বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থিত বুর্জ খলিফা। এর উচ্চতা ৮২৮ মিটার, যা নিকটবর্তী সুউচ্চ ভবন সাংহাই টাওয়ারের চেয়েও ১৯৬ মিটার উঁচু। কিন্তু খুব বেশি দিন দুবাই এ রেকর্ড ধরে রাখতে পারবে না। কারণ সৌদি আরবের জেদ্দায় নির্মিত হচ্ছে আরেকটি ভবন, যেটি বুর্জ খালিফাকে ছাড়িয়ে উঠে যাবে আরও অন্তত ১৮০ মিটার!
জেদ্দা টাওয়ার বা বুর্জ জেদ্দা, যার নাম প্রথমে প্রস্তাব করা হয়েছিল কিংডম টাওয়ার, মূলত সৌদি আরবের অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ২০ বিলিয়ন ডলারের মেগা প্রজেক্টের প্রাথমিক ধাপ। সৌদি আরবের জেদ্দার অদূরে, লোহিত সাগরের তীরে ৫.২ বর্গ কিলোমিটার জমির উপর যে নতুন কিংডম সিটি বা জেদ্দা ইকোনমিক সিটি প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, জেদ্দা টাওয়ার থাকবে তার প্রাণকেন্দ্রে এবং এটিই হবে শহরটির প্রধান আকর্ষণীয় স্থাপনা।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী জেদ্দা ইকোনমিক সিটির আয়তন হওয়ার কথা ছিল ২৩ বর্গ কিলোমিটার, যদিও পরে তা ৫.২ বর্গ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হয়। তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত এই প্রকল্পটি সম্পন্ন হতে সময় লাগবে মোট ১০ বছর, তবে প্রকল্পের প্রথম ধাপ জেদ্দা টাওয়ারের নির্মাণ সম্পন্ন হবে আগামী ২০২০ সালে। প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে জেদ্দা টাওয়ারের আশেপাশের অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হবে। আর প্রকল্পের তৃতীয় ধাপ এখনও উন্মুক্ত করা হয়নি।
জেদ্দা টাওয়ারটি বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় মেগা-টল টাওয়ার এবং বিশ্বের প্রথম কিলোমিটার টাওয়ার। অর্থাৎ এর উচ্চতা হবে এক মিলোমিটারের চেয়েও বেশি। প্রাথমিকভাবে ১ মাইল বা ১.৬ কিলোমিটার উঁচু ভবন বানানোর পরিকল্পনা ছিল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু ভূ-প্রকৃতি অনুকূল না হওয়ায় অন্তত ১ কিলোমিটার উঁচু ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়, যদিও প্রকৃত উচ্চতা এখনও প্রকাশ করা হয়নি। এটিই বিশ্বের প্রথম কিলোমিটার ভবন এবং বর্তমানে নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনাধীন ভবনগুলোর মধ্যে এটিই একমাত্র ভবন, যা ১ কিলোমিটারের মাইলফলক স্পর্শ করতে যাচ্ছে।
জেদ্দা টাওয়ারের নকশা করেছেন মার্কিন স্থপতি অ্যাড্রিয়ান স্মিথ, যিনি ইতোপূর্বে বুর্জ খালিফার নকশাও তৈরি করেছিলেন। এছাড়াও চীনের জাইফেং টাওয়ার, শিকাগোর ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেল টাওয়ার সহ বিশ্বের সর্বোচ্চ ১১টি ভবনের ৪টিই অ্যাড্রিয়ান স্মিথের পরিকল্পনায় তৈরি।
জেদ্দা ইকোনমিক সিটি প্রকল্পটির উদ্যোক্তা সাবেক সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজের ভ্রাতুষ্পুত্র, প্রিন্স আল-ওয়ালিদ বিন তালাল, যাকে মধ্যপ্রাচ্যের সেরা ধনী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল-ওয়ালিদ সৌদি আরবের কিংডম হোল্ডিং কোম্পানীর চেয়ারম্যান। এই কোম্পানিটি জেদ্দা টাওয়ার এবং জেদ্দা ইকোনমিক সিটি নির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত জেদ্দা ইকোনমিক কোম্পানীর অংশীদার। প্রকল্পটির প্রধান কন্ট্রাক্টর সৌদি বিন লাদেন গ্রুপ।
জেদ্দা টাওয়ারটি মূলত ব্যবহৃত হবে আবাসিক হোটেল হিসেবে। প্রায় ২০০ তলার এই ভবনের সবগুলো তলার মোট ক্ষেত্রফল হবে ২ লাখ ৪৫ হাজার বর্গ মিটার। এতে থাকবে ২০০ কক্ষ বিশিষ্ট ফোর সীজনস হোটেলের অ্যাপার্টমেন্ট, ১২১টি সেবা প্রদান ভিত্তিক অ্যাপার্টমেন্ট এবং ৩৬০টি আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট। এছাড়াও এর নিচের তলাগুলো অফিস কক্ষ এবং বিলাসবহুল আবাসিক স্যুট হিসেবে ব্যবহৃত হবে। হোটেলের সর্বোচ্চ তলায় স্থান পাবে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত পর্যবেক্ষণ-গৃহ এবং মানমন্দির। ভবনটির ১৫৭ তম তলার সামনে ৩০ মিটার ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট একটি বহিঃস্থ বারান্দা থাকবে। এই বারান্দাটি প্রথমে হেলিপ্যাড হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই উচ্চতা এবং পরিবেশ হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য উপযোগী মনে না হওয়ায় এটিকে বারান্দা হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
উপর থেকে দেখতে জেদ্দা টাওয়ারের আকৃতি অনেকটা ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মতো। এর গঠন ত্রিভুজাকৃতির এবং উপরের দিকে এর বহির্ভাগ ক্রমশ সরু হয়ে উঠেছে প্রধানত বাতাসের বেগের প্রভাব হ্রাস করার জন্য। ত্রিভুজের তিনটি বাহু ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় গিয়ে শেষ হয়েছে, যা ভবনটিকে একটি প্রতিসম আকৃতির মধ্যেও এক ধরনের ভিন্নতা এনে দিয়েছে। ভবনটির তিনটি পাশের ধারগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, এর বিভিন্ন অংশের উপর সম সময়ই আংশিক ছায়া পড়বে এবং খুব কম অংশই সরাসরি সূর্যের তীব্র আলোর মুখোমুখি হবে।
ভবনটির নকশা তৈরি করা হয়েছে মরুভূমির এক ধরনের গাছের পাতার আকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, যার ঊর্ধ্বগামিতা সৌদি আরবের দ্রুত উন্নয়নশীল ভবিষ্যতকেই নির্দেশ করে এবং পবিত্র মক্কা নগরীর প্রবেশ পথ হিসেবে জেদ্দাকে বিশ্বের সামনে বিশেষভাবে তুলে ধরে। জেদ্দা টাওয়ারের নিচে এবং আশেপাশের ২৩ হেক্টর জায়গা জুড়ে নির্মিত হবে শপিং মল, আবাসিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র, এবং সাধারণ মানুষের বিচরণের জন্য খোলা প্রাঙ্গণ। ভবনটির চারপাশে থাকবে কৃত্রিমভাবে তৈরি জলাধার। সব মিলিয়ে ভবনটি সহ এর আশেপাশের এলাকাটি পরিচিত হবে জেদ্দা টাওয়ার ওয়াটার ফ্রন্ট ডিসট্রিক্ট নামে, যার মধ্যে শুধু ভবনটিই দখল করবে ৫ লাখ বর্গ মিটার জায়গা।
জেদ্দা টাওয়ার নির্মিত হবে উচ্চ গুণাগুণ সম্পন্ন কনক্রিট এবং স্টিলের সমন্বয়ে। এর মূল কাঠামো নির্মিত হবে কাস্ট-ইন-প্লেস রিইনফোর্সড কনক্রিটের বীম, ওয়াল এবং ছাদের সমন্বয়ে। এর ভিত্তির পাইলগুলো একেকটির ব্যাসার্ধ প্রায় ৩ মিটার এবং এদের কোনো কোনোটির গভীরতা প্রায় ১০০ মিটার পর্যন্ত। ভবনটির বাহিরে চতুর্দিকে থাকবে সম্পূর্ণ কাঁচের দেয়াল। ভবনটি নির্মাণ সম্পন্ন করার জন্য প্রায় ৮০,০০০ টন স্টিলের প্রয়োজন হবে। আনুমানিক ৬৩ মাসব্যাপী নির্মাণ কাজে খরচ হবে প্রায় ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৯,৮০০ কোটি টাকার সমতুল্য। অবশ্য এ টাকার পরিমাণ বুর্জ খলিফার তুলনায় অনেক কম, যেটির উচ্চতা আরও কম হওয়া সত্ত্বেও নির্মাণে খরচ হয়েছিল ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জেদ্দা টাওয়ারে মোট ৫৯টি এলিভেটর এবং ১২টি এস্কেলেটর থাকবে। এলিভেটরগুলোর মধ্যে ৫টি হবে দোতলা। এলিভেটরগুলো ঘন্টায় ৩৫ কিলোমিটার বেগে যাতায়াত করবে। অপেক্ষাকৃত কম সুউচ্চ ভবনে লিফটগুলো এর চেয়ে বেশি গতিতে ভ্রমণ করতে পারলেও জেদ্দা টাওয়ার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হবে না, কারণ অতিরিক্ত উচ্চতার কারণে বায়ুর ঘনত্ব হ্রাস পাওয়ায় দ্রুতগতি আরোহীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
ভবনের কোনো লিফটই নিচ থেকে একেবারে উপর পর্যন্ত যাবে না। তিনটি ‘স্কাই লবি’ দ্বারা লিফটগুলোর গন্তব্য মোট চারভাগে বিভক্ত থাকবে, যেন লিফটগুলোকে বহনকারী তারের ওজন সীমা ছাড়িয়ে না যায়। আরোহীদেরকে এই স্কাই লবিগুলোতে বিরতি নিয়ে নিজেদেরকে এক লিফট থেকে অন্য লিফটে স্থানান্তর করে অপেক্ষাকৃত উচুঁ তলাতে পৌঁছতে হবে।
বুর্জ খলিফার মতো জেদ্দা টাওয়ার নির্মাণেরও মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পর্যটকদেরকে আকর্ষণ করা, দেশের জন্য আকর্ষণীয় প্রতীক সৃষ্টি করা, যাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের শহর ব্যাবসায়িকভাবে লাভবান হবে। বুর্জ খলিফার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভবনটি নিজে অর্থনৈতিকভাবে সফল হয়নি, কিন্তু ভবনটিকে উপলক্ষ করে নির্মিত এর আশেপাশের শপিং মল, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সর্বোপরি পুরো শহরটি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়েছে। জেদ্দা টাওয়ার নির্মাণের পেছনেও নির্মাতাদের উদ্দেশ্য একই রকম।
কর্তৃপক্ষ আশা করছে, ভবনটি সৌদি আরবের পর্যটন শিল্পে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। ভবনটির স্থপতি অ্যাড্রিয়ান স্মিথ বলেন, তারা আশা করছেন, জেদ্দা টাওয়ার নির্মাণ সম্পন্ন হলে বছরে অন্তত ৩০ লাখ পর্যটক এটি ভ্রমণ করতে আসবে। তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল হওয়ায় সৌদি আরবের ধনী নাগরিকরা বার্ষিক ছুটি উপভোগ করার জন্য ইউরোপ, আমেরিকা বা অন্যান্য আরব রাষ্ট্রে ভ্রমণ করে। জেদ্দা ইকোনমিক কোম্পানির সিইও মুনিব হাম্মুদ জানান, ভবনটি নির্মিত হলে আশা করা যায় সৌদি নাগরিকদের বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না, ফলে দেশের অর্থ দেশেই থেকে যাবে।
২০১৩ সালে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে খুব দ্রুতগতিতে জেদ্দা টাওয়ার আকাশপানে ধেয়ে চলছে। বর্তমানে এর ৪৭ তলা পর্যন্ত নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু ঠিকভাবে চললে ২০২০ সালেই বিশ্ব উপহার পাবে আকাশ ছোঁয়া আরেকটি ভবন, যেটি মধ্যপ্রাচ্যের আকাশসীমাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
ফিচার ইমেজ: Business Insider