দাম কমে যাওয়ার কারণে প্রত্যেকটি বাসা নিজেরাই তাদের নিজস্ব পাওয়ার সিস্টেম তৈরি করে নিতে পারে এবং নিজেদের শক্তি নিজেরাই তৈরি করতে পারে। কিন্তু নিজেরা নিজেরা শক্তি তৈরি করলেও নিয়ন্ত্রণ থাকে কেন্দ্রীয় একটি মাত্র পাওয়ার প্ল্যান্টে। তাদের কাজ থাকে শক্তির সমবণ্টন করা। আসলে কেন্দ্রীয় শক্তি কার্যালয় এই কাজটি করবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে।

টেসলার এই উদ্যোগ অনেক কম খরচে শক্তি সরবরাহ করতে পারবে; Source: fortune.com

যদি পরের দিন একটি অঞ্চলের উপর দিয়ে তাপীয় প্রবাহ বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে আগের দিন রাতে কম দামে, অফ-পিক আওয়ারে প্রত্যেকটি বাসা তাদের ব্যাটারি বিদ্যুৎ চার্জ করে নিতে পারবে। আবার যদি পরের দিন আবহাওয়া মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয় তাহলে সোলার প্যানেলগুলো চালানো যাবে না। এমন ক্ষেত্রে গ্রিড থেকে টপ-আপের মতো শক্তি সরবরাহ করে নেয়ার ব্যবস্থাও থাকবে। এই ব্যবস্থা অনেকটা পিয়ার-টু-পিয়ার শক্তি সরবরাহ করার মতো ব্যাপার।

২০১৫ সালে জার্মানির সোনেন (Sonnen) নামক একটি ব্যাটারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এরকম পিয়ার-টু-পিয়ার শক্তি সরবরাহ করার একটি প্রকল্পে হাত দিয়েছিলো। প্রাথমিকভাবে তারা দশ হাজার বাড়ি দিয়ে এরকম একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে শক্তি সরবরাহ করার ব্যবস্থা শুরু করে। সেই ব্যবস্থার জন্য একেকটি বাসার সোলার প্যানেল এবং ব্যাটারি লাগানোর জন্য দশ হাজার ডলার খরচ করতে হয়েছিলো এবং নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে মাসে ৩০ ডলার করে দিতে হয়েছিলো। কিন্তু বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য আর কোনো টাকা তাদের দিতে হয়নি। এমনিতে যে মাসে মাসে গ্রিডের শক্তি পাওয়ার জন্য ২০০ ডলার করে দিতে হতো সেটাও আর দিতে হচ্ছিলো না। অর্থাৎ ৫ বছর পর তারা তাদের খরচ পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ পেলো। অর্থাৎ পাঁচ বছর পর তাদের লাভ হওয়া শুরু হবে। এখানে লাভ ছাড়া লোকসান নেই, কারণ যে ব্যাটারি বাসাগুলো লাগিয়েছিল সেগুলোর ওয়ারেন্টি ছিল প্রায় দশ বছর করে। অর্থাৎ একটি দীর্ঘমেয়াদী লাভের জন্য প্রাথমিকভাবে একটু বেশী খরচ করার ফলে এখন জার্মানিতে শক্তির অপচয় রোধ করা গিয়েছে এবং সবার জন্য সমান শক্তি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করে গিয়েছে।

টেসলা প্রতিটি বাসার ছাদে সোলার প্যানেল লাগাবে; Source: Energy Storage News

শুধুমাত্র বাসা বাড়িতেই যে শক্তি ভাগ করে নেয়ার এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় কোম্পানিগুলোও শক্তির অপচয় রোধ করার জন্য এমন প্রকল্প থেকে সুবিধা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং করছেও।

শুধুমাত্র যে বিদ্যুতের ক্ষেত্রেই এমন ব্যবস্থা করা যাবে তা কিন্তু নয়। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের গ্যাস সমস্যা যেখানে গ্যাস কোম্পানিগুলো প্রায়ই বেশী দাম নিয়ে এরপর গ্যাসের যোগান দিয়ে থাকে এবং কোনো কারণে যদি জরুরি অবস্থায় শক্তির প্রয়োজন পড়ে তখন প্রায় একশ গুণ বেশি দামে সেই শক্তি সরবরাহ করা হয়। জরুরি অবস্থা বলতে তাপ প্রবাহকালীন সংকট কিংবা গ্রিড যদি কোনো কারণে ফেল করে এমন সময়কে বোঝায়।

এরকম ভার্চুয়াল সিস্টেম চালু করলে এবং পুরো জায়গায় ছড়িয়ে দিলে শক্তি যোগানের স্থিতিস্থাপকতা অনেক বেশি বেড়ে যাবে। কারণ সব বাসার ব্যাটারি একসাথে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম, প্রায় শূন্যের কাছাকছি। তাই একটি বাসার ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেলে গ্রিড থেকে বা অন্য কোনো বাসা থেকে শক্তির সরবরাহ সেই বাসাতে করা যাবে। তাছাড়া বাসায় বাসায় যে ব্যাটারি ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো গ্রিড থেকে অনেক কম জায়গা দখল করে এবং সাশ্রয়ী। তাই ভার্চুয়াল সিস্টেম কিন্তু একদিক দিয়ে ভালো কিছু দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

এরকম ভার্চুয়াল সিস্টেম চালু করলে এবং পুরো জায়গায় ছড়িয়ে দিলে শক্তি যোগানের স্থিতিস্থাপকতা অনেক বেশি বেড়ে যাবে; Source: theverge.com

এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এটা থেকে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে তা দিয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে পুরো অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ শক্তি উৎস হবে বাসা-বাড়িগুলোতে লাগানো সোলার প্যানেল, যা দিয়ে একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে কম খরচে শক্তি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

তবে এরকম প্রকল্পেরও কিন্তু কিছু খারাপ দিক থাকে এবং এর থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। যেমন, যেসব দেশে সূর্যের আলো খুব বেশি সময় ধরে পাওয়া যায় না কিংবা শীতকালে যে সূর্যের আলো কম পাওয়া যায় সেই ক্ষেত্রে ওই সময়টার জন্য হয়তো ভার্চুয়াল শক্তি সরবরাহ করা কষ্টকর হয়ে যাবে। তখন হয়তো যে খরচ সাশ্রয়ের কথা বলা হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে খরচ ওই সময়টার জন্য বেড়ে যাবে।

জে ওয়েদারিল, টেসলার প্রকল্প উদ্বোধনের সময়; Source: smh.com.au

তবে যদি এই প্রকল্প অনেক বেশি মানুষের জন্য ঠিকঠাকভাবে চলে তাহলে খরচ কমানোর দিক দিয়ে এবং দূষণ রোধের দিক দিয়ে এটি অনেক বড় একটি অর্জন হিসেবে প্রতীয়মান হবে বলে ধারণা করা যায়। উন্নত দেশের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশ এবং অর্থনৈতিকভাবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এই প্রকল্প কেমন কাজ করবে সেটাও দেখার বিষয়। প্রাথমিক যে খরচ সেটা যদি সরকারের তত্ত্বাবধায়নে করা যায় তাহলে হয়তো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য এই পরিকল্পনাটি একটি আশার বাণী হয়ে উঠতে পারে।

ফিচার ইমেজ সোর্স: New Scientist

তথ্যসূত্র:

New Scientist (International Edition) March, 2018, pp. 22-23

Related Articles

Exit mobile version