যুদ্ধবিমানের কথা উঠলে সাধারণত রুশী/সোভিয়েত বা মার্কিন যুদ্ধবিমানের কথাই মাথায় আসে। হাল আমলে অবশ্য চীন, ভারত, পাকিস্তান, তাইওয়ান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশীয় শক্তিরাও যুদ্ধবিমান নির্মাণের ব্যাপারে মনোযোগী হয়েছে। তবে এই ডামাডোলে ইউরোপীয় যুদ্ধবিমানের কথা একটু চাপাই পড়ে থাকে। গুণে, মানে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে দারুণ কার্যকরী এমনই কিছু ইউরোপীয় যুদ্ধবিমানের কথা আজ জেনে নেওয়া যাক। এর কোনোটি একইসাথে অনেকগুলো ভূমিকায় যুদ্ধে অংশ নিতে সক্ষম, কোনোটি আবার দূরপাল্লায় বোমা নিক্ষেপের কাজে পারদর্শী, আবার কোনো বিমানের মুখ্য ভূমিকাই হচ্ছে শত্রুর স্থলবাহিনীর ওপরে হামলা চালানো।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইউরোপের যুক্তরাজ্য আর জার্মানী যুদ্ধবিমান নির্মাণে বিশেষ সাফল্য দেখায়। এর পাশাপাশি ইতালী, ফ্রান্স এবং পরে স্নায়ুযুদ্ধের সময় চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রোমানিয়া, সুইডেন প্রভৃতি দেশ বিমান নির্মাণের ব্যাপারে অল্পবিস্তর সাফল্য লাভ করে। উল্লেখ্য, মহাযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের কলোনি হারিয়ে এবং যুদ্ধের প্রবল খরচের চাপে আগের শক্তি অনেকখানি হারিয়ে ফেলে। তবে তারপরেও যুদ্ধক্ষেত্রে ইউরোপীয় যুদ্ধবিমান বরাবরই প্রতিপক্ষকে শক্ত চাপে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
ডসল্ট মিরেজ-৩
কোরিয়া যুদ্ধের সময় সোভিয়েত মিগ-১৫ এর দ্রুতগতি আর সাফল্য দেখে ফরাসি কর্তারা ঠিক করেন অমন ছোটখাট, দ্রুতগতির বিমান তাদেরও লাগবে। এরই ফলাফল হিসেবে ১৯৬১ সালে আকাশে ওড়ে মিরেজ-৩। ডসল্ট এভিয়েশন পরে রাফায়েলের মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান বানালেও মিরেজ-৩ই তাদের এখন পর্যন্ত বানানো সেরা বিমান হিসেবে বিবেচিত।
মিরেজ-৩ দ্বিতীয় প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। এটি প্রায় ৫০ ফুট লম্বা। লেজবিহীন ডেল্টা আকৃতির ডানাবিশিষ্ট এই বিমান আকাশযুদ্ধে ডগফাইটে পারদর্শী। একজন পাইলটই বিমানটি চালাতে পারে, পাল্লা দিতে পারে প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার। প্রথম ইউরোপীয় বিমান হিসেবে মিরেজ-৩ এর গতিবেগ ম্যাখ ২ ছাড়ালে এটি বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল সে আমলে। একেকটি বিমান নির্মাণে খরচ পড়ে প্রায় ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলার।
লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে মিরেজ-৩। ১৯৬৭ সালে, ৬ দিনের যুদ্ধে আরবদের ৫৯টি যুদ্ধবিমান আকাশযুদ্ধে ধ্বংস হয়, এর মধ্যে ৪৮ খানাই মিরেজ-৩ এর শিকার। ১৯৭৩ এর যুদ্ধে মিরেজ-৩ ও এর ইসরায়েলী ভার্সন নেশের এর আক্রমণে প্রায় দুই শতাধিক সিরীয় আর মিশরীয় যুদ্ধবিমান বিদ্ধস্ত হয়েছিল। ফকল্যান্ডের যুদ্ধেও আর্জেন্টিনা সফলভাবে এই বিমান ব্যবহার করেছে। বিশ্বের অনেক দেশেই মিরেজ-৩ এর নানা আপগ্রেড করা সংস্করণ ব্যবহৃত হচ্ছে।
সাব জেএএস ৩৯ গ্রিপেন
স্নায়ুযুদ্ধের সময় সুইডেনের নেতারা ভয় পেতেন যেকোনো মুহূর্তে সোভিয়েত সমরযন্ত্র তাদের ওপরে হামলে পড়বে। সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় সুইডেন অনেক ক্ষুদ্র শক্তি। কাজেই সুইডিশ সামরিক পরিকল্পনায় সস্তা অথচ কার্যকরী সমর প্রযুক্তির কদর বেশি। সুইডিশ যুদ্ধবিমানেও এর ছাপ পড়েছে। গ্রিপেনের পূর্বসুরী ভিজ্ঞেন বা ড্রাকেন ছিল ছোট মাপের, সস্তা বিমান, যেগুলো খুব সহজে তুষারাবৃত বা অনুন্নত রানওয়ে ব্যবহারে সক্ষম। এই গুণাবলী গ্রিপেনেও রাখা হয়েছে।
সাব গ্রিপেন আকাশে ওড়ে আশির দশকে। বিমানটি পঞ্চাশ ফুটের মতো লম্বা, গতিবেগ প্রায় ম্যাখ ২, পাল্লা প্রায় ৯০০ কিলোমিটার। এর রক্ষণাবেক্ষণ সহজ এবং মার্কিন বিমানের তুলনায় গ্রিপেন অনেক কম খরুচে। আকাশযুদ্ধ বা মাটিতে হামলা চালানো, দুই ক্ষেত্রেই এই যুদ্ধবিমান পারদর্শী। সাইডউইন্ডার, মাভেরিকসহ ন্যাটো অস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম বিমানটি সুইডিশ বিমানবহরের মুখ্য জঙ্গীবিমান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সুইডেন দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল এবং ইউরোপের নানা দেশে গ্রিপেন রফতানী করেছে বা করছে। তবে এসব বেচাকেনা আসলেই সুইডিশ বিমানটির গুণপনার জন্য সম্ভব হয়েছে নাকি সংশ্লিষ্ট কর্তাদের ব্যাপক হারে ঘুষ দেওয়ার জন্য, তা নিয়ে সুইডেনে বিতর্ক চলমান।
জাগুয়ার
ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন এবং ফরাসি ব্রিগিত এভিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে বানানো হয় জাগুয়ার। এটি মূলত স্থলবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করবার উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে। জাগুয়ার ১৯৭৩ সালে ফরাসি ও ব্রিটিশ বিমানবাহিনীতে প্রবেশ করে। ২০০৫ এর কিছু পরে এই বিমানগুলোকে অবসরে পাঠানো হয়। ভারত অবশ্য এখনো কিছু জাগুয়ার ব্যবহার করে। সময়ের সাথে সাথে জাগুয়ারে নানাবিধ পরিবর্তন আনা হয়েছে।
জাগুয়ার ৫৫ ফুট লম্বা, সুইপ্ট উইং প্রযুক্তি এবং দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। প্রায় হাজার কিলোমিটারের কাছাকাছি পাল্লা দিতে পারে এরা। নিতে পারে অনেকগুলো রকেট, মিসাইল এবং বোমা। এর রোলস রয়েস ইঞ্জিন ম্যাখ ১.৫ এর মত গতিবেগ অর্জনে সক্ষম। বিমানটি এশিয়া আর আফ্রিকার বহু যুদ্ধে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। একেকটির নির্মাণ ব্যয় প্রায় আশি লক্ষ মার্কিন ডলার।
ফরাসিরা আফ্রিকার শাদ, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র মৌরিতানিয়াসহ নানা দেশে জাগুয়ার এত বেশি ব্যবহার করেছে যে ওসব অঞ্চলে ‘জাগুয়ার কূটনীতি’ নামের একটি কথাই চালু হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীতে এখনো অনেকগুলো জাগুয়ার আছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ আর ফরাসি জাগুয়ার ইরাকী বাহিনীর ওপরে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে। বিমানটি গোয়েন্দাগিরি কাজেও বহুল ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
ইউরোফাইটার টাইফুন
ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি আর স্পেনের বিমান নির্মাতারা আশির দশকে যৌথভাবে ইউরোফাইটার টাইফুন নির্মাণে কাজ শুরু করে। পরে ফ্রান্স এই জোট থেকে বেরিয়ে আলাদাভাবে রাফায়েল যুদ্ধবিমান বানায়। যা-ই হোক, ১৯৯৪ সালে যখন প্রথম টাইফুন আকাশে ওড়ে তখন স্নায়ুযুদ্ধ শেষ, অত্যাধিক খরুচে হওয়াতে এই বিমান নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়েও অনেক জল ঘোলা হয়েছে।
টাইফুন খুবই আধুনিক যুদ্ধবিমান। কানার্ড যুক্ত ডেল্টা ডানা, গ্লাস ককপিট, ফ্লাই বাই ওয়ার সিস্টেম, ইনফ্রা রেড ট্র্যাকিং সিস্টেম, শক্তিশালী রাডার এবং বিমানটির অসাধারণ নিয়ন্ত্রণক্ষমতা আকাশে একে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার ক্ষমতা দিয়েছে। টাইফুনের গতিবেগ ম্যাখ ২। কী পরিমাণ বাড়তি তেল নেওয়া হচ্ছে তার ওপরে নির্ভর করে এটি কয়েকশত থেকে হাজারের বেশি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। বিমানটি মাত্র পঞ্চাশ ফুটের মতো লম্বা হলেও সমসাময়িকদের তুলনায় প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র বইতে সক্ষম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাইলট দরকারে স্রেফ মুখে নির্দেশ দিয়ে বিমানটিকে চালাতে পারেন, তবে অবশ্যই সবক্ষেত্রে নয়।
ইউরোপীয় ভূমিতে সরাসরি বিমান হামলা চালানোর মতো কোনো প্রবল শত্রু না থাকায় টাইফুনকে পরে ভূমিতে হামলা চালাবার মতো সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। লিবিয়াতে গাদ্দাফীপন্থী সেনাদের ওপরে টাইফুন ব্যাপক হামলা চালায়। সৌদি আরবসহ বিশ্বের নানা দেশ এই বিমান কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে টাইফুনের দামের ব্যাপারটাও একটু জেনে রাখা ভাল। একেকটির জন্য গুণতে হবে প্রায় ১৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্যানাভিয়া টর্নেডো
ব্রিটেন, ইতালি আর জার্মানির যৌথ প্রচেষ্টার ফলাফল হিসেবে প্যানাভিয়া টর্নেডো ১৯৭৯ সালে আকাশে ওড়ে। এটি দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট, সুইপ্ট উইং যুদ্ধবিমান। টর্নেডোর মুখ্য দায়িত্ব ছিল সোভিয়েত বা ওয়ারশ চুক্তিভূক্ত দেশের স্থলবাহিনীর ওপরে আক্রমণ চালানো। সেরকম কোনো যুদ্ধ অবশ্য আর হয়নি, কাজেই পরবর্তীকালে টর্নেডোকে বিমানযুদ্ধ এবং গোয়েন্দাগিরির কাজে ব্যবহার করার উপযোগী করা হয়।
দুই আসন বিশিষ্ট টর্নেডো যুদ্ধবিমানের গতি ম্যাখ ২ এর বেশি, রেঞ্জ হাজার কিলোমিটারের ওপরে। পরমাণু বোমা সহ নানা অস্ত্রশস্ত্র বহন করতে পারে এই বিমান। জার্মানি, ইতালি আর যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি সৌদি আরব এই বিমান ব্যবহার করে। উপসাগরীয় যুদ্ধ, ২০০৩ এর ইরাক যুদ্ধ, আইএস এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিককালের ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের হামলায় টর্নেডো যুদ্ধবিমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে।
অ্যাভরো ভালকান
বিখ্যাত ‘ভি-বোমারু’দের মধ্যে অন্যতম অ্যাভ্রো ভালকান পঞ্চাশের দশকে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীতে যুক্ত হয়। এটি মূলত স্ট্র্যাটেজিক বোমারু, পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম এবং লম্বা দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন। পাঁচজন মানুষ লাগতো বিমানটি চালাতে। পরমাণু বোমা না থাকলে ২১ খানা প্রায় পাঁচশো কেজি ওজনের বোমা নিতে পারতো এটি।
অতিকায় বোমারুটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় একশো ফিট। লেজবিহীন ডেল্টা ডানা দুটোর প্রস্থ ছিল আরেকটু বেশি। ঘন্টায় প্রায় সাড়ে ছয়শো মাইল গতিতে উড়তে পারে ভালকান। ১৯৮২ এর ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় ছয় হাজার কিলোমিটার আকাশপথ পাড়ি দিয়ে ভালকান বোমারু আর্জেন্টাইন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। যদিও আকাশপথে ট্যাংকারের সাহায্য না পেলে বিমানটির পাল্লা নেমে আসে চার হাজার কিলোমিটারে।
ফকল্যান্ড যুদ্ধ ছাড়াও ব্রিটিশদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোতে সমর্থনের প্রমাণ হিসেবে ভালকান পাঠানো হতো। মালয়েশিয়াতে ইন্দোনেশিয়া সমর্থিত গেরিলারা যুদ্ধ বাধিয়ে বসলে ব্রিটিশরা যথারীতি মালয়ে ভালকান বোমারু পাঠায়। বর্তমানে অবশ্য এই বিশাল বিমানটি আর ব্যবহার করা হয় না।
ফিচার ইমেজ – Youtube