২০১৪ সালে ওয়ানকয়েন নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি পুরো ইউরোপে সাড়া ফেলে দেয়। ওয়ানকয়েনের স্রষ্টারা বললেন এটি বিশ্বের অর্থনীতিকে আজীবনের জন্য পালটে দেবে, বিটকয়েনের চেয়ে এর পরিধি হবে কয়েকগুণ বড় ও উন্নত। আর অল্প বিনিয়োগেই লভ্যাংশ হবে অনেক বেশি। আর আদান-প্রদান এতটাই স্বচ্ছ হবে যে সরকার পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না। কিন্তু ২০১৭ সালে ওয়ানকয়েনের স্রষ্টা নিজেই সিনেমার মতো ৪ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করে হাওয়া হয়ে গেলেন। ব্যক্তিটি ছিলেন নিজেকে ক্রিপ্টোকুইন হিসেবে দাবি করা ডক্টর রুজা ইগনাটোভা। দ্যা টাইমস পত্রিকা এই ঘটনাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় স্ক্যাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ড. রুজার ঠিকানা আজও সবার অজানা।
ডক্টরেট থেকে ক্রিপ্টোকুইন
রুজা ইগনাটোভা ১৯৮০ সালে বুলগেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৯০ সালে তার বাবা-মা জার্মানিতে কর্মসংস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ১০ বছর বয়সে নিজের দেশ ছেড়ে তাকে জার্মানিতে পাড়ি দিতে হয়। সেখানে গিয়ে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলেও মেধাবী হওয়ায় একাডেমিক বিষয়গুলোতে তার ফলাফল ছিল নজরকাড়া। অত্যন্ত ভালো ফলাফলের জন্য তিনি নবম গ্রেড বাদ দিয়ে সরাসরি দশমে উঠেন এবং ইউনিভার্সিটি অফ কন্সট্যান্স থেকে মাত্র আড়াই বছরে আইন বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর ২০০৫ সালে ইউরোপিয়ান প্রাইভেট ল -এর উপর পিএইচডি করেন। জানা যায় পরবর্তীতে তিনি মাস্টার্সের জন্য অক্সফোর্ডেও ভর্তি হয়েছিলেন। ২০১২ সালে জার্মানিতেই একটি কোম্পানি অধিগ্রহণে জালিয়াতির কারণে রুজাসহ তার পিতাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
২০১৪ সালে রুজা তৈরি করেন ওয়ানকয়েন নামক একটি পনজি স্কিম। সেসময়ও সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিপটোকারেন্সি ছিল বিটকয়েন। ক্রিপ্টোকারেন্সি জনপ্রিয়তা পাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকা। ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিয়োগের পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে সাধারণ মানুষের উপর, অর্থের মূল্য সরকার কিংবা ব্যাংকের উপর নির্ভর করবে না। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর মানুষের গতানুগতিক মুদ্রার প্রতি বিশ্বাস হালকা হয়ে পড়ে। এই সুযোগে আবির্ভাব হয় নতুন একধরণের মুদ্রার ধরন- ক্রিপটোকারেন্সি।
প্রতিটি ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট মুদ্রার একটি ওয়ালেট বা একাউন্ট থাকতে হয়। যাবতীয় লেনদেন হয় এই ওয়ালেটের মাধ্যমে। প্রতি মুদ্রার অর্থ নির্ধারিত হয় এর জনপ্রিয়তা এবং মাইনিং (Mining)-এর উপর। মাইনিং হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি উৎপাদন প্রক্রিয়া। মাইনিং সময়সাপেক্ষ এবং খানিকটা ব্যয়বহুল হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ সাধারণ অর্থ দিয়েই ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনে থাকে এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অপেক্ষা করতে থাকে। ওয়ানকয়েনকে জনপ্রিয় করাই ছিল রুজার মূল উদ্দেশ্য, যাতে একটি বিশাল অংশ প্রচলিত অর্থ দিয়ে তার ওয়ানকয়েন কিনে জমা রাখে। ২০১৪ সালে তৈরির পর থেকে রুজা বিভিন্ন জায়গায় এটি নিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন এবং বিভিন্ন ইভেন্ট তৈরি করে মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালান। এক্ষেত্রে তার শৈশবের গল্প এবং একাডেমিক পরিচয় মানুষের আস্থা তৈরিতে তাকে সাহায্য করে। এভাবেই রুজার ফাঁদে পড়ে প্রায় ১৭৫টি দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং তিনি হয়ে ওঠেন ক্রিপ্টোকুইন।
যেভাবে এই স্ক্যাম পরিচালিত হয়েছে
ওয়ানকয়েন ছিল একধরনের মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম। এই মার্কেটিং তৈরি করা হয় কিছু প্যাকেজ দিয়ে, যেমন স্টার্টার (Starter) কিংবা এডুকেশনাল প্যাকেজ। একজন যদি কোনো প্যাকেজ কিনে আরেকজনকে একটি প্যাকেজ কিনতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে তাহলে অন্য ব্যক্তিটি যখন প্যাকেজ কিনবে তখন প্রথমজন কিছু কমিশন পাবে। কিন্তু এই মার্কেটিংয়ে কতিপয় মানুষ ছাড়া কেউ লাভবান হয় না। এখানে লাভবান হয় শুধু প্রথম সারির ক্রয়কারীরা। যতই নিচের দিকে যাওয়া হয় ততই লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ওয়ানকয়েনের নানাপ্রকার প্যাকেজ ছিল যেগুলোর মূল্য ছিল ১০০ থেকে ১০০,০০০ ডলার পর্যন্ত।
ওয়ানকয়েনের প্যাকেজগুলো টোকেন হিসেবে বিক্রি হতো, যা দিয়ে পরবর্তীতে মাইনিং করা যাবে এমনটি বলা হয়েছিল। এছাড়া আরও বলা হয় যে, মার্কিন ডলার কিংবা অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির চেয়ে ওয়ানকয়েনের মূল্য ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু শেষে দেখা যায় ক্রিপ্টোকারেন্সির ভিত্তি অর্থাৎ ব্লকচেইনের কোনো স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানকয়েন ব্যবহার করেনি এবং এর পুরোটিই ছিল ভাঁওতাবাজি।
রুজা সবসময় আর্থিক স্বাধীনতা টার্মটি ব্যবহার করে তার অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করতো। প্যাকেজ ক্রেতাদের বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপ খুলতে বলা হতো এবং বাহ্যিক যাবতীয় সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করতে বলা হতো। ওয়ানকয়েন সবচেয়ে ভালো এবং অভিজ্ঞ মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং ব্যাপ্তিবর্গকে নিয়োগ করেছিল এবং সাথে রুজার অনবদ্য বক্তৃতা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে ওয়ানকয়েন অত্যন্ত দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে এবং উগান্ডার মতো অঞ্চলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।
শুধু অনুপ্রেরণামুলক বক্তব্য দিয়েই নয়, রুজা নানারকম প্রযুক্তিগত কারসাজিও করেছিল। গুগলে তার নাম সার্চ দিলে তার ছবিযুক্ত ফোর্বস ম্যাগাজিনের একটি কভার পাওয়া যেতো, যেখানে তাকে ক্রিপ্টোকারেন্সির একজন অগ্রদূত হিসেবে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে ফোর্বসের কভারে এমন কিছুই ছাপা হয়নি। এটি একটি বিজ্ঞাপন ছিল মাত্র। এই ট্রিকের ফলে অনেকেই তার ফাঁদে পড়েছিল। এছাড়া যখনই কোম্পানিটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হতো তখনই এটি নানান রকমের ইভেন্টের আয়োজন করতো। বিউটি কন্টেস্ট ছিল এরকমই একটি ইভেন্টের উদাহরণ। যেখানে পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়েছিল বাস্তব অর্থের সমমূল্য ওয়ানকয়েন ভাউচার। তারা প্রচার করে ইভেন্টে প্রায় ২০-৩০ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করেছে এবং Vogue Magazine এই ইভেন্টের স্পনসর, অথচ Vogue এর কোনো ধারণাই ছিল না এ সম্পর্কে।
রুজার ওয়েবসাইটের নাম ছিল onelife.com। সাইটটিতে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাকরণগত ভুলের দেখা মিলতো। এসব সত্ত্বেও অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে ওয়ানকয়েনে সকল মানুষের ইনভেস্টমেন্টের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। ডেসটিনি কেলেঙ্কারির সাথে এর মিল পাওয়া গেলেও ওয়ানকয়েনকে কিন্তু তৈরি করা হয়েছে পুরো প্রযুক্তির খেলা দিয়ে।
বর্তমানে প্রযুক্তির সহায়তায় যে বিশাল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়া সম্ভব তার একটি উদাহরণ হচ্ছে ওয়ানকয়েন। ইন্টারনেট জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য তথ্যাদি এবং প্রতিনিয়ত আরও নিত্যনতুন তথ্য যুক্ত হচ্ছে। এসবের মাঝে খুব কম সংখ্যক মানুষই সঠিক তথ্য যাচাই করে কাজ করে। এ কারণে কোম্পানিগুলো খোলামেলাভাবেই মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করতে পারে এবং একটি বিশাল অংশকে ভুল দিকে ধাবিত করাতে পারে। যদি কোনো ভুল তথ্য ধরা পড়েও যায় তখন সেটি ফেক কিংবা হেটারদের দ্বারা তৈরি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। ওয়ানকয়েন স্রষ্টা রুজা ইগনাটোভা সাধারণ মানুষকে সরকারবিরোধী করে কাজ চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। অতঃপর তিনি হলেন অদৃশ্য!
ওয়ানকয়েন গল্পের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল লন্ডন। রুজার হাতে যতই অর্থ আসছিল তার ব্যয়ের সীমানাও যেন ততই বিস্তৃত হয়ে উঠছিল। বুলগেরিয়া, জার্মানিতে রুজা তৈরি করেছিলেন বিশাল সব ম্যানশন। ব্লাক সি তে রেখেছিলেন একটি ইয়ট এবং সাথে দামি অলংকার তো আছেই। এমনকি তার লেক্সাস গাড়িটিও ছিল কাস্টমভাবে তৈরি করা।
এছাড়া ২০১৬ সালের এপ্রিলে ইন্টারন্যাশন্যাল মার্কেটিং স্ট্রাজেটেজিস লিমিটেড নামক কোম্পানির মাধ্যমে তিনি ব্রিটেনের স্বনামধন্য এলাকা নাইটসব্রিজে অফিস তৈরির নামে ৩৬ মাসের জন্য একটি জায়গার ইজারা গ্রহণ করেন। তিনি কেনসিংটনে কয়েক মিলিয়ন ডলারের সমমূল্য একটি পেন্টহাউজও কিনেছিলেন যেখানে ছিল সুইমিং পুল, দামি পেইন্টিংস সহ সকল ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ ব্যবস্থা। যদিও এসব পরবর্তীতে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
হারিয়ে যাওয়া
২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে পর্তুগালের লিসবন শহরে রুজার একটি বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সেমিনারটিতেই পৌঁছাননি, তার সহকর্মীদের কাছেও এটি ছিল একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ রুজা ছিলেন অত্যন্ত সময়ানুবর্তী। কারো এক মিনিট দেরি হওয়াতেও মিটিং ক্যান্সেল করে দেওয়ার নজির আছে তার। কল কিংবা মেসেজ কোনোটারই আর উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। রুজার সাথে সবসময় দুটি বডিগার্ড থাকতো কিন্তু তারাও ছিল সূত্রহীন। রুজার এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গী ছিল তার ভাই কন্সট্যান্সটিন ইগনাটোভ। রুজার হারিয়ে যাওয়ার পর কোম্পানির হাল ধরেন তিনিই। রুজাকে খোঁজার জন্য কিছু প্রাইভেট ডিটেক্টিভেরও সাহায্য নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তবুও তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
২০১৯ সালের মার্চে কনস্ট্যান্সটিন একটি ফ্লাইটে করে লস এঞ্জেলেস থেকে বুলগেরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনার পথে এফবিআই তাকে গ্রেফতার করে। রুজা এবং তার উপর অর্থ পাচার ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। কন্সট্যান্সটিনকে মোট ৯০ বছরের সাজা দেয়া হয় এবং রুজাকে আজও খুঁজে বেড়াচ্ছে এফবিআই সহ নানা গোয়েন্দা সংস্থা। কন্সট্যান্সটিনের দেওয়া সাক্ষ্যে রুজা সম্পর্কে আরও তথ্য বেরিয়ে আসে। জানা যায় গায়েব হওয়ার পূর্বে রুজা তাকে বলেছিলেন তার উপর সংকট আসন্ন এবং কেউ তাকে এফবিআই-এর হাতে তুলে দিতে পারে। এছাড়া তিনি ভিয়েনা ও এথেন্সের উদ্দেশ্যে কিছু প্লেন টিকিটও কিনেছিলেন। এটিই ছিল ড. রুজা ইগনাটোভা সম্পর্কে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য।
এতকিছুর পরেও এখনও অনেকে মনে করেন বড় কোম্পানিদের ষড়যন্ত্রের কারণেই ড.রুজা আত্মগোপন করেছেন। জালিয়াতি ঘোষণা করা স্বত্বেও এখনও তার তৈরি ওয়ানকয়েন কেনাবেচা হচ্ছে। রুজা বেঁচে রয়েছেন কি না এই উত্তর দেয়া সম্ভব নয় আর তাকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভবনাও ক্ষীণ। হয়তো এটিই একদিক দিয়ে ভালো। প্রযুক্তির সাহায্যে যে সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব রুজা তা দেখিয়ে গিয়েছেন, বুঝিয়েছেন যে প্রযুক্তির এই বিশাল জগতে আমাদের সতর্ক হয়ে চলতে হবে।