কম্পিউটার যন্ত্রটি আজ আমরা যেরকম দেখি, অর্থাৎ যে সকল কাজে ব্যবহার করি, এর শুরুটা কিন্তু মোটেও এরকম ছিল না। প্রথমে কম্পিউটারের জন্ম হয়েছিল শুধু হিসাব-নিকাশ করার জন্য। আরও মজার বিষয় হলো, সর্বপ্রথম কম্পিউটার শব্দটি দ্বারা কোনো যন্ত্রকে বোঝাতো না। বরং যারা হিসাব-নিকাশের কাজ করতো, তাদের বোঝাতো।
এই লেখায় আমরা কম্পিউটার নামক এই যুগান্তকারী যন্ত্রের পূর্বাপর ইতিহাস জানব। কে কে এর উদ্ভাবনের সাথে জড়িত, কাদের অবদানে আমরা আধুনিক কম্পিউটার পেয়েছি, কোন কোন কোম্পানির অবদান সবচেয়ে বেশি- এগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে এই সিরিজে। আজকের এই লেখায় আমরা আলোচনা করবো কম্পিউটারের প্রারম্ভিক ধাপ নিয়ে।
আজকের আধুনিক দুনিয়ার চালিকাশক্তি হলো কম্পিউটার। যদি হুট করে পৃথিবীর সব কম্পিউটার বন্ধ হয়ে যায়, তবে বৈদ্যুতিক পাওয়ার গ্রিড বন্ধ হয়ে যাবে, উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটবে, পানি ব্যবস্থাপনা নষ্ট হয়ে যাবে, শেয়ারবাজার মুখ থুবড়ে পড়বে, খাদ্যবোঝাই যানবাহন বুঝবে না কোথায় সরবরাহ করতে হবে, এমনকি চাকরিজীবীরা বেতন পাবে না। শুধু তা-ই নয়, বড় বড় কলকারখানাগুলোও কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আজকে আমরা প্রযুক্তি-নির্ভর সমাজব্যবস্থায় বাস করছি। অটোমেটেড ফার্মিং থেকে চিকিৎসা খাত, বৈশ্বিক টেলি-যোগাযোগ থেকে শিক্ষাসহায়ক যন্ত্রপাতিতে, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি থেকে স্বচালিত গাড়ি… কম্পিউটার সবজায়গায় বিরাজমান। সত্যিকার অর্থেই আমরা ইলেক্ট্রনিক যুগে বাস করছি।
কম্পিউটার এসেছে Compute তথা গণনা করা থেকে। অর্থাৎ, যে গণনা করতে পারে, তাকেই কম্পিউটার বলে। গণনাক্ষমতাসম্পন্ন ইতিহাসে সর্বপ্রাচীন যে যন্ত্রটির কথা জানা যায়, তা হলো ‘অ্যাবাকাস’। এটি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সালে (কমপক্ষে ১১০০ খ্রিস্টপূর্ব) মেসোপটেমীয় সভ্যতায় আবিষ্কৃত হয়। এর আয়তাকার ফ্রেমে হালকা সমান্তরাল রড থাকত। প্রতিটি রডে ভিন্ন এককের, ভিন্ন ওজনের চাকতি থাকত। এটি কাউকে হাত দ্বারা পরিচালনা করতে হতো, যা যোগ-বিয়োগ করতে পারতো। এতে গণনার বর্তমান অবস্থাকে স্টোর করে রাখা যেত, আজকের দিনের হার্ডড্রাইভের মতন। এখানে কয়েক স্তরে চাকতি বা ঘুঁটির মতো জিনিস সাজানো থাকত, প্রতি স্তরে যার মান দশ গুণ করে বৃদ্ধি পেত।
অ্যাবাকাসের সূত্র থেকে পরবর্তী ৪,০০০ বছর ধরে মানবসভ্যতা আরও জটিল যন্ত্র তৈরি করতে থাকে। যেমন- অ্যাস্ট্রোলেব, যা সমুদ্রে অক্ষাংশ মাপতে ব্যবহৃত হতো। আক্ষরিক অর্থেই শত শত প্রকার ঘড়ি তৈরি হয়েছিল, যেগুলোর দ্বারা শুধু সময়ই নয়, সূর্যোদয়, জোয়ার-ভাটা, নক্ষত্রের অবস্থানও নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা যেত। প্রতিটি যন্ত্রেরই কিছু না কিছু বিশেষত্ব থাকতো, ফলতঃ পূর্ববর্তী সময় থেকে কম পরিশ্রমে আরও সঠিকভাবে নিখুঁত মান পাওয়া যেত। এ ব্যাপারে আধুনিক কম্পিউটারের জনক চার্লস ব্যাবেজ বলেন,
জ্ঞানের প্রতিটি উৎকর্ষের সাথে সাথে প্রতিটি নতুন সরঞ্জামের উদ্ভাবনের সুফল হেতু মানব শ্রম সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
যদিও এগুলোর কোনোটিকেই আদৌ কম্পিউটার বলা হতো না। কম্পিউটার শব্দটির প্রথম ব্যবহার পাওয়া যায় ১৬১৩ সালে রিচার্ড ব্র্যাথওয়েইটের লিখিত একটি বইয়ে। আগেই বলা হয়েছে, শুরুতে আদতে কোনো যন্ত্রকেই বোঝাতো না, এটি ছিল একটি চাকরির পদবির নাম। এমন একজন ব্যক্তি, যে কি না হিসাব-নিকাশের কাজ করতো; কখনো যন্ত্রের সাহায্যে, কখনো বা সাহায্য ছাড়াই! ব্র্যাথওয়েইট বলেন,
সময়ের দ্রুততম কম্পিউটার এবং সেরা পাটিগণিতবিদদের সাথে আমার দেখা হয়েছে, তাদের অবদানেই দিনগুলো সংক্ষিপ্ত হয়েছে, সময়গুলো বেঁচে গেছে।
এই পদবী অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত চলতে থাকে, যার পর থেকে এর দ্বারা মানুষকে না বুঝিয়ে যন্ত্রকে বোঝানো শুরু হয়।
১৬২৩ সালে জার্মান জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদ উইলহেম শিকার্ড প্রথম ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন। তার জ্যোতির্বিদ বন্ধু জোহাননেস কেপলারকে লেখা এক চিঠিতে তিনি এ সম্পর্কে খুলে বলেন। এর নাম তিনি দেন ‘ক্যালকুলেটিং ক্লক’। ১৬২৪ সালে তিনি আবার একটি চিঠি লেখেন, যার সাথে যন্ত্রটির একটি প্রোটোটাইপও ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুটোই আগুনে পুড়ে যায়। আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারগণ পরে চিঠির বিবরণ অনুযায়ী যন্ত্রটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
কিন্তু শিকার্ডেরও এক শতাব্দী আগে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ক্যালকুলেটরের একটি মডেল স্কেচ করেছিলেন, যা থেকে আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারগণ ক্যালকুলেটর বানাতে সক্ষম হয়েছেন।
১৬৪২-৪৪ সালে যেকোনো পরিমাণে উৎপাদনক্ষম অ্যারিথমেটিক মেশিন (প্যাসকেলাইন) তৈরি করেন ফরাসি গণিতবিদ-দার্শনিক ব্লেইস প্যাসকেল। তিনি তার ট্যাক্স কালেক্টর বাবার জন্য যন্ত্রটি তৈরি করেন। পরবর্তী দশ বছরে তিনি এরকম পঞ্চাশটি যন্ত্র বানিয়েছিলেন। এতে ডায়াল ঘুরিয়ে সংখ্যা প্রবেশ করালেই যোগ-বিয়োগ করতে পারতো।
এরকম যন্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জার্মান গণিতবিদ গটফ্রেড লিবনিজের তৈরি স্টেপড রেকোনার (১৬৯৪)। লিবনিজ বলেন,
It is beneath the dignity of excellent men to waste their time in calculation when any peasant could do the work just as accurately with the aid of a machine.
যন্ত্রটিতে গিয়ারের সিরিজ ছিল, প্রতিটি গিয়ারে ০ থেকে ৯ এর জন্য দশটি করে দাঁত থাকতো। যখনই কোনো গিয়ার ৯ পার হতো, এটি আবার শূন্যতে ফিরে আসতো, আর পরের গিয়ারকে এক ঘর এগিয়ে দিত। প্রায় পুরোটাই অ্যাবাকাসের মতো পদ্ধতিতে বিপরীত কাজ করে বিয়োগ করা যেত, কিছু বুদ্ধিমান কলাকৌশলের মাধ্যমে স্টেপড রেকোনার গুণ-ভাগও করতে পারতো। গুণ-ভাগ তো আসলে অনেকগুলো যোগ-বিয়োগেরই সমষ্টি। স্টেপড রেকনারই প্রথম এমন যন্ত্র ছিল, যা একসাথে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ সবগুলোই করতে পারতো।
এই পদ্ধতি এতটাই সফল ছিল যে, পরবর্তী তিন শতাব্দী ব্যাপী ব্যবহৃত হয়েছিল। যদিও বাস্তব জীবনের অনেক সমস্যার জন্য অনেক ধাপে সমাধান করতে হতো, যার ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেত, এমনকি পুরো এক দিনও পার হয়ে যেত একটি উত্তর খুঁজে পেতে। তাছাড়া এটি ব্যয়বহুলও ছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুততা আর নির্ভুলতা খুবই প্রয়োজনীয়; তাই সামরিক খাতেই জটিল হিসাব-নিকাশের যন্ত্র প্রথম ব্যবহৃত হয়। এমনই সমস্যা দূরীকরণে চার্লস ব্যাবেজ ১৮২২ সালে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে একটি পত্র লিখলেন। চার্লস ব্যাবেজ ‘ডিফারেন্স ইঞ্জিন’ নামে সম্পূর্ণ নতুন এক জটিল যন্ত্রের প্রস্তাবনা করেন, যা বহুপদীর সমাধান করতে পারতো। এই বহুপদী সমীকরণগুলোর সাহায্যে লগারিদমীয় এবং ত্রিকোণমিতিক সমস্যার সমাধানও করা যেত।
১৮২৩ সালে ব্যাবেজ এই যন্ত্র তৈরি করা শুরু করেন। দুই দশক ধরে ২৫,০০০ যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে তৈরি এই যন্ত্রের ওজন দাঁড়ায় ১৫ টনেরও বেশি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রজেক্টটি বাতিল হয়। কিন্তু ১৯৯১ সালে ঐতিহাসিকগণ ব্যাবেজের মডেল অনুযায়ী ডিফারেন্স ইঞ্জিন তৈরি করতে সক্ষম হন, যা কাজও করে!
ডিফারেন্স ইঞ্জিন তৈরির সময়ই ব্যাবেজ আরও জটিল ‘অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন’ তৈরির কথা চিন্তা করেন। ডিফারেন্স ইঞ্জিন, স্টেপড রেকোনার বা অন্য সব ধরনের যন্ত্রগুলোর থেকে অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন ছিল পুরোই আলাদা। এটা ছিল জেনারেল পারপাস কম্পিউটার। শুধু একটি কাজ নয়, এর দ্বারা অনেকগুলো কাজ করা যেত। এতে ডেটা প্রবেশ করানো এবং ক্রমান্বয়ে তা সম্পাদন করা যেত, এমনকি এতে মেমোরি এবং আদি প্রিন্টারও ছিল। অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন ছিল সময়ের থেকে এগিয়ে, এবং একে কখনোই পুরোপুরি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যেই ইংরেজ গণিতবিদ অ্যাডা লাভলেস ইতিহাসে প্রথম কমান্ড লেখেন, যার জন্য তাকে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম প্রোগ্রামার বলা হয়। তিনি বলেন,
একটি নতুন, বিশাল পরিসরে ব্যবহার উপযোগী একটি শক্তিশালী ভাষা তৈরি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যাবে।
অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন আরও অনেক প্রথম প্রজন্মের ইঞ্জিনিয়ারদের উৎসাহী করে তোলে, যারা কি না এই যন্ত্রের আরও উৎকর্ষ সাধন করেন। এ কারণেই ব্যাবেজকে ‘ফাদার অফ কম্পিউটিং’ বলা হয়।
আমেরিকার সরকার ১৮৯০ সালের আদমশুমারি করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যায়, যা কি না কেবলমাত্র কম্পিউটার দ্বারাই সমাধান সম্ভব। মার্কিন সংবিধান ফেডারেল ফান্ড বণ্টন, কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করা প্রভৃতি কারণে প্রতি দশকে আদমশুমারি করতে বলে। ১৮৮০ এর দশকে অভিবাসন প্রভৃতি কারণে জনসংখ্যা অতি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। হাতে-কলমে এই আদমশুমারি করতে সাত বছর সময় লেগে গিয়েছিল। হিসাব করে দেখা গেল, এভাবে করলে ১৮৯০ এর আদমশুমারিতে ১৩ বছর লেগে যাবে। সমস্যা হলো, ততদিনে পরের আদমশুমারির সময়ই পার হয়ে যাবে।
এমতাবস্থায় সেন্সাস ব্যুরো হারম্যান হলারিথের শরণাপন্ন হলো যিনি একটি ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল ‘ট্যাবুলেটিং মেশিন’ বানিয়েছিলেন, যা স্টেপড রেকোনারের মতোই হিসাব করতে পারতো। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিলেন পাঞ্চ কার্ড ব্যবহার করে ইলেক্ট্রিক্যালি হিসাবের ফাংশনালিটি দেওয়া, যা কি না দ্রুততায় ছিল দশগুণ। তাই আদমশুমারি মাত্র দু’বছরে শেষ হলো সেন্সাস অফিসের মিলিয়ন ডলার বাঁচিয়ে দিয়ে।
ব্যবসা খাতগুলো এ যন্ত্রের কদর বুঝতে লাগল। তারা ‘ডেটা-এক্সপেন্সিভ’ কাজগুলোতে (যেমন: অ্যাকাউন্টিং, ইনস্যুরেন্স এবং আবিষ্কার, উদ্যোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে) এর ব্যবহার শুরু করার কথা ভাবলো। এই চাহিদা পূরণে হলারিথ ট্যাবুলেটিং মেশিন কোম্পানি তৈরি করলেন, যা পরে অন্যান্য মেশিন তৈরির কোম্পানির সাথে মিলে তৈরি হলো ‘ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিন’ (আইবিএম)। এই কোম্পানি প্রচুর লাভের মুখ দেখে, এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও সরকারি খাতকে ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল রূপ দিতে বাধ্য করে।
বিংশ শতকের মাঝের দিকে জনসংখ্যা বেড়ে যায়, সাথে এগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে আরও উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্র তৈরি করে। যার ফলশ্রুতিতেই পরবর্তীতে আধুনিক কম্পিউটারের যাত্রা শুরু হয়।
আমরা পরবর্তী পর্বে আধুনিক কম্পিউটার সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।