সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রমকে প্রতিহত করতে অনেক আগে থেকেই ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার ব্যবহার করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। আর বেশ কিছুদিন ধরে কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেই নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার পৌঁছে দিতে চাচ্ছে ব্যবসায়ীরা, বাড়াতে চাচ্ছেন এর বাজার। তবে প্রশ্ন উঠেছে এর ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে। আসলেই কি ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার আমাদের জন্য লাভজনক এবং ভালো?
শুরুতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে সঠিক পরিচয় খুঁজে বের করতে এর ব্যবহার হয়ে আসছিল। এরপর পুলিশ অফিসারদের হাতে এবং তারও অনেক পরে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে শুরু হয় ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যারের ব্যবহার। কেবল সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করার জন্যই নয়, ব্যবসায় গ্রাহকদের আরো উন্নত এবং নিখুঁত সেবা দেওয়ার কথা চিন্তা করেই বাড়ানো হয়েছিল ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যারের ব্যবহার। সবার চিন্তার জায়গাটুকু এখানেই। সন্ত্রাসীদের জন্য উপযুক্ত এই ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার গ্রাহকের জন্য মানানসই হবে তো?
আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির তথ্য ব্যবস্থাপনার সহযোগী অধ্যাপক ব্রায়ান মেনেক জানান, একদিক দিয়ে ব্যাপারটি খুবই ভালো। মানুষকে আর অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে না তথ্যের জন্য। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের কোন গ্রাহকের কোন সেবা দরকার, কেমন সেবা দিলে গ্রাহক সেটা লুফে নেবে- সবকিছু সহজেই বুঝে নিতে পারবে। তবে মুদ্রার অপর পিঠ নিয়েও কথা বলেন মেনেক। আর সেদিকে আছে গ্রাহকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা।
এত বছর ধরে কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহকের কাছ থেকে কেবল সেই তথ্যগুলোই নিয়ে এসেছে, যেগুলো কিনা গ্রাহক সহজেই দিতে পারেন এবং নিজের ইচ্ছাতেই দেন। কিন্তু বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ব্যাপারটি হয়ে যাবে একেবারেই অন্যরকম। এক্ষেত্রে গ্রাহক চান কিংবা না চান, ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে তার তথ্য কোম্পানি নিয়ে নিতে পারবে। অনেকেই হয়তো সেটা চাইবেন না। আপনি নিশ্চয়ই ফেসবুক ব্যবহার করেন? ইদানিং কি লক্ষ করেছেন যে, আপনি চান কিংবা না চান, আপনার পোস্ট করা ছবিতে অনেকগুলো মানুষ ট্যাগড বা সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছে? কীভাবে হচ্ছে, এটা বুঝতে পারছেন তো? কারণ, ফেসবুক ইতোমধ্যেই ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার ব্যবহার করা শুরু করে দিয়েছে। এতে করে আপনি যখন কোনো ছবি পোস্ট করছেন সেখান থেকে ফেসবুক ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে সেই ছবিটির মধ্যে আপনার বন্ধু তালিকায় যে মানুষগুলো আছে তাদের শনাক্ত করে নিজে থেকেই ট্যাগ করে দিচ্ছে। এতে করে অবশ্য ভুল মানুষও ট্যাগ হয়ে পড়ছেন অনেক ক্ষেত্রে।
একটা দিক দিয়ে ব্যাপারটি বেশ মজার। কিন্তু এর মানে কিন্তু ফেসবুক আপনার ছবি, পোস্ট, লেখা, ইনবক্সের ইতিহাস- সবকিছুই নিজের আওতায় রাখছে। আপনার একটি পুরো ডাটাবেস আছে ফেসবুকের কাছে। থাকছে অনেক গোপনীয় তথ্যও, যার অনুমতি আপনিই জেনে কিংবা না জেনে তুলে দিয়েছেন ফেসবুকের হাতে। ব্যাপারটি কি আপনার ভালো লাগলো? অনেকের উত্তরটা “না” হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে “হ্যাঁ” কথাটিও বলবেন বাকিরা। তো চলুন, দেখে নেওয়া যাক দু’পক্ষকেই। একপক্ষে আছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছে ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার ব্যাপারটি ইতিবাচক। নিজেদের মতন করে এই প্রযুক্তিকে আপন করে নিতে চান তারা। কিন্তু অন্যদিকে আবার আছেন ভোক্তা বা গ্রাহকেরা, যাদের অনেকের কাছেই ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার গোপনীয়তা লংঘনের সমান।
ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী
এই যেমন ইন্টেলের কথাই ধরুন। নিজেদের ডিজিটাল সাইনেজ ডিসপ্লেতে ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার ব্যবহার শুরু করেছে তারা। এই ডিসপ্লেটি গ্রাহকদের সাথে কাজ চালানোর জন্য টাচ স্ক্রিনের সাহায্য নেয়। এছাড়া ইন্টারনেটে ভিডিও, গ্রাফিক্স- সব ধরনের মাধ্যমই এর আওতায় পড়ে। এটি সাধারণ সবরকমের তথ্য, এই যেমন বয়স, লিঙ্গ, জাতি, গ্রাহক কতক্ষণ ধরে ডিসপ্লে ব্যবহার করেছেন এবং কীভাবে করেছেন ইত্যাদি সবকিছুই চিহ্নিত করে। ইন্টেল অবশ্য কেবল এই তথ্যগুলোই নয়, গ্রাহকের শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে এবং অন্যান্য তথ্য যাচাই বাছাই করে পুরো একটি প্রোফাইল তৈরি করে নিয়েছে। এর তথ্য এবং নাম অবশ্য গোপন রাখছে তারা। মেনাক এর নাম দিয়েছেন ‘মার্কেটিং অ্যাভাটার’ বা ‘ম্যাভাটার‘।
ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি একেবারেই অন্যরকম। নিজেদের এবং গ্রাহকদের ভালোর জন্যেই এমনটা করেন বলে দাবি জানান তারা। এতে করে কোন গ্রাহক কেমন সেবা চায়, সেটা জানা সহজ হয়ে যায়। সেইসাথে কোনো গ্রাহককে সেবা দিতেও সময় লাগে কম। এই ধরুন, কোনো একটি সংস্থা কোনো বিজ্ঞাপন তৈরি করবে তাদের পণ্যের। কিন্তু কেমন বিজ্ঞাপন করবে, কোন ধরনের পণ্য তৈরি করবে তারা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুব সহজ হয়ে যায় যদি গ্রাহকদের আগ্রহ আর চাহিদার ব্যাপারটি জানা যায়। আর ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে সেটি নির্ধারণ করা অনেক সহজ হয়ে যায়। সে বিজ্ঞাপন দেখলে গ্রাহকও সহজেই বুঝতে পারেন কোন দ্রব্য কেনা ঠিক হবে তার জন্য।
গ্রাহকের নিরাপত্তা
ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে বলা হয় যে সামান্য একটু গোপনীয়তার বদলে খুব সহজেই ভালো মানের সেবা পেতে পারেন গ্রাহক। গ্রাহকেরাই যে এতে বেশি লাভবান হবেন, সেটা বলা হয় বারবার। তবে এই লাভের জন্য গ্রাহকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য কি দিতে চাইবেন? অবশ্য ব্যাপারটি এমন কিছু নতুন নয়। এর আগেও স্মার্টফোনের নানারকম অ্যাপের কারণে অনেক তথ্য সহজেই পেয়ে গিয়েছে কোম্পানিগুলো। সেগুলো ব্যবহার করলেও আপনার গোপনীয়তা অনেকটা ঠুনকো হয়ে পড়ে। তবে মানুষ সেটাতে বেশি চিন্তিত হয়নি। কারণ তাতে চেহারার কোনো ভূমিকা ছিল না। ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তির উৎপাত ছিল না। তথ্য যখন চেহারার মাধ্যমে নেওয়ার কথা আসে, তখন মানুষ যে খানিকটা দ্বিধায় পড়ে যাবে এটা তো স্বাভাবিক!
সহযোগী অধ্যাপক মেনেকের মতে, আমরা বছরের পর বছর ধরে ক্রেডিট কার্ডের মতন ব্যাপারগুলো ব্যবহার করছি আর আমাদের তথ্য একটু একটু করে দিয়ে দিচ্ছি। তাই মনে হয় না যে খুব বেশি কঠিন কিছু হবে পুরো বিষয়টি। কেবল এই গোপনীয়তার বদলে যদি কিছু সেবা দেওয়া যায়, এই যেমন- বিনামূল্যে ওয়াইফাই প্রদান, তাহলেও হয়তো মানুষ আর এত মূল্যবান কিছু প্রদানের জন্য বেশি ভাববে না। কারণ এই প্রক্রিয়াতে মানুষ অভ্যস্ত।
তবে মূল চিন্তার জায়গা এখানে নয়, চিন্তা থাকে তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে। মানুষ তাদের গোপন তথ্যগুলো কোম্পানিকে দিচ্ছে, কোম্পানি তার ব্যবসা করছে এবং মানুষ সহজে সেবা পাচ্ছে। কিন্তু যদি কোনোভাবে তথ্য ফাঁস হয়ে যায় কিংবা এমন কারো হাতে গিয়ে পড়ে যে সেগুলোকে খারাপ উপায়ে ব্যবহার করতে পারে? সম্প্রতি গুগল গ্লাস নামক একধরনের পণ্য বাজারে চালু হয়েছে যেটি পরা থাকলে মানুষ চোখের পলক ফেলেই ছবি তুলতে পারবে। এতে ছবি তোলার ঝামেলা নাহয় কমে গেল, কিন্তু কারো গোপন কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ছবি এবং বিনা অনুমতিতে তোলা ছবি- ইত্যাদি ব্যাপারগুলো যদি ঘটে? ইতোমধ্যেই এ নিয়ে কথা চলছে। মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং হচ্ছে। আর সেটাকেই আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে চলেছে ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার। এর সাথে জড়িত সমস্যাগুলোকে কি দূর করা সম্ভব? ব্যবহারকারীরা সেটা নিশ্চিত করতে পারলে অবশ্য এ ব্যাপারে বলার কিছু নেই। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়- গ্রাহকদের এত তথ্যের নিরাপত্তা কি ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত করতে পারবেন? উত্তরটা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক।
ফিচার ইমেজ: The Privacy Surgeon